You dont have javascript enabled! Please enable it!

অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দুই বাংলা

— গৌরী আইয়ুব

‘বাংলাদেশ’ নিয়ে এই মাতামাতি, মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এই উচ্ছাস পশ্চিম বাংলার অনেক মুসলমান পছন্দ করছেন না। এই নিয়ে বহু প্রশ্ন, কিছু বিদ্রুপ, কিছু বা হতাশা মিশ্রিত মন্তব্য শুনতে পাই। কিন্তু হিন্দু সমাজের পক্ষে এটা বােঝা কি খুব কঠিন যে পাকিস্তান ধসে পড়ার অর্থ ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান উভয়ের কাছে এক হতে পারে না? এই উপমহাদেশে রাজাগােপালচারী কিংবা জয়প্রকাশ নারায়ণের মতাে গুটি দুই চার মানুষ ছাড়া আর প্রায় কোনাে হিন্দুই পাকিস্তানকে মনে মনে মেনে নেননি। ফলে আজ যখন পাকিস্তানের বুনিয়াদ টলে উঠেছে তখন মুখ্যত সেই কারণেই হিন্দুরা খুশি; একথা গােপন করে লাভ নেই। তবু বাংলাদেশের। একটা বিরাট জনসংখ্যা আরও একটি কারণে খুশি; পূর্ব বাংলার বাঙালী মুসলমান ফিরেছে আজ মায়ের ডাকে। একদিন যে বাঙালী মুসলমান বলতেন ‘হিন্দুর সাহিত্যে আমাদের স্থান নেই’ সেই মুসলমানই আজ হিন্দুর লেখা গান গেয়ে মৃত্যুকে পর্যন্ত বরণ করেছেন বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার আশায়। এরপর এই বাংলার অধিকাংশ হিন্দুরও যে হৃদয়ে টান পড়বে এতাে বলাবাহুল্য।

কিন্তু পশ্চিম বাংলার মুসলমানের প্রতিক্রিয়া ঠিক একই রকম না হলে বিস্ময়ের কিছু নেই। যেসব মুসলমান দেশ ভাগ হবার নানা কারণে এদিকে থেকে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অধিকাংশরই মনে পাকিস্তান। সম্বন্ধে একটা দরদ, একটা প্রত্যাশা স্বভাবতই ছিল যা কোন হিন্দুর মনে থাকা সম্ভব নয়। এখানে আবার।  একটা দাঙ্গা বাধলে হয়ত শেষ পর্যন্ত সেখানেই চলে যেতে হবে। এখানে চাকরীর বাজারে যে তীব্র প্রতিযােগিতা তাতে ব্যর্থকাম হলে হয়ত ঢাকা চট্টগ্রাম কি খুলনায় ছেলের একটা চাকরী মিলবে। এদিকে মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র না পাওয়া গেলেও ওদিকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এই অবস্থায় পাকিস্তন সম্বন্ধে কি করে এদিককার মুসলমানের মন বিরূপ হতে পারে। পশ্চিম বাংলার বহু মুসলামনের কাছেই তাই পূর্ব পাকিস্তান একটা ভরসা, একটা আশ্রয়ের মতাে ছিল। অতএব পাকিস্তান ধসে পড়ছে দেখে এদিককার মুসলমান যে বিচলিত বিভ্রান্ত এমন কি ক্রুদ্ধও বােধ করতে পারেন এটা প্রত্যাশিত।

কিন্তু প্রত্যাশিত হলেও যুক্তিযুক্ত নয়, মঙ্গলকরও নয়। বাংলাদেশে অর্থাৎ সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে ২৩ বছর ধরে যা ঘটেছিল তার খবর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এদিকে কেউই আমরা তেমন রাখিনি। ফলে আজ যখন বিস্ফোরণের মত এসে এত বড়াে ঘটনাটা আমাদের চমকে দিল তখন একদল উল্লসিত, একদল বিমর্ষ বিভ্রান্ত। যাঁরা উল্লসিত তারাও যে সবাই সঙ্গত কারণে উল্লসিত তা নয়, যারা বিভ্রান্ত ও বিমর্ষ তারাও মনে হয় ব্যাপারটাকে যথাযথ বুঝতে পারছেন না। এই বাংলার যে-সব মুসলামন আশাহত ও উদ্ভ্রান্ত বােধ করছেন, যাঁরা বলছেন মুজিবুর রহমানের অসহিষ্ণু ও হঠকারিতা বাঙালী মুসলমানের সর্বনাশ ডেকে এনেছে, যারা বাঙালী হিন্দুর উচ্ছ্বাস দেখে দ্বিগুণ সন্ধিগ্ধ হয়ে বাংলাদেশের এই মহান আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারছেন না, তাঁদের কাছে আমার এই সবিনয় নিবেদন। কেন এই বাংলার মুসলমানেরও পায়ের তলার মাটি আজও কেঁপে উঠেছে তা আমি বুঝতে পারি, বুঝতে পারি কেন সর্বান্তঃকরণে তারা মুজিবর রহমানের জয়যাত্রাকে আশীর্বাদ করতে পারেননি। কারণ তাদের একটি বড়াে আশার বাসা ভেঙে গেছে। এবং তারা মনে করছেন এমনভাবে তা ভেঙে দেবার স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ছিল না।

কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের স্বাভাবিক বিবর্তনের অমােঘ ইঙ্গিত যেদিকে ছিল, এই বাংলার অনেক মুসলমান সেদিকে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। শুধু ধর্মের মিলটুকু মূলধন করে ভিন্নভাষাভাষী আর ভিন্ন সংস্কৃতিপুষ্ট ১২০০ মাইল দূরবর্তী দুটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের অধিবাসীরা একদা একটা রাষ্ট্র গড়েছিলেন। এই অভূতপূর্ব রাষ্ট্র পাকিস্তান কতদিন টিকবে তা নিয়ে তখনই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন হিতৈষী এবং বিদ্বেষীরা। ২৩ বছর পর আজ দেখা যাচ্ছে সন্দেহটা অমূলক ছিল না। কিন্তু কি করে এই সন্দেহটা সত্যে পরিণত হয়ে উঠল ক্রমে তার খবর কি পশ্চিম বাংলার মুসলমান দেখেছিলেন?

খবরটা এই। বাংলাভাষা, বাঙলাসংস্কৃতি এমন কি বাঙালী মুসলমানের বিদ্যাবুদ্ধি আকৃতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে গােড়া থেকেই গভীর অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা । অসভ্য বাঙালীকে সুসভ্য করার জন্য উর্দু শেখাবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। হিন্দুর স্পর্শ দুষ্ট বাঙলা সংস্কৃতি ভুলিয়ে খাটি ইসলামী এবং উন্নত পাঞ্জাবী সংস্কৃতি দান করতে এসেছিলেন তাঁরা। কিন্তু গোঁয়ার বাঙালীরা বার বার সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করেছে। তবে তার মূল্য দিতে হয়েছে বহু বীরের রক্ত ও মাতার অশ্রুমুখের ভাষা ও হৃদয়ের সম্পদ বাঙালীর সংস্কৃতি তারা। 

কেড়ে নিতে না পারলেও চাকরী-বাকরির সিংহভাগ দখল করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা সামরিক বিভাগেও বাঙালী মুসলমান বিশেষ পাত্তা পাননি। তাও বােধহয় বাঙালী মুসলমানের সহ্য হতাে যদি না বাঙালী চাষী, বাঙালী মজুরের রক্ত জল করে অর্জন করা বৈদেশিক মুদ্রা লাহাের, করাচী, রাওয়ালপিণ্ডিকেই বছরের পর বছর বেশি পুষ্ট করে চলতাে। পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক সাচ্ছল্য পূর্ব বাংলার পরিশ্রমে, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বপ্রকার তাচ্ছিল্যও ঐ বাঙালীদের প্রতি। এই অসহনীয় অবস্থা পূর্ব বাংলার মানুষকে প্রতিনিয়ত পীড়া দিচ্ছিল। ফলে ধর্মের ঐক্যকে দীর্ঘ করে বাঙালিত্বের স্বাভিমান জেগে উঠেছিল। কিন্তু সেটা উপলব্ধি করতে পারেন নি এই দিককার মুসলমানেরা অনেকেই। এঁরা সংখ্যালঘুর প্রবণতা অনুযায়ী এঁদের মুসলিম স্বাজাত্যবােধকে আঁকড়ে ধরে আছেন এদিকে! ফলে তারা আজও প্রথমে মুসলমান এবং পরে বাঙালী’ রয়ে গেছেন। কিন্তু ওঁরা প্রথমে বাঙালী ও পরে মুসলমান হয়ে উঠেছেন। এই তফাৎটুকুর জন্যই এ বাঙলার বহু মুসলমান আজ ঐ বাঙালার মুসলমানের এই মরণপণ সংগ্রামের তাৎপর্য বুঝতে পারছেন না। ইতিহাসের এমনতর পরিহাস এই প্রথম নয়।

কিন্তু আমার বিশ্বাস, এই বাঙলার মুসলমানের কাছেও ক্রমে কয়েকটা কথা পরিষ্কার হবে প্রথম ধাক্কার বিমূঢ় ভাবটা কেটে গেলে। প্রথমত স্বাধীন বাংলার জন্য লড়াই পাকিস্তানের বুনিয়াদ গুঁড়িয়ে দিলেও এই  উপমহাদেশের মুসলমানের এতে সর্বনাশ নয়, মঙ্গলই হবে। এই আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অভুতপূর্ব বিপ্লব বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাছাড়া এই সংগ্রামের নায়ক মুজিবুর রহমান একদিন বিশ্বের ইতিহাসে একজন উজ্জ্বল জ্যোতি বলে গণ্য হবেন কারণ শুধু পূর্ব বাংলার মুসলমানকে নয়, সারা ভারতের মুসলমানকেই তিনি এক মহত্তর পথের সন্ধান দিচ্ছেন।

যারা ভয় পাচ্ছেন স্বাধীন বাংলা স্বাধীন থাকবে না, ভারতের কুক্ষিগত হবে, তাদের বিচারবুদ্ধি স্বচ্ছ থাকলে একথা বুঝতে কষ্ট হতাে না যে মুজিবুর রহমানের বাংলাকে বন্ধুভাবাপন্ন স্বাধীন প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে পেলে ভারতের যত লাভ একে কুক্ষিগত করে ভারতের তত লাভ নেই। স্বাধীন ও মিত্র বাংলাদেশ” আমাদের সামরিক ব্যয় কমিয়ে দেবে কারণ পূর্ব সীমান্তে সমরসজ্জা কম করা চলবে। বাণিজ্যেরও উন্নতি হবে। চীন এবং আমাদের মাঝখানে শক্ত ঘাঁটি থাকবে গণতন্ত্রের। অন্যপক্ষে স্বাধীন বাংলাকে কুক্ষিগত করবার চেষ্টা করলে সারা পৃথিবীতে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে। তাছাড়া স্বাধীন বাংলার ভিতর থেকে তখন যে বিদ্রোহ দেখা দেবে তা দমন করতে আমাদের আর্থিক ও নৈতিক ক্ষতিও হবে প্রচুর। দুই বাংলার এক হবার বিরুদ্ধে দুদিকেই মানসিক প্রতিরােধ কম নয়। সে বিষয়টি বিশদ আলােচনা সাপেক্ষ। তবে একটা কথা সম্ভবত অনেকের কাছে স্পষ্ট যে, দুই বাংলা এক হয়ে আবার একটি মুসলিম সংখ্যাগুরু রাজ্য হবে এই সম্ভাবনা বহু হিন্দুর কাছেই উপাদেয় ঠেকবে না। অন্যদিকে পূর্ব-বাংলার মুসলমান চাকরী বাকরি, রাজ্যশাসন কিংবা সংস্কৃতির চর্চায় আর একবার এখনই হিন্দুর প্রবল প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হতে প্রস্তুত বলে আমার মনে হয় না। অতএব আগ্রহটা দুদিকেই মুখ্যত সাংস্কৃতিক যােগাযােগ ও হার্দিক সম্পর্ক স্থাপনের দিকে রাজনৈতিক ঐক্যসাধনের পক্ষে ততটা নয়। স্বাধীন বাংলা ও ভারতবর্ষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ধার ক্ষয়ে যাবে এবং দুই সম্প্রদায়ের হৃদয়ক্ষত অনেকটা নিরাময় হবে বলে আমার বিশ্বাস। ধর্মভিত্তিক একটি সামরিক সরকারের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গড়ে উঠলে আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পন্ন মানুষ তাকে প্রগতি বলেই চিনবেন আশা করি।

এই সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থানের দাবী করে কারণ সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এমন সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে অহিংস অসহযােগে প্রবৃত্ত করতে ইতিপূর্বে আর কেউ পারেননি। মনে রাখা ভালাে যে, গান্ধীজীর প্রতিপক্ষ ছিল একটি সভ্য সরকার ও জাতি যার স্বদেশে গণতন্ত্রের এবং একটি উদার সাংস্কৃতির ঐতিহ্য ছিল। আর মুজিবুর রহমানের প্রতিপক্ষ একটি ধর্মান্ধ-সামরিক শক্তি বা গণতন্ত্র বা উদার কোন সাংস্কৃতির ধার ধারে না। জনতাকে ক্ষেপিয়ে ধংসাত্মক কাজে লাগানাে সহজ, কিন্তু তাদের বুঝিয়ে একটি গঠনমূলক অসহযােগিতার পরিকল্পনায় যুক্ত করা যে তত সহজ নয় তা বার বার গান্ধীজী উপলব্ধি  করেছিলেন। মুজিবুর রহমান সেই কঠিন ব্রত অন্তত তিন সপ্তাহের জন্য পালন করেছিলেন এবং ভীত ক্রুদ্ধ ইয়াহিয়া খান উন্মত্তের মত এই নিরস্ত্র জনতার উপর ঝাপিয়ে না পড়লে এই অহিংস অসহযােগ তিনি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারতেন সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ নেই। কারণ মুজিবের শক্তির উৎস বন্দুকের নলে নয়, তার শক্তির উৎস আত্মনিয়ন্ত্রিত জনসাধারণের সমর্থনে, শ্রদ্ধায় আত্মদানে। শুধু মুজিবুর রহমানের নয় তাঁর অনুগামীদেরও দেখলাম জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন। এই জনতা মরবার জন্য যত প্রস্তুত হয়েছিলেন মারবার জন্য তত নয়। যদি মারবার শিক্ষা আগে থেকেই নিয়ে রাখতেন তারা তবে কোনাে। ইয়াহিয়ার ফৌজের সাধ্য ছিল না এক সপ্তাহ এই জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে মুজিবের ডাকে প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন এই মহত্ত্বকে অশ্রদ্ধা করতে পারে শুধু তারাই যাদের বুদ্ধি বিবেককে আচ্ছন্ন করে রেখেছে কোনাে সংকীর্ণ শাস্ত্রবাক্য- সে আধুনিক রাজনীতি শাস্ত্রই হােক আর সুপ্রাচীন ধর্মশাস্ত্র। পৃথিবী ইতিপূর্বে কতবার এমনতর বীরত্বের পরিচয় পেয়েছে সে হিসেব ইতিহাসের পণ্ডিতরা করবেন। কিন্তু একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে আজ যারা এই বীরকে শ্রদ্ধা করতে পারছেন না, এই বীরত্বের গৌরবে নিজেকে গৌরবান্বিত বােধ করছেন না তারা বড়াে হতভাগ্য। জাতীয় নেতা নির্বাচনে ভুল আগেও হয়নি, এমন নয়, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালী যদি এই এই ভুল আবার করে তবে তার সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবেনা। মুজিবুর রহমান আর আর একটি নাম নয়, মুজিবুর রহমান আজ একটি ভাবনা। এই ভাবনায় ভাবিত না হতে পারলে ইতিহাস আমাদের করুণা করবে।

৩ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!