নববর্ষ
সে এক দুঃসহ যন্ত্রনার দিন। পরিশ্রমের দিন। অলসের ঘুম ও ভীরুর বিশ্রাম কোনটাই সেদিন ছিল না ঈপ্সিত। সেদিন ছিল শপথ নেবার দিন। সমগ্র জাতিকে তাই কবি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘মুছে ফেলাে ধূলাে, মুছ অশ্রুজল, ফেলাে ভিখারীর চীর, পরাে নব সাজ, ধরাে নব বল, তােলাে তােলাে নতঃশির। বারােশ বিরানব্বইয়ের বাঙলাদেশের সঙ্গে একালের এই তেরােশ আটাত্তরের বাঙলাদেশের ব্যবধান অনেক দুস্তর তফাৎ। এই বিরাটকালের ফাক দিয়ে গঙ্গা ও পদ্মা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে অনেক জল। গেছে অনেক আন্দোলনের ঢেউ। গেছে দুটি মহাযুদ্ধের সর্বনাশা বিভীষিকা। আর স্বাধীনতার মুহূর্তে যে রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়ে গেছে আমাদের দ্বি-খণ্ড দেহ থেকে ইতিহাসে তার নজির মেলা ভার। যে সােনার বাঙলার ছবি পরাধীন ভারতেও একদা আমাদের চোখের সামনে জ্বল জ্বল করত, তা এক লহমায় দপ্ করে নিভে গেল। ‘বন্দেমাতরম্’ বলে যে মাতৃবন্দনা শােনা গিয়েছিল, তা-ধ্বনিত হয়েছিল প্রথমে সপ্তকোটি কণ্ঠেই। বঙ্গদর্শনের মশাল জ্বেলে বঙ্কিম যে-স্বদেশ খুঁজতে বেরিয়াছিলেন, আর যেভাবে ভাবিত হয়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথ বাঙলাদেশ আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়েছিলেন, সমাধি ঘটল সে ভাবনার। হারিয়ে গেল আমাদের স্বদেশ চিন্তা। সােনার বাঙলার সােনার স্বপ্ন মিলিয়ে গেল বাতাসে।
কিন্তু কে জানত, আমাদের সেই হারানাে স্বপ্ন আবার বেঁচে উঠবে এবং এতদিন পরে আটাত্তরে। এবারের নব জন্ম তাই নববর্ষের সঙ্গেই একাত্ম। এবারের নববর্ষে জন্ম নিচ্ছে তাই নতুন ইতিহাস। আমরা যে আবার রৌদ্রকরােজ্জ্বল সােনালী দিনের ভাবনায় অবগাহন করতে পারব, এ যেন তারই ইঙ্গিত। | এই নববর্ষের শিখরচূড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই অতীত ও ভবিষ্যতের বহু দূরদূরান্ত । ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা যেমন রঙিন স্বপ্ন দেখতে পাই, তেমনি আমাদের ভালােলাগে সেই সব মানুষদের কথা ভাবতে যারা এই স্বদেশ-স্বপ্নে ছিলেন মশগুল হয়ে। সেই পাঠশালার ছবিটা মন্দ নয়, যেখানে বসে নবগােপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু অথবা বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ পাঠ নিচ্ছেন। মনের ভেতর গুনগুনিয়ে ওঠে সেই কবিতার লাইন যেখানে কবি লিখেছেন, ‘স্বদেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’
কোন এক বিষন্ন অপরাহ্নে বঙ্কিম হতাশ হয়ে লিখেছিলেন, ‘বাঙলার ইতিহাস নাই, যাহা আছে তা ইতিহাস নয়। … বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙলার ভরসা নাই। কে লিখিবে?- বিষন্ন বঙ্কিমকে আশার আলাে দেখিয়েছিলেন রাজকৃষ্ণ মুখােপাধ্যায়। সাহিত্য সম্রাটের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি প্রথম শিক্ষা। বাঙ্গলার ইতিহাস।’ সেদিন ক্ষুধার মরুভূমিতে এ ছিল মুষ্টি ভিক্ষা। কিন্তু বঙ্কিম আপুত হয়েছিলেন, ‘মুষ্টি ভিক্ষা হউক, সুবর্ণের মুষ্টি …. ‘ঈদৃশ সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ বাঙ্গালার ইতিহাস আর নাই।’ | স্বদেশ প্রেমের সত্যি সত্যিই সে এক আশ্চর্য যুগ। বঙ্গচিন্তা তখন ধীরে ধীরে রূপায়িত হচ্ছে ভারত ভাবনায়। কেউ লিখে চলেছেন নিজের আবেগে, কেউ গেয়ে চলেছেন গান। কেউ বসছেন তর্কে, আবার কেউ বা পাঁচজনকে নিয়ে বসেছেন সভায় । তখন রবীন্দ্রনাথ কিশাের। সেই কিশাের দিনের উত্তেজনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা এমন একটা খ্যাপামির তপ্তহাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে, অহরহ উৎসাহে যে আমরা চলিতাম। লজ্জা ভয় সঙ্কোচ আমাদের কিছুই ছিল না। …. আমাদের প্রধান কাজ উত্তেজনার আগুন পােহানাে। | এ উত্তেজনার আগুন জ্বলছিল নিত্যি-নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে। কেউ গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছেন, ‘সর্বজনীন পরিচ্ছদ আমাদের নেই কেন? আবার লেগে গেলেন স্বদেশী দেশলাই বানাতে। আবার কেউ বা দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কাপড়ের কল’ তৈরির চেষ্টায়। অনেক চেষ্টায় যদি বা স্বদেশী দেশলই বের হল এখন দেখা গেল, ‘আমাদের এক বাক্সে যে খরচ পড়িতে লাগিল তাহাতে একটা সম্বৎসরের চুলা ধরান চলিত এবং আবিষ্কার করা গেল ‘নিকটে অগ্নিশিখা না থাকিলে তাহাদিগকে জ্বালাইয়া তােলা সহজ ছিল না।
এ জাতীয় ঘটনা অনেক। সেই ব্রজবাবুর কথাও মনে পড়তে পারে। একমাথা তার পাকা চুল। কিন্তু মনটা তরল আগুনে ভরা। স্বদেশী কাপড়ের কল’ তৈরির উত্তেজনায় একদা তিনি আহার দ্রিা হারালেন। আর তারপর? অবশেষে একদিন দেখি ব্রজবাবু মাথায় একখানি গামছা বাঁধিয়া জোড়া সাঁকোর বাড়িতে অসিয়া উপস্থিত। কহিলেন, “আমাদের কলে এই গামছার টুকরাে তৈরি হইয়াছে।’ বলিয়া দুই হাত তুলিয়া তাণ্ডব নৃত্য। আর রাজনারায়ন বসু যিনি মধুসূদনের সহপাঠী ছিলেন, তার কথা না তােলাই ভালাে। খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ায় তিনি আরেক আগুন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- তাহার দুই চক্ষু জ্বলিতে থাকিত, তাঁহার হৃদয় দীপ্ত হইয়া উঠিত, উৎসাহের সঙ্গে হাত নাড়িয়া আমাদের সঙ্গে মিলিয়া গান ধরিতেন- গলার সুর লাগুক আর না লাগুক সে তিনি খেয়াল করিতেন না’-। আর ন্যাশনাল নবগােপাল’। সর্বত্র ন্যাশনাল চিন্তা করতে করতে একদিন তিনি খুলে বসেছিলেন ন্যাশনাল সার্কাস।’
ভাবতে ভালাে লাগে এইসব দিনের কথা। আর বার বার মনে হয় আমরাও এমনি করে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারি না কেন? – আজ বাঙলাদেশের শিরায় শিরায় এরই অনুভব যেন রােমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে। পথে অনেক বাধা, অনেক মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। কিন্তু এ মৃত্যুকে আমরা জয় করবই। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন যে স্বপ্নকে, আমাদের রক্তে তারই ডাক এসেছে। | সােনার বাঙলায় আজ তাই আগুন জ্বলছে। এ আগুনে দীক্ষা নেবার সময় এসেছে। এবারের আটাত্তরের নববর্ষ গ্রহণ করে এনেছে দীক্ষা নেবার আহ্বান। আর এ আহ্বান পূর্বসূরী মনীষীদের আশীর্বাদে উজ্জ্বল। সুতরাং সাড়া আমাদের দিতেই হবে। দরকার হলে জ্বালাতে হবে আবার খ্যাপামির তপ্ত হাওয়া। নইলে আমাদের মুক্তি নেই।
১৫ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭