You dont have javascript enabled! Please enable it! নদীর ওপারে- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় - সংগ্রামের নোটবুক

নদীর ওপারে– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ইস্কুলে আমার সঙ্গে একক্লাসে পড়ত মকবুল। ভারী দুরন্ত ছেলে ছিল সে। আমাদের গ্রামের পাশে নদীটির নাম ছিল ভারী অদ্ভূত; আড়িয়েল খাঁ। নাম শুনলেই গা ছমছম করে এমন দুর্দান্ত নদী। মকবুল বলতাে তার এক পূর্ব-পুরুষ নাকি ছিল জলডাকাত, তার নামেই ঐ নদীর নাম। বানিয়ে বানিয়ে কত কথাই বলতাে মকবুল। সেই মকবুল এখন পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে স্বাধীন বাংলার । মকবুল কোনােদিন কোনাে খেলায় হারেনি, সে এবারও জিতবে। চাদু লেখা পড়া করতাে না। সে ছিল নমঃশুদ্র পাড়ার ছেলে, সবাই বলতাে ওরা নিচু জাত। একদিন ওদের বাড়িতে আমায় জোর করে পান্তা ভাত খাইয়ে দিয়েছিল চাদু। বলেছিল, যাও বামুনঠাকুর, তােমার জাত মেরে দিলাম। কি সুন্দর স্বাদ ছিল, সেই লেবুপাতা দিয়ে মাখা পান্তা ভাতের প্রায়ই আমি জাত হারাতে যেতাম। চাদু কোচ নামে এক ধরনের বল্লম দিয়ে মাছ মারতাে। একদিন সে একটা কুমীর গেঁথেছিল। খুব গর্ব হয়েছিল আমার চাদুর জন্য। চাদু এখন লড়াই করছে পাঠান সৈন্যদের সঙ্গে। চাদুর জন্য এখনাে আমার গর্ব হয়।

আলতাফ ছিল বড় ভালাে ছেলে। সারাদিন পড়াশুনাে করতাে। আমারা যখন নদীতে সাঁতার কাটতে যেতাম কিংবা যেতাম-শেয়াল মারা দেখতে, তখনও আলতাফ বাড়ীতে বসে বসে বই পড়তে শুধু। আমরা বলতাম আলতাফের জীবনে কিছু হবেনা। আলতাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছিল। নিষ্ঠুর মিলিটারি যখন অত্যাচার করতে শুরু করলাে, তখন আলতাফ বইপত্র ছেড়ে নেমেছিল লড়াইয়ে। আলতাফ মারা গেছে। কিন্তু আলতাফের জীবন সার্থক হয়ে গেল, তার কথা আমি সারা জীবন মনে রাখবাে।

৫ এপ্রিল, ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা 

(আনন্দমেলা)

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭