You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.21 | সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্র বিরােধিতা -  হাসান মুরশিদ - সংগ্রামের নোটবুক

সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্র বিরােধিতা

—  হাসান মুরশিদ

সাম্রাজ্য ও সম্পদের লােভে আরব ইরান থেকে যে মুসলমানরা এদেশে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে দেশীয় দীক্ষিত মুসলমানদের একটা মৌল পার্থক্য, এমন কি, বর্তমান শতাব্দীতেও দুর্লক্ষ্য নয়। মােগল পাঠানদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের সাদৃশ্য বরং যথেষ্ট । উভয় গােষ্ঠীই এ দেশের এসে শাসনের নামে শােষণ ও স্বৈরাচারে মত্ত হয়েছেন। এঁরা কখনও একাত্ম হননি এ দেশীয়দের সঙ্গে। উপরন্তু স্বদেশীয় ভাষা-সংস্কৃতি খানাপিনার প্রতি আত্যন্তিক আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন। আর দেশীয় যে-সব নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধরা বর্ণহিন্দুদের অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে অথবা সরকারি দয়া বা আর্থিক সুযােগ সুবিধার প্রলােভনে ইসলাম কিংবা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যেও একটি মিল সহজেই—এঁদের প্রথম পুরুষের প্রতি মােগল পাঠান অথবা ইংরেজরা হয়তাে আধেক আঁখির কোণে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ দয়া বর্ষণ করেছেন, কিন্তু * পরিণামে তারা মিশে গেলেন অগণিত দেশীয়দের ভিড়ে। নতুন নামের আড়ালে আনুগত্য দেখিয়েছেন পুরােনাে ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতি। এছাড়া একদল ছিলেন, যাদের বলা যেতে পারে দোআঁসলা- দোআঁসলা মুসলমান ও দোআঁসলা খ্রিষ্টান (অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান)। এঁরা স্বদেশে চিরদিনেই পরদেশী ছিলেন- আপনাদের মােগল পাঠান ইংরেজ বলে ভাবতে পেরেছেন, না পেরেছেন দেশীয় বলে নিজেদের চিহ্নিত করতে।

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে যারা আদৌ কোনাে নেতৃত্ব দান করেছিলেন, তাঁরা এই দোআঁসলা শ্রেণীর। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা একথা তারা কখনােই স্বীকার করেননি, কেননা এঁদের কাছে তখনকার বাঙালী দীক্ষিত মুসলমানরা অন্ত্যজ বলে গণ্য হতেন। একারণে, নবাব আবদুল লতিফের মতাে বাঙালীও ভাণ করতেন উর্দুভাষীরূপে। কেননা, অবাঙালী হওয়াই ছিলাে তখনকার আভিজাত্যের পয়লা শর্ত। অতএব নবাব লতিফ অথবা সেয়দ আমীর আলী ইংরাজী চর্চার অপরিহার্যতার কথা বুঝতে পারলেও, বাঙলাকে আদৌ বাঙালী মুসলমানদের মাতৃভাষা কিংবা শিক্ষার ভাষা হিসেবে স্বীকার করেন নি। এই উচ্চবিত্ত তথাকথিত কুলীন মুসলমানদের সঙ্গে পল্লীর বিপুল সংখ্যক কৃষকশ্রমিক মুসলমানদের ধ্যানধারণার আদৌ কোনাে মিল ছিলাে না। ইংরাজী শিক্ষা লাভ করে দেশীয়দের ভেতর থেকে মধ্যবিত্ত মুসলমানদের একটি শ্রেণী গঠিত হতে অনেক সময় লেগেছিলাে। প্রকৃতপক্ষে, ব্যাপকভাবে এ শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে স্বাধীনতা লাভের পরেই। এই মধ্যবিত্তের মাতৃভাষা বাংলা। দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর নির্ভর করে দেশবিভাগের যে আন্দোলন পরিচালিত হয়, তার নায়ক ছিলেন কুলীন নবাবরা- উর্দুকে যারা মাতৃভাষা বলে গণ্য করতেন। এঁদের পক্ষে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কল্পনা করা স্বাভাবিক ছিলাে। তদুপরি পাকিস্তানের কিম্ভুত ভৌগলিক অবস্থান এবং ভাষা-সংস্কৃতির। সর্বাত্মক বৈসাদৃশ্য একটি সংহত রাষ্ট্র গঠনের প্রতিকূল, মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর চেলারা সে সত্যকে ভালােভাবেই জানতেন। এইজন্যে, প্রথম থেকেই তারা ভাষা ও সংস্কৃতিকে একটি ছাঁচে ফেলে গড়ে তুলতে। চেয়েছিলেন এবং ভৌগােলিক দূরত্ব জয় করতে চেয়েছিলেন জনগণকে সর্বদা ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে। | বাংলা ও বাঙালীর প্রতি শাসকবর্গের মনােভাব মুখােশমুক্ত হয়ে প্রকাশ পায় দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (বর্তমান স্বাধীনতা সংগ্রামে দখলকারি পাক সৈন্য দ্বারা নৃশংসভাবে নিহত) পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে প্রস্তাব করেন দুই-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানীদের মাতৃভাষা বাংলাকে পরিষদের পরিচালনকার্যে মর্যাদা দেওয়া হউক। উজিরে আজম’ লিয়াকত আলী গায়ের জোরে এই ন্যায়সঙ্গত দাবিকে কেবল অগ্রাহ্য করেননি, সেই সঙ্গে দেশের প্রতি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কতখানি আনুগত্য আছে সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। ১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। কিন্তু সে আন্দোলন একান্তভাবে সীমাবদ্ধ ছিলাে ঢাকায় কিছু সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে। (বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ ছাত্রনেতা এবং ডক্টর মােহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর কাজী মােতাহার হােসেন, আবুল কাশেম প্রমুখ শিক্ষক সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।) তাই, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা একাধিক স্থানে প্রহৃত হয়েছিলেন। কুলীনদের প্রচার অনুসারে তখনকার ঢাকায় অকুলিন অর্ধশিক্ষিত মুসলমানরাও মনে করতেন, বাংলা ভাষার দাবিতে যারা 

সােচ্চার এবং বিক্ষুব্ধ, তারা প্রকৃত পক্ষে ভারতের দালাল (কথাটি পাকিস্তানের একাধিক মন্ত্রী কর্তৃক উচ্চারিত) এবং বাংলাভাষা একান্ত ভাবেই হিন্দুদের ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাগুলি এ আন্দোলন সমর্থন করায় তাকেও সাংস্কৃতিক দালালরা প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায়। বস্তুত, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ছিলাে সংখ্যালঘুদের আন্দোলন।

ভাষা আন্দোলন তথাপি সে আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় দুটি মুখ্য লাভ হয়েছিলাে। প্রথমত, আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ধীরে ধীরে বৃহত্তর সমাজের মনােযােগ আকর্ষণ করে এবং এর যৌক্তিকতা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়। দ্বিতীয়ত, জাতীয় পরিষদের কাছে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ না জানালেও, প্রাদেশিক সরকারের কাজকর্মের জন্যে বাংলাকে আংশিক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিতে নাজিমুদ্দিন সরকার বাধ্য হয়েছিলেন। | বাংলাভাষার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের মনােভাব স্পষ্ট হয় মহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরের সময় (মারচ ১৯৪৮)। জিন্নাহ সাহেব অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক ছিলেন, ছাত্রদের সঙ্গে আলােচনা থেকে সে কথা সুস্পষ্ট হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দেখা করতে চান, কিন্তু জগন্নাথ হলের হিন্দু দুই প্রতিনিধি থাকায় তাদের সঙ্গে আলােচনা করতে অস্বীকার করেন। অতঃপর মুসলিম ছাত্রদের বিবদমান দুটি দলের মধ্যে মিলন ঘটানাের উদ্দেশ্যে বলেন, সম্মিলিত ভাবে হিন্দু ও হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে। শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তান টিকে থাকতে পারবে না। জিন্নাহ সাহেব রেসকোর্সের ময়দানে ঘােষণা করেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তখন তিনি পাকিস্তানের অবিসংবাদিত ‘জাতির পিতা।’ অতএব তাঁহার সুবােধ পাত্ররা তার এ অন্যায় আবদার শুনেও পিতার প্রতিবাদ করেননি। এর চারদিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে পিতৃদেব পুনরায় ঘােষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা । তখন কতিপয় বেয়ারাপুত্র একযােগে না, না, বলে চিৎকার করে ওঠেন। দ্বিতীয়বার তাই তিনি আমার মতে উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত’ বলে আপন বক্তব্য পেশ করেন। | রাষ্ট্রনীতিক হিসেবে জিন্নাহ সাহেব যথেষ্ট ধুরন্ধর ও ধূর্ত ছিলেন। তিনি জানতেন উর্দু ও বাংলা দুটি ভাষা রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহিত হলে পাকিস্তানের উভয়াংশের দুর্বল যােগসূত্র আরও দুর্বল হবে এবং পরিশেষে। বিচ্ছিন্নতাই হবে একমাত্র পরিণাম। হয়েছেও তাই। এতগুলাে লােকের মাতৃভাষার ন্যায্য দাবি কেড়ে নিলে তার প্রতিক্রিয়া যে অবশ্যম্ভাবী, এটা অবশ্য একদশদর্শী জিন্নাহ সাহেব ভেবে দেখেননি। ১৯৪৮ সালে বাংলা 

ভাষার ওপর সরকারি বাঁধন শক্ত হলাে বলেই, ১৯৫২ সালে সে বাঁধন টুটলাে।

মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি মানুষের যে অকৃত্রিম দরদ ও সেন্টিমেন্টাল মূল্যবােধ থাকে, তা আহত হলাে বলেই, জনগণের প্রতিরােধ এবং বাংলাপ্রীতি সহসা বৃদ্ধি পেলাে। শাসকচক্র মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে আনতে চাইলেন বলেই, মাকে নিবিড় করে আঁকড়ে ধরেন পাঁচ কোটি বাঙালি সন্তান। সহজাত দরদ আরােপিত সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে দীর্ঘদিন আবদ্ধ রাখা যায় না, তা এক সময়ে প্রকাশ পাবেই। এই কারণে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন হলাে তা আর কতিপয় শিক্ষক ছাত্রদের ভেতর গণ্ডিবদ্ধ হয়ে থাকেনি। আপামর জনসাধারণ তার শরিক হয়েছেন। এই হচ্ছে স্বল্পতমকালে পূর্ববাংলার ব্যাপকতম চিত্তজাগরণের স্বাক্ষর । যে ভাষাকে একদিন শিক্ষিত মুসলমানরা দেখেছেন আত্যন্তিক অনীহার সঙ্গে, তার জন্যে বুকের রক্ত দিলেন নবজাগ্রত যুবকরা। বাংলা হলাে তাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। তারপর যতদিন অতিবাহিত হয়েছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি সকল মানুষের ভালােবাসা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। সে ভালােবাসা যেমন আন্তরিক, তেমিন স্বতঃস্ফুর্ত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বােধহয় কেবল ভাষার প্রশ্নে ১০টি ছাড়া বাকি সবগুলি আসনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় ঘটে, যদিও কেন্দ্রের মুসলিম লীগের চক্রান্তে, যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতালাভে ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা না এলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে বাঙালীরা একটি অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ধীরে ধীরে রূপ দিতে থাকেন। এই সংস্কৃতি একান্তভাবে পূর্ববঙ্গীয়, পড়ে-পাওয়া নয়, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে একে।

পরিণতিতে এই সংস্কৃতিই জনগণের মনে বাঙালী জাতীয়তাবােধের জন্ম দিয়েছে। বাঙালী বলে আত্মপরিচয় দিতে এবং বাংলার জয় ঘােষণা করতে পূর্ব বাংলা উদ্বুদ্ধ হয়েছে এ পথেই। কেবল যদি  অর্থনৈতিক শােষণ ও রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করতেন বাঙালিরা, তা হলে সে আন্দোলন বােধহয় পাক বাংলার স্বশাসন অথবা স্বাধীনতার জন্যে পরিচালিত হতাে। কিন্তু সােনার বাংলাকে এবং ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারির ফসল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ভালােবাসতে পেরেছেন বলেই, স্বাধীন বাংলা দেশ গঠনের সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র পূর্ব বাংলার সকল মানুষ। ভাষা আন্দোলন, ভাষা সংস্কৃতিকে মধ্যবিত্তের ড্রইংরুম থেকে কৃষকের পর্ণকুটিরে নিয়ে গেছে। অগণ্য সাধারণ মানুষ, এই জন্যে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ঢাকার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহে’ যােগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের মহাকবি স্মরণােৎসবের’ দর্শকরা ছিলেন অধিকাংশই অ-কবি। ‘সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ আজ পূর্ববাংলার কৃষক শ্রমিক সকলের প্রিয়সম্পদ।

২১ এপ্রিল ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা