মােনেম খানের মৃত্যুর ওপর লিখতে বসলে বেশ কিছুদিন হয় মােনেম খান মার্শাল আয়ুব খানের এককালের দুর্দন্ড-প্রতাপ লাটবাহাদুর একজন তরুণ মুক্তিযােদ্ধার গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠকদের কাছে এ খবর এখন রীতিমতাে বাসি সংবাদ। সম্ভবত ইতিমধ্যেই মােনেম খানের মতাে কলংকিত নাম মানুষের মনের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে । কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। ভাবছি, বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু ধিকৃত নাম মােনেম খানের মৃত্যুর ওপর লিখতে বসলে কি লিখবাে। আয়ুবের যােগ্য সহকারী মােনেম খানের মৃত্যু হলাে এখন না আরাে বেশ কয়েক বছর আগে, আয়ুবশাহীর মৌলিক গণতন্ত্রের রাজত্বে মন্ত্রী ও লাট হলেন যখন ঠিক তখনই? কিংবা ৬৮-৬৯এর গণআন্দোলনে জনতা যখন ক্ষমতার উচ্চাসন থেকে নামিয়ে মােনেম খানের কবর রচনা করেছিলেন তখন? বস্তুত মানুষ মােনেম খানের মৃত্যু হয়েছিল বহু আগেই। শকতি ও ক্ষমতামত্ত অন্ধ মােনেম তা উপলব্ধি করতে পারেননি, উপলব্ধি করতে পারেননি যে তিনি মানুষ মােনেম খানের প্রেতাত্মা মাত্র।
জীবন্ত দুঃস্বপ্ন হতভাগ্য মােনেম খানের এই আত্মােপলব্ধির মতাে প্রতিভা ছিল না। নাহলে অন্তত ৬৮-৬৯-এর গণআন্দোলনে তার পতনের পর এ কথা বুঝতে পারতেন। আয়ুব-মােনেম-ইয়াহিয়া কেউই প্রতিভাবান ব্যক্তি নন, অন্তত হিটলারকে যে অর্থে প্রতিভাবান বলা যায়, সেই বিকৃত প্রতিভাবানও নন তারা তাই আত্মদর্শনের ক্ষমতা তাদের নেই। শুনেছি বৃদ্ধ বিসমার্ক জীবনসায়াহ্নে শহর ছেড়ে গ্রামে বাস করেছিলেন। একদিন ভােরবেলা বিসমার্ক বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে রয়েছেন। সম্মুখে সবুজ বনানী, গাছে গাছে নবপত্রপল্লবের সমরােহ, বসন্ত আসছে। বৃদ্ধ বিসমার্ক চোখ মেলে ভােরের আলাে আর সবুজের সমারােহ দেখছিলেন। দেখতে দেখতে তার দুচোখ বেয়ে জল নেমে এলাে। বিসমার্ক আর্তনাদ করে উঠলেন-হায় আমার জন্য, শুধু আমার জন্য ইউরােপের তিন তিনটা যুদ্ধ হলাে। এতাে অফুরন্ত জীবন আমার এই গ্রামে, এই সবুজ
অরণ্যে, আর আমি হতভাগ্য এমনি করে জীবন থেকে বঞ্চিত হলাম-“আই হ্যাভ লস্ট মাই লাইফ।
জীবনকে বােঝার মতাে যােগ্যতম ও মেধা কোনটাই মােনেম খানের ছিল না। নাহলে নির্বোধ মােনেম | দেখতে পেতেন কতাে আগেই কি নির্মমভাবে তিনি জীবন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন । অনুশােচনায় দুফোটা তপ্ত | চোখের জল না, হৃদয় বলতে যার ছিলাে একটা নিষ্ঠুর ইটপাথরের কারখানা, তার জীবনের ঘটনার জন্যে বিসমার্কের দৃষ্টান্তে টানা নিরর্থক। | ইতিহাসে বহু লােকেরই নিষ্ঠুর হৃদয়হীন বলে পরিচয় আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে মােনেম খান কেবল একটি নাম নয়, একটি জীবন্ত দুস্বপ্ন। তিনি তিনটে যুদ্ধে গােটা একটি মহাদেশে যে ধ্বংস ও বিভীষিকা না ঘটে, মােনেম খান বিনা যুদ্ধেই বাংলাদেশের একটা গােটা জাতির জীবনে তার চেয়েও বড়াে ধ্বংস ও বিভীষিকার কালরাত্রি ডেকে এনেছিলেন। বাংলাদেশের বহু ঘটনার নায়ক, বহু ষড়যন্ত্রের হােতা, বহু রক্তপাতের কলংকিত অধ্যায়ের সংযােজনকারী আয়ুবের বশংবদ অনুচর এই মােনেম খান বাঙালী হয়েও যিনি বাঙ্গালীর সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, বাঙ্গালীর রক্তে কলংকিত করেছেন নিজের হাত, নিজের বংশের ধারাকে বিযুক্ত করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুদের কাছ থেকে পাওয়া ক্ষমতার লােভে, নিজেকে যিনি অনায়াসে বিকিয়ে দিয়েছেন, বাঙ্গালীর ইতিহাসে তার স্থান নির্মিত হয়েছে বহু আগেই, যে স্থানে বাঙলার মীরজাফরদের জন্যে বহুদিন থেকে নির্দিষ্ট। | পারস্য উপন্যাসে কাহিনী আছে চমকপ্রদা এক সুন্দর প্রত্যুষে কোন এক প্রখ্যাত মেষচালক হাতির পিঠে চড়ে রাজপ্রাসাদে উপনীত হয়ে সহসা দেখলাে রাণী তার জন্যে বরমাল্য হাতে অপেক্ষা করছেন, মেষচারক হবেন সম্রাট। পারস্য উপন্যাসে এমনি বহু চাঞ্চল্যকর কাহিনী আছে। কিন্তু পারস্য উপন্যাসের সেই রােমাঞ্চকর কাহিনীর চেয়েও অবিশ্বাস্য রকমের চমকপ্রদ পূর্ববাংলার সাবেক লাটবাহাদুর মােনেম খানের আবির্ভাব।
মােনেম সাহেব প্রকৃতপক্ষে ছিলেন ময়মনসিংহের স্রেফ বটতলার উকিল । শুনেছি বার লাইব্রেরীতে তাঁর বড় একটা জায়গা হতাে না। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করলেন পূর্ববাঙ্গলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জনাব নুরুল | আমীন। কথায় বলে রতনে রতন চেনে। নইলে এমন যােগ্য ব্যক্তিকে জনাব নুরুল আমীন ছাড়া আর কেউবা | রাজনীতিতে টেনে আনতে পারে। নুরুল আমীনের কল্যাণে মুসলিম লীগের আমলে মােনেম খানের রাজনীতিতে হাতে খড়ি। সম্ভবত নিজ জেলার লােক বলেই নুরুল আমীন সাহেব এমন লােককে কদর না
করে পারেননি। আর তারই নেকনজরে পড়ে মােনেম খানসাহেব ময়মনসিংহ ডিষ্ট্রিকট স্কুল বাের্ডের চেয়ারম্যান পদ পর্যন্ত অলংকৃত করেছিলেন। বরাত মন্দ, পাক আর নিন্দুকজনের তাে অভাব নেই, তারাই খামােখা খসাহেবের নামে স্কুল বাের্ডের অর্থ তছরুপের অভিযােগ আনলেন। অগত্যা নুরুল আমীন সাহেবের রাজনৈতিক মানসপুত্র মােনেম খানকে মানে মানে স্কুল বাের্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হলাে।
লাটগিরি কিন্তু বরাত খুলতে আর কতােদিন। ১৯৬২ সালের আয়ুবী শাসন তন্ত্রের জোরে পরােক্ষ নির্বাচনে মােনেম সাহেব জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেন-সদস্য থেকে সােজা চালান হলেন কেন্দ্রের মন্ত্রীসভায় । বলা বাহুল্য জীবনে কখনাে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে জেতার সৌভাগ্য ঘটেনি প্রবল প্রতাপান্বিত লাটবাহাদুর আব্দুল মােনেম খানের। পেছন দরজা দিয়েই তাঁর রাজনীতিতে আগমনার পূর্ব বাঙলায় গভর্ণর হিসেবে জেনারেল আজম খান ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। ফলে আয়ুব খান-সাহেব তাঁকে সরিয়ে গভর্ণর করে পাঠালেন গােলাম ফারুককে। গােলাম ফারুকের সঙ্গে সম্ভবত সে সময় উপর-তলাদের মতের তেমন বনিবনা হচ্ছিল
। তাই ফারুকসাহেব লাটগিরিতে ইস্তাফা দিলে পূর্ব বাঙলায় লাট হয়ে এলেন বাঙালী সন্তান মােনেম খান; বাঙালীদের শােষণ করবার যার যতাে উপযুক্ত বশংবদ আয়ুব খানের মতাে ধুরন্ধরলােকও খুব বেশি জোটাতে পারতেন না। সেই থেকে ১৯৬৮-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত একটানা প্রায় দীর্ঘ ছ বছরের বেশী সময় ধরে পূর্ব বাঙলার তার লাটগিরি।
মূর্তিমান শয়তান কোন একক ব্যক্তি একটি জাতির এতােবড়াে ক্ষতি করতে পারে কি না তা আমার জানা নেই। মােনেম খান
বাঙালী জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, সাংস্কৃতিক সত্তা ও রাজনৈতিক বুনিয়াদ ধ্বংস করবার সকল অপকৌশলই অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর স্বৈরতন্ত্রের প্রভুদের ক্রুর ইচ্ছা চরিতার্থ করার কাজে মােনেম খান একাই ছিলেন একশ। তাঁর লাটগিরির আমলেই প্রেস ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ করার সবরকম অপচেষ্টা চালানাে হয়। কুখ্যাত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স জোরদার করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করার প্রচেষ্টা চলে। দৈনিক আজাদ ও সংবাদের জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়। কোন কোন সংবাদপত্র থেকে বিজ্ঞাপন কেটে মূলত সে সব সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করায়ই চেষ্টা চলতে থাকে। মােনেম খানের লাটগিরির আমলেই দৈনিক ইত্তেফাক প্রায় আড়াই বছরকাল বন্ধ থাকে-বস্তুত এর সবটাই করা হয় পূর্ববাংলা থেকে স্বাধীন মত প্রকাশ ও মুক্ত চিন্তাকে গলা টিপে হত্যা করার জন্যে। বাংলা সংস্কৃতির এতােবড় শত্রু আর কেউ ছিল কিনা বলা শক্ত। | এদিকে মােনেম খান সাহেব নিজে আবার ছিলেন একটি খবরের কাগজের মালিক। সেই খবরের কাগজের নাম দৈনিক পয়গাম। পয়গাম প্রকাশের পেছনে একটু ইতিহাস আছে। করাচীর ক্লিফটন বীচে আইয়ুব সাহেবের রাজনৈতিক দল কনভেনশন মুসলীম লীগের জন্ম। বীচলাকসারীতে কথা উঠলাে কনভেনশন মুসলিম লীগের একখানি বাংলা দৈনিক খবরের কাগজ চাই। স্থির হলাে দৈনিক পয়গাম বেরুবে। আর সে ভার নিলেন স্বয়ং মােনেম খান নিজে। অতএব গৌরী সেনের অর্থে প্রতিষ্ঠিত পয়গাম কাগজের খােদ মালিক হলেন মােনেম খান সাহেব, নিজ পুত্রকে নিয়ােজিত করলেন তদারকীতে।
কি খবর যাচ্ছে? পয়গামে মােনেম খানের খবরদারির অনেক চটকদার গল্প শুনেছি একাধিক বন্ধুজনের মুখে। প্রতি রাত্রেই। টেলিফোন ধরে খাস গভর্ণর হাউস থেকে পয়গামের খোঁজ নিতেন লাটবাহাদুর। আগামীকাল কি কি খবর বেরুবে, কাগজের কয় জায়গায় তার ছবি আছে ইত্যাদি। গভীর রাতে পয়গামের নিউজ টেবিলে যখন টেলিফোন বাজতাে, তখন ভয়ে কেউই টেলিফোন ধরেই প্রথমেই গভর্ণর সাহেবের মুখ থেকে অশ্রাব্য কিছু গালিগালাজ শুনতে হবে। এই ছিলাে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের গভর্ণর আব্দুল মােনেম খান।
জয় জায়গায় তার ছবি
নি ধরেই প্রথমেই গভর্ণর কলমে
| সংবাদপত্রের মতােই বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা-জীবনকেও কলুষিত করেছিলেন। ইউনিভার্সিটি অর্ডিন্যান্স বা বিশ্ববিদ্যালয় কামাবাতুল পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকার খর্ব করা হয়েছিলাে। মােনেম খানকে পূর্ববাংলার মানুষ যতাে মন্দ বলতাে পশ্চিমা প্রভুদের কাছে ততােই তার কদর বাড়তাে। ঢাকা এয়ারপাের্টে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে বিষােদগার করলে উপস্থিত একদল তরুণ তার মাথা থেকে কিস্তি টুপি কেড়ে নিয়ে তাকে অপমান করেছিল। আর এই অপমানই হয়েছিলাে তার জন্যে শাপে বর । সেদিন থেকেই আইয়ুব সাহেবের কাছে তার পেয়ার আরাে বেড়েছিলাে। সুতরাং পূর্ব বাংলার মানুষের প্রশংসাকেই তিনি ভয় করতেন, নিন্দাবাজই ছিলাে তার পদোন্নতির চাবিকাঠি, মােনেম খান তার ভাগ্যোন্নতির এই সহজ পথটি অনায়াসে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।
ঠিকাদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক দশকের কলংকজনক অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন মােনেম খান। রাজনীতির স্বার্থে একদল বাঙালি তরুণকে অর্থের লােভে পথভ্রষ্ট করে কাজ হাসিলের চেষ্টা করেছিলেন। আর তার এই পােষা ছাত্র সংগঠনটির নাম ছিলাে এন এস এফ। গভর্ণর সাহেবের একদল পােষা ছাত্র বছরের পর বছর একই ক্লাসে অধ্যায়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় হলের একক সুসজ্জিত কক্ষ তাদের জন্যে নির্দিষ্ট, ডাইনিং হলের চাদা দিতে হয় না, শােনা যায় তাদের রুমে টেলিফোনের পর্যন্ত ব্যবস্থা ছিল। ক্লাশে শিক্ষকদের থােরাই কেয়ার করে, চায়ের টেবিলে বসে গলাবাজি করে সময় কাটায়, দামি স্যুট পরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঘুরে বেড়ায়। শহরের রাস্তায় তারা নতুন মডেলের গাড়ি হাকিয়ে চলে। শিক্ষকদের প্রহার থেকে শুরু করে, বিশ্ব বিদ্যালয় হলে মদ ও মেয়ে আমদানির মতাে অপকর্মও তারা নির্দ্বিধায় চালিয়ে যায়। এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির দুই ঝানু সর্দার ছিলাে সাইদুর ওরফে পাঁচপাড়ুর আর খােকা-খােকা ও পাঁচপাড়ুর দুজনেই মৃত-জনাব মােনেম
খান নিজের চোখেই এদের পরিণতি দেখেছেন। সাইদুর মারা গেছে ৬৮-এর গণ-আন্দোলনের মুখে, খােকা মরলাে এই সেদিন রমনার মাঠে যার লাশ পাওয়া গিয়েছিলাে। মােনেম খান ভাগ্যবান, তার নিজের অপকীর্তির পরিণতি তিনি স্বচক্ষেই দেখে গেলেন। বিবেক ও মন বলে কোনাে বস্তু অবশিষ্ট থাকলে মােনেম খান অন্তত এদের মৃত্যুতে দু’ফোটা চোখের জল ফেলতেন।
মােনেম খান রাজনীতিবিদ নন। তবু বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সংগে মােনেম খানের মত একজন অখ্যাত উকীলের নাম যুক্ত হবে ভেবে আমার দুঃখ হয়। আর মােনেম খানের সবচেয়ে বড়াে ভুল বােধহয় এইখানেই, এই রাজনীতিতে আসা। আসলে মােনেম খান প্রকৃতই নির্বোধ। না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপকদের ডেকে বলতে পারেন, আপনারা এতাে শিক্ষিত লােক রয়েছেন, রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেন না। এই হলাে মােনেম খান। আর সে কারণেই নির্যাতনের স্টীম রােলার চালিয়ে তিনি তার গদী পাকাপােক্ত করতে চেয়েছিলেন, ঢাকা-রাজশাহী-চট্টগ্রামের জেল ভর্তি করেছিলেন অসংখ্য ছাত্র-তরুণ, রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে। ভেবেছিলেন তার এই তাসের ঘর চিরদিন এমনি অটুট থাকবে। হায় মােনেম খান ইতিহাসের কোনাে শিক্ষাই তােমাকে পথ দেখাতে পারেনি।
তাসের ঘর। ১৯৬৮-৬৯ এর গণ-আন্দোলনে মােনেম খানের সেই তাসের ঘর মুহূর্তে উড়ে গিয়েছিলাে। আর সেই সঙ্গে তারও পতন ঘটেছিলাে অন্ধকার আস্তাকুড়ে। জনগণ যে কাউকে এমনভাবে বর্জন করতে পারে, মােনেম খানের পতন পরবর্তী জীবনই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মােনেম খান এই নামটি শুনলেই পূর্ব বাংলার মানুষ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতাে, তার নামটিও উচ্চারণ করতে চাইতাে না। আসলে বর্তমানে মােনেম খান ছিলেন অন্ধকার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত একটি নাম।
ক্ষমতাচ্যুত হবার পর থেকে ইদানিং মােনেম খান প্রায় বন্দী-জীবন যাপন করতেন। রাস্তায় বেরােবার মতাে সাহস পর্যন্ত ছিলাে না। একবার কিছুদিন আগে ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে ক্ষুব্ধ জনসাধারণের উদ্যত প্রহার থেকে কোনাে রকমে গা বাঁচিয়ে ছিলেন।
দুঃখ করার কেউ নেই মােনেম খান মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তি মােনেমের জন্য দুঃখ করার কেউ নেই। ক্ষমতামদমত্ত শাসক এখন ইতিহাসের করুণার পাত্র। মৃত্যু বেদনাদায়ক কিন্তু দু-একটি মৃত্যুতে কারাে চোখে একফোটা অশ্রু গড়ায় না, বরং হাজার হাজার নরনারী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচে। মােনেম খানের মৃত্যু তেমনি একটি মৃত্যু। মােনেম খান যদি কখনাে নিজের মনেই প্রশ্ন করতেন, তাহলে অনেক আগেই হিটলারের মতাে রহস্যজনক মৃত্যুই তাকে বেছে নিতে হতাে। মােনেম খানের চোখ থাকলে দেখতে পেতেন, কতাে সুখের সংসারে তিনি আগুন লাগিয়েছেন, কতাে জননীর স্নেহের কোল শূন্য করেছেন, নিজ হাতে হত্যা করেছেন, বাংলার জাগ্রত তারুণ্যকে, হত্যা করেছেন নিজেকেই কসাইয়ের মতাে নিজের বিবেককেই। বহু হত্যায় কলঙ্কিত মােনেমের হাত। মােনেম বাংলার সংস্কৃতিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন, বাঙলার যৌবন ও তারুণ্যকে হত্যা করতে চেয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের গতি এমনি বিচিত্র যে, যে মােনেম বাঙলার তারুণ্যকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন, বাঙলার সেই জাগ্রত তারুণ্যের হাতেই তাকে অবশেষে মৃত্যু বরণ করতে হলাে। আত্মবিক্রীত ঘাতক মােনেমের ক্ষমা নেই। মৃত্যুর পরও তার মৃত্যু আছে, ক্রমাগত মৃত্যু আর তাই মৃত মােনেমের-ভয়াবহ ধূসর মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে কেবল প্রার্থনা করি, আগামীদিনের-বাঙলাদেশের মাটিতে আর যেনাে কোনাে মােনেম খান না জন্মায়। [মােনেম খানকে হত্যা করেন তৎকালীন স্কুল ছাত্র মােজাম্মেল হক বীর প্রতীক।
২৯ ডিসেম্বর ‘৭১
সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা