You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.27 | ইতিহাস কিছু ভােলে না - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ - সংগ্রামের নোটবুক

ইতিহাস কিছু ভােলে না

— সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম হাতে-নাতে প্রমাণ হতে চলেছে, সামরিক একনায়কত্বও নয়-অসামরিক জনসাধারই প্রকৃতপক্ষে চরম একটি শক্তি আমাদের এ বিশ্বাস তাে আসলে ছিল নীতিবাক্যে আনুগত্যের মতাে, যথা ঃ চুরি করা বড় দোষ। মনে আমরা কোন দিনও কি মানতাম একে! এটি অষ্ট প্রহর আমরা ব্যবহার করেছি  রাজনীতির দরবারে মােল্লাপুরুতের “দিববাণী” আওড়ানাে মাত্র। আমরা এমনও বলেছিলাম, জনগণ শক্তি বটেতবে কিনা রাইফেলই শক্তির উৎস। রাইফেল যে ধরে, তার একজোড়া বাহু এবং মন যেন কিছু নয়। সে যাই হেক, মুখে যতই জনগণ বলে যত চেঁচাই- সামরিক একনায়কত্ব তথা সামিরক অভ্যুত্থানের মহামারীর ত্রাস। বুকে হাত দিয়ে বলা যেতে পারে, আমাদের কীভাবে পাণ্ডুর করে তােলে। কিন্তু আজ ‘বাংলাদেশ’ সাক্ষী, সামরিক শক্তি কোন জগদ্দল বােঝা আদৌ নয়, বিশালতম কোন অচলায়তনও নয়— জনগণ ইচ্ছে করলে তাকেও উৎখাত করতে পারে। প্রমাণ হলাে, গণতন্ত্রই সভ্যতার প্রকৃত নিয়ামক। বাংলাদেশের এই ঘটনার পর দুনিয়ার যেখানে যেখানে সামরিক একনায়কতন্ত্র রয়েছে, সেখানের সচেতন মানুষ মাত্রেই আজ দ্রুত চকিতে নড়ে উঠতে বাধ্য। ইতিহাসে একটা নতুন সত্য হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি যুগের সূচনা করল বাংলাদেশ’। দুনিয়ার যেখানে যত সামরিক একনায়ক আছে, কিংবা সামরিক অভ্যুত্থানের গােপন ষড়যন্ত্রে যারা এখন লিপ্ত, এমনকি যে সাধারণ মানুষটিও গণতন্ত্রের কোন্দল কেচ্ছা কলুষিত আবহাওয়ায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে মিলিটারী শাসনই আসুক’ বলে চাপ বিক্ষোভ প্রকাশ করেছে তাদের মাথায় ধূসর রঙের বিশেষ পদার্থটি থাকলে অবশ্যই উদ্বিগ্ন হবে এবং ভাববে।

পক্ষান্তরে জনগণের কাছেও এ একটা শিক্ষা। কতখানি রক্ত দিতে হয়, হাতে-নাতে জানা গেল। আরও জানা গেল, ধর্ম মানুষের সমাজে যতখানি শুভকে নিয়ে আসে, অশুভকে নিয়ে আসে তারও বেশি। ধর্ম যখন। জাতীয় সংহতি ও অখণ্ডতার দাবি করে তখন সে স্বয়ং শয়তানেরই প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। আর বাঙালী মুসলমান জনসাধারণের তাে এ একটা প্রায়শ্চিত্ত। বড় সহজে সকালে ঘুম ভেঙে যে স্বপ্নের সােনা বাস্তব হয়েছিল ‘ছপ্পর ছুঁড়ে পড়া ধনের মতাে যা-তার মূল্য ইতিহাসের পাওনা ছিল নাকি? তবে যেনখুব বেশি হয়ে গেল এ মূল্যশােধের পরিমাণ। এত রক্ত! আসলের চেয়ে সুদটা এত বেশি।  এবং আমাদের সামনে আজ ওই সূর্যদীঘল দর্পণ। যারা ধর্মকে জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান মনে করি, সেই সব সাধু সাবধান! যারা এখনও ধর্মকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবন থেকে বাইরের বৃহত্তর সমাজ জীবনে টেনে আনি, তারা হুঁশিয়ার। ইতিহাস কিছু ভােলেনা। সে আমাদেরই অস্তিত্বের সামুহিক একটি রূপ- আমরা সবাই তার মধ্যে আছি; তবু তার নিজস্ব স্বতন্ত্র একটি অবজেকটিভ সত্তা আছে- নিয়মাবলী আছে। প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের মতাে সে একটি সুব্যক্ত স্বাধীনতা স্রোত- তার কাছে কোন হিন্দুমুসলমান-খ্রিষ্টান নেই। 

ওই সূর্যদীঘল দর্পণে আমাদের আজ সবটুকু দৃষ্টি দরকার। আমরা স্পষ্ট দেখব, ধর্ম এবং রাজনীতির কতদূরে দেশাত্ববোেধর অবস্থিতি। আমরা জানব, এই তেইশ বছরে আমাদের চেহার কী বিকৃত আর অমানুষিক হয়ে পড়েছে। বীভৎস ক্ষতলাঞ্ছিত আমাদের অস্তিত্ব সুপ্রকট হবে প্রতিবিম্বে। দেখতে পাব,  কতখানি চাকর হয়ে পড়েছি আমরা। আমাদের রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সায়েব সাজা, বিলিতী ঢঙের নকলিয়ানা, খ্রিস্ট মাসে সমারােহে কেক খাওয়া কিংবা খােকাখুকুর জন্মদিনে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গাওয়া সমেত কী হাস্যকর বেলেল্লা নফর এক ভাড়ের চেহারা। আরও একটা কাণ্ড দেখা গেল। দুনিয়া আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে। ঘাের রক্ত-সন্ধ্যা নেমেছেচারিদিকে বিশাল সব যন্ত্র। রােবােট। রাষ্ট্রসংঘের টেবিলে টেবিলে ওরা কারা সব বসে আছে? আমরা এ যাবৎ বহুদেশে বহু হত্যা দেখেছি- এমন কি গণহত্যাও দেখেছি কিন্তু আজ পূর্ববাংলায় বাংলাদেশে যা দেখেছি, তার কোন নজির নেই। এই নজিরহীন ভয়ঙ্করতম গণহত্যাকাণ্ড চলছে, চলবে। রােববাটের নিজ নিজ কমপিউটারে যদি শেষ অবধি লাল সংকত ফোটে, তবেই হুঁশিয়ারের বােতামে আঙ্গুল পড়বে- নয়তাে না। হায় রাষ্ট্র, হায় মানবতা। আপাতত শুধু আক্ষেপই সার। আমরা বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা হাড়ে-হাড়ে ভীষণ আন্তর্জাতিক ছিলাম। আজ তাে চোখ রেখেই অবাক। আমরা আমাদেরই মুখের ওপর ভায়ের রক্ত এসে ছিটকে পড়ছে। এ রক্ত আমাদেরও ধমনীতে প্রবাহিনী। আজ আর আন্তর্জাতিক হতে পারছিনে। ওই সুবিশাল সূর্যদীঘল দর্পণে তাকিয়ে দেখছি, ওটা মিথ্যে, ওটা ভঁড়ামি। “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি”র যে সুর, যে দুঃখ তা আমাদেরই গভীরভাবে ছুঁয়েছে। অন্যেরা তাে আসলে উৎসাহী দর্শক।

২৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা