You dont have javascript enabled! Please enable it!

অন্যেরা-বিপন্নের জন্য তিব্বত পুরানাে পাপ। পূর্ব বাংলা আমাদের দ্বিতীয় বার পাতকী যেন না করে-নিখিল সরকার

ওরা এসেছিলেন পাহাড় ডিঙিয়ে, ক্ষেত খামার পেরিয়ে, নদী নালা গলিপথ বেয়ে; ওরা এসেছিলেন জীবন দান করতে …। সঠিক ছত্রগুলাে মনে পড়ছে না, কিন্তু ডব্লিউ এইচ অডেনের সেই কবিতাটি সে ঘটনাকে উপলক্ষ করে লেখা তার কথা অবশ্যই মনে আছে। ইতিহাসে সে-ঘটনার শিরােনাম -স্পেনের গৃহযুদ্ধ। কবি অডেন সেই যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক, রিপাবলিকানদের অ্যামবুল্যান্স বাহিনীর সসদ্য। অনেক কবি, অনেক লেখকের ভিড় এই শিবিরে। ম্যালরাে, স্টীফেন স্পেনডার, আরনেস্ট হেমিংওয়ে আরও কত কে! নানা দেশ ঠিকানা তাদের। বাহিনীর নাম ইনটারন্যাশনাল ব্রিগেড। প্যারিসের এক হােটেলে বসে স্বেচ্ছা সৈনিকদের নামে লিখছেন যুগােশ্লাভিয়ার টিটো, ফরাসী লেখক ম্যালরাে চেষ্টা করছেন বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে, – ব্রিটিশ শ্রমিক নেতা এটলি একজন মেজর,- ভারতের জহরলাল নেহেরু আবেগে কম্পমান একজন দর্শক।

কমিনটার্ন-এর। সে সংঘ এখন লুপ্ত। চলতি কনভেনসন অন্যের ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না-করা। ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। এদের প্রকৃতি আলাদা। কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের নাম, ভিয়েতনামে “গণতন্ত্র রক্ষার জন্য। সংক্ষেপে, এই দুই আগুনে বাইরে থেকে হাত দেওয়া হয়েছিলআন্তর্জাতিক রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য। যখন সে জাতীয় কোনও সমূহ লক্ষ্য নেই, কিংবা ঝুঁকি যখন অত্যাধিক তখন অন্যরা স্রেফ দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে তার নজীর- হাঙ্গেরী; চেকোস্লোভাকিয়া এবং সেদিনের বিয়াফরা। হাঙ্গেরীতে ওরা নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আশা ছিল। সেখান থেকে কিছু ঝরে পড়বে। সে আশা পূর্ণ হয়নি। না চেকোস্লোভাকিয়ায়ও না। বয়ফ্রাও খাদ্য পথ্যের বেশি খুব কিছু পায়নি। বিশেষত দূরের মানুষের কাছ থেকে।

পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে তার সঙ্গে এইসব ঘটনার কোন মিল নেই। এযুদ্ধ গৃহযুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধ। নবীন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নবীন জাতীয়তার মরণপণ লড়াই। বরং এই লড়াইয়ের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, আলজিরিয়ার এফ-এল-এনের দুঃসাহসী লড়াইয়ের সঙ্গে। পূর্ব বাংলা আরও ঐক্যবদ্ধ, আরও সংহত এবং অস্ত্রে দীক্ষা তার সবে মাত্র- এই যা।

এই মহান যুদ্ধে কোন বৃহৎ শক্তি পূর্ব বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াবেন- এটা আশা করতে অবশ্যই ভাল লাগে, কিন্তু মনে হয় সেটা দুরাশা। এ সময় অতি প্রাকৃত কোনও কিছুতেই বিশ্বাস না করাই ভাল। আমরা সকলেই জানি ইয়াহিয়া খা যে আইন শৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলেছেন, সেটা তােলার কোনও আইনগত অধিকার তার নেই।- কে তিনি? একজন সফল ষড়যন্ত্রকারী ছাড়া আর কিছু নিশ্চয়ই নন। তার তুলনায় মুজিবর রহমানের নৈতিক এবং আইনগত অধিকার অবশ্যই বেশি। বিশেষত, সাম্প্রতিক নির্বাচনের পরে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক শক্তি নির্বিশেষে সকলের কছে আয়ুব- ইয়াহিয়া দীর্ঘদিন জলচল। কারণ, এঁরা তাদের বৃহত্তর স্বার্থের সমর্থক। ইয়াহিয়া ‘সেনটো’, ‘সিয়াটোর সদস্য, সুতরাং আমেরিকার মুখ বন্ধ। ব্রিটেন- দুঃখিত।’ দুঃখের হেতু আছে বই কি? পাকিস্তান যে তাদেরই হাতে গড়া। বিপ্লবী চীনও এখন পর্যন্ত মৌন। কারণ খান সাহেবেরা তাঁদের দোস্ত। শ্যাম রাখি না কূল রাখি- চীন এই দোটানায় পড়েছে বলে মনে হয়না। আপাতত সেও বেড়ার ওপর বসে।

বাকী রইল ভারত। এস এম যােশী অভিযােগ করেছেন- ইন্দিরা তাঁর পিতার মত হতে পারছেন -কেন? জহরলাল নেহরু স্পেনে ছুটে গিয়েছিলেন, চীনে মেডিক্যাল মিশন পাঠিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়ার সমর্থনে এশীয় সম্মেলন ডেকেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী কি কিছুই করতে পারবেন না? জানি না। শুধু এটুকু জানি, সমর্থন জানাবার সব পথ গুলাে বন্ধ নয়। বিশেষত, ভারতের ঘােষিত নীতি যেখানে উপনিবেশকতার বিলােপ। আমাদের আরাে-এশিয়া, আমাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি- সবই যখন ওই লক্ষ্যে, তখন ভারতের কোনও অধিকার নেই বাংলার মুক্তিযুদ্ধে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার। আফরিকার মুক্তি যােদ্ধাদের অন্যভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও কিন্তু ভারতের মুখে শােনা গেছে। | হােনা নৈতিক সাহায্য- তারও মূল্য আছে বই কি! স্মরণীয়- সুয়েজ প্রসঙ্গ। মাথা হেঁট করে ঘরে ফিরতে হয়েছিল ইংরাজ ফরাসিকে। ব্রিটিশ সিংহ শেষ পর্যন্ত ভেজা বেড়ালে পরিণত। তবে ইয়াহিয়া খাই বা বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরবেন কেন? তাকে বাধা দিতে হবে। দিল্লিতে তাে বটেই ঃ এশিয়ায়, আফরিকায়, জাতিপুঞ্জে- সর্বত্র। আমাদের এক পাপ- তিব্বত; পূর্ব বাংলা যেন দ্বিতীয়বারের মত এই জাতিকে পাতকী না করে।

২৮ মার্চ, ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!