ঢাকার বাংলা একাডেমী — হাসান মুরশিদ
দ্রাবণের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে, অতিরিক্ত দ্রব্যকে তলানি হিসাবে পড়ে থাকতে হয়। কোনাে সংবাদ শুনে মন আন্দোলিত হওয়ারও তেমনি একটা মাত্রা আছে, তারপর ভোতা মনে দুঃসংবাদ অথবা সুসংবাদ কোনােটাই তেমন সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় না। সীমান্তের ওপার থেকে আরাে হাজারাে দুঃসংবাদের মতাে খবর এসেছে যে, সকল গণআন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও শতস্মৃতিমাখা ঢাকার শহীদ মিনারটি ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ধ্বংস করেছে, ধ্বংস করেছে ভাষা আন্দোলনের অন্য আর একটি স্মৃতি বাংলা অ্যাকাডেমীকে। ১৯৬২ সালের ভাষা আন্দোলনের দুটি অক্ষয় স্মৃতিকে এমন পাষণ্ডের মতাে বিনষ্ট করার বর্বরতা ও নির্লজ্জতা দখলদারি সৈন্যরা দেখাতে পেরেছে অনায়াসে। আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ইয়াহিয়া যে কোনাে নীচতার আশ্রয় নিতে পারে। সুতরাং শহীদ মিনার এবং বাংলা অ্যাকাডেমী ধ্বংস করাটা সে পুরােনাে ছকের মধ্যে পড়ে গেছে এর মধ্যে নূতনত্ব যেটুকু সে কেবল সৈন্যদের বর্বরতা ও দুঃসাহস বরং ধ্বংস না করলেই বােধহয় পাক সৈন্যোচিত হতাে না; আমরা বিভ্রান্ত হতুম।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পূর্ববাংলাকে উপনিবেশ হিসেবে শাসন ও শােষণ করার জন্যে মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর পারিষদবৃন্দ পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের দুর্বল যােগসূত্রকে সবল এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বহু শতাব্দীর দৃঢ় যােগসূত্রকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তথা বাংলা সংস্কৃতিকে নির্মূল করার নানা সুচিন্তিত পরিকল্পনা উদ্ভাবন করেছেন। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদাদানে অস্বীকৃতি জানালে প্রথমে ১৯৪৮ ও পরে ১৯৫২ সালে দুটি ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ স্বেরাচারী পাকিস্তান সরকার বাধ্য হলেন বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার সম্মান দিতে ১৯৫৪ সালে জনগণের দাবির স্বীকৃতি স্বরূপ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউজে স্থাপিত হয় বাংলা অ্যাকাডেমী আর মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে স্থাপিত হয় শহীদ মিনার যদিও শহীদ স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্যে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয়,তবু পরবর্তীকালে এ মিনার শুধু ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকেনি, বরং প্রতীক হয়েছে সকল ন্যায় আন্দোলনের সকল আন্দোলনের কালেই শহীদ মিনার উদ্দীপনা জুগিয়েছে সংগ্রামী জনতার অন্তরে এবং শহীদদের স্মৃতি ক্রমে মর্মর মিনার থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে আপামর মানুষের হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। তাই আজ শহীদ মিনারকে ধূলিসাৎ করেও শহীদদের অক্ষয় স্মৃতিকে অথবা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অপরিসীম ভালােবাসাকে মুছে ফেলা যাবে না। শহীদ মিনারের মাধ্যমে যেমন শহীদদের স্মৃতিকে চিরজাগরুক করে রাখার চেষ্টা হয়েছে, তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি বিকাশের জন্যে স্থাপিত হয়েছিল বাংলা অ্যাকাডেমী অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, সরকারি সাহায্যে পরিচালিত হয়েছে বলে বাংলা অ্যাকাডেমী সর্বদা জনগণের আশা আকাঙ্খকে মর্যাদা দেয়নি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির নামে অ্যাকাডেমী যে সব কর্মসূচী অনুসরণ করেছে তার মধ্যে পাকিস্তানের মৌল আদর্শেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তাই যদিও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সামগ্রিক উন্নয়ন বাংলা অ্যাকাডেমীর লক্ষ বলে কথিত হয়েছে, তথাপি দেখা যাবে, বাংলা অ্যাকাডেমী বাংলা সাহিত্য বলতে পূর্ব বাংলার সাহিত্যকে কিংবা বিভাগপূর্ব বাংলার মুসলিম সাহিত্যিকদের রচিত সাহিত্যকে বুঝেছে এর ফলস্বরূপ অ্যাকাডেমী গবেষণাকার্য পরিচালনা করেছে মধ্য যুগের কিংবা উনবিংশ শতকের মুসলিম কবিসাহিত্যিকদের নিয়ে অথবা আধুনিক বাংলা সাহিত্য বলে যার পৃষ্ঠপােষকতা অ্যাকাডেমী করেছে তা একান্তভাবেই পূর্ববঙ্গীয় লােকসাহিত্য সংগ্রহ ও গবেষণার যে কাজ অ্যাকাডেমী করেছে তা আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় সংকীর্ণতামুক্ত মনে হলেও সুবিচারে দেখা যাবে তার নীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে আঞ্চলিকতা অথবা ধর্মীয় বিবেচনার দ্বারা।
কিন্তু এ সব সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, মধ্যযুগ নিয়ে যে ব্যাপক ও গুরুতর গবেষণার গােড়াপত্তন অ্যাকাডেমী করেছে তার কোন তুলনা পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে আদৌ থাকলেও বিরল। এনামুল হক, আহমদ শরীফ প্রমূখ পণ্ডিত মধ্যযুগ নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন বাংলা অ্যাকাডেমীর পৃষ্ঠপােষকতায়। লােক সাহিত্য নিয়েও একাধিক পণ্ডিত নানা গবেষণাকার্যে লিপ্ত হয়েছেন। কেবল গবেষণাকর্মের পরিচালনা নয়, বহু গ্রন্থ ও বাংলা অ্যাকাডেমী নামক ত্রৈমাসিক গবেষণা পত্রিকার মাধ্যমে অ্যাকাডেমী এই সব গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে। সৈয়দ সুলতান, গরীবুল্লাহ, শাহ সগীর, আলাওল, দৌলতকাজী প্রমুখ মুসলিম কবির গ্রন্থসমুহের মূল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রশংসনীয় কাজও বাংলা অ্যাকাডেমী সম্পন্ন করেছে। এতদ্ব্যতীত লােকসাহিত্যের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলা অ্যাকাডেমী একটি ক্ষুদ্র ‘আরকাইভস্ স্থাপন করেছে। লােকসাহিত্য বিষয়ক সে গ্রন্থগুলি অ্যাকাডেমী প্রকাশ করেছে সেগুলিও প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য।
বিভাগপূর্ব অপেক্ষাকৃত আধুনিক মুসলিম সাহিত্যিকদের নিয়েও বাংলা অ্যাকাডেমীর উৎসাহ লক্ষণীয়। মাশহাদী, শেখ আবদুর রহীম, মীর মশাররফ হােসেন, মােজাম্মেল হক, ফজলুল করীম, মতীয়ুর রহমান, বেগম রােকেয়া, নুরুন্নেসা, কাজী নজরুল ইসলাম, কায়কোবাদ, শাহদাত হােসেন, প্রভৃতি কবি সাহিত্যিকের রচনার পুনরুদ্ধার ও পুনর্মূল্যায়ন বাংলা অ্যাকডেমির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এইসব লেখকের রচনাবলী পুনঃ প্রকাশ করে এবং এদের সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্যাদি সংকলিত গ্রন্থাদি প্রকাশ করে অ্যাকাডেমী তার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছে। অ্যাকাডেমী কর্তৃক লুপ্তপ্রায় রচনাবলীর পুনঃপ্রকাশ ও পুনর্মূল্যায়ন প্রয়াস যেমন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তেমিন সাহিত্য বিষয়ে যে সাম্প্রদায়িকতার মনােভাব এই প্রয়াসে অনায়াসে লক্ষণীয় তা সমান নিন্দনীয়।
তবে অ্যাকাডেমীর পরিচালকদের এই মনােভাবের কারণ আবিষ্কার করা অসম্ভব নয়। একদিকে অ্যাকাডেমীর ওপর সরাকরি চাপ যেমন বর্তমান ছিলাে তেমনি অন্যদিকে একটি হীনমন্যতা তার মধ্যে ছিলাে সুস্পষ্ট। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের একটা বড় অবদান স্বীকৃত হয়েছে। লােকসাহিত্যেও মুসলিম ঐতিহ্যকে অবহেলা করা যায় না। কিন্তু সমাজ-অর্থনৈতিক কারণে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। সুতরাং স্বাধীনতা-উত্তরকালে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের নায়করা যদি অদূর অতীতের দৈন্যকে ঢাকবার জন্যে প্রাচীন অতীতের দিকে সংগ্রহে হাত বাড়ান তা হলে সঙ্গত হােক অসঙ্গত হােক সেটা অন্তত স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হতে পারে। তাই বাংলা অ্যাকাডেমীর পরিকল্পনাসমূহে একটি হীনমন্যতা ও এই পেছনে তাকানাের মানসিকতা লক্ষ্যযােগ্য দৃষ্টির এই অনাধুনিকতাকে মেনে নিলে বাংলা অ্যাকাডেমীর কার্যকলাপের মূল্য ও উপযােগীতা অস্বীকার করা যায় এবং তেমন অবস্থাতে বলা যায় পূর্ব বাংলার ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিকল্পে বাংলা অ্যাকাডেমী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
অ্যাকাডেমী ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের নিমিত্ত যে কর্মসূচী নিয়েছিলাে তাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা চলে ?
১। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ও বাংলা অ্যাকাডেমী বহু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করেছে। এ সমস্ত পাণ্ডুলিপির মধ্যে আছে সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, আরতি, ফারসি ও বাংলা গ্রন্থাদি। পরাগলী মহাভারত আলাওল ও দৌলতউজীর মূল পাণ্ডুলিপি এ সংগ্রহের বিশেষ উল্লেখযােগ্য দিক । (বাংলা দেশের বর্তমান সংগ্রামে এ পাণ্ডুলিপিগুলাে নাকি অন্যান্য সব জিনিসের সঙ্গে বিনষ্ট হয়েছে।) পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে মধ্যযুগীয় কয়েকখানি গ্রন্থ সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
২। লােকসাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ও লােক সাহিত্যের লুপ্ত প্রায় নিদর্শন সমূহ উদ্ধার করে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে অ্যাকাডেমী। শব্দ ধারক যন্ত্র ও অন্যান্য উপায়ে এই সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চলের লােক সাহিত্যের ওপর কয়েকটি গ্রন্থও অ্যাকাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
৩। রচনাবলী প্রকাশ : যে সমস্ত মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের রচনাবলী দুষ্প্রাপ্য ও প্রায় বিস্মৃত, সেগুলাে প্রকাশের একটি বৃহৎ পরিকল্পনা অ্যাকাডেমী গ্রহণ করেছে। এ পর্যন্ত আলাওল, শেখ আবদুর রহীম, মীর মশাররফ হােসেন, মতীয়ুর রহমান, ইয়াকুব আলী, নুরুননেসা, বেগম রােকেয়া প্রমূখের রচনা প্রকাশিত হয়েছে।
৪। সৃষ্টিধর্মী রচনার প্রকাশ ও পূর্ব বাংলার সাহিত্যিকদের সৃষ্টিধর্মী রচনা বিশেষত নাটক প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়ে অ্যাকাডেমী এযাবৎ অনেকগুলাে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।
৫। মৌলিক গবেষণামূলক রচনার প্রকাশ মূল্যবান গবেষণামূলক বহু সংখ্যক রচনা অ্যাকাডেমী এ পর্যন্ত প্রকাশ করেছে।
৬। জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ ও বিশেষত ইসলাদি নীতির দিকে লক্ষ্য রেখে অ্যাকাডেমী বেশ কিছু সংখ্যক জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। “জিন্নাহনামা” থেকে শুরু করে নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত অনেকগুলাে ভালমন্দ গ্রন্থ এ পরিকল্পনার অধীনে প্রকাশিত হয়েছে।
৭। অনুবাদকর্ম ও শ্রেষ্ঠ বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদের দ্বারা বাংলা সাহিত্যকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করার জন্যে অ্যাকাডেমী প্রত্যক্ষভাবে একটি অনুবাদ বিভাগ পরিচালনা করেছে এবং গ্রন্থ প্রকাশ করে পরােক্ষভাবে অনুবাদকদের উৎসাহিত করেছে। তাছাড়া বাংলা সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশীদের নিকট তুলে ধরার চেষ্টাও অ্যাকাডেমী করেছে। নজরুলের কিছু কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য।
৮। গবেষণাবৃত্তি দান ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করার জন্যে অ্যাকাডেমী প্রতি বছর কয়েকটি করে গবেষণাবৃত্তি দিয়েছে। এই বৃত্তি নিয়ে কয়েকজন ডকটরেট ডিগ্রিও ইতিমধ্যে লাভ করেছেন।
৯। সাহিত্য পুরস্কার দান : গবেষণাকর্ম কাব্য, নাটক, ছােটগল্প, উপন্যাস ও কিশাের সাহিত্যের জন্যে বাংলা অ্যাকডেমি প্রতি বছর এক-একটি খাতে দু’হাজার টাকার এক-একটি সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, এ পুরস্কার ও সম্মান সাহিত্য সেবীদের পরােক্ষভাবে উৎসাহিত করে।
১০। সাংস্কৃতিক কর্মসূচী ও সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাংলা অ্যাকাডেমী নিয়মিত পালন করে আসছে। ২১ ফেব্রুয়ারি, রবীন্দ্র-ইকবাল-নজরুল জন্মােৎসব প্রভৃতি উপলক্ষে অনেক সময়ে সিমপােসিয়াম অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিমপােসিয়ামে পঠিত প্রবন্ধসমূহ পরে অ্যাকাডেমী পত্রিকায় অথবা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য আইয়ুবের শাসনকালে বিপ্লব দিবস এবং উজ্জ্বল দশকও অ্যাকাডেমী সােৎসাহে পালন করেছে, তবে তার কারণ অস্পষ্ট নয়।
সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনামুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী দীন মহম্মদ ও কবীর চৌধুরী বাংলা অ্যাকাডেমী পরিচালনা করেছেন। ইসলাম ও সাম্প্রদায়িকতার প্রতি এঁদের ব্যক্তিগত আনুগত্য কতখানি সে প্রশ্ন অবান্তর, কিন্তু পাকিস্তানের তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের মৌল আদর্শ এই প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এই জন্যে দেখতে পাই আধুনিক গদ্য ও আধুনিক পদ্য সংগ্রহ নামে যে সংকলন দুটি অ্যাকাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে, নামটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকলেও, তা বস্তুত বাঙালী মুসলমানদের রচনা সংগ্রহ। অতিসাম্প্রতিককালে জীবনানন্দকে নিয়ে কাজ করার জন্যে একটি গবেষণাবৃত্তি দান করা হয়েছে বটে, কিন্তু এ যাবৎ অ্যাকাডেমী সকল গবেষণা মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের মধ্যেই গণ্ডীবন্ধ ছিলাে। এমনকি, কাজী দীন মহম্মদের মতাে সাম্প্রদায়িক পরিচালকের কাছে রবীন্দ্রনাথও স্বীকৃতি লাভ। করেননি। লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, বাংলা অ্যাকাডেমী প্রায় ৩০০ খানা গ্রন্থ এ যাবতঃ প্রকাশ করে থাকলেও, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত কোনাে গ্রন্থ নেই। যেহেতু বাংলা সন সংক্ষেপে অবৈজ্ঞানিক, অ্যাকাডেমী তাই একটি সংস্কৃত বঙ্গাব্দ প্রণয়ন ও প্রচলন করেছে। আপাত দৃষ্টিতে কাজটি প্রশংসনীয় বলে বিবেচিত হলেও, একটু ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে হিন্দু বঙ্গাব্দকে মুছে ফেলে একটা নতুন কিছু করার পরিকল্পনা থেকে এ উদ্যমের জন্ম। উপরন্তু কাজী দীন মহম্মদের পরিচালনায় সে সনটি প্রবর্তিত হয়, তা জুলীয়ান ক্যালেনডারের মতাে সমান ত্রুটিপূর্ণ। বাংলা ভাষা সাহিত্যের সঙ্গে সরাসরি কোনাে যােগাযােগ না। থাকা সত্ত্বেও ইসলাম ও জাতীয় সংহতির প্রতি দৃষ্টি রেখে ইসলাম ধর্মবিষয়ক অনেকগুলি গ্রন্থ এবং ধর্মীয় ও জাতীয় নেতাদের কতকগুলি জীবনীগ্রন্থ বাংলা অ্যাকাডেমী প্রকাশ করেছে। তাছাড়া, অ্যাকাডেমীর প্রায় সবগুলি পরিকল্পনাই আধুনিক সমস্যা ও সংঘাতপূর্ণ জীবনের প্রতি বিমুখ। অ্যাকাডেমীর স্বল্পসংখ্যক কাজই এ কারণে, উপযােগিতার মাপে মূল্যবান বলে স্বীকৃত হতে পারে।
কিন্তু এসকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অ্যাকাডেমী এমন কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেছে অথবা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে এমন কিছু প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সহায়তা দান করেছে, যা অবশ্যই উল্লেখের উপক্ষা রাখে। মহম্মদ শহীদুল্লাহের সম্পাদনায় যে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকাশিত হয়েছে, তা যেমন অভিনব, তেমন প্রশংসনীয়। বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত শব্দাবলীর একটি অভিধান প্রণয়নের কাজও অ্যাকাডেমী প্রায় শেষ করে রেখেছে। কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরড স্থাপনে আগে অ্যাকাডেমী কিছু পরিভাষাও রচনা করেছ। তাছাড়া শহীদুল্লাহ প্রণীত ‘বাঙলা ভাষার ইতিবৃত্ত এবং মহম্মদ আবদুল হাই প্রণীত ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব বাংলা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক সকল গ্রন্থের মধ্যে একটি বিশিষ্ট আসনের দাবি করতে পারে। প্লেটোর সিমপােসিয়াম’, ‘প্লেটোর সংলাপ’, ‘জরাথ, বললেন, হান্টারের ‘দি ইনডিয়ানস মুসলমান’, হিট্টির ‘আরব জাতির ইতিহাস প্রভৃতি অনুবাদ কর্ম দর্শন ও ইতিহাস বিষয়ক প্রকাশনার নমুনা বলে বিবেচিত হতে পারে। আনিসুজ্জামানের মুসলিম সাময়িক পত্র’, মুনীর চৌধুরীর ‘মীর মানস’, মহম্মদ সিদ্দিক খানের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশণের গােড়ার কথা”, রফিকুল ইসলামের নজরুল নির্দেশিকা’, সুফী জুলফিকার হায়দারের ‘নজরুল। জীবনের শেষ অধায়’ প্রভৃতি গ্রন্থ নিঃসন্দেহে অর্থমূলক এবং সকল সাহিত্যামােদি ও গবেষকের কাছে মূল্যবান বলে সমাদর লাভ করবে। অতি সাম্প্রতিক কালে বাংলা অ্যাকাডেমী পূর্ব বাংলার চিত্তজাগরণের প্রতি ক্রমশ মনােযােগী হচ্ছিলাে। হয়তাে অদুর ভবিষ্যতে তার কার্যকলাপের মধ্যে সে স্বাক্ষর পরিস্ফুট হতাে; কিন্তু ইয়াহিয়া অত্যন্ত হুঁশিয়ার অঙ্কুরে বিনষ্ট করার প্রবচন তিনি ভালাে করে জানেন। বাঙালীদের গর্ব ও আশার একটি প্রতিষ্ঠান তাই এভাবে ধূলিসাৎ হলাে।
১২ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা