১৮ ডিসেম্বর ‘৭১
রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন। মনােরম বিশাল ভবনে প্রেসিডেন্টের সুসজ্জিত ডেস্ক। ডেস্কের ওপর রুপাের ফ্রেমে আঁটা তিনটি ঝকমকে ছবি: মাওসেতুং, যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন ও ইরানের শাহের। এঁরা বরাবরই পাকিস্তানের সামরিক একনায়কত্বের সমর্থক ও আশীর্বাদক। শীতার্ত সকাল। ডেস্কে প্রতিদিনের মতাে প্রােগ্রাম সাজানাে। দিনের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে সর্বশেষ মিসট্রেসের জন্যে জকি ক্লাবে প্রেসিডেন্টের ডিনার পার্টি। খােশমেজাজে ফৌজিকর্তা তারই অপেক্ষায়। দিনের অন্যান্য কর্মসূচি বাতিল। এমনকি বেগম আইয়ুব খানের সাথে নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্টও সব কিছুই যেন ঠিকঠাক। কোথাও কিছু হয় নি এমন ভাব। এর মধ্যে আচমকা ভাবান্তর। কর্নেল আগা হারুনের দিকে উৎসুক দৃষ্টি মেলে প্রেসিডেন্ট বললেন : কেমন বােকা ছেলে, কই, ওটা তাে দিলে না। থতমত খেয়ে সেক্রেটারি হারুন বললেন : কোনটার কথা বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার। প্রেসিডেন্ট : কেন, ওয়ার সিচুয়েশন রিপাের্ট! বােবা বিয়ে কর্নেল হারুন প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে। নীরবতা ভঙ্গ করে তারপর মলিন মুখে বললেন : আজ কেবল ওই একটা জিনিসই নেই। দি ওয়ার ইজ ওভার। অর্থাৎ পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধের ঝামেলা চুকে গেছে। হারুনের জড়ানাে কণ্ঠে কম্পিত উচ্চারণ। কথাটা শুনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। তিনি এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে দলবলসহ অধিনায়ক আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি দু’দিন আগে আত্মসমর্পণ করেছেন। টেবিল চাপড়ে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতাে তর্জন গর্জন করে ওঠেন ইয়াহিয়া খান : ‘না হতে পারে না।’ ক্ষোভে দুঃখে তার গণ্ডদেশ বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা। ঠিক এমন সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের টেলিফোন।
নিক্সন গভীর সহানুভূতি জানালেন পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীর সর্বাধিনায়ককে। ইয়াহিয়ার ঠোটের কোণে তৃপ্তির হাসি। নিক্সনের সান্ত্বনা পেয়ে জঙ্গীকর্তা আপাতত চাঙ্গা। আবার টেলিফোন বেজে উঠলাে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী প্রেসিডেন্টকে স্মরণ করিয়ে দিলেন : পরিস্থিতি সুবিধার নয়। ক’দিন জনসমক্ষে বের না হওয়াই ভাল। আপনার জীবন হুমকির মুখে। ইয়াহিয়া শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে জবাব দিলেন : যতসব বাজে কথা; আমার কেশাগ্রও স্পর্শ করবার ক্ষমতা নেই কারাে। আমি পাকিস্তানের সর্বকালের সবচাইতে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। রিসিভার রেখে দিয়ে নিজে বিড় বিড় করতে করতে ইয়াহিয়া বললেন : ওই বােকারা মনে করেছে জনতার রুদ্ররােষ থেকে আমাকে রক্ষা করতে হবে। আমরা যুদ্ধে হেরেছি তাতে কি, এবার শান্তিকে জয় করবাে। আরে হ্যা, কর্নেল আমাকে একটা ফাইল দেখাতে হয় যে, ডেটে (রাজবন্দী) শেখ মুজিবুর রহমানের ফাইলটা বড় দরকার। আমার মনে হয় তাঁকে ফাসি দেয়ার উপযুক্ত সময় এখনই। শেখ মুজিবুর রহমান তখন মিয়ানওয়ালি কারাগারের ক্ষুদ্র কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। তিনি তখনও জানেন না তাঁর স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। মুজিব শুধু জানেন, মৃত্যু দুয়ারে করঘিাত করছে। প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে তাঁর আর বুঝি ফেরা হল না।