ওদের সংগ্রামের দিকে তাকিয়ে আমরা (২)– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এখান থেকে প্রায় একশাে মাইল দূরে ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে আসছে। ভিন্ন জাতীয় সামরিক বাহিনী। মানবিকতার সমস্ত রকম মান অগ্রাহ্য করে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে খুন। করছে নিরস্ত্র বাঙালীদের। আমিও একজন বাঙালী, শুধু তাই নয় যে সব এলাকায় এখন প্রবল যুদ্ধ চলছে, তারই কোন অংশে আমার জন্ম। অথচ আমরা এখন এখানে চা খাচ্ছি, গল্প করছি, সিনেমা থিয়েটার সবই চালু, পাড়ায় পাড়ায় খুনােখুনি, রেসের মাঠে ভিড়-সবই চলছে। আমরা বড়জোর কখনও একটু উত্তেজিত আলােচনা চালাচ্ছি, রেডিওর প্রতি উত্তৰ্ণ, দু-একটা মিটিং, কিছু কিছু লেখালেখি। ওদিকে অপর বাঙালীরা বীরের মতন লড়াই করে মারছে ও মরছে। নাটক নভেলে এইরকম অবস্থাকেই বােধহয় বলে নিয়তির পরিহাস। বার বার মনে হয় যাই, যাই। কোথায়? সে সম্পর্কে ঠিক স্পষ্ট ধারণা করা যায় না। এ যেন স্বপ্নের যাওয়া। স্বপ্নের মধ্যে ইচ্ছাপূরণ। পথের নিশানা নেই, পাথেয়র প্রয়ােজন নেই, পথ যানের চিন্তা নেই- হঠাৎ হাজির হয়ে গেছি রণাঙ্গনে, আমার হাতে রাইফেল, বাঙালী মুক্তিসেনার পাশে দাঁড়িয়ে আমিও শত্রুর দিকে রইফেল তুলে অব্যর্থ লক্ষ্যে ….। যদিও আমি এ পর্যন্ত কখনােও রাইফেল ছুঁয়ে দেখিনি। তবু স্বপ্নের মধ্যে অবিরাম যাই, যাই। গাঢ় লাল রং আমি খুব অপচ্ছন্দ করি। রক্তের দৃশ্য আমার সহ্য হয় না, নরহত্যা আমার কাছে খুবই অরুচিকর মনে হয়। কোনাে মহৎ আদর্শের জন্যও হত্যাপন্থী হওয়া আমার পক্ষে ইহজীবনে আর সম্ভব হবে। যে পাঞ্জাবী সৈনিকরা বাংলাদেশে লড়াই চালাতে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে, তদের জন্যও আমার কষ্ট হয়। তারাও তাে পাঞ্জাবের কোনাে গ্রাম্য কৃষক পরিবারের ছেলে, নিছক বেতনভূক এবং বিবেকহীনতার শিক্ষা। পেয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলায় এখন যে যুদ্ধ চলছে, একমাত্র এই রকম যুদ্ধেই আমি মন-প্রাণ দিয়ে অংশ নিতে পারি। ন্যায়সম্মত দাবি যারা খর্ব করতে চায়, শক্তির অহংকারে তাদের প্রতিনিবৃত্ত করতে গিয়ে প্রাণ দেওয়াও গৌরবের। আমার বিপ্লবের স্বপ্ন এইরকম। আমি এখনাে যাইনি, করণ যাওয়ার সুযােগ নেই। কিংবা প্রয়ােজন আসেনি এখনাে। শেষ মুহূর্তে ডাক এলে নিশ্চয়ই যাবাে। আমিও তােমাদের সঙ্গে আছি। মনের মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে আসে, আছি, আছি।
৪ এপ্রিল, ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭