You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.17 | সত্তর দশকে। মুক্ত বাংলার মুক্ত রাজধানী ঢাকা - সংগ্রামের নোটবুক

সত্তর দশকে। মুক্ত বাংলার মুক্ত রাজধানী ঢাকা।

মাহবুব তালুকদার ঢাকার স্মৃতি ঢেকে রাখা যায় না। সময় বা স্থানের দূরত্বে তার প্রতিচ্ছবি চোখের পাতায় উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। যত দূরেই যাই, কোন স্মৃতিময় অবসরে পরমাত্মীয়ের মত ঢাকাও যেন মনের কোণ ছুঁয়ে যায়। আলগােছে  মমতা বুলিয়ে যায় মনের শিরায় শিরায়। এই ঢাকাকে প্রথম চিনেছিলাম উনিশ শ আটচল্লিশের শেষের দিকে। শৈশবের আয়নায় মুখ রেখে সে দিনটিকে আজও মনে পড়ে। তেইশ বছর আগের সেই ঢাকা আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কতটুকুই বা পরিধি ছিল তার। কিন্তু তখনও এর গরব ঠিকরে পড়ত রাজধানী বলে। মােগল আমল থেকেই সে ‘প্রাচ্যের রহস্য নগরী।’ দেশ বিভাগের পর আবার সে গরবিনী রূপ নিল ভবিষ্যতের নব রূপায়ণের প্রতীক্ষায়। সদরঘাট থেকে কাকরাইল আর স্বামীবাগ থেকে আজিমপুর, এইটুকু ঢাকাই একদা বাংলাদেশের গ্রামীণমানুষের কাছে বিস্ময়ের বিষয় ছিল। শহরের মানুষ আবদ্ধ হয়েছিল তার প্রাত্যহিক আত্মীয়তায়। রাজধানীর রাজপথ ছিল তখন ইসলামপুর আর নবাবপুর । বাদবাকী রাস্তাগুলি মফস্বলের অপরিসর রাস্তার মত। অধিবাসী বােধকরি তখন দুলাখের বেশি নয়। বিকেলে প্রায়ই ফুটবলের প্রতিযােগিতায় ডি এম এ গ্রাউনডের মরশুমে উজ্জীবিত হত। এদিকে ব্রিটেনিয়া হলে ছায়াছবির দর্শকের ভিড় জমে উঠত। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতে নির্জনতা নেমে আসতাে রমনার রাস্তায়। ধানমনডির ওদিকে পতিত জমি ও ঝােপঝাড় জঙ্গলে সচরাচর মানুষ যেতে সাহস করতাে। না।

কিন্তু আজকের ঢাকার অন্যরূপ। শহর ছড়িয়ে পড়েছে মাইলের পর মাইল । নারায়ণগঞ্জ থেকে টংগী পর্যন্ত। এখন বৃহত্তর ঢাকা। ঘনবসতিতে সে আজ কল্লোলিনী হয়ে উঠেছে। মতিঝিলের ঘন অরণ্যের একটি দুটি গাছও বুঝি আজ অবশিষ্ট নেই। ওখানে গড়ে উঠেছে কর্মব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা। কে বলবে একদিন। বাঘ ডাকত এই জঙ্গলে? ইংরেজ সাহেবদের অধুনা অবলুপ্ত লালকুঠির সামনে আসতে ভয় পেত দেশী মানুষেরা। কমলাপুরের গােরস্তানের উপর এখন সরকারী কর্মচারিদের বাসস্থান। লাটের বাড়ি নবাব বাড়ির মাঝখান দিয়ে লাল খােয়ার রাস্তা আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। শেষ ইংরেজ গভর্ণর লরড ফ্রেডারিক বােরন। ঘােড়ার খুরে রাঙ্গা ধুলাে উড়িয়ে প্রাতভ্রমণে বেরােতেন ওই রাস্তা দিয়ে। মতিঝিলের দিকে যেতে দুই বড়। বাড়ির মাঝখানে পড়ত বিরাট একটা বটগাছ। কে জানে কত বয়স ছিল তার। রাশি রাশি ঝুরি নেমেছিল। গাছটার গা বেয়ে। যুগ যুগ ধরে ওই গাছটি ঢাকা শহরের অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ছিল। কিন্তু সে আজ। নেই। নতুন শহরের ইতিহাসের সাক্ষী আজ হাইকোরটের পাশের বটগাছটি। ওরও বয়সের মাপজোক নেই । ওরই পাশ দিয়ে স্বল্পপরিসর পুরানাে পথটি চলে গিয়েছিল রমনা মাঠের দিকে। প্রবীণরা বলেন ঢাকা শহরের। প্রথম মােটরগাড়ি নাকি এনেছিলেন নবাব সাহেবেরা। কালাে রংএর ওই গাড়িটি যখন ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ছুটে যেত, ওই বটগাছের তলে ভিড় জমিয়ে কলের গাড়ি দেখতে ছুটে আসত ঢাকার শহরবাসী। এখন সেই বটগাছের নীচে প্রতি বৃহস্পতিবার নিকটস্থ দরগার মেলা বসে। উঠল নিউমার্কেট, বায়তুল মােকাররম। নতুন স্টেডিয়ামকে ঘিরেও আজ বিপণি সমারােহে। ঢাকায় আদিবাসীদের অতি প্রিয় ঘােড়ার গাড়ির দিন শেষ হয়ে এসেছে। দেশ বিদেশের ভিড়ে ঢাকার আদি বাসিন্দারা যেন ভিনদেশী। অথচ একদিন তারা ভাবত ঢাকা। তাদের শহর, একমাত্র তাদেরই।

সেদিন ঢাকার মানুষের কাছে প্রবাদ ছিল, সদরঘাটের মীরজুমলার কামানকে কেউ নড়াতে পারবে না বুড়ি গঙ্গা নদীর তীর থেকে। এই তাে তাকেও ফিরিয়ে আনা হল শহরের মাঝখানে। সময়ে সবই হয়। সবই সয়। | পুরানাে ঢাকার কাঠামােতে নতুন ঢাকা গড়ে উঠলেও, রূপে প্রসাধনে এখনকার ঢাকা আগের চেয়ে অনেক আলাদা। দশ লক্ষ বাঙালী অবাঙালীর বসতিপূর্ণ শহরটি ততটা কসমােপলিটান না হলেও ছিমছাম ও আধুনিক । ধনমনডি ও গুলশানের বিস্তৃত এলাকায় এখন অভিজাত আবাস গড়ে উঠেছে। আরও আবাস তৈরি হচ্ছে ‘বনানী’ ও ‘বারিধারা’। তেজগাঁয়ের দ্বিতীয় রাজধানী আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শনে এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ লাভ করেছে। তেইশ বছর আগে মহিলাদের বাইরে মুখ দেখালেই যেমন বিপদ ও দুর্নামের আশঙ্কা থাকত। আজ তার তা নয়। সেদিনের মত শাড়ি ঢাকা রিক্সা হয়তাে এখন চোখেই পড়বে না। স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা সহজ ভাবে যাতায়াত করছে, বােরখা বা পরদা ছাড়াই। দুপুরে রমনা পার্কে নিভৃতি সবুজে কিছু কিছু নারী পুরুষের জোড়া দৃষ্টিগােচর হবে; কয়েকবছর আগে যা দূর্ণিরীক্ষ ছিল। শাহবাগে পঞ্চতারকামানের হােটেল ইন্টারকনটিনেন্টাল আছে, যাতে রীতিমত ক্যাবারে নাচ হয়। এককথায় কেবল  চেহারায় নয়, জীবনযাত্রার প্রণালীতে ঢাকা গায়ে এখন পাশ্চাত্তের ছোঁয়া পুরােপুরি লেগেছে । কালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। ভাষা আন্দোলনের উদ্গাতা বােধ করি বাইরের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নয়, মূলতঃ ছাত্র সমাজই বাংলাভাষার রাষ্ট্রীক মর্যাদা দানে এগিয়ে গিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী অন্যান্যরা যােগ দিয়েছেন পরে। ঢাকার এই ছাত্র সমাজের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটি জিনিস। একটি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বতন কলাভবনের আমতলা এবং অন্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্তোরাঁ ওরফে মধুদার দোকান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের ওই ঐতিহাসিক আমতলায় বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতন ঘটেছে। অনেকবার রাজনীতির দাবার চাল চালিত হয়েছে এখান থেকে। আমতলার বক্তৃতা থেকে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে পদার্পণ করেছেন অনেক ছাত্রনেতা। উনিশ শ চৌষট্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনটি সরিয়ে নেওয়া হয় নীলক্ষেতের নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে। তার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহাসিক আমতলাটির গুরুত্ব হারালেও ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে রইল। নতুন স্থানে গিয়ে অবশ্য আবার নতুন আমতলার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের আন্দোলনের সঙ্গে মধুদার ক্যানটিনের নাম বিশেষভাবে জড়িত। এখানেও হত ছাত্রদের সভা। তরুণ বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনটি খুলেছিলেন মধুদা। এখন তার ছেলেই তরুণ। অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ এই মধুদা। কত ছাত্র বাকী করে খেয়ে যেতে বছরের পর বছর মধুদার দোকানে। তারপর পরীক্ষায় বৈতরণী পার হয়ে চাকরী করে বেতন থেকে টাকা শােধ করে দিতাে তাকে। কেউ আবার দিতও। তাতে তার এসে যেতাে না কিছু। মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ক্ষেত্রের উচ্চ কর্মচারী পর্যন্ত নাম লিখিয়েছেন মধুদার ধারের খাতায়। অনেক বড় বড় কর্মকর্তা অতীত ছাত্র জীবনের কথা মনে করে হােমরা চোমরা হয়েও মধুদার দোকানে গিয়ে দেখা করতেন। নাম ও পরিচয় মনে রাখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল মধুদা তার স্ত্রী। পঁচিশে মারচের পর মধুদা কোথায় আছেন, আছেন কিনা, কে বলতে পারে?  ঢাকার জনজীবনের সঙ্গে সে পূণ্যেস্থানটি ওতপ্রােতভাবে জড়িত তা হচ্ছে শহীদ মিনার। ভাষা। আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে- মেডিকেল কলেজের এককোণে বড় রাস্তার ওপর এটি স্থাপিত হয়। এই মিনারের মূল নীল-নকশাটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল, কিন্তু তা পূর্ণতা পায়নি। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, নারী-পুরুষ নগ্নপদে এর প্রাঙ্গণে এসে জামায়েত হয়ে স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগের শপথ 

নেয়। ফুলে ফুলে সমগ্র শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববােধে মানুষের মনপ্রাণ অনুরণিত হয়। বিগত পচিশে মারচ শহীদ মিনারটি পাকিস্তানের হানাদার দস্যুরা গােলার আঘাতে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘকাল পরে আপনি যদি ঢাকায় আসেন তবে দেখতে পাবেন ফুলবাড়ীর সেই পুরানাে রেলস্টেশন এখন আর নেই । কমলাপুরের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এখন নতুন রেল স্টেশন। এত বৃহৎ এবং সুন্দর রেল স্টেশনটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বলে দাবীদার। যদিও এটি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। সব থেকে পরিবর্তন হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে নতুন ঢাকার ব্যাপ্তিতে। এককালের গভীর অরণ্যে এখন গড়ে উঠেছে গুলশান অভিজাত এলাকা। এইসব জায়গায় গিয়ে পূর্ব পরিচিত এলাকাকে চেনা দায়। পুরানাে ঢাকার ঠাটারী বাজার, তাঁতীবাজার, বনগ্রাম, নবাবপুর, শাখারিপটিই ছিল অতীতের স্মৃতি বহন করে। পঁচিশে মারচে হানাদার দস্যুরা পুরানাে। ঢাকায় অনেক স্থান একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। আদ্যিকালের ঢাকার বহু পরিবর্তন ঘটেছে, আজ। রূপ স্বভাবে ও জীবনযাত্রায়। ঢাকার ঘরে ঘরে এখন টেলিভিশন। পুরানাে পল্টনের মাঠে এখন বড় জনসভা হয় না, যেতে হয় রমনা রেসকোরসের বৃহৎ ময়দানে। সবকিছু পালটে গেলেও শহর সংলগ্ন চিরকালের বুড়িগঙ্গা বয়ে চলেছে তেমনি নিরবধি। আদি ঢাকার প্রতিচ্ছবি আজও পড়ে তার জলে।

১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা