You dont have javascript enabled! Please enable it!

৫ স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি

— হাসান মুরশিদ

১৯৪০ সালে লাহােরে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলাে। প্রস্তাবে বলা হয়েছিলাে, কয়েকটি স্বশাসিত প্রদেশ নিয়ে একটি ইসলামি রাষ্ট্র গঠিত হবে- যে রাষ্ট্র মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ পুরােপুরি সংরক্ষিত হবে। বিশ্লষণ করলে দেখা যাবে এ প্রস্তাবে পাঁচটি শর্ত আছে। (ক) ইসলামি সংস্কৃতিচর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা; (খ) হিন্দুদের সঙ্গে অসম প্রতিযােগিতা থেকে বাঁচানাের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের জন্যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন; (গ) এই নতুন রাষ্ট্রের জনগণের জন্যে অর্থনৈতিক সুবিচার নিশ্চিতকরণ; (ঘ)। জনগণের রাজনৈতিক অধিকার দান; এবং (ঙ) সম্পূর্ণ স্বশাসিত প্রদেশ গঠন।

কিন্তু এই শর্তগুলির তিনটি শর্তকে অস্বীকার করার জন্য একটি সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্র হয়েছে। একথা সত্য যে মুসলমানরা তৎকালীন শাসকগােষ্ঠী ও ইংরাজী বিদ্যার প্রতি বিমুখতা ও অবহেলা প্রদর্শন করার জন্যেই উনবিংশ শতাব্দীর গােড়া থেকেই মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হয়েছে এবং সামাজিক প্রতিপত্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য হেতু হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পরবর্তীকালে যে প্রতিযােগিতা চলে তা একান্তভাবেই অসম । ইংরেজরা এই বৈষম্যকে। সাম্প্রদায়িক বিরােধ সৃষ্টির কাজে অত্যন্ত চতুর ও সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। হিন্দু মুসলমান উভয়। 

সম্প্রদায়ই পর্যায়ক্রমে তাদের হাতে ক্রীড়নকের মতাে কাজ করেছেন। ফলে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেই এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি খুব জটিল আকার ধারণ করে। হিন্দু জাতীয়তা এবং মুসলমানদের পশ্চিমী প্রীতি একই প্রতিক্রিয়াশীল মনােভাবের উল্টো পিঠ। শিক্ষা ও সম্পদের সুষম বন্টনের সাহায্যে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করে হয়তাে। এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে লড়াই করা যেতাে। কিন্তু হিন্দু মুসলিম কিংবা ইংরেজ এর কোনাে। শিবির থেকেই সে প্রচেষ্টা চালানাে হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর অবশ্য এই বৈষম্য দ্রুত কমে আসে। ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেখানে মাত্র কিঞ্চিদধিক দু-হাজার মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন, ১৯৭০ সালে- ৩০ বছর পরে সেখানে এক পূর্ব বাংলা থেকেই দুলক্ষের চেয়েও বেশি মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। তাছাড়া, চাকুরি ও ব্যবসা বাণিজ্যক্ষেত্রে হিন্দু প্রতিযােগীর অভাবে অল্পকালের মধ্যেই মুসলমানদের সুযােগ সুবিধা বৃদ্ধি পায় এবং হিন্দুদের প্রতি তাদের ঈর্ষা ও বিদ্বেষ মন্দীভূত ও দূরীভূত হয়। শিক্ষিত মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত সম্মানজনক সামাজিক প্রতিপত্তি লাভ করেন এবং তার ফলে হিন্দুদের সঙ্গে তুলনা করে তারা। অতীতে যে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন, তা-ও মুছে ফেলতে সক্ষম হন। বরং এখন তারা পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলমানদের শােষণ ও শাসনের প্রতিই সচেতন ও বিরূপ হয়ে ওঠেন।

ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার বিষয়েও হিন্দুদের অনুপস্থিতিতে মুসলমানদের একটি ঈর্ষামুক্ত উদার ও স্বকীয়। দৃষ্টিলাভ করতে সহায়তা করে। বরং পরিবর্তিত পরিবেশে ধর্মের চেয়ে তাদের কাছে পার্থিব বিষয়ই বেশি প্রাধান্য লাভ করে। নব্য শিক্ষিত মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তথা বৃহত্তর জগতের সংস্কৃতি চিন্তার সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হয়ে ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি প্রশস্ত মানসিকতার অধিকারী হন। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হতে পারলাে বলেই একথা অনস্বীকার্য, সাম্প্রদায়িক চেতনা অল্পকালের মধ্যে বিলীন হলাে।

 অপরপক্ষে পূর্ববাংলার জনগণ যখন তথাকথিত একটি স্বাধীনদেশের অধিবাসী হয়েও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীকার থেকে বঞ্চিত হলেন, তখন প্রথমে তাদের বিদ্বেষ এবং পরে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিচালিত হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ষষ্ঠ দশকের মাঝামাঝি থেকেই, পূর্বোক্ত কারণসমূহের ফলশ্রুতি স্বরূপ লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ববাংলায় সচেতন মানুষরা জানাতে থাকেন। ন্যায্যপ্রাপ্তির পরিবর্তে ক্রমবর্ধমান শােষণের মুখে এই দাবি অল্পকালের মধ্যেই প্রবল হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে বাঙালিরা সােচ্চার হয়ে ওঠেন। এই সময়ে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন। স্থানে যে আন্দোলন হয়, তাতে পুরােনাে পাকিস্তানের ধারণায় ফাটল ধরে। জিন্নাহ ও আইয়ুব সাহেবের আলােকচিত্র নানাস্থানে ভেঙে ফেলা হয় এবং স্বাধীন বাংলার দাবি সংবলিত পােস্টার ও হ্যান্ডবিল ছড়িয়ে পড়ে।

তবে একথা মানতেই হবে যে, এ সময় পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার দাবি সার্বজনিক সমর্থন লাভ করেনি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিলাে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছ-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসনের এক বলিষ্ঠ দাবি উত্থাপন করেন। এ দাবির গুঢ় তাৎপর্য এবং সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করে আইয়ুব ও তাঁর দালালরা আতঙ্কিত না হয়ে পারেননি। অনতিকাল পরেই শেখ মুজিব এবং কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি ও সামরিক কর্মচারী গ্রেপ্তার হন। আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক একটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয় তাদের। সত্যি সত্যি এমন কোন ষড়যন্ত্র’ হয়েছিলাে কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর, কিন্তু মামলাসূত্রে বাঙালির জানতে পারলেন পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার। একটি মহান পরিকল্পনা চলছে। এই সময়ে এবং পরবর্তীকালের ১৯৬৯-৬৯ সালের এ মামলার বিচার চলতে থাকার সময়ে, সরকারি ও পত্র-পত্রিকার প্রচারণার ফলে বাংলার স্বাধীনতার ধারণা সকল মানুষের মনে। দৃঢ়মূল হয়। মামলার সাক্ষী ও আসামীদের বিবৃতি থেকে পূর্ব বাংলার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্ঠুর ও নির্মম শোষণ ও শাসনের ইতিহাস পুনঃপুনঃ প্রচারিত হতে থাকে এবং তার ফলে সকল মানুষের মনে পশ্চিমপাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ ও বিক্ষোভ জন্মায়। এই মামলা পূর্ব বাংলার পক্ষে শাপে বর হয়। 

১৯৬৮ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর থেকেই এ মামলার এবং সামগ্রিক ভাবে আইয়ুব-মােনেমের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৬৯-এর জানুয়ারি মাসে ছাত্রনেতা আসাদ নিহত হওয়ার পর এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং রীতিমত প্রবল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে প্রচুর বুলেট ও বেয়নেট চালিয়েও এই আন্দোলনকে প্রতিহত করা যায় নি। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ডকটর শামসুজ্জোহা সৈন্যদের গুলিতে নিহত হলে এ আন্দোলন চরমে পৌছে। সে রাত্রে ঢাকায় কারফিউ অমান্য করে লক্ষাদিক লােক রাস্তায় নেমে পড়ে। তার দুদিন পরই দুর্দমনীয় এ আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক কর্মীরা সৈন্যদের ছাউনি থেকে মুক্ত হন।

এরপর আইয়ুব আহুত গােল টেবিল বৈঠকে ব্যর্থ হওয়ায় ২৫ মারচ বর্তমান স্বনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আইয়ুবকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন অনতিবিলম্বে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করে ব্যারাকে ফিরে যাবেন।

যতদিন ক্ষমতার লােভ তাঁর মন দখল করেনি, অথবা দাবি মেনে নেবার তাৎপর্য সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট সচেতন হতে পারেননি, ততদিন ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলার দু-একটি ন্যায্য-দাবিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক সুবিচার করা হয়নি, এ অভিযােগ তিনি স্বীকার করেন। উপরন্তু জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ববাংলা থেকে কেন্দ্রীয় পরিষদের আসনসংখ্যা নির্ধারণের দাবিও তিনি মেনে নেন। ১৯৭০ সালের প্রথম। দিকেই তিনি অক্টোবর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘােষণা করেন।

পরিপূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ একটি ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করেন। এই ম্যানিফেস্টো যে পূর্ব বাংলার সকল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করেছিলাে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল এবং ১৯৭১ সালের মারচ মাসে বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযােগ আন্দোলনের পরিপূর্ণ সফলতা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। | মারচ-মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগ কার্যত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণার পূর্বে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধই মৌলনা ভাসানী পূর্ব বাংলার জন্যে পরিপূর্ণ-স্বাধীনতার দাবি করেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের আশা করেছিলেন এবং শাসন তান্ত্রিক উপায়ে স্বায়ত্তশাসন লাভ করাই ছিলাে তাদের লক্ষ। মারচ মাসের পয়লা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দেওয়া হলেই আওয়ামী লীগ। 

তথা পূর্ব বাংলার সকল মানুষ বুঝতে পারেন; ১৯৫৪ সালের মতাে এও বাঙালিদের রাজনৈতিক স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করার আর একটি হীন ও ক্রুর ষড়যন্ত্র । এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ২রা মারচ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের পতাকা পােড়ানাে হয় এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। কার্যত সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। এর প্রতি মুষ্টিমেয় দালালছাড়া পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিলাে। প্রায় একবছর আগে বঙ্গবন্ধু যে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান তােলেন, সেই বাংলার জয়ের জন্যেই ২৫ মারচ রাত থেকে পূর্ব বাংলার আপামর সকল মানুষ প্রাণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। রক্তের মূল্যে একদিন তারা যে স্বাধীনতা লাভ করবেন তা সত্যিকার ভাবে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং বিচূর্ণ শশানের ওপর তারা যে নতুন দেশ নির্মাণ করবেন সেখানেই সম্ভবত যথার্থ বঙ্গ সংস্কৃতি লালিত ও বিকশিত হতে পারবে।

৪ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!