You dont have javascript enabled! Please enable it! আমরা কেমন লােক- শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় - সংগ্রামের নোটবুক

আমরা কেমন লােক— শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

ইংরাজি নববর্ষে স্কুলে ছুটি পেতাম। অফিসে বাবাও পেতেন। ক্যালেন্ডারে লাল কালিতে লেখা থাকত ওয়ান। টাকায় তখন রাজার মুণ্ডু। সারা বাড়ী খুঁজলেও বাংলা ক্যালেণ্ডারের দেখা পাওয়া কঠিন ছিল। বাংলা বছর ফুরােচ্ছে, জানতাম চৈত্র সংক্রান্তির মেলার তােড়জোড় দেখে। পিচ রাস্তার দু’ধারে পাঁপর ভাজার দোকান বসে যেত- ট্রেন বােঝাই দিয়ে তরমুজ আসত। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেই সরকার একটা পুরনাে সালকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। এখনাে কাগজপত্রে তা থাকে। জানতে চাইলে বলতে পারব না। এ অবস্থা বােধহয় সবারই । আসলে ব্যাপারটা কারাে মনে দাগ কাটেনি।

ধুতি ধরেই মালকোছা দিয়ে পরতে শিখলাম। পৌরুষের প্রথম কেশর তখন সবে দু’গালে উকি দিতে শুরু করেছে। লক্ষ্য করে দেখলাম, বৈশাখ- তরুণ সূর্য ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান রয়েছে। ফি বছর ভােরে নর্থ ক্যালকাটায় প্রভাতফেরি বেরােয় পয়লা বােশেখে। পার্ক, ময়দানে ঝরা বকুল রােদুরে পুড়ে লালচে হয়ে যায় সন্ধ্যের ভরাবাতাসে দ্বিগুণ গন্ধ ছড়ায় এ সময়। রাধাচূড়াে, কৃষ্ণচুড়াে তাপে তাপে লাল করে ফুল ফুটিয়ে তােলে। কাগজে কাগজে নানান পাখার বিজ্ঞাপন। | পয়লা বৈশাখ ছুটি দিতে শুরু করে সরকার মােলকলা পূর্ণ করে দিলেন। আমরা যারা জুতাে পরি, কাগজ পড়ি, শহর নামধারী, চাকরীর আড়তে ঘােরাফেরা করি- সেই সামান্য কজন লােক কয়েক মাসের মধ্যে দু’রকম বছরের পয়লা দিনে সবেতন ছুটি পেয়ে সকালে বাজার ও দুপুরে ঘুম দিয়ে আহ্লাদ বাড়ালাম; বিশ্রাম নেওয়ার একটা দিন বাড়িয়ে ফেললাম। স্বাধীনতার পর গােড়ায় গােড়ায় এই দুটি হচ্ছে না বলে আমরা কতই

জাতীয় সরকারের অবিচারের কথা তুলেছিলাম। অথচ আজও কজনের বাড়ীর দেওয়ালে বাংলা ক্যালেন্ডার ঝােলে তাতাে আমরা নিজেরাই জানি। বরং দেখি গায়ে গঞ্জে চাষী, কামার, কুমাের, জেলে সবাই জানেন পয়লা বৈশাখ কবে। এই সময় ক্ষেতে কড়াই তােলে, উচ্ছে ওঠায়। যার কাজ নেই- তাকে কাজ খুঁজতে হয়। তারই ফাকে শুভদিনটিতে ভাের ভাের পুকুরে একটা ডুব দিয়ে নেয়। ছেলেমেয়েরা মারধরটা কিছু কম করে। মুদির দোকানে হালখাতা থাকলে ট্র্যাকে একটা টাকা খুঁজে খােকাখুকুর হাতধরে গিয়ে হাজির হয়। আমরা মাস মাইনের মাসকাবারি । শুভদিনগুলাে আমাদের কাছে ছুটির মােড়ক পরে হাজির হয়। অথচ এখনাে শহরের বাইরে এই বিশাল দেশে বাঁশ বাগানের খালে সন্ধ্যেবেলা আঁটকুড়ে বউ এই দিনটিতে বড় আশায় প্রদীপ ভাসায়। চটা ওঠা ঠাকুরতলায় এমন শুভদিনে নারায়ণ পুজোর সময় ঘণ্টা নাড়েন ঠাকুরমশায়হাড়ি ঝুলিয়ে সারা মাসের জন্যে ঠাকুরকে শীতল দেন-ধারা স্নানের ব্যবস্থা হয়।

কচি লাউ কাঁধে চাপিয়ে আট বছরের বিনােদ মাঠ ভেঙে বাড়ীর পথ শটকাট করার সময় সেই ঘণ্টাধ্বনি কানে পৌছতেই ডবলহাফ মেরে রাস্তা কাবার করে ফেলে। বাঁধের রাস্তায় নারকেলের ডেকোয় ছায়া দক্ষিণের বিখ্যাত বাতাসে চাদের আলােয় এমন দাপাদাপি করে, পুকুরের কচুরিপানা একদিকে গিয়ে জমা হয় – বিনােদ, বিনােদের বাবা খানিকক্ষণ স্থির হয়ে পৃথিবী দেখে। বিপিনের মামা বুঝেই পরম ভক্তিতে আঁচলের খুটে তিনকানা বাতাসা বেঁধে ফেলে। সম্প্রতি একজন বাঙালী আমাদের কিছু শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভাষায় বাঁধনে আমাদের বাঙালী করে তুলতে চেয়েছেন। জন্মভূমির নাম রেখেছেন বাংলাদেশ। এবার যদি আমরা বাংলা বছরের বচ্ছরকার দিনটিকে তেমন করে চিনে নিতে পারি তবে ওই বাঙালীর শিক্ষা খানিক সার্থক হবে।

১৫ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা