You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকার কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরড

–হাসান মুরশিদ

পূর্ব বাংলার তীব্র ভাষা আন্দোলনের মুখে, প্রসন্ন মনে না হলেও, পাকিস্তান সরকার অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলারদাবিকে মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দাবি স্বীকৃত হয়। ১৯৬২ সালে তঙ্কালীন এক নায়ক আইয়ুব খার নির্দেশে তথাকথিত জাতীয় পরিষদের কর্তাভজা সদস্যবৃন্দ যে শাসনতন্ত্র রচনা করেন, তাতে বাংলার দাবি গৃহিত হয়। এই শাসনতন্ত্রে বলা হয়, বাংলা ও উর্দু সকল শিক্ষা ও সরকারি কাজের বাহন হিসাবে ব্যবহৃত হবে। তবে তার পূর্বে এ ভাষাদ্বয়কে ব্যবহারােপযােগী করে গড়ে তােলার পরিকল্পনা নিতে হবে। ১৯৭২ সালে জাতীয় পরিষদ বিবেচনা করবেন ইংরাজির পরিবর্তে আলােচ্য ভাষাদ্বয়কে সকল কাজে ব্যবহার করা যায় কিনা? ভাষাকে গড়ে তােলার সরকারি নির্দেশ কার্যে পরিণত করার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি উর্দু বােড এবং পূর্ব বাংলায় একটি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরড’ স্থাপিত হয় ১৯৬২ সালের পর। এর আগে অবশ্য করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ট্রানসলেশন ব্যুরাে’ ও ঢাকার বাংলা অ্যাকাডেমী উরদু ও বাংলা পরিভাষা নির্মাণ ও টেকসট-বুক রচনার কাজে হাত দিয়েছিল। এ ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যােগে আরাে দুএকটি প্রতিষ্ঠান এ কাজে ব্রতী হয়েছিল। সহযােগিতার মাধ্যমে এ সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপের সমন্বয় করা অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় ছিল। তাছাড়া উপযুক্ত সরকারি অর্থ সাহায্যপুষ্ট একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার পরিচালনায় পরিভাষা ও টেক্সট বুক রচিত না-হলে অসংগতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশংকা ছিল পুরােপুরি। এ দিকে দৃষ্টি রেখেই কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বোক্ত স্বতন্ত্র ও স্বশাসিত বােরড দুটি গঠন করেন।

বাংলা অ্যাকাডেমী থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরড গঠন আপাতবিচারে বাহুল্য বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু বাংলা অ্যাকাডেমীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরডের একটি মৌল পার্থক্য আছে। বাঙলা অ্যাকাডেমী ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন- এর লক্ষ্য বাংলা ভাষা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা ও গবেষণা। অপরপক্ষে, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরডের লক্ষ্য হলাে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার ও সরকারি কাজের বাহন হিসবে গড়ে তােলা। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, উভয় প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ জল-অচল দেয়াল দিয়ে অলাদা করা যাবে না। বাংলা অ্যাকাডেমী যেমন মহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ অথবা মহম্মদ আবদুল হাই-এর ‘ধ্বনিতত্ত্ব ও বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞান গ্রন্থ প্রকাশ ও কিছু সংখ্যক পরিভাষা নির্মাণ করেছে, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরড তেমনই অনেকগুলাে সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলি বেশ কয়েক বছর আগইে স্নাতক শ্রেণী পর্যন্ত বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাছাড়া স্নাতকোত্তর পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর বাংলায় লেখা ঐচ্ছিক করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলাে স্নাতকোত্তর অথবা স্নাতকসম্মান শ্রেণীতে সুযােগ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষার্থীরা অনেকেই বাংলায় উত্তর লিখছেন না, বিশেষত বিজ্ঞান বিষয়ে। এর জন্যে দায়ী প্রধানত টেকসট-বুকের অভাব এবং বাংলায় শিক্ষাদানের ব্যাপারে শিক্ষকদের অপটুতা ও আন্তরিকতার অভাব। পরিভাষা ও পণ্ডিতজনের বাংলা লেখার অনুৎসাহ আবার টেকস্ট-বুক রচনার প্রতিবন্ধক।

পরিভাষা তৈরির জন্যে পন্ডিতজনদের নিয়ে বাংলা উন্নয়ন বােরড অনেকগুলাে কমিটি গঠন করেন। তত্ত্বমূলক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞান এবং কলা ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থাদি রচনার কাজও এমনি পণ্ডিতদের ওপর অর্পিত হয় । লেখকদের যথােপযুক্ত পারিশ্রমিক দান ও গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে বােরড এই পরিকল্পনাকে যথেষ্ট পরিমাণে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পরিভাষা। ছাড়াও অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের পরিভাষা রচিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এ বিষয় সমূহের ওপর অনেকগুলাে টেকসট বুক প্রণীত ও প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর জন্যে এ যাবৎ যে গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়েছে, তার সবগুলি প্রামাণ্য না হলেও কয়েকটি গ্রন্থ সকল মানদণ্ডের বিচারে মূল্যবান ও শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে। রসায়ন বিষয়ে কুদরত-ই-খুদা অনেকগুলি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, তার মধ্যে চার খণ্ডে সমাপ্ত জৈব রসায়ন’ সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য।

আবদুল জব্বারের একাধিক খণ্ড খগােল পরিচয় আর একটি প্রশংসনীয় গ্রন্থ। মহম্মদ ইউনুস রচিত ‘ণতত্ত্ব’ বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও ভাষার উৎকর্ষে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। এবনে গােলাম সামাদের ‘নৃতত্ত্ব টেকসট-বুক নয়, কিন্তু আলােচ্য বিষয়ের ওপর এমন তথ্যমূলক রচনা বাংলা ভাষায় বেশি নেই। বােরডের অনেকগুলি গ্রন্থ বর্তমানে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। সবগুলি গ্রন্থ প্রকাশিত হলে, স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত বাংলাকে শিক্ষার বাহন করা নিঃসন্দেহে সম্ভব হবে। কেবল টেকসট বুক প্রণয়ন ও পরিভাষা রচনার কাজই নয়, বাংলা সাহিত্য বিষয়ক বহু গ্রন্থও বাংলা উন্নয়ন বােরড প্রকাশ করেছে। চার খণ্ডে ‘নজরুল রচনাবলী’ প্রকাশের যে পরিকল্পনা বােরড গ্রহণ করেছে, তার তিনটি খণ্ড এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে। কাজী এমদাদুল হক, ইসমাইল হােসেন শিরাজী প্রমুখ মুসলিম সাহিত্যিকের রচনা পুনঃ প্রকাশের দায়িত্বও বােরড গ্রহণ করেছেন। সেই সঙ্গে মুসলিম সহিত্য সাধক চরিতমালা প্রণয়নের কাজও বােরড আংশিক ভাবে সম্পন্ন করেছে। শুধুমাত্র মুসলিম সাহিত্যিকদের সম্পর্কে বােরর্ডের উৎসাহের কারণ বাংলা অ্যাকাডেমীর অনুরূপ। বাঙালী মুসলমানদের একটা হীনমন্যতা ও অদূর।

অতীতের তিক্ততার লজ্জা ঢাকার প্রয়াসই এরমধ্যে লক্ষ্যযােগ্য। এই প্রয়াসের অন্যতম ‘ফসল ইসলাম ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থাদি। যদিও হাদিসশরীফ অথবা চার খলিফার জীবনী কোনােক্রমেই বাংলা ভাষার উন্নতির সংগে সংশ্লিষ্ট নয়, তথাপি পাকিস্তান সরকারের ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার নীতির সমর্থনেই বাংলা উন্নয়ন বােরড এ জাতীয় গ্রন্থাদি প্রকাশ করেছে। লােক সাহিত্যক বিষয়য়ক গ্রন্থাদি প্রকাশের মধ্যে কমবেশি এই মানসিকতাই লক্ষণীয়। | বাংলা সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা কার্যে উৎসাহ দান করার জন্যে উন্নয়ন বােরড বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অর্থসাহায্য করে থাকে। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগগুলি যথাক্রমে ‘সাহিত্য পত্রিকা’, ‘সাহিত্যিকী’ ও ‘পাণ্ডুলিপি’ নামক তিনটি গবেষণা পত্রিকা প্রকাশ করে। এগুলি উন্নয়ন বােরড-এর অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত হয়। তদুপরি বাংলা বিভাগগুলি কোনও গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ করতে চাইলেও, বােরডের আনুকূল্য লাভ করে। কতগুলি সাহিত্য পত্রিকা ও কিশাের-সাময়িকী প্রকাশের ব্যাপারও বােরড অর্থসাহায্য দান করে। বােরড নিজেও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরড পত্রিকা’ নামে এক ত্রৈমাসিক গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামিক বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতাও ঐ পত্রিকায় লক্ষ্য করা যায়।  কার্যকলাপে পাকিস্তান সরকারের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক নীতি বিভিন্ন সময়ে স্পষ্ট হলেও, একথা অনস্বীকার্য যে, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরড বাংলা ভাষাকে সফল শিক্ষার ও সরকারি কাজের বাহন করার জন্যে যে  বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন বাঙালীরা। সরকারি ভেদনীতি, এনামুল হকের উদার পাণ্ডিত্য এবং আশরাফ সিদ্দিকীর সংকীর্ণতা হয়তাে বােরড এর কাৰ্যসূচীকে নানা সময়ে নানা খাতে প্রভাবিত করেছে, তথাপি বলা যায়, বাংলা ভাষাকে ব্যবহারােপযােগী করে তােলার ব্যাপারে বােরড-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

১৮ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!