পূর্ববাংলা, মুজিবর, আমরা — সুনীল চট্টোপাধ্যায়
সম্প্রতি পূর্ব-বাংলায় পুরানাে একটি বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি এর আগে আমরা অনেকেই, হয় সখ করে, না হয় বাধ্য হয়ে পড়েছি। তবুও কাচের শাে-কেস এ চকচকে একটা বই দেখলে কার না লােভ হয়। একটা নতুন, না-পুরানাে, সে কথা সাময়িকভাবে মনে থাকেনা। তবে পাতা ওলটাতে, গন্ধ শুকতে ইচ্ছে করে। এ বইটিও তাই আমাদের যথারীতি প্রলুব্ধ করেছে। বইটির বিষয়বস্তু মহৎ। মুক্তি সংগাম। দৈনন্দিন ব্যাবহারের মধ্য দিয়ে অনেকগুলি শব্দের বিশেষ অনুবঙ্গ আমাদের মনে দানা বেঁধে থাকে। যেমন সুন্দরী’ শব্দটি। ওটি আমাদের মনে রমণীকে আনে, লতাকে আনেনা। ‘মুক্তি’ কথাটিও আমাদের মনে রাজনৈতিক অধীনতা থেকে মুক্তি এবং মুক্তি সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রামের আভাস বহন করে আনে। কিন্তু মুক্তি’ শব্দটির যদি মুক্ত হবার অধিকার না থাকে, তাহলে, এই বাক্-সর্বস্বতার যুগেও সে অধিকার আর কে দাবি করতে পারে? মুক্তি বলতে তাই রাজনৈতিক অধীনতা থেকে মুক্তির পাশাপাশি, অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তিও বােঝায়। যতদিন যাচ্ছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চির মত, মুক্তি শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ, প্রথম অর্থটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে যেমন রাজতন্ত্র, অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক অধীনতা পৃথিবী থেকে সদাচারের মত দ্রুত অপমৃত হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে তাই এই শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ শুধুমাত্র প্রথম হবে; তাই নয়, হয়ত একমাত্র হবে। বইটির বিষয়বস্তুকে তাই এই অর্থে নিতে হবে। নাহলে পূর্ব বাংলার প্রতি আমাদের যতই সহানুভূতিই থাকুক, সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিলনা, একথা বােধহয় বলা যাবেনা। কেননা সাতচল্লিশের আগসটের সেই তারিখটি মধ্যে রাত্রে, নিবাত নিষ্কম্প মুহূর্তে যেমন স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র, তেমনি পাকিস্তানেরও জন্ম হয়েছিল। উভয় রাষ্ট্রেরই গলা থেকে পরাধীনতার শিকল সেই প্রাচীন নাবিকের গলা থেকে মৃত পাখিটির মত এক সঙ্গে খসে পড়েছিল। পাকিস্তানের একাংশে পূর্ব বাংলার সেই শিকল এতদিন কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে বা ছিল, এমন মনে করা বােধহয় ঠিক হবে না। এরকম করলে একদিকে যেমন অধীনতার শিকলকে হাল্কা করা হয়, অন্যদিকে তেমনি পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং মানসিক তেজবীর্যকে সম্মান করা হয় না।
তাই বলা উচিত, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু অধিকারের সাম্য ছিলনা। এই সাম্যের অভাব, স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ, সঙ্কুচিত করে, হত্যা করে না। কিন্তু অর্থনৈতিক শােষণ ও অবিচার, ক্ষয় রােগ যেমন ফুসফুসকে, রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে কুরে কুরে খায়। এর পরেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি বা এবং যতটুকু থাকে, তাকে চেনা যায় না।
পূর্ব বাংলায় যাচ্ছিল না। কেননা একই স্বাধীন রাষ্ট্রের বৃহৎ অংশের উপর ক্ষুদ্র অংশের এই শােষণের নজির ইতিহাসে বড় বেশী পাওয়া যায় না। এ একান্তভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের নিজস্ব ঘরানা। | তাই একে চিনতে হলে তার আগে একটি মারাত্মক সত্যের মুখােমুখি হতে হয়। এটা এই যে, সাম্রাজ্যউপনিবেশ না থাকলেও, মাথা-না-থাকলেও-মাথাব্যথার মত, সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ যাবে। ভীষণ ঝড়ে ঘরের দেওয়াল ধূলিসাৎ হলেও দরজায় খিল দেওয়ার পুরানাে অভ্যাস সহজে যায় না। | তা যদি যেত, তাহলে গত দেড়শাে বছরের এশিয়া-আফরিকার ইতিহাস অন্য রকম হত। পূর্ব বাংলায় পুরানাে বইয়ের নতুন সংস্করণটি গরম কেকের মত এমন বিকোত না।
বিকোচ্ছে, তার কারণ সেখানে বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এই বাজারে যারা ক্রেতা, গত তেইশ বছরে, তারা গােকুলে বেড়েছে। তারা মধ্যবিত্ত । উপনিবেশিক শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই ইতিহাসে যাত্রীর কাজ করে, তবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পূর্ব বাংলারও ট্যাঙ্ক, বােমারু বিমান আজ যতই গর্জন করুক, আগামীকাল এরাই এগিয়ে যাবে। ইংরেজি-ফরাসী, ডাচ-পর্তুগীজরা যা পারেনি, পশ্চিম পাকিস্তানীরা তা পারবে না।
কিন্তু বিদেশী শাসন শেষ হলেও যেমন বিদেশী শােষণের শেষ হয়না। তেমনি বিদেশী শােষকের মৃত্যু হলেও, শােষণ কই মাছের প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকে। সেই শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধ চলছে। ভবিষ্যতে ও বঙ্গেও শুরু হবে। আজকের সংগ্রামে পাকিস্তানের একদা প্রাণ পুরুষ কায়েদ-ই-আজমের যেমন কোন স্থান নেই, সেদিনের সেই সংগ্রামে হয়ত মুজিবর রহমান ও তাঁর সহচরদের কোন স্থান থাকবে না।
কিন্তু সেজন্য মুজিবর রহমান যদি ইতিহাস-সচেতন হন, তাঁর মনে কোন খেদ থাকবে না। তিনি জানেন যে সময়ের নির্দিষ্ট বৃত্তে নেতৃত্বের পরিমাপ করা হয়। সেই সীমাবদ্ধ পরিমাপে মুজিবর রহমানের শির আজ সবার উপরে । আজকের কোরাসে তার কণ্ঠ সবার উর্ধ্বে। আজকের এই সত্য, আগামীকাল মিথ্যা হয়ে যাবে না। | ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে মুজিবর রহমান যা করেছেন, গত তেইশ বছর দুই বাংলার অপর কোন নেতা তা করেননি, করতে পারেননি। মুজিবর দুই বাংলাকে কাছাকাছি, পাশাপাশি এনেছেন, এ বাংলার ইতিহাসের লক্ষ্য ও পথের সঙ্গে তিনি ও বাংলার ইতিহাসের লক্ষ্য ও পথের মিল ঘটিয়েছেন। দুইয়ের মধ্যে মৌলিক ব্যবধান, একটি প্রবল ফুৎকারে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। তার কল্যাণে দুই বাংলার মানুষ আজ একই ট্রেনের যাত্রী হতে পেরেছে। সময়ের দিক আমরা সামান্য এগিয়ে আছি এই যা। বলতে পারি একই ট্রেনে আমরা এনজিনের কাছাকাছি কামরায় আছি। তার চেয়েও সুখের কথা অপ্রত্যাশিত এই বাঁকে ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা ওদের দিকে।
২ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা