You dont have javascript enabled! Please enable it! বুড়িগঙ্গার পাড়ে যে বাজনা এবার বাজছে না- আবদুল গাফফার চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক

বুড়িগঙ্গার পাড়ে যে বাজনা এবার বাজছে না– আবদুল গাফফার চৌধুরী

গত বছর ঠিক এই সময় ঢাকা শহরের সূত্রাপুর পাড়ার সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির কাছ থেকে এটা আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম। ছােট কার্ড। মাথার উপরে লেখা ছিল- ‘শ্রী শ্রী দুর্গা শরণম্।’ গতানুগতিক আমন্ত্রণ ভেবে কারডটা ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আকৃষ্ট হলাম তার বক্তব্য দেখে। চিঠিটা এখন আমার কাছে নেই। যতটা মনে করতে পারছি, তার বক্তব্য ছিল এই ধরনের-“মা আসছেন। বাংলাদেশে এবার মা আসছেন নতুন ভাবে ও নতুন বেশে। উনসতুরে মা অসুর বিনাশ করেছেন। সরে তাই শক্তিস্বরূপিণী আসছেন সাক্ষাৎ মূর্তিতে। আসুন আমরা দশভুজার বন্দনা করি, মায়ের শক্তিকে আত্মশক্তির উপলব্ধিতে সকলে জাগ্রত ও মিলিত হই’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

স্পষ্টতঃই চিঠিটার ভাষায় ছিল এক বছর আগের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এই রাজনৈতিক পরিবর্তন ধারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নিজেদের পুনর্বাসনের আশায় উৎসাহিত হয়েছেন, চিঠিটার বক্তব্যে তারও আভাস ছিল স্পষ্ট। উনসত্তুরে মা অসুর সংহার করেছেন এই কথাটার রাজনৈতিক তাৎপর্য উপলব্ধি করার মত। উনসতুর সালের গণআন্দোলনেই পাকিস্তানে আয়ুবের নেতৃত্বাধীন জঙ্গীশাহীর পতন ঘটে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে মােটামুটিভাবে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে থাকে। এতে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মত সংখ্যালঘু হিন্দুরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। বলতে গেলে সংখ্যালঘু হিন্দুরা একটু বেশি স্বস্তিই পেয়েছিলেন। কারণ, রাওয়ালপিণ্ডির আইয়ুব-সরকার বাংলাদেশের হিন্দুদের কাছে প্রকৃতই ছিলেন অসুরস্বরূপ। পাকিস্তানের লৌহ মানব’ আইয়ুব দেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রভাব ও গরিষ্ঠতা খর্ব করার জন্য সংখ্যালঘু-পীড়ন ও বিতাড়নের এক চতুর কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। ফলে বাংলাদেশ ক্রমে হিন্দুশূন্য হচ্ছিল। সামাজিক জীবনে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার দরুণ সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মও প্রায় লােপ পেতে বসেছিল। ১৯৬৪ সালে ঢাকা শহরে সরকারী পৃষ্ঠপােষকতার যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাের চেষ্টা হয়, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দাঙ্গা বিরােধী আন্দোলনের ফলে তা ব্যর্থ হয় বটে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের সামাজিক জীবনে তাতে নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তা আরাে বেড়ে যায়। ১৯৬৫ সালের সেপটেম্বর যুদ্ধের পরের বছর ঢাকা শহরে প্রধান হিন্দু পল্লীগুলােতেও আশ্বিন মাসে। পূজোর বাদ্য বাজেনি। এই অবস্থায় আইয়ুব সরকার অত্যন্ত ব্রিত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিশ্চিন্তমনে ও নিরাপদে নিজেদের ধর্মকর্ম পালন করতে পারছে না, বিদেশে এই খবর ছড়িয়ে যাবে এই ভয়ে ১৯৬৭ সালে ঢাকা এবং আরাে কয়েকটি বড় শহরে সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু মুখচেনা লােককে পয়সাকড়ি দিয়ে সর্বজনীন দুর্গোৎসবের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাতে প্রতিমা তৈরী হয়েছিল এবং বিসর্জনের বাদ্যও বেজেছিল । কিন্তু পূজোর মণ্ডপে লােকসমাগম হয়নি। ঢাকা শহরের প্রধান কটি পূজামণ্ডপ ঘুরে আমার মনে হয়েছিল, গােটা ব্যবস্থাটিই পূর্ব নির্ধারিত, সাজানাে, প্রাণহীন অভিনয়। আইয়ুব আমলে বাংলাদেশের শারােদ্যোৎসবে কোন বারই প্রতিমায় প্রাণসঞ্চার হয়নি।

এই প্রতিমার প্রাণ ফিরে পেল উনসত্তর সালে । আয়ুবের জঙ্গীশাহীর পতনের পর। গতবছর সূত্রাপুর পাড়ার সর্বজনীন দুর্গোৎসবের উদ্যোক্তরা তাই মিথ্যে লেখেননি- এবার শক্তিস্বরূপিণী আসছেন সাক্ষাৎ মূর্তিতে। সেবার কিন্তু সরকার পূজোর পয়সা দেননি। তবু ঢাকার শারদ আকাশ বিজলির আলােয় ছেয়ে গেছে। মণ্ডপের প্রতিমা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সারারাত সারাদিন বাজনা বেজেছে। ঘরের ছাদে লাউড স্পীকার বসিয়ে পাল্লাদিয়ে রেকরড বাজানাে হয়েছে। হিন্দী বা উরদু ছবির গান নয়। বাংলাগান। বুড়িগঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন দেখতে গিয়ে দেখি সে এক এলাহি কাণ্ড ।এক রাতেই প্রতিমা এসেছিল শ’য়ের উপর । বাজনা, আলাে ও চিকার মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, ঢাকা আবার ফিরে তার চব্বিশ বছর আগের জীবনে।

সবচেয়ে মজার কথা, বিসর্জনের দিন প্রতিমা বহনকারীদের মধ্যে একটা উল্লেখযােগ্য অংশ দেখেছি মুসলমান ছেলে। সমবয়সী হিন্দু ছেলেদের চাইতে তাদের উৎসাহ কম নয়। পাড়ার চেনা একটি ছেলেকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, তুমি এসেছাে কেন? ছেলেটি চটপট জবাব দিল, দেখুন, ওসব মধ্যযুগীয় প্রেজুডিস ছাড়ুন। এটা শুধু পূজো নয়, সর্বজনীন উৎসব। বাঙালীর ঋতু উৎসব। স্বদেশের উৎসবে যােগ দেব, তাতে আবার ধর্মের বাধা কোথায়? 

ঢাকা শহরে গত বছরের দুর্গোৎসব এখন আমার কাছে বহু যুগ আগের এক ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মত মনে হয়। সবশেষে একটি মজার গল্প না বললে এই স্বপ্ন-কাহিনীর অনেকটাই না বলা থেকে যাবে। ঢাকার কুমারটুলির পালেরা পুরুষানুক্রমে প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। গত বছরও বুড়াে পাল এক ডজন প্রতিমার অরডার পেয়েছিলেন। কিন্তু গােল বাধালাে তার ভাইপাে ছােট পাল। কাকাকে বলল, কাকা, তুমি এবার রিটায়ার করাে, আমি প্রতিমা বানাই।’ কাকা রাজি হলেন না; দুজনে মিলে পাল্লা দিয়ে প্রতিমা বানালেন। রঙের কাজ শেষ। কাকা ভাইপাের কাজ দেখে ছিঃ ছিঃ করে উঠলেন, “ছিঃ ছিঃ, জগজ্জননীকে অমন ছুকরি । সাজিয়েছিস কেনাে? আর কার্তিকতাে মনে হয় সিনেমার হিরাে। ভাইপাে বলল, তােমার চোখ খারাপ তাই অমন কথা বলছাে। আমার দুর্গা এযুগের জননী। তােমার প্রতিমা ত্রেতাযুগের বুড়ি। ওটা এ যুগে অচল।’ বুড়াে পাল সালিশ মানলেন আর এক প্রৌঢ় প্রতিবেশীকে। তিনি বললেন, ‘দুর্গার শরীরে এত সেক্স এপিল থাকা ভালাে নয়। ছােট পালের প্রতিমা দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত রূপসী নারী।’- ছােট পালকে যখন সেক্স এপিলের বাংলা মানে বলা হল,তখন সে চটে লাল বলল, তােমাদের পাপমন তাই ওসব কথা বলছে। আমি মায়ের মূর্তিতে প্রাণ দিয়েছি। তােমরা সেই মা-কে চাওনা। খুড়কুটো আর মাটির মূর্তি চাও। তােমরাই বলছাে দুর্গা শক্তিস্বরূপিণী। শক্তিস্বরূপিণী কখনাে বুড়ি হতে পারেন? তিনি চিরকালের যৌবনবতী। তার বয়স বাড়ে , কমেও না। প্রতিবেশীরা যাই বলুক, প্রতিমার অরডার যারা দিয়েছিলেন তাঁরা কিন্তু পছন্দ করেছিলেন ছােট পালের প্রতিমা। গত বছর ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় পূজোর মণ্ডপে ঘুরেছি। সঙ্গে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। দেখেছি নতুন যুগের নতুন শিল্পকর্ম। জয়নুল-আবেদীন আমার কানে কানে বলছেন, এটা নতুন শিল্প কর্ম নয়। বাঙালীর মানস প্রতিমা ধীরে ধীরে দেবীমূর্তি ছেড়ে মানবীতে রূপান্তরিত হচ্ছেন। বাঙালীর কামনা-বাসনা সৌন্দর্যানুভূতির নিজস্ব ছাপ দেখবে এবারের প্রতিমাগুলােতে। বিদেশী প্রভাব কিছুটা এসেছে, তা গৌণ। বাঙালীর দুর্গা আবার পিত্রালয়ে এসে কেমন রক্তমাংসের বাঙালিনী হয়েছেন দ্যাখাে।’ | উনসতুরে অসুরের সংহার শেষ হয়নি। একাত্তুরে সেই সত্যটিই বড় বেশি দাম দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানকে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুকে। গত বছর বিসর্জনের দিনটিতে কেউ কল্পনা করতে পারনি, আগামী বছর এই বাজনা হয়ত এমনভাবে আর নাও বাজতে পারে।

২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা