হায়দার আমার সাতাশ বছরের বন্ধু — অমিতাভ চৌধুরী
জঙ্গীশাহী যেখানে সমগ্র একটি জাতিকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন, সেখানে বুদ্ধিজীবী আর অধ্যাপকেরা ব্যতিক্রম হবেন কেন? নিহতের তালিকায় আর একজন অধ্যাপকের নাম যুক্ত হল। তিনি ডাঃ মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রীডার। হায়দার আমার গত সাতাশ বছরের বন্ধু-যৌবনের শুরুতে আমরা একই বছরে একই মাসে (১৯৪৪ সালের জুলাই) শান্তিনিকেতনের কলেজে ভরতি হয়েছিলাম। হায়দার থার্ড ইয়ার বাংলা অনার্স, আমি ফারস্ট ইয়ার। একই হােস্টেলে একই রুমের বাসিন্দা ছিলাম দুজনে।।
আমাদের অধ্যাপক প্রবােধচন্দ্র সেন ওঁকে বলতেন মুখােজ্জল হায়দার। কেননা ঢাকা থেকে আই এ পরীক্ষায় ও প্রথম হয়েছিল। তারপর করল এক অভাবনীয় কাণ্ড, ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাতে হল প্রথম। তার আগে কোন মুসলমান ছাত্র প্রথম হয়নি। সত্যি সত্যিই মােফাজ্জল মুখােজ্জ্বল করেছিল শান্তিনিকেতনের। বি.এ. পাশ করেও হায়দার শান্তি নিকেতন ছাড়ল না। ওখানেই কাজ নিল রবীন্দ্র ভবনে, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিল এম এ। পাকিস্তান হওয়ার পরও ঢাকা গেলনা। শান্তিনিকেতনের ফুল, গাছ, গান, পাখীর প্রতি এত আকর্ষণ, রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার এত অচলাভক্তি, নােয়াখালির বাসিন্দা হয়েও থেকে গেল পশ্চিমবঙ্গে। পরে যখন আত্মীয় স্বজনের অনুরােধে নিতান্ত অনিচ্ছায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি নিয়ে গেল, তার মন পড়ে থাত শান্তিনিকেতন। আসত প্রায়ই, আর না এলে চিঠি লিখত- “ও গাছটা কত বড় হল? ওই ফুল এখনও। কি ফোটে?”ইত্যাদি ইত্যাদি।হায়দার নিজেও ভাল কবিতা লিখত। কয়েকখানি প্রবন্ধের বইও লিখেছে। শান্তিনিকেতনে সে “সাহিত্যকার সম্পাদক ছিল দীর্ঘকাল। সর্বোপরি সে ছিল একজন মুক্তমনের বাঙালী- রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার ধ্যানজ্ঞান। অনুমান করতে পারি হায়দার রবীন্দ্রনাথের কোন গানের কলি কিংবা কোন কবিতার লাইন উচ্চারণ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
৬ এপ্রিল, ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭