You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ববাংলায় রবীন্দ্রনাথ

–হাসান মুরশিদ

পূর্ব বাংলা থেকে বাঙালীত্বকে মুছে ফেলার প্রয়াস ছিলাে পাকিস্তানি নেতাদের। তারা আশা করেছিলেন পূর্ব দিগন্তে বাস করেও বাঙালীরা স্বপ্নে বিচরণ করবেন আরব ইরানে। দোয়েল কোয়েল-ডাকা তালতমালজারুল হিজল বনে বেষ্টিত থাকলেও সে দেশের কবিরা কবিতা লিখবেন খেজুর-বাবলা আর বুলবুলি নিয়ে। কিন্তু স্বভাব স্বীকরণ করে না এমন অসম্ভব এবং উদ্ভট পরিকল্পনাকে। সংস্কৃতি কি কলকারখানায় ছাঁচে ঢেলে তৈরি করা যায়? সে থাকে মনােলাকের গভীরে। ভাষার মতাে সব অত্যাচারকে অগ্রাহ্য করে সে প্রকাশ করে আপন স্বরূপকে। পূর্ব বাংলার সংস্কৃতির ওপর সরকারি জুলুম এসেছে নানা পথে। রবীন্দ্রনাথের ওপর উদ্ধত আক্রমণ তার অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের পরাজয় এবং বিলােপ যেহেতু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পরাজয় এবং বিলােপের নামান্তর, তাই তিনি হিন্দু বলে মুসলিম বীরােধী বলে পক্ষপাতদুষ্ট বলে নিন্দিত হয়েছেন। সুপরিকল্পিতভাবে তাঁর রচনা বর্জিত হয়েছে পাঠ্যপুস্তক থেকে, পাকভারত যুদ্ধের নাম করে নিষিদ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার। (যেন রবীন্দ্রনাথ একজন ভারতীয় সৈনিক।)। | কিন্তু পাকিস্তান হয়েও যারা ভােলেননি তাদের বাঙালীত্বকে, রবীন্দ্রনাথকে সকল রূঢ় আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার কাজকে তারা বিবেচনা করেছেন পবিত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্যরূপে। এঁদের চোখে বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতীক হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ওখানকার মানুষের যে উৎসাহ সম্ভবত তা কেবল সাহিত্যসঙ্গীতের জন্যেই নয়। ছায়ানটের’ সঙ্গীতানুষ্ঠানে উপস্থিতির সংখ্যা যে অযুতের ঘরে পৌছতাে তার কারণ এই নয় যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সমঝদরের সংখ্যা ওখানে অত বেশি। বরং নিপীড়ন ও নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ অতাে প্রবল বলেই ক্রমশ স্ফীত হয়েছে এই সংখ্যা। তদুপরি শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা রবীন্দ্রনাথে শুনেছিলেন এক উদার মানবতার বাণী; কোনাে ধর্মীয় সংকীর্ণতা যাকে খাটো করে না কোনাে আচারের দৈন্য যাকে কুৎসিত করেনা, কোনাে ইজম যাকে নিয়ন্ত্রিত করেনা। সেই মহৎ মানবতার আহ্বান রাষ্ট্রীয় সীমানার সুউচ্চ প্রাচীর এবং ধর্মীয়-আচারের দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধানকে পরাস্ত করে অনায়াসে। জন্ম নেয় এক নতুন চেতনা। স্বদেশ আর স্বকীয় সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম ও অশেষ ভলােবাসার। মানুষকে মানুষ বলে স্বীকার করায়। পশ্চিমবঙ্গের যে অংশ এই প্রশস্ততাকে অঙ্গীকার করেছে তার সঙ্গে এভাবে পূর্ববঙ্গের সম্মিলন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের সূত্র দিয়ে ঐক্য রচিত হয়েছে দুটি আপাত বিপ্রতীপ মতের। | তথাপি একথা অবশ্য স্বীকার্য পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্র চর্চার যে ধারা প্রবাহিত তার রঙ আলাদা, তার গতি 

ভিন্ন। প্রবল রিপু তাদের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে বলে রবীন্দ্রনাথকে ‘বাঙাল’রা অর্জন করেছেন নতুনরূপে, আত্মসাৎ করেছেন এমনভাবে, যাতে বহিঃশত্রুর অপহরণের ভীতি বিদূরিত হয় চিরতরে। উপনিষদের পটভূমিকায় ঋষির মূর্তিতে অথবা গুরুদেবরূপে তিন বাঙালীদের চোখে ধরা দেননি। জীবন দেবতা নয় তার মানবতা বােধই বরণীয় ও বাংলার কাছে। এই কারণেই আনিসুজ্জামানের কাছে রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তাই প্রাধান্য লাভ করে। আক্রাম তাঁর উপন্যাসের সমাজ চিত্র বিশ্লেষণে তৎপর। মহাম্মদ আবদুল হাই তাকে বিচার করেন ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে। হায়াত মামুদ ব্যাপৃত তার প্রেমের উৎস সন্ধানে। তার গণসচেতনতা গবেষণার বিষয় হয় ওখানকার গবেষকের কাছে। আনিসুজ্জামান সম্পাদিত গােটা রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে মূল্যায়নের যে প্রয়াস এবং যে মেজাজ বিধৃত তা স্বতন্ত্র পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সে কারণেই সম্ভবত সকল ঘূর্ণিঝড়ের বৈপরিত্য সত্ত্বেও ওখানে রবীন্দ্রনাথের এক নিষ্কলঙ্ক মূর্তি নির্মীয়মান আর। এ বাংলায় তার নিষ্প্রাণ মর্মরমূর্তিও বিচূর্ণ। এ বাংলার রাজনীতির তিনি করুণ শিকার; ওপারের রাজনীতি তার নতুন জন্ম দেয়। স্বাধিকার সংগ্রামের প্রতীক রবীন্দ্রনাথের নতুন জন্ম আবার ওপারের রাজনীতিকে দুর্বার বেগে পরিচালিত করে নতুন পথে। কোনাে দেশে কোনাে কালে কোনাে সত্যদ্রষ্টা কবি এমন প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছেন সে দেশের সমাজচিন্তাকে?

৯ মে, ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!