আমার জন্মভূমির এলাকায়— পূর্ণেন্দু পত্রী
বাংলাদেশ জ্বলছে। মৃত্যুর কামানে। মুক্তির কামনায় । ঐ জ্বলন্ত জীবন্ত বাংলাদেশ কিন্তু আজও মেঘনার জল স্পর্শ করিনি কোনদিন। বন্ধুরা স্মৃতির কপাট খুলে বাংলাদেশের শ্যামল ঐশ্বর্যের গল্প বলে। শুনতে শুনতে বারবার মনে হয় কী যে পাইনি জীবনে। কী যেন সােনার জিনিস ছোঁয়া রয়ে গেল বাকী। | তবুও ঐ বাংলাদেশকে আমি চিনি। সেটা অন্যভাবে। তার সংগে অন্তরঙ্গতা ইতিহাসের সূত্রে। অন্যকালের এক অনন্য সংগ্রামের পটভূমিকায় আমি তাকে ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁজে নিয়েছি নিজের মত করে। লােলুপ রাষ্ট্র নেতারা কামানে বিমানে রক্তে ধ্বংসে হত্যার তাণ্ডবে নিজের রাজ্যের এলাকাকে বাড়াতে চায়। কিন্তু আমি যদি কেবল মনে মনে, কেবল ভালবাসায়, শ্রদ্ধায়, প্রীতিতে আমার জন্মভূমির এলাকাকে। বাড়িয়ে যেতে চাই, কিসের দোষ? আজ খবর আসে রংপুর জ্বলছে শত্রুর বােমায়। খবর পড়ি রংপুর রণাঙ্গনে। হানাদারী ফৌজ ছাউনীতে বন্দি, মুক্তিবাহিনীর বেড়াজালে ঘেরাও। রংপুর বললেই আমার চোখে ভেসে ওঠে একটা সভার ছবি। সে সভা চোখে দেখিনি। কিন্তু যেন এখনও শুনতে পাই তার সুদৃঢ় ঘােষণা। ১৯০৫। ১৬ অক্টোবর। ইংরেজ সরকার জারী করল এক নতুন পরােয়ানা। নাম কার্লাইল সার্কুলার । তার বিধানে ছাত্রদের রাজনীতির সভায় বা মিছিলে যােগ দেওয়া নিষেধ। বন্দেমাতরম্ গাওয়া বারণ। স্বদেশী। কোন কিছুর সামিল হওয়া মানেই ভীষণ শাস্তি। ৩১ অক্টোবর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ এমার্সনের মারফৎ সে সার্কুলার এসে পৌছুল রংপুর জেলা ও টেকনিক্যাল এই দুই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের হাতে।
সেখান থেকে ছাত্রদের কানে। দল বেঁধে বেরিয়ে এল ছাত্রেরা, প্রতিবাদে। ছুটল কাছাকাছি স্বদেশী সভায়। গান ধরলে ‘বন্দেমাতরম্’। ক’দিন বাদেই সরকার পক্ষ থেকে এক তালিকা এসে পৌছল এ দুই স্কুলে। জেলা স্কুলের ৮৬ আর টেকনিক্যাল স্কুলের ৫৬ জন ছাত্রের ৫ টাকা করে ফাইন। অনাদায়ে নাম কাটা যাবে স্কুলের খাতা থেকে। সেই সংগে ঐ ছাত্রদের অভিভাবকদের কাছেও একটা করে কড়া নােটিশ। ছেলেদের সামলান। নইলে বিপদ বাড়বে। চিঠি পড়ে জ্বলে উঠলেন অভিভাবকেরা। তারা নিজেরাই ডাকলেন একটা সভা। সেদিনকার রংপুরের। জনপ্রিয় উকিল উমেশচন্দ্র গুপ্ত। তিনি এগিয়ে এলেন পুরােভাগে। রংপুরের মানুষ সেদিনের সভায় মাথায় তুলে নিলাে এক ঐতিহাসিক সংকল্প কিংবা শপথ। তাঁরা কেউই তাঁদের ছেলেদের সরকারী স্কুলে পড়াবেন । পড়াবেন তাহলে কোথায়? তারা নিজেরাই গড়বেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাই-ই হল। কলকাতায় এসে পৌছল সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ঢেউ। কলকাতাতেও গড়ে উঠল অ্যান্টি সার্কুলার সােসাইটি। কলকাতাতেও সংকল্প, গড়তে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বরােদা থেকে অরবিন্দ ঘােষ ছুটে এলেন অধ্যক্ষ হতে। রবীন্দ্রনাথ বসলেন পাঠ্যক্রম রচনায়। কলকাতার বিদ্বজ্জনের পক্ষ থেকে বিনয় সরকার রংপুরকে জানালেন সংবর্ধনা। রংপুর হচ্ছে বাংলার শিক্ষাস্বরাজের প্রবর্তক। সেখানকার উকীলেরা এই আদালতের জন্যে যারপরনাই উচুদরের সৎসাহস ও স্বার্থত্যাগ দেখিয়েছেন।” | এমনি করেই বাংলাদেশকে আমার চেনা। রংপুর বললেই, যেমন মনে পড়ে সভা, বরিশাল বললে তেমিন আর একজন দিলখােলা দরদী অথচ দুঃসাহসী মানুষের মুখ। তাকে একজন প্রশ্ন করেছিল আবার যদি জন্মাতে হয়, কোন দেশে জন্মাবেন? উত্তর, কেন এই বাংলাদেশে। অশ্বিনীকুমার দত্তের জীবনের ছবির মধ্যে দিয়েই বরিশালকে চিনি, জানি।
শ্রীহট্ট আজ অগ্নিগর্ভ। শ্রীহট্ট অক্ষরটার দিকে তাকালে আমার চোখে ভেসে ওঠে এক ১৫ কিংবা ১৭ বছরের বালকের ছবি। দীপ্তি অগ্নিশিখা। সিলেটের ছেলে সদ্য গড়া জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র। কলকাতায় সেদিন তুমুল কাণ্ড। আদালত অবমাননার দায়ে বন্দী বিপিন পালের সেদিন কারামুক্তির দিন। ১৯০৭। ২৬ আগস্ট। হাজার হাজার মানুষ এসে জড়াে হয়েছে কোর্ট প্রাঙ্গনে, তাদের অন্যতম প্রিয় নেতাকে অভিনন্দন জানাতে। পুলিশ জনতা সামলাতে হিমসিম। সেই সময় কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ সার্জেন্ট বেটন হাতে ঝাপিয়ে পড়ল জনতার উপর। তারপর নির্মম প্রহার। সেই ভীড়ের মধ্যে ছিল সুশীল । দেখতে দেখতে রাগে ক্রোধে আক্রোশে ১৫ বছরের ছেলে হয়ে উঠল কেশর ফোলানাে সিংহ। তার কোমল মুঠিতে ভর করল যে আকাশের বত্র। যার একটা ঘায়ে একজন সার্জেন্টের শক্ত চোয়াল ঘেঁৎলে যাবার জোগাড়। | পরের দিন বন্দী সুশীল সেনের বিচার, তখনকার কালের দুদে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের আদালতে। বিচারের রায়, ১৫ ঘা বেত। সুরেন বাড়ুজ্যে তার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন সােনার পদক। কলকাতার মানুষ তাকে সম্মান জানালেন সভা ডেকে। | সুশীল যেন আমার জন্মভূমির এলাকাকে বাড়িয়ে দিয়েছে শ্রীহট্ট পর্যন্ত, তেমনি তাকে কুমিল্লা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে শান্তি ঘােষ (দাশ) ও সুনীতি চৌধুরী, ওদিকে ঢাকা পর্যন্ত বিনয় বাদল দীনেশ । শান্তি ও সুনীতি দুই দামাল কিশােরী, বলেছিল, আমরা আসছি কিশােরগঞ্জ থেকে। সাঁতারু। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মিঃ স্টিভেন্সের সংগে দেখা করতে চাই, একটা প্রতিযােগিতার ব্যাপারে তাঁর অনুমতি নেব বলে। সাঁতারু মেয়ে? তবে আর ভয় কী? নিরুদ্বিগ্নচিত্তে বেরিয়ে এলেন স্টিভেন্স সাহেব। তার পরেই তাে বন্দুকের গর্জন। তার। পরেই তাে ইতিহাস। আর বিনয় বাদল দীনেশ, ওরা তিনজনেই বিক্রমপুরের ছেলে। তিনজনই বিক্রমীবীর। কিন্তু ওই তিনজনের মধ্যে, যাদের কাউকেই দেখিনি, সবচেয়ে বেশী আত্মীয়তা যেন দীনেশের সংগে, রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় কবি বলে? সব সময় তার গলায় রবীন্দ্রনাথের গান বাজতাে বলে? আশ্চর্য, মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও তার চিঠিতে গান আমার দিন ফুরালাে, ব্যাকুল বাদল সাঝে। যারা বাংলা দেশের সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে দুবেলা স্নান করেছে, তাদের ঈর্ষা করি। কিন্তু আমিও তাে পেয়েছি এক সূর্যের আলাে। ওই বাংলাদেশের আকাশ থেকে। চট্টগ্রামের সূর্য এপার ওপার গােটা বাংলাদেশের সূর্য। বাংলাদেশ জ্বলছে। মৃত্যুর কামানে। শক্তির কামনায় । যতদূর আগুন, যতদূর কালাে ধোঁয়া, যতদূর অশ্রু ও রক্ত, যতদূর সাহস ও সংগ্রাম, আজ ততদূর জুড়ে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে আমার জন্মভূমির এলাকা।
১৫ এপ্রিল ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭