আনন্দময়ীর আগমনে …. কল্যাণী ক্যামপে– আবদুল গাফফার চৌধুরী।
কল্যাণীর দুনম্বর শরণার্থী ক্যামপের মাথার উপরে তখন ভাদ্রের শাদাটে মেঘে রােদ চমকাচ্ছে। শরতের শিউলি ফোটা ভাের নয়। দুরন্ত তালপাকানাে দুপুর। ক্যামপের একপাশেই একটি নালা। কর্দমাক্ত জল। কজন শরণার্থী মহিলা সেই কাদাজলেই কাপড় কাচছেন। কাছেই একটি ন-দশ বছরের ছেলে বসে তাল তাল ।
কাদামাটি ঘাটছে। শীর্ণ চোহারা। সারা শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন। একটু এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, “কি করছাে খােকা?’ ছেলেটা কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর বলল, ‘পত্তিমে বানাই।’ পত্তিমে মানে প্রতিমা। দুর্গাপ্রতিমা। কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এসময় আনন্দময়ীর আগমনে বাংলার শারদ আকাশ, গানে আর সুরে মুখর থাকার কথা। কল্যাণীতে কিন্তু সেই কল্যাণময়ীর আগমনের কোন আভাস নেই। এক শরণার্থী প্রৌঢ়া মহিলা নালার জলে কাপড় কাচছিলেন। ছেলেটার কথা শুনে মুখিয়ে। উঠলেন, “হুঃ পত্তিমে বানাই। ব্যাটা পেটপুরে খেতে পাসনা। ওদিকে পত্তিমে বানাই।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘দ্যাখেছেন ছেলেটার শরীরের হাল। এই ক্যামপের সবছেলে ওইরকম ভুগছে। রােজই মরছে দু’একটা। তবু পত্তিমে বানাবার শখ গেল না। আবার বলে কিনা, পূজোর কাপড় চাই । বেমক্কা বায়না।” | মহিলার খেদোক্তির জবাব দিলাম না। এ-তাে ছেলেটিকে তিরস্কার করা নয়। নিজেকেই নিজে তিরস্কার করা। ছেলেটিকে বললাম, তােমার নাম কি?’ সে কাদার তাল রেখে উঠে দাঁড়ালাে। বলল, লালটু। তারপরই অকস্মাৎ আমাকে বিমূঢ় করে দিয়ে বলল, “পূজোর জামা দিবা?’ মহিলাটি বললেন, ‘আপনাকেও এখানকার কেস্ট্রবিষ্টুগােছের কেউ মনে করছে! অতটুকু ছেলে হলে কি হয়? এখন সব বােঝে। অবস্থাই ওকে সব শিখিয়েছে। বললাম, “ওর মত ছেলে এই ক্যামপে কতজন আছে?’ মহিলা বললেন, ‘তা শ’পাঁচেক হবে। ধরুণগে এই ক্যামপের বাসিন্দা হল আট হাজারের মত। ক্যামপের।
বাইরেও কেউ কেউ থাকেন। তাদের ছেলে মেয়ে ধরা হলে সব মিলে হাজারের বেশি হবে। তবে যেভাবে। মারা যাচ্ছে, তাতে মাস না ঘুরতেই এই সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়াবে ভগবান জানেন।’ বললাম,“শিশুরা কি রােগে মারা যাচ্ছে?’ মহিলা বললেন, ‘তা জানিনা বাবা, ডাক্তাররা বলছেন অপুষ্টি। দেখতে দেখতে শুকিয়ে হাড়কাঠি হয়ে যায়। তারপরই শরীরে জল জমে। জল জমলে আর বাঁচোয়া নেই। ওই যে দেখেছেন লালটুকে। ওর নাম লালটু কুমার সাহা। কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে বাড়ি। পাকিস্তানী সৈন্যের গুলিতে ওর এক ভাই মারা গেছে। এক ভাই আর বাপ সঙ্গে এসেছে। এই ক্যামপে এসেও দেখেছি অতটুকু ছেলে আধমণ। ওজনের কাঠখড়ির বােঝা মাথায় নিয়ে টানতে পারে। এখন দু’সেরও পারে না। দ্যাখছেন শরীরের অবস্থা।
লালটু তখন পূজোর জামার আশা ছেড়ে প্রতিমা তৈরিতে মন দিয়েছে। মহিলাকে বললাম, ‘আপনি বাংলাদেশের কোন জেলা থেকে এসেছেন? যশাের জেলা থেকে। বাড়ি মাগুরায়। আমার স্বামী ছিলেন নামকরা কবিরাজ। এখনাে সিকদার বাড়ি বললে মাগুড়ার একডাকে সকলেই আমাদের বাড়ি চেনে। আমার নাম অমিয়ারানী সিকদার।’ বললাম, ‘সকলকে নিয়ে আসতে পেরেছেন তাে?’ মহিলা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বললেন, না বাবা তিন মেয়ে, দুই ছেলে নিয়ে কোনরকমে প্রাণ নিয়ে এসেছি। বড় জামাই রয়েছে হরিণঘাটায়। মেজ জামাই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ডাকতারি পড়তাে। আজ ছ’মাসে তার খোজ নেই। আমার কচি মেয়েটা মাথার সিদুর মুছে ফেলেছে। আর এরই মধ্যে একটি বাচ্চা হয়েছে। এই বাচ্চাটাও বাঁচবে না।’ মহিলা কিছুক্ষণ নীরবে কাদলেন। চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন, কামারখালি আমার বাপের বাড়ি। বাপের সম্পত্তি পেয়েছিলাম পঞ্চাশ বিঘার মত জমি। স্বামী যদ্দিন বেঁচেছিলেন, ততদিন বাড়িতে পালাপার্বণ লেগেই ছিল। উনি মারা যাবার পরও কালীপূজা, দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজায় কম করে হলেও দু-তিন হাজার টাকা খরচ করেছি। ছেলে মেয়েকে, গরিব পাড়াপড়শিকে কাপড়-জামা দিয়েছি। এখন আমাকে দেখে বুঝতে পারবে না, আমরা কি ছিলাম।
মহিলা মিথ্যা বলেননি। এখন একমাত্র শরণার্থী ছাড়া এদের আর কোন জাত বা পরিচয় নেই। আগে সম্ভবত ছিল ডেয়ারি ফারম। গরু থাকার ঘর পরিষ্কার করে এখন হয়েছে শরণার্থী শিবির। পঞ্চাশ জনের স্থান নেই যে ঘরে তাতে মাথা গুঁজেছে পাঁচশাে । কি করবেন একা ভারত সরকার? বন্যার ঢলের মত রােজ আসছে শরণার্থী। তার উপর তিন-চারটি রাজ্যে এবার হয়েছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বন্যা। আরেকটু এগিয়ে গেলাম কানে ভেসে এল মৃদু গুঞ্জনের মত শব্দ, একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারি বেদ ….। একদল উলঙ্গ ও আধা উলঙ্গ ছেলে দাড়িয়ে, নামতা মুখস্থ করছে। সেই লালটুকুমার সাহার। মত অধিকাংশের স্বাস্থ্য। মাথার উপর চড়া রােদ। পায়ের নীচে জল কাদা। আমাকে দেখে একজন আধবুড়াে লােক এগিয়ে এলেন। নাম বললেন, বৃন্দাবনচন্দ্র বিশ্বাস । ফরিদপুরে গণপত্যা গ্রামের প্রাইমারী ইস্কুলে তিরিশ বছর শিক্ষকতা করেছেন। এখন নিজেও শরণার্থী ক্যামপে ছােট ছেলেমেয়েদের রােজ দু ঘণ্টা করে। রােদেজলে দাঁড় করিয়ে জ্ঞানদান করেন। বললাম, ইসকুল করার জন্য একটা চালাঘরও পাননি মাসটার।
তা দখল করে নিয়েছে। কথা বলতে বলতে খেয়াল করিনি, নিজের অজান্তেই কখন ঘেরাও হয়ে গিয়েছি। এক দঙ্গল ছেলে আমাকে ঘিরে শাের তুলেছে, “পূজার জামা চাই বাবু, পূজার জামা।” বৃন্দাবন বিশ্বাস স্লান মুখে হাসলেন, ‘ওরা আপনাকে সরকারী লােক মনে করেছে।’ নিজের অক্ষমতায় আমার নিজের উপরই রাগ হচ্ছিল। ভাবলাম, কেন এসেছি এখানে মরতে? এতগুলাে শিশুর মনে মিথ্যা প্রত্যাশা জাগিয়ে লাভ কি? এই ছােট ছােট অপাপ বিদ্ধ শিশু। এরা রাজনীতি বােঝে না। রাজনীতির ত্রিসীমানায় নেই এরা। তবু এই বিশ শতকে এরা শিকার হয়েছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ধর্মান্ধ রাজনীতির ।
মাস্টার মশায়কে বললাম, এবার তাহলে কল্যাণীর শরণার্থী শিবিরে পূজোর কোন ব্যবস্থাই হয়নি?’ বৃন্দাবন বিশ্বাস বললেন, একেবারে হয়নি তানয় । কল্যাণীতে ক্যামপ তাে একটা নয়, সাতটা। লােক সংখ্যা দু’লাখের উপরে। প্রত্যেক ক্যামপে শরণার্থীরা নিজেরাই পূজার ব্যবস্থা করেছেন। বছরের এই একটা মাস। নাই হল পূজোর কাপড়-জামা। মেঠাই-মণ্ডা। তবুতাে মা আসবেন আমাদের ঘরে। দেশছাড়া হয়েছি বলে কি মাকেও ছাড়বাে? বুঝলাম শ্রীমতী অমিয়ারাণী সিকদারের মত বৃন্দাবন বিশ্বাসের গলাও ভিজে উঠেছে।
সেই চালাহীন খােলা আকাশের স্কুল ছেড়ে সামনে এগিয়েছি দেখি, জনা চার শরণার্থী যুবক মহা উৎসাহে বাঁশ কাটছে। জিগগেস করলাম এখানে কি হচ্ছে? মায়ের মণ্ডপ বাঁধছি, জবাব এল। মায়ের মণ্ডপ? মা কোথায় জিগ্যেস করলাম। একজন যুবক বলল, কাঁচরাপাড়ায় প্রতিমা তৈরির বায়না দেওয়া হয়ে গেছে। বললাম, প্রতিমা তৈরির জন্য টাকা খরচ করতে গেলেন কেন? আপনাদের মধ্যে প্রতিমা বানাতে জানেন, এমন শরণার্থী নেই? ওই যুবক আরেকজনকে দেখিয়ে দিল ‘ওই তাে হরেন্দ্রনাথ ঘােষ, ফরিদপুর জেলার পাংশা। থানায় লক্ষ্মীকোল গ্রামে বাড়ি। প্রতিমা বানানাে পৈত্রিক পেশা।’ হরেন্দ্রনাথ ঘােষের বয়স ত্রিশের মত। শক্তসমর্থ চেহারা। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, ভাই বােন মিলিয়ে দশজন নিয়ে এই শরণার্থী শিবিরে আছেন। অন্য যুবকের কথায় চটে উঠে বললেন, ‘প্রতিমা বানাব? রঙ কই, তুলি কই, মাটি কই। ছাঁচ কই, প্রতিমা বানানাে মুখের কথা নাকি?’ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ঠিক কথা। সবই তাে রেখে এসেছেন বাংলাদেশে। এখানে প্রতিমা তৈরি করবেন কি করে? হরেন্দ্রনাথ ঘােষ বললেন, আমার কি প্রতিমা তৈরিতে অসাধ? তিন জেলার লােক আসতাে আমার কাছে প্রতিমা তৈরির অরডার দিতে। এক-এক পূজায় পাঁচ-সাতটা প্রতিমা তৈরি করেছি। আয় করেছি তিন হাজার, চার হাজার টাকা। সারা বছর তাতেই সংসার চলেছে। এখনতাে আমার ভিখিরিরও অধম। গেলবার পূজোতে বউকে পঞ্চাশ টাকার জোড়া শাড়ি দিয়েছি। এবার বউ কাপড়ের অভাবে আমার একটা সাদা ধুতি পরছে। সধবা মেয়েমানুষ, তাও চোখে চেয়ে দেখছি। | প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য বললাম, এই যে মণ্ডপ তৈরির বাঁশ চালা এনেছেন, কাঁচরাপাড়ার প্রতিমা অরডার দিয়েছেন, টাকা পেলেন কোথায়?
হরেন্দ্রনাথ ঘােষ বললেন, সব আমাদের এই রক্ত জল করা টাকা। আগে আমরা মাথাপিছু দৈনিক চাল পেতাম চারশাে গ্রাম। এখন তিনশাে গ্রাম। সেই রেশনের চাল থেকে সবাই মিলে বাঁচিয়ে চাল বিক্রির টাকায় এই পূজোর ব্যবস্থা হয়েছে। | কল্যাণী থেকে যখন বিদায় নিলাম তখন মাথার উপরে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সেই চালাহীন ইসকুল, ছুটি হয়েছে। সেই শীর্ণ অপুষ্ট শিশুর দল কলরব জুড়েছে মণ্ডপ বাঁধার স্থানে। এবারের পূজোয় জ্যাম নেই, কাপড় নেই, পিঠে পুলি নেই, তবু এই শিশুদের হুললােড়েরও শেষ নেই। হয়তাে বিসর্জনের দিন পর্যন্ত এরা কেউ কেউ বেঁচে থাকবে না। তবু কল্যাণী শরণার্থী শিবিরে মা আসছেন। আসছেন আনন্দময়ীর রূপ ধারে।
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা