ত্রিশ দশকে মুক্ত বাংলার মুক্ত রাজধানী ঢাকা— জগদ্বন্ধু ভট্টাচার্য
দূর থেকে দেখেছি ঢাকা শহর, সময়ের পথ ধরে প্রায় চল্লিশ বছর পেছনে চলে গেলে যেমন দেখা যাবে শহরটিকে। যারা এ যুগের ছেলে তারা যদি পেছনে হাঁটতে পারেন, তবে চলে আসুন, ঘুরে বেড়ান আমার সঙ্গে। চল্লিশ বছর আগে ৩০-৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ করিডরে একটু দাঁড়ালেই আপনি হিন্দু মুসলমান ছাত্রদের আলাদা করে চিনতে পারবেন। কমন রূমে ঢুকলেই দুটি সমাজ বা আরও পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হলে, দুটি সংস্কৃতি আপনার চোখে পড়বে। মুসলমান ছেলেদের চিনতে আপনার আদৌ কষ্ট হবে না । ফেজ টুপি মাথায় ঢিলা পাঞ্জাবী ও পায়জামা পায়ে চটি-চটি জুতাের শব্দ এমন শব্দ করে চলবে যাতে বুঝিয়ে দেওয়া হবে এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের, এটা মক্কা ইউনিভারসিটি- স্যাডলার কমিশন মুসলিম সংস্কৃতি বাঁচাবার জন্যইত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওঁরা হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গ বর্জন করে চলবেন। তাদের চোখে হিন্দু ছাত্র মানেই “বিপ্লবী”, নিদেন পক্ষে স্বরাজী। কোন জাতীয় বিক্ষোভের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হরতাল, ধর্মঘট প্রভৃতি ডাকা হলে তারা সেদিন অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। কেন না, ওটা ডেকেছেন হিন্দু ছাত্ররা এবং সেই জন্যই অবশ্য বর্জনীয়। মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা শতকরা ২৫ জনও নয় তবু তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব শিক্ষা নিকেতন বলে ভাবতেন।
তারা অন্য সব বিষয়ে অনারস পড়তে আগ্রহী কিন্তু বাংলা ভাষায় অনারস কিছুতেই নয়, অনারসে ‘সংস্কৃত প্রধান বাংলা ভাষায় এমন সবকিছু পড়ানাে হয়, যা ঐসলামিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, বা পৌত্তলিকতাকে প্রশ্রয় দেয়। উর্দু বা ফারসীতে অনারস পড়তেই তারা ভিড় করেন, কেন না, ওটা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে চমক্কার মিলে যায়। তবুও চারুবাবু, মােহিতবাবু, ডঃ সুশীল দে-প্রমুখ বাংলা অধ্যাপকদের প্রতি তাদের অসীম শ্রদ্ধা। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধার ব্যাপারে তারা আদি যুগের গ্রাম পাঠশালার ছাত্রদের মতােই । লবীতে যে কোন প্রফেসারের সঙ্গে মুখােমুখি হলেই, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা পাশ কাটিয়ে চলে যায়, সেখানেই মুসলিম ছাত্ররা নির্ঘাত সালাম-আলায়কুম’ বলে শ্রদ্ধা জানাবেন। তা ছাড়া ওঁরা প্রকসি দেন না; ক্লাসে কোন গােলমাল বা হৈ-হুল্লোড় করেন না। সব ক’খানা পড়ার বই ও তৎসহ-খাতাপত্র নিয়ে ঘন্টা বাজতেই ক্লাসে হাজির। বাংলা ভাষায় ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লাকে ওরা দুচোখে দেখতে পারতেন না। কেননা ওই কুঁজো বুড়ােটি রবীন্দ্র সাহিত্য পড়াতে পড়াতে কোনও কোন সময় ভগবদগীতার শ্লোক আওড়াতেন,
ভক্তিযােগের কোন স্থানে এসে হয়ত হিন্দু ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করে বসতেন ‘এই তােমরা পড়েছ কি?’ | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে সেদিন জ্যোতিষ্কের সমাবেশ। চারু বন্দোপাধ্যায়, মােহিতলাল মজুমদার, ডঃ সুশীল দে, সত্যেন বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘােষ, ডঃ কৃষ্ণা, ডঃ খাস্তগীর, ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লা, উঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ হরিদাস ভট্টাচার্য, ডঃ ফুস, ডঃ এইচ এল দে, ডঃ পৃথ্বীশ চক্রবর্তী এবং আরও কত নামকরা অধ্যাপক। এ নিয়ে মুসলমাত্র ছাত্রদেরও গর্বের অন্ত ছিলাে না।- ওই একটি মাত্র ক্ষেত্রেই হিন্দু, মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে এক স্বীকৃতি, অন্যথায় তারা দুই সমাজ, দুই চিন্তা। | এখন যেটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভবন, দেশ বিভাগের আগে সেটিই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবন। এককালে এটি সেকরেটারিয়েট বিলডিং নামেও পরিচিত ছিল বিজ্ঞান শাখার জন্য ছিল কারজন হল এবং তার সন্নিহিত আরাে কয়েকটি বাড়ি।
১৯৩৩ সাল, হয়তাে মারচ বা এপরিল মাস। ‘ঢাকা হল’-এ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের পুনর্মিলন উৎসব ডাকা হল। মুসলিম ছাত্ররাও আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে উপস্থিত। সংগীত নৃত্য এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান তারা উপভােগ করলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদার অভিনয় শুরু হতেই তারা একে একে অনুষ্ঠান বর্জন করে চলে গেলেন। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই অভিনয়ের ব্যবস্থা করে মুসলিম সংস্কৃতিকে ঘায়েল করা হচ্ছে এবং এটা তারা কিছুতেই সহ্য করবেন না। পরের দিন অন্য একটি কাজে গেলাম হক-এর কাছে। মুসলিম।
হলের বাসিন্দা হক বিজ্ঞান শাখায় আমার বন্ধু ও সহপাঠী। এই হল সম্পূর্ণভাবে মুসলিম ছাত্রদের জন্য বিশেষভাবে মুসলিম ছাত্রদের ঐসলামিক আদব-কায়দা শেখাবার জন্য এবং হিন্দু সংস্কৃতির অনিষ্টকর প্রভাব থেকে মুসলমানদের বাঁচাবার জন্য তৎকালে দশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল। | ঢুকে পড়লাম হকের ঘরে। অবাক হয়ে দেখলাম, খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে সেই চিত্রাঙ্গদার’ অভিনয় করছে। নিজেই অর্জুন হয়ে কথা বলছে, চিত্রাঙ্গদা হয়ে জবাব দিচ্ছে। আত্মপ্রতারণায় অপরাধী হক আমাকে দেখে লজ্জায় মুখ লুকাল। ঐসলামিক সংস্কৃতির দূর্গে সেদিন যা দেখে এসেছিলাম, সত্যি বলতে কি, তার তাৎপর্য আমি সেদিন বুঝতে পারিনি।
প্রায় দুই দশক পরে আর একদিন গিয়েছিলাম হকের ঢাকার বাড়িতে। সে তখন পাকিস্তান প্ল্যানিং বােরডের প্রথম সারির উপরের অফিসার। প্রথম একটু ভয়ের ভাব এসেছিল বৈকি কিন্তু সে ভয় আমার ঢাকা বা পূর্বের বাংলা ভ্রমণের প্রায় সব সময় মনে আঠার মতাে লেগেছিল। অবশ্য আমার পকেটে রয়েছে ভারতীয় পাসপােরট- পরিষ্কার লেখা আছে যে এই ভারতীয় নাগরিককে যেন কোন অসুবিধায় না ফেলা হয়, বিপদে পড়লে তাকে যেন সাহায্য করা হয় । These are to request and require in the Name of President of the Republic of Indian all those whom it may concern to allow the berarer to pass freely wishout let or hindrance and to afford him or het every assistance and protections of which he or she may stand in need.
সােজা হকের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়লাম । কিন্তু সে অনুপস্থিত। কয়েকমিনিট আগেই বেরিয়ে পড়েছে। খােলা দরজা দিয়ে পাশের ঘরে দেখলাম একটি ছেলেকে, সে এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চাইলাে। কৃতার্থ হল সে, বাবার বন্ধু এসেছে দেখা করতে এবং এসেছে হিন্দুস্থান থেকে। কিন্তু চম্কে গেলাম আমি। অতবড় অফিসারের পড়ার ঘরের দেওয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। নুরুল আমিনের রক্ত চাই।’ ঐ শ্লোগানটি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হবে, কিন্তু সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না ভেবে নিজেকে সংযত করলাম। বললাম ? ভেবেছিলাম তােমার বাবাকে নিয়ে শহর দেখতে বের হব; – কিন্তু হল না। -তারজন্য কী, আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, চলুন কোন দিকে যাবেন? ইনটার কনটিনেন্টাল হােটেল, মেডিকেল কলেজ, হাইকোরট? -না ওসব কিছু নয়। পুরােনাে শহর দেখবাে আমি, খােলা নর্দমা বস্তি, ছ্যাকরা গাড়ি। আর যাব ইউনিভারসিটির দিকে।
বন্ধুর কিশােরপুত্র আমার গাইড। ইসলামপুর রােড ধরে সােজা মিটফোরড হসপিট্যাল । অনেক নতুন বাড়িঘর, অনেক অট্টালিকা আকাশ চুম্বী-তবুও চিনে নিতে কষ্ট হল না। মিটফোরডের গেটে পৌছুতেই বললাম, দেখছাে, ওই ফটক দেখছ, ওখানে বিনয় বােস হ্যাডসন ও লােম্যান নামে দুই সাহেবকে গুলি করেছিল। বিস্মিত দৃষ্টিতে, সে আমার দিকে তাকাল এবং আরও কিছু শুনতে চাইল। এনিয়ে আর আলােচনা নিরাপদ নয় ভেবে নিজেকে সংযত করলাম। ইসলামপুর থেকে নবাবপুর রােড। হয়ে মদন মােহন বসাক রােড ধরে সােজা উয়ারি। আক্রাম বলল ঃ এটা বড় লােকের পাড়া। বড় বড় অফিসাররা থাকেন এখানে। আপনার জানাশুনা কেউ আছে এখানে? ঢাকায় এখন পরিচিত বলতে আছে তােমার বাবা এবং তুমি। দেখাে, দেখাে, র্যানকীন স্ট্রীটের ঐ বাড়িটিতে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কামাখ্যা সেনকে হত্যা করা হয়েছিল। | গাড়ি ঘুরল, বলদার বাড়ি ও বাগানের পাশে আসতেই সে বললঃ ওই বাগানটিতে অনেক কিছু আছে জানেন, অনেক গাছ নাকি এশিয়ার কোথাও জন্মায় না। উয়ারির সব কয়টা রাস্তা ও গলি ঘুরে বেড়ালাম। বললাম ঃ এককালে উয়ারি ছিল সব রকম নতুন ফ্যাসানের ঘাটি। কলকাতার বালিগঞ্জ, ঢাকার উয়ারি।
আভিজাত, রুচি এ দুটো জায়গা থেকেই নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ত। উয়ারি ঘুরে একেবারে পলটনের মাঠ ও এখন এখানে খেলাধুলা হয়? নিশ্চয়ই। দেশ বিদেশের টিমের খেলাতাে এই মাঠেই। – আমাদের আমলে কোন বিদেশী টিমকে তাে এখানে দেখিনি। আমরা যে কত হতভাগ্য ছিলাম সেটা কল্পনা করে আক্রাম আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাল। পলটনের মাঠে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। বাম পাশে মেডিকেল কলেজ, ডান পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবন। আর এক দূরে জগন্নাথ হল ও পাশের রােকেয়া হল। মেডিকেল কলেজের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। শহীদ স্তম্ভ- ভাষা শহীদের স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত শ্বেতস্তম্ভ। আক্রাম বলল ঃ এটি তাে আগে দেখিনি?
বাম পাশে বেশ খানিকটা দূরে ঢাকেশ্বরী মন্দির, চারিপাশে উঁচু বাড়ী উঠে মন্দিরটাকে ঢেকে ফেলেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে রেসকোরসের পাশ দিয়ে চরছি,- রেসকোরসের সবুজ সমুদ্রের মধ্যে রমনার কালীবাড়ি। আক্রাম বলল ঃ ওই পথে আর একটু এগােলেই তাে ইনটার কনটিনেনটাল হােটেল। যাবেন সেখানে? | প্রয়ােজন নেই তার চাইতে চল চল কারজনহলের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখা আজও সেখানে রয়েছে। প্রধান ফটকটি আজও বন্ধ । মনে পড়ল একদা ত্রিশ সালের আইন অমান্য আন্দোলন। আন্দোলন কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অজিত ভট্টাচার্য পুলিশের লাঠি পেটা হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং ওখানেই ভাইস চ্যানসেলার ল্যাংলী সাহেব বাঁশ হাতে নিয়ে ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপারকে পালটা তাড়া করেছিলেন। মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিনানুমতিতে পুলিশের প্রবেশ এবং ল্যাংলীর আচরণ সম্পর্কে সেদিন ব্রিটিশ পারলামেন্টে ঝড় উঠেছিল। মৃত ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন ল্যাংলী সাহেবের কান্না অনেকেই দেখেছিলেন। | ওই কারজন হল। ওর দোতালায় বসে আমরা সত্যেন বােসের কৃষ্ণানের লেকচার এ্যাটেনড করেছি। শিক্ষক ডঃ খাস্তগীরের সঙ্গে আমরা আডডা জমিয়েছি। আজ আমি এই শহরের কেউ নই, এই দেশেরও কেউ নই। ক্লাশ ফাকি দিয়ে গালিচার মত নরম ওই ঘাসের আঙিনায় কতদিন রােদে বসে কটিয়েছি। -আজ কি পারিনা সবাইকে ফাকি দিয়ে ওই জায়গাটুকুতে একটু সময় কাটিয়ে যেতে। না, সেটা সম্ভব নয়। অসম্ভব, আমি বিদেশী। | কিন্তু ফটকের কাছে ওই বৃদ্ধ শিরীষ গাছটি? আজও বৃদ্ধ জীর্ণ, মৃত্যুর অপেক্ষা। মনে আছে কারজন। হলের বিহারী দারােয়ান প্রতিদিন ওর গােড়ায় জল দিতে আসত। পরম পরিচর্যার মধ্যে একটু একটু বড় হয়েছিল।
আক্রামকে বললাম ঃ ওই গাছটি সেদিন শিশু ছিল, একেবারে লিকলিকে চেহারা। আক্রাম সাহস করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলঃ আচ্ছা ওই কবিতাটি কি আপনার মনে আছে, “যেদিন ধরণী ছিল ব্যথাহীন বাণীহীন মরু। ‘আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতা! বাবাকে দেখেছি একদিন গােপনে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করতে। কিন্তু ছেলের কণ্ঠে কোন গােপনীয়তা নেই। তা মুখর, বাধাহীন। প্রাক-মধ্যাহ্নের সূর্যলােকে এখান থেকেও শহীদ বেদী দেখা যাচ্ছে। স্বাধীনতা ও মুক্তির আলােয় একটু যেন বেশী উজ্জ্বল।
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা