জন্মভূমি– নরেন্দ্রনাথ মিত্র
আম কাঁঠালের ছায়া ঘেরা প্রথমে একটি বাড়ির ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তিনটি উঠানওয়ালা সেই বাড়িতে অনেকগুলি ঘর, একটি পুকুর, দু দিকে খাল- বর্ষার সময় সেই খাল জলে ভরে ওঠে, খরার সময় খটখট করে। তারপর সেই মানচিত্র বাড়ি থেকে পাড়ায়, পাড়া থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছােট ভূখণ্ডের একান্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব পাড়াপড়শীদের কথা মনে পড়ে যায়। তাদের অনেকেই লােকান্তরিত। বাকি যারা, তারা কোথায় আছে, কেমন আছে জানিনা। তারা এখন সবাই আমার স্মৃতিলােকের অধিবাসী। আমার সর্বশেষ যাত্রা একুশ বছর আগে। তখন গিয়ে সেই গ্রামের বাড়ীতে দিন পনের ছিলাম। পুরােন পাড়াপড়শীদের অনেককেই কাছে পেয়েছিলাম। তারা সবাই তখনও উদ্বাস্তু হয়নি। তারপর থেকে প্রত্যক্ষ দর্শনের পালা বন্ধ। কিন্তু পরােক্ষ যােগাযােগ রয়ে গেছে। কোন কোন বাল্যবন্ধুকে চিঠি লিখি, জবাব পাই। ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রে কেউ কেউ সীমানা পেরিয়ে কলকাতা আসেন। দেখা সাক্ষাৎ হয়। দরিদ্র মুসলমান। ডাক দেয়, পুরােন ছাতা-‘। পুরােন স্মৃতির ভাণ্ডার উছলে ওঠে। বাইরের ঘরে ডেকে এনে বসতে দিই । পুরােন ছাতাটি বাড়িয়ে দিই তার কাছে। পর পর খুঁটে খুঁটে দেশের কথা জিজ্ঞাসা করি। সে হয়তাে আমাদের ঠিক গ্রামের নয়, এমন কি পাশের গ্রামেও নয়। কিন্তু একই ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা। পুরােন ছাতাটি সারাতে সারাতে সে অনেক কথা বলে। আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়।
তারপর ১৯৬৫ সনে পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে সীমান্তে যখন আরও কড়াকড়ি, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্বেষবােধ আরও প্রখর, তখন সেই ব্যক্তিগত যােগাযােগও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। পূর্ববঙ্গের পটভূমিতে আগে যত বেশি লিখতাম, লিখতে পারতাম, এখন আর তা পারিনে। স্মৃতি ধূসরতর হয়ে আসে। পূর্ববঙ্গ যেন পূর্বজীবন। জন্মভূমিকে যেন জন্মান্তরে ফেলে রেখে এসেছি। কিন্তু আমার কাছে যে দেশ শুধু স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। সে দেশের জীবন্ত মানুষের চলা ফেরার কথা মাঝে মাঝে কানে আসে। তাদের ভাষা আন্দোলনের কথা শুনি, মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গের কথা কাগজে পড়ি, শিক্ষায় সংস্কৃতিতে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবের আভাস পাই। কবিতায় গল্পে উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক সীমানার ওপারে নতুন একদল লেখকের পরীক্ষা নিরীক্ষার আভাস পাই। সেই সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় যত প্রত্যক্ষ হবে বলে আশা করি, তা হয় না। দ্বিখণ্ডিত দেশের কৃত্রিম সীমানার এপারের লেখা ওপারে ছাপা হয়না। ওপারের বই পত্র এপারে এসে পৌছায় না। ওপারের সামরিক শাসন নিষেধের দেওয়ালকে দূর্ল করেছে। তবু আমাদের মধ্যে যারা বেশি অধ্যবসায়ী, উৎসাহী এবং উদ্যমশীল তারা কিন্তু খোজ খবর রাখেন। তাদের কাছেই শুনতে পাই, নতুন মাটিতে নতুন ফসলের চাষ হচ্ছে।
কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতি তাে সামগ্রিক জীবন থেকে আলাদা নয়। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আশা আকাঙ্খার সঙ্গে তা ওতঃপ্রােতভাবে জড়িত। দীর্ঘকালের উৎপীড়ন-নিপীড়নের প্রতিবাদে যে এক নতুন জনসমাজ সঘবদ্ধ হয়েছে, আমাদের চোখের আড়ালে এক নতুন জাতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সে খবর আমরা সবাই যে সমভাবে রেখেছি তা নয়। বিশেষ করে এই অতিমাত্রায় রাজনীতি-সচেতন যুগেও স্বভাবধর্মে যে একান্ত উদাসীন, কালকের সংবাদপত্র দূর অতীতের ইতিহাসের পাতার মতই পুরােন, রাজনীতির রণাঙ্গন যার কাছে ক্রীড়ামােদীর খেলার মাঠের কাছাকাছি, রাজ্য ভাঙ্গাগড়ার সংবাদে সে স্বভাবধির। | কিন্তু সেই বধিরতাও ভাঙল, যখন শুনলাম আমাদেরই সেই ছেড়ে আসা পূর্ববঙ্গে একটি দল সারা দেশের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। সেই দলনায়ক উদাত্তকণ্ঠে বলতে পেরেছেন, ‘আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগােরে সকল দেশ।’ এ এক নতুন ধরনের একনায়কত্ব। স্বেচ্ছাচার নয়, বহু মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু ইচ্ছার অস্পষ্ট অর্ধোচ্চারিত বহু আকাঙ্খার সম্মিলিত এক প্রবল ধারা।
তারপর শুনলাম, সেই প্রবল প্রাণস্রোতকে রুদ্ধ করে দেওয়ার স্তব্ধ করে দেওয়ার দানবীয় উল্লাস। প্রায় নিরস্ত্র এক জনসমাজের ওপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের এক অমানুষিক অভিযান। আর প্রাণপণ শক্তিতে নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে সেই নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রাম। স্বীকার করতে হবে এই পূর্ববঙ্গ আমার কাছে অদৃষ্টপূর্ব। সংকল্পে অটল এই বীরত্বের কাহিনী এতদিন শ্রুতির অগােচরে ছিল। ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মের গােড়ামি একটি মাত্র আকাঙ্খার বন্যায় ভেঙে গেছে। সে আকাঙ্খা স্বাধীনতার। সেই স্বপ্ন আর সাধ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্বভৌম স্বাধীনরাষ্ট্রের। স্বপ্ন কেন, সেই সাধ তারা বাস্তবে রূপ দিয়েছে। সেই সাধ আজ রক্ত শতদলে অভিষিক্ত। এবার ফিরে আসি সীমানার পশ্চিম পারে। দুই যুগ বাদে যেন এই দ্বিখণ্ডিত ভূমির সীমারেখা মুছে গেছে। রাজনৈতিক মানচিত্রে নিশ্চয়ই মােছেনি; কিন্তু মনের মধ্যে যে আর একটি চিত্র আছে সেখানে তা উঠে যাওয়ার মধ্যে। এযেন মাঠের মধ্যে পাশাপাশি দুখানি জমির আলের মত। লাঙলের ফলায় তা তুলে দিলেই হল। পূর্ব নয়, পশ্চিম নয়, সমবেদনায় সহানুভূতিতে আমরা যেন এক অখণ্ড চিন্ময় বঙ্গের অধিবাসী। কিন্তু সবই যেন মনে মনে মুখে মুখে। হাতে কলমে নয়। আমাদের মধ্যে যাদের হাতে কলম আছে। তারাও অন্য ধরনের লেখায় অভ্যস্ত। ইচ্ছা করলেই কি আগুন ঝরানাে যায়। আমরা যার কিছুই করতে পারিনে, তাদেরও হাত নিসপিস করে, মন আনচান করে একথা সত্যি। গত-যৌবন কয়েকজন বায়ুসেবী আমরা যারা পাড়ার পার্কে সকাল বেলায় গিয়ে জড় হই তাদের সবাইর মুখেই এখন প্রায় একই কথা। এখানকার কথা পরে, সেখানকার কথা আগে। আগে বল সেখানে কি হচ্ছে ।
ঘটনাক্রমে যাদের সঙ্গে দেখা হয়, তারা প্রায় সবাই পূর্ববঙ্গের। এঁরা কেউ পূর্ব পাকিস্তান বলতে অভ্যস্ত নন। বলতে ভালােবাসেন পূর্ববঙ্গ। বাংলাদেশের আর কোন অংশকে পাকিস্তান বলতে হবে না, এই আশায় আনন্দে উল্লসিত। আমরা পরস্পরের সহিত এই নিয়ে আলাপ করি। কী মশাই, যাবেন নাকি একবার দেশে? ‘মন তাে যেতে চায়, কিন্তু যাই কী করে। সীমানায় বেড়া, পায়ে বেড়ি। যাই কী করে।’ তাছাড়া আমরা গিয়ে করবই বা কী। অনর্থক ভার বাড়াবাে। যারা যাবার তারা যাবে। যাচ্ছেও। সেই নওজোয়ানরা আপনার আমার ইচ্ছে অনিচ্ছার ধার ধারে না।’ “কিন্তু আপনারও কি ইচ্ছে করেনা একবার দেখে আসি?”
করে বই কি। শুধু দেখে আমার ইচ্ছা কেন, আমার তাে মশাই বাকী জীবন সেখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছাও করে। কিন্তু ঘরে আর একজন আছেন যে। সবই সেই ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা।’ নানাকারণে সেখানে গিয়ে বাস করা হয়তাে আর হবে না। সে কথা আমরাও জানি। দীর্ঘকাল ধরে ভিন্ন রুচি প্রবৃত্তি, ভিন্ন অভ্যাস আজ আমাদের মনে বাসা বেঁধেছে। গ্রামে গিয়ে সেই বাস্তৃভিটা আর নতুন করে গড়ে তােলা হবেনা। সেই রাম, সেই অযােধ্যাকে আর একসঙ্গে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তবু বাল্যের কৈশােরের প্রথম যৌবনের সে বাসভূমি আমাদের অনেককেই দিনান্তে একবার না একবার হাতছানি দেয়। আমরা চাই সেই হাতছানি যেন আলেয়া না হয়, অলীক না হয়। স্থায়ী ভাবে বাস করি না করি, দেখে আসার দেখা দিয়ে আসার পথে যেন কোন বাধা না থাকে। পুরােন বন্ধুদের যেন মুখ দেখতে পাই। পুত্রতুল্যদের পিঠে হাত রেখে যেন বলতে পারি, ‘সাবাস, আমরা যা পারিনি তাই তােমরা পেরেছ। আমরা যা পারিনি তাই তােমরা করে দেখালে।
৪ এপ্রিল, ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭