You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে আরহাম সিদ্দিকী - সংগ্রামের নোটবুক

আরহাম সিদ্দিকী

আমি সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে পড়তাম। তাজউদ্দীন সাহেবও সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে পড়তেন। সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে সেই সময় প্রায় ৯৫ ভাগ হিন্দু ছাত্র ছিল। যেমন আমাদের ক্লাসে ১২৩ জন ছাত্রের মধ্যে আমরা ৪ জন মাত্র ছিলাম মুসলমান ছাত্র। মুসলমান ছাত্ররা সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে বেশি একটা পড়ত না। তাজউদ্দীন সাহেব খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। আমিও খুব ভাল ছাত্র ছিলাম। তিনি ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করে বেরিয়ে যান। আমি ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করি। সেই হিসেবে তাঁর সাথে আমার ব্যবধান তিন বছরের। স্কুলে থাকার সময়ে তিনি আমাকে প্রায়ই ডেকে নিতেন এবং লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতেন। তখন আমাদের সম্পর্কটা দু’জনের পরিচয় জানা এবং কুশল বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে আমি জানতাম, তিনি তখন থেকেই রাজনীতি করেন। হিন্দু ছেলেরা ওই সময়টাতে খুব রাজনীতি করত। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে তিনি ম্যাট্রিক পাস করার আগে থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত, সে জন্য আমি তাকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতাম।

তাঁর সম্পর্কে আরও শুনতাম যে, তিনি উচ্চ পর্যায়ের ছাত্রদের সঙ্গে রাজনীতি করেন। তারপর কয়েক বছর তাঁর সাথে হঠাৎ দু-একবার দেখা হওয়া ছাড়া আর কোন যােগাযােগ হয়নি। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ছি তখন তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। রাজনীতির জন্য তাঁর ধারাবাহিক লেখাপড়ায় সাময়িক ছেদের কারণে আমরা দুজন তখন সহপাঠী । এইভাবে আবার কিছু জানাশােনা এবং যােগাযােগ। অনার্স ফাইনালের পর আবার কয়েক বছর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। এরপর লেখাপড়া শেষ করে আমি আইন ব্যবসা শুরু করলাম। সেখানে আব্দুল মােমিন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয়। এটা ১৯৫৮ সালের কথা। মােমিন সাহেবই আমাকে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে আবার নিয়ে গেলেন। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে দেখে বললেন, ‘আরহামকে নিয়ে এসেছেন, সে জমিদারের ছেলে, এত কষ্ট করে রাজনীতি করতে পারবে নাকি ? আমি বললাম, ‘আমি তাে এই পথের কিছু জানি না, তবে সঙ্গে থেকে দেখতে পারি পারব কিনা।’ তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে।’ এই আমার তার সাথে থেকে চলার শুরু।

মােমিন সাহেবের সঙ্গেও যেতাম, আবার মাঝে মাঝে আমি একাই চলে যেতাম। তাঁর কাছে বসতাম, জিজ্ঞাসা করতাম। এইভাবে মােটামুটি সবার সাথেই পরিচয় হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর সাথেও ভাল পরিচয় হয়ে গেল। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, “তুমি যদি রাজনীতি কর, তবে তাজউদ্দীনের সাথে থেকে দেখেশুনে কাজ করবে। তারপর তাে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেলাম। থানা কমিটির সভাপতি হলাম। পরবর্তীতে সেন্ট্রাল কমিটিরও সদস্য করে নেয়া হয় আমাকে। এইভাবে রাজনীতির মধ্য দিয়ে তার সাথে আমার সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল। তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি দেখেছি অত্যন্ত সৎ এবং আন্তরিক মানুষ হিসেবে। তিনি যে জিনিসটাকে বিশ্বাস করতেন সেটাকে খুব গভীরভাবেই বিশ্বাস করতেন। তিনি আমাদেরকে তাঁর মতের বিপক্ষে বলার জন্য আহ্বান জানাতেন। বলতেন, আমার বক্তব্যে একমত না হলে আপনাদের যা বলার আছে বলেন। যুক্তি দিয়ে যদি আমাকে বােঝাতে পারেন তা হলে মেনে নেব। আর যদি যুক্তিতর্কের পর বােঝা যায় আমার সিদ্ধান্তই ঠিক তাহলে যে পদ্ধতিতে আমি কাজটা করছি সেভাবেই আপনাদের মেনে নিতে হবে। তিনি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা বলতেন, যেটা আমাদের পক্ষে না মানা ছিল কঠিন। আমাদের চিন্তাধারাগুলােও প্রকাশ করার যথেষ্ট সুযােগ তিনি দিতেন। তবে রাজনীতিক হিসেবে তাে তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ এবং পরিষ্কার ধারণার মানুষ ছিলেন। কাজেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর কাছ থেকে আমি শিখতে চেষ্টা করতাম । তাঁকে উপদেশ বা পরামর্শ আমার খুব একটা দেয়া হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে আমি যখন মাঝে মাঝে তার কাছে আমার যুক্তি তুলে ধরতাম তখন তিনি ছােটখাট ত্রুটি শুধরে দিয়ে সেসব মেনে নিতেন। তাজউদ্দীন সাহেব ইংরেজিতে খুব সুন্দর লেখালেখি এবং খসড়া করতেন। আমারও ইংরেজিতে খুব ভাল দখল ছিল। তিনি সেটা জানতেন। সে কারণেই এবং কোন সমঝােতার মাধ্যমেও এই দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। একমাত্র সম্পূর্ণ আন্দোলন এবং যুক্তির ভেতর দিয়েই আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। এতে কে বাঁচবে, কে মরবে, কে কী করবে, সেসবও তিনি বলতেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হল, তখন, তাজউদ্দীন সাহেব বললেন যে, এখন ওদের ওপর একটা প্রচণ্ড চাপ প্রয়ােগ করা যেতে পারে, কিন্তু তারা আমাদের হাতে কোন কিছু তুলে দেবে না। তিনি আরও বললেন, ‘৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানে একে একে যে পটপরিবর্তন হয়েছে। সেখানে কিন্তু কোন অবস্থাতেই তারা কোন রকম সমঝােতা করেনি। আমাদের ব্যাপারে পশ্চিমের মনােভাব কোনদিনই সুখের ছিল না। এই অবস্থায় ওদের সাথে যদি স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আমাদের একটি সমঝােতা হয়, তবু তারা আমাদের হাতে সম্পূর্ণ শাসনভার তুলে দেবে না। এখানকার অর্থনৈতিক যে অবস্থা তাতে করে যতটুকু পর্যন্ত দেয়া সম্ভব, সেটাই তারা দেয়ার চেষ্টা করবে। সমতার কথা মুখে যতই বলুক, কার্যক্ষেত্রে সেটা তারা মানবে না। কিন্তু সেই সময়ে আমিসহ প্রায় সবারই ধারণা ছিল, নির্বাচন হয়েছে, এত বড় বিজয়, নিশ্চয় তারা আমাদের হাতে এখন ক্ষমতা দিয়ে দেবে। তারপর যখন এখানে কথাবার্তা হতে থাকল তখন আমার একটা ধারণা হয়েছিল যে, তাজউদ্দীন সাহেবের কথা বােধ হয় ততখানি সঠিক নয় । হয়ত কিছু ফলাফল হলেও হতে পারে। কিন্তু পরে গিয়ে দেখলাম তার কথাটাই ঠিক। আমার মনে একটা প্রশ্ন হত যে, এত জোর দিয়ে তিনি বলেন কীভাবে? তখনও তাে আমরা দুই দিক মিলে একই দেশ। সেই সময় স্বাধীন বাংলাদেশ হবে এরকম চিন্তা কোন অবস্থাতেই কোনভাবেই আমরা করিনি। অবশ্য তাজউদ্দীন সাহেবও দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে এইভাবে সরাসরি আমার কাছে খুব একটা খুলে বলেননি। তিনি এইভাবে বলতেন যে, স্বায়ত্তশাসন কতটুকু দেবে, আদৌ শাসনক্ষমতা দেবে কিনা সেটাই প্রশ্ন। তার ভেতরের ধারণা যে, ওরা কি এত সহজেই দিয়ে দেবে ? এই জায়গা থেকে এতকিছু খাচ্ছে, এতকিছু নিচ্ছে, সেটা কি মুখের কথাতেই দিয়ে দেবে ? এর পিছনে কিছু একটা ব্যাপার থাকতে পারে বলে আমার ধারণা। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, আমাদের আন্দোলন যখন চলছে তখন কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব এর পাশাপাশি দেশটার অর্থনীতি নিয়ে অনবরত চিন্তাভাবনা করছেন। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতির লক্ষ্যে এর সম্ভাবনা, সমস্যা এবং সাফল্য নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা এবং বিশ্লেষণ করতেন।

তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সমস্ত দেশের বিভিন্ন ধরনের লােকজনের আসা-যাওয়া ছিল তার কাছে। তাঁদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলােচনা করতেন তিনি। বিশেষভাবে আমাদেরকে বলতেন, শুধু স্বায়ত্তশাসন পেলেই বাঁচা যাবে না। স্বায়ত্তশাসন পেয়ে বাচার ব্যবস্থা করতে হবে। কিভাবে তা হবে, কিভাবে আমরা বেঁচে থাকবার মত গ্রহণযােগ্য পর্যায়ে নিজেদেরকে নিয়ে যেতে পারব সেই বিষয়ে তিনি তার মতামত দিতেন। তাজউদ্দীন সাহেব বলতেন, আমাদের দেশটা হল কৃষিভিত্তিক দেশ। আমাদের কৃষি থেকে যে জিনিসগুলাে হয় তা থেকেই যদি আয় এবং লাভটা না আসে তাহলে পূর্ব পাকিস্তান কোনক্রমেই আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে না। পাটকে কৃষি খাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বলে উল্লেখ করে তিনি বলতেন যে, পাটের পরিবর্তে যে সমস্ত সিনথেটিক এবং অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করা যায় সেগুলাের দিকে মানুষ যাতে আকৃষ্ট না হয় সে জন্য পাট খাতটার দিকে গভীর মনােযােগ দিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে একে পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা যদি না করতে পারি তা হলে ভারতে পাট উৎপাদন বাড়বে, আমাদের বাজার ছােট হয়ে যাবে; সাথে অন্যান্য দেশও যদি পাট উৎপাদন শুরু করে তাহলে আমাদের যে মনােপলি আছে তা নষ্ট হয়ে যাবে। মনােপলি না থাকলে, রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে অর্থনৈতিক উন্নতিটা কীভাবে হবে ? আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা না করতে পারলে ঘাটতি পােষাতে বাড়তি টাকা কোথায় পাব? শুধু ধারদেনা করলে তাে চলবে না, কারণ এক সময় তাে সেই ধারও মিটিয়ে ফেলতে হবে। না হলে তাে দেশের নীতি-আদর্শই থাকে। তিনি বলতেন, অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আমাদের চারপাশে যে দেশগুলাে আছে সেইসব দেশের সাথে যদি আমাদের বাণিজ্যটা বেশি হয় তাহলে আমাদের সুবিধাটা বেশি হবে। এই ক্ষেত্রে জিনিস আনা-নেয়ার খরচটা কম হলে পণ্যের দাম কম পড়বে, মানুষের টিকে থাকাটা সহজ হবে। যেমন কয়লা আমি ভারতের উপর রাগ করে বললাম যে, ভারতের কয়লা নেব না। রাগটা আমি হয়ত রাজনৈতিক কারণে করলাম, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে আমাদের রাগ করাটা চলে না। আমি অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোন দেশ থেকে যদি কয়লা আনতে চাই তবে সে ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণে যে পরিবহন খরচটা প্রয়ােজন শুধুমাত্র সেই পরিবহন খরচ দিয়েই তাে আশপাশের দেশ থেকে সম্পূর্ণ জিনিসটা নিয়ে আসতে পারি। যেখানে সুস্থভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকার অবস্থায় আমরা
নেই, সেখানে তাে আমাদের সব সময় চিন্তা করতে হবে কীভাবে আমরা এই অবস্থার উন্নতি ঘটাব, কীভাবে আমরা কম দামে জিনিস এনে তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে পারব। এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হবে। তিনি বলতেন, জমি সীমাবদ্ধ। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে স্বায়ত্তশাসনই আসুক বা যাই আসুক, অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে না।

আরও বলতেন, আমরা আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের একটা বাজার। ওরা যে জিনিসগুলাে তাদের শিল্প কারখানায় তৈরি করছে তা এখানে বিক্রি করছে। আমাদের এই দিকে শিল্প গড়বে মনে হয় না। কাজেই আমাদের হাতে যদি ক্ষমতা আসে তখন আমরা কী কী করব এবং অর্থনীতিকে সম্ভাবনাময় করতে যে সমস্ত জিনিস দরকার তারও একটা হিসাব রাখতে হবে। আমাদের এইদিকে প্রপার মানি-মার্কেট নেই। সেটাও থাকতে হবে। অর্থাৎ, তিনি অর্থনীতির প্রতিটি পয়েন্ট নিয়ে আলাপ করতেন। সব সময় বলতেন, অর্থনীতির দিকটা চিন্তা না করলে একটা দেশ বাঁচতে পারে না। তাজউদ্দীন সাহেব নিয়মিত অর্থনৈতিক জার্নাল, বই-পুস্তক পড়তেন। মাঝে মাঝে কোন জার্নাল পড়ে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে বলতেন, “এটা পড়ে আসবেন। এই বিষয়ের উপর আলােচনা করব।’ আবার হয়ত কখনও কোন আলাপ করছি, মুহুর্তেই টান দিয়ে কোন বই বা পত্রিকা নিয়ে এসে তা থেকে পড়ে শুনিয়ে বলতেন, ‘শুধু মুখে বললে হবে না, নিয়মের মধ্যে আছে কিনা তা জানতে হবে।’ বলতেন, এখানে পড়েন, দেখেন কী আছে। যারা একটু পড়াশােনায় আগ্রহী ছিলেন তাঁদেরকে তিনি পছন্দ করতেন। তাজউদ্দীন সাহেবের একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই ছিল দেশটা কিভাবে চলতে পারে। আর স্বাভাবিকভাবেই তার যে লেখাপড়া, গভীরতা, চিন্তাধারা তা আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করত।

আমি আমার মৃত্যু পর্যন্ত আর এমন মানুষ দেখব বলে মনে হয় না। ‘৭১ সালের মার্চে যখন অসহযােগ আন্দোলন শুরু হল তখন একটা সেল করা হল। কোন্ কোন্ সেক্টর কীভাবে কাজ করবে, কতটুকু করবে এই যে নির্দেশনাগুলাে সেই সেল থেকেই দেয়া হত। তাজউদ্দীন সাহেব এই সমস্ত নির্দেশনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমি ওই সময় দেখেছি দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি কীভাবে কাজগুলাে এগিয়ে নিচ্ছিলেন।
আর এদিকে যখন রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা চলছে, বাইরে থেকে আমরা মনে করছি অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে যখন আলাপ করেছি তিনি তখন বললেন, ‘আলাপ-আলােচনা চলছে, তবে আমার যেন মনে হচ্ছে তারা আন্তরিক নয়। মনে হয় না যে শুধু বললাম আর দিয়ে দিল, এমনটা করবে। আমার কেন জানি ধারণা যে ওরা আমাদেরকে ক্ষমতা দেবে।’ মার্চের ২০ তারিখের দিকে বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে বলেছিলেন, ঘটনা যদি অন্য দিকে মােড় নেয় তবে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবেন। আমি তখন তাঁকে বলেছিলাম, আমি কি সে রকম কোন জায়গার ব্যবস্থা করব?’ তিনি এতে সম্মতি জানিয়ে বলেছিলেন, ব্যবস্থা করতে পারেন।’ ২৫ তারিখ রাতে আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখনও তিনি বললেন চলে যাবেন। এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধুকে আমি জানালাম যে, তাঁর কথামত আমি একটি জায়গার ব্যবস্থা করেছি। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘মােমিন সাহেব বাইরে গেছেন। এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলে নেন। একটু পরেই মােমিন সাহেবের সঙ্গে কথা হল । তাঁকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু আপনার সাথে আমাকে আলাপ করতে বলেছেন। মােমিন সাহেব আমাকে বললেন, এ ব্যাপারে আপনার মাথা ঘামানাের প্রয়ােজন নাই। আপনার গাড়িতে আমাকে এক্ষুণি বাসায় পৌছে দিয়ে আপনি নিজের বাসায় চলে যান।’ মােমিন সাহেব আমাকে জিগাতলায় তার বােনের বাসায় যেতে বললেন। তার বােনের বাসায় গাড়ি থেকে তাঁকে নামতে দেখে আমি বললাম, এখানে নামছেন কেন?’ তিনি আমাকে বললেন, ‘আলাপের সময় নাই। আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান এবং গুলশানে আপনার নিজের বাড়িতে না থেকে শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। তখন আমি তাড়াতাড়ি গুলশান গিয়ে আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে পুরনাে ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে চলে গেলাম।

সেই রাতেই পাকিস্তানি আর্মির ক্র্যাকডাউন শুরু হল। পাকিস্তানি আর্মি ঢাকার অন্যান্য স্থানের মত নয়াবাজারেও আগুন লাগাল। বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে সব দেখলাম। পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে পালিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি করছি, এরই মধ্যে শুনলাম, তাজউদ্দীন সাহেব সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেছেন। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কোন উপায় ছিল না। ভাবলাম, এইভাবে না থেকে চেষ্টা করে দেখি কোথাও যাওয়া যায় কিনা। এরই মধ্যে আমি ১৭ এপ্রিল
তাজউদ্দীন সাহেবের বক্তৃতা রেডিওতে শুনলাম। ঠিক করলাম কুষ্টিয়া যাব। পথঘাট ঠিকমত জানা নেই, এক পর্যায়ে বগুড়া গেলাম। সেখান থেকে হিলি যাবার পথে দু-তিনজন এমপি-র সঙ্গে দেখা হল। সিরাজগঞ্জের এমপি আব্দুল মমিন তালুকদার, মানিকগঞ্জের সিদ্দিক আহমদ এবং আবুল খায়ের। আমরা একসাথে সীমান্ত অতিক্রম করি এবং কলকাতা যাই। সেখানে বেশ কয়েকদিন এখানে ওখানে থাকার পর তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হল। তিনি আমাকে কিছু কাজের দায়িত্ব দিলেন। ৮ থিয়েটার রােডে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। কিছুদিন পর আমাকে অন্য কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই দায়িত্ব নিয়ে আমি, গাজী গােলাম মােস্তফা এবং ময়েজউদ্দীন সাহেব আগরতলায় গেলাম। সেখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে ঢাকার আশপাশের কিছু লােকের থাকার ব্যবস্থা করলাম। এরা নিয়মিত খবর নিয়ে দেশের ভেতরে, বিশেষ করে ঢাকায় যেত। তাজউদ্দীন সাহেব যেভাবে নির্দেশ পাঠাতেন সেভাবেই কাজ হত। তিনি সবসময় আমাদেরকে একে অপরের সাথে সমন্বয় রেখে সহযােগিতার মাধ্যমে কাজ করতে বলতেন।

আগরতলার দায়িত্ব শেষ হলে আমি আবার সম্ভবত অক্টোবরনভেম্বরের দিকে কলকাতা ফিরে যাই। তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁকে এবং তাঁর কাজের ধরন দেখা ছিল আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। সে সময় তিনি এত বেশি একনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন যে নিজের চোখে দেখার পরও তা ছিল আমার চিন্তার অতীত। আমি তাকে এমনও দেখেছি যে, পরদিন খুব ভােরে কারাে সঙ্গে তিনি দেখা করবেন অথবা দেখা করতে যাবেন, তাই একমাত্র শার্টটি রাতে নিজে ধুয়ে বাথরুমে শুকাতে দিয়েছেন। আমি একবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাথরুমে ওটা কী ঝুলছে? তিনি বললেন, এটা ধুয়ে না শুকালে কাল কী পরে বাইরে যাব!’ তিনি প্রধানমন্ত্রী, অথচ তার একটিমাত্র কাপড়—এ কথাটি আগে তাে চিন্তা করিনি। আমার নিজের দুটি প্যান্ট ছিল, খুব ভাল না, তবুও তাে দুটো। আমি পরদিনই কাপড় কিনে তাঁর জন্য শার্ট-প্যান্ট বানিয়ে দিলাম। তাজউদ্দীন সাহেব কলকাতায় সরকারি কার্যক্রম চালাবার জন্য একটি পুরােপুরি সচিবালয়-ব্যবস্থা স্থাপন করে ফেলেছিলেন। ক্যাবিনেট, সংস্থাপন, অর্থ, ত্রাণ, স্বাস্থ্য প্রভৃতি আলাদা আলাদা বিভাগ। নিয়মমাফিকভাবে একটা দেশ চালাবার জন্য যা প্রয়ােজন তা হয়ত সেখানে ছিল না, কিন্তু যেটকুই ছিল সেটাকেই তিনি সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন ।
আর একটি ব্যাপার না বললেই নয়, সেটা হল, মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস তিনি পরিবারের সাথে বসবাস করেননি। এমনকি ছেলের কঠিন অসুখের সময় বাসায় যেতে অনুরােধ করলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি এইসব আলাপ করতে আসেন তাহলে তাে দেশ স্বাধীন করে ফিরে যাওয়ার দরকার নাই। সােহেলকে নিয়েই আমি থাকি, আমার জন্য এইখানে একটা বাড়িঘর করে এখানেই থাকার ব্যবস্থা করেন। ভারত যদি আপনাদেরকে রাখার জন্য রাজি থাকে তাহলে সেই সংস্থান করে এখানেই থাকেন। সােহেলের মত তাে কত ছেলে আমার চারদিকে। তাই এটা নিয়ে আমার সঙ্গে আলাদাভাবে আলাপ করার প্রয়ােজন নাই।’ এই কথাটা তিনি যখন আমাকে বলছেন, তখন ওই মুহূর্তে আমার শ্রদ্ধা কোন পর্যায়ে পৌছেছে বলতে পারি না। তার একনিষ্ঠতা আমি তাে দেখেছি। নিজের চোখে দেখেছি, কত রকমের প্রতিকূল অবস্থার ভেতরে থেকে তিনি সমস্ত বিষয়ের সমাধান করে যুদ্ধটাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন যে, আমরা স্বাধীনতা পেলাম, দেশে ফিরে আসবার সুযােগ পেলাম। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, হয়ত তাজউদ্দীন সাহেবের একনিষ্ঠতার কারণেই আমাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে ভারত মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে। না হয় আমাদের মধ্যে যে গােলমাল-কোন্দল ছিল তা যদি তুঙ্গে নিয়ে তােলা হত তাহলে ভারতই বা কী করত সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। দেশ স্বাধীন হবার দুই বছর দশ মাসের মাথায় হঠাৎ একদিন তাজউদ্দীন সাহেবকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হল। আমি এ খবর শােনার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাসায় গেলাম। অনেক লােকজন বাসায় ভর্তি। আমরা কয়েকজন তাকে উপরতলায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ব্যাপার, হঠাৎ এই ঘটনা? তিনি বললেন, এটা তাে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা। তিনি যখন খুশি তখন যে কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে পারেন এবং নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। আপনারা কেন আমাকে এই প্রশ্ন করছেন ? এটা প্রশ্ন করার মত কোন বিষয় না। মন্ত্রিসভার উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।’ তাজউদ্দীন সাহেবের কাছ থেকে এই কথা শুনে আমি এবং ময়েজউদ্দীন সাহেব সােজা বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, কী খবর?’ আমি বললাম, ‘তাজউদ্দীন সাহেবকে তাে আপনি আজকে পদত্যাগ করতে বলেছেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, হ্যা, ওকে সরিয়ে দিয়েছি, কী হয়েছে তাতে! চট্টগ্রামের নূরুল ইসলাম (সেই সময় মন্ত্রী) আমাকে বলেছে, তাজউদ্দীন নাকি একটা দূতাবাসে গিয়ে নানা ধরনের উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলেছে। আমি সাথে সাথে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু,
আপনি কি এটা যাচাই করেছেন? উনি বললেন, না, তা তাে করিনি। তারপর উনি আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন, কাঁদলেন কিছুক্ষণ। বললেন, ‘তাজউদ্দীনের সাথে আমার সম্পর্ক কী তােমরা তাে জান। নূরুল ইসলামের কাছ থেকে ওই কথা শােনার পর আমার একটা প্রতিক্রিয়া হল। যাই হােক, এটা তাে অল্প, কয়দিনের ব্যাপার, আমি অন্যভাবে চিন্তা করছি। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাজউদ্দীনের সাথে দেখা হয়েছে তােমার?’ বললাম, ‘পদত্যাগের পর আমি তার বাসায় গিয়েছিলাম।

তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, এটা তাে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, তিনি যে কোন সময় তার মন্ত্রিসভা বদলাতে পারেন, এখানে জিজ্ঞাসা করার তাে কিছু নাই।’ এটা শুনে বঙ্গবন্ধু মনে খুব কষ্ট পেলেন বলে মনে হল। এরপর আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কাছেও যেতাম, বঙ্গবন্ধুর কাছেও যেতাম। আমি দুই জায়গায় আসা-যাওয়া করতাম। একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম, তখন তাজউদ্দীন সাহেব তার নিজের বাড়িতে চলে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাজউদ্দীনের কাছে গিয়েছ?’ বললাম, না, গতকাল যাইনি।’ তখন তিনি আমাকে বললেন, আমি তাজউদ্দীনকে এখানে আসবার জন্য গাড়ি পাঠাতে চাচ্ছি। সে যেন আসে। তুই গিয়ে বলবি এই কথা। আমি তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় ঢুকতেই তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, কী ব্যাপার, বঙ্গবন্ধুর ওখান থেকে আসলেন নাকি?’ আমি বললাম, আপনাকে কি টেলিফোন করেছিল ? বললেন, না, আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে। আমি হেসে বলেছি, হ্যা, আমি বঙ্গবন্ধুর ওখান থেকে এসেছি।’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আমার সাথে কমপ্রােমাইজ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমার তাে মুজিব ভাইয়ের সাথে কোন ঝগড়া নাই, তবে কমপ্রােমাইজটা কিসের ? আপনারা এইসব কী করছেন? তাঁর সাথে আমার যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক আছে। লােকজন গিয়ে মিথ্যা কথা বলে এইসব অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আমি বললাম, আমি কিছু বুঝি না, আমাকে বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে, কালকে গাড়ি পাঠাবেন। তাে আপনি যাবেন।’ তিনি বললেন, ‘গাড়ি পাঠালে যাব কেন, নিশ্চয়ই যাব।’ একদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে, তাজউদ্দীনকে আমি আমার প্রধান উপদেষ্টা বানাব এবং ওর মর্যাদা কোন অংশেই প্রধানমন্ত্রীর চাইতে কম হবে না।’ আমি আওয়ামী লীগে যােগ দেয়ার পর থেকে সবসময় দেখেছি বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন সাহেবকে যথেষ্ট ভালবাসতেন এবং তাজউদ্দীন সাহেবও পাল্টা তার ভাবমূর্তি কত গুণ বড় করা যায় এটা সবসময় চিন্তার মধ্যে রাখতেন।

কোন জিনিসটা করলে বঙ্গবন্ধুর ভাল হবে কোনটা করলে ভাল হবে না এই চিন্তাটা তার মধ্যে সবসময় থাকত। বঙ্গবন্ধুর দিক থেকে কোন কিছু ভুল হলে তাজউদ্দীন সাহেব কিন্তু চুপ করে থাকতেন না, বলতেন এটা ভুল হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে তিনি নির্ভুল, নির্মল রাখতে চাইতেন। বঙ্গবন্ধুকে ফোকাস করে যত উপরে দেয়া যায় এই চেষ্টাই ছিল তাজউদ্দীন সাহেবের সবসময়। কাজেই তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর যে একটা দূরত্ব হবে বা হতে পারে এটা আমি কোন সময়ই চোখের সামনে ভাসাতে পারি না। আমার দুজনের কাছেই আসা-যাওয়া ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই একটু একটু করে এই দূরত্বটাকে অনুভব করতে পারতাম। যতদূর মনে হয়, এই দুজনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব কেউ তৈরি করেছে। এমন সূক্ষ্মভাবে তৈরি করেছে যে, যেন সন্দেহ না হয়। আর তাজউদ্দীন সাহেব ততা মন্ত্রিসভা থেকে চলে যাবার পর কিছু বলতেনই না। শুধু বলতেন, ‘না, ঠিক আছে, আমি তাে এমপি আছিই।’ ‘৭৫-এর জানুয়ারি মাসে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। এই পদ্ধতির বিষয়ে দলে যথেষ্ট মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একটা কথা বললে দলের আমরা সবাই সেই কথাটি ঠিক আছে বলে মেনে নিতাম। আমাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে বড়ভাবে সামনে রেখে কাজ করবার প্রবণতা ছিল। সেই জন্য আমরা সংসদীয় পদ্ধতি করি বা যাই করি, বঙ্গবন্ধু সর্বশেষ যা বলতেন আমরা তা মেনে নিতাম। এটাই ছিল আমাদের সবার কাছে গণতন্ত্র। তেমন তাে কেউ ছিল না যে তাকে সামনাসামনি কিছু বলতে পারে। দলের মধ্যে থেকে দু-চারজন সরাসরিবলে ঘুরিয়েটুরিয়ে একটু-আধটু যা বলত। যদি এই সময়টাতে তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকতেন তাহলে হয়ত বলতেন। কারণ তাকে বঙ্গবন্ধু অ্যালাউ করতেন এই ধরনের কথা বলতে। তবে অন্যরা এই বিষয়ে কিছু বলেছে কিনা আমি জানি না। তারপর তাে বাকশাল হল। তাজউদ্দীন সাহেবের ধারণা ছিল, পরিকল্পিত অর্থনীতি বাকশালের মধ্য দিয়ে সম্ভব, কিন্তু প্রিম্যাচিউর জিনিস দিয়ে কিছু করা যাবে না। মানুষ তাে শিক্ষিত বা তৈরিই হয়নি ওই কাজের জন্য। সেই প্রস্তুতি বা শিক্ষাটাই যদি ভিত্তিতে না থাকে, তাহলে হঠাৎ করে কিছু করা যাবে না, চাপিয়ে দিয়ে কোন জিনিস হবে, হতে পারে না। যেমন, মােহাম্মদ তুঘলক তামার নােট প্রচলন করেছিল। দ্যাট ওয়াজ টু আরলি, তামার নােট ওই সময়ে চলেনি। এটাও একই অবস্থা বলে আমি পরিষ্কার মনে করি। তিনি বলতেন, যারা এটা করবে তারা যদি কঠোর রাজনৈতিক শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী না হয় তবে এই পদ্ধতির ভুল ব্যবহার করবে। এর ফলে আপনি যা যা করবেন ব্যুরােক্রেটরা দেখিয়ে দেবে কোনটাই কৃতকার্য হয়নি। আর বর্তমান বাংলাদেশে আমরা যে অবস্থায় আছি এটা কিছুতেই সেই কাজের জন্য উপযুক্ত সময় নয়। আমাদের দেশে তাে চতুর লােকের অভাব নেই, কাজেই যারা সমস্ত জীবন ত্যাগস্বীকার করেছে তাদেরকে পেছনে ঠেলে ওইসব লােক সামনে আসছে। এরা শুধু বাহবাই দেয় এবং এরাই সবচাইতে বেশি স্যাবােটাজ করে। এর মধ্যে টিকে থাকা যাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। আমরা কর্মীদেরকে আন্দোলন করা শিখিয়েছি, দেশ গড়ার কাজ কীভাবে করতে হবে তা। শেখাইনি। তার মধ্যে সামনে চলে আসছে নতুন পদ্ধতি, কাজেই মনে একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে যে আলাপ-আলােচনা আমার হয়েছে তাতে কিন্তু তিনি কোনদিনই পাল্টা কোন দল করা সঠিক বলেই মনে করতেন না। তিনি সিস্টেমে বিশ্বাস করতেন। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি একদম গােড়া থেকে কাজ করে এসেছেন। এর প্রতি তাঁর যে দরদ ছিল, সেটা তিনি কোন সময়ই নষ্ট করতে চাননি। আর বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে যা বলেছেন সেটা হল যে, বঙ্গবন্ধু একটা বিপদসঙ্কুল অর্থনীতির উপর এসে বসেছেন। আমি নেই বলে কি হয়েছে, তাকে একটা কাজ করার সুযােগ তাে দেবেন আপনারা! আগেই যদি এত কথা বলা শুরু করেন তাহলে একটা মানুষ কাজ করবে কীভাবে ? আমি আছি, আমি নেই। আবার এক সময় আসতে পারি বা নাও আসতে পারি। জিনিসটা তাে ব্যক্তিবিশেষের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বঙ্গবন্ধুকে অন্তত হাত খুলে কাজ করার সুযােগটা তাে আপনারা দিন—এই কথাগুলাে তাজউদ্দীন সাহেব সবসময় সবার কাছেই বেশ জোরে জোরেই বলেছেন। তা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন সাহেব নতুন দল করবেন এরকম রটনা কেউ কেউ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুও সে রটনা হয়ত বিশ্বাস করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমি নিজেও বলেছি যে, আপনার কাছে যে যাই বলুক, তিনি নতুন দল করবেন।। তিনি কিন্তু কখনই আপনার বিরুদ্ধে কোন দল করা বা এমন চিন্তা কোন দিনও করেননি এবং কোন সময়ই করবেন না।’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কেন বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল সম্পর্কে কিছু বলেন না?’ তখন তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু যেহেতু এটা করে ফেলেছেন, তাই এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে গেলে আমাকে ভুল বুঝবেন। আর যারা বঙ্গবন্ধুকেবুঝিয়েছে তাজউদ্দীন আপনার বিরুদ্ধে, তারা তখন আমার কথাকে প্রমাণ হিসেবে দেখিয়ে বলবে যে, এই দেখেন আপনাকে না করছে। তাই এই সময়ে চুপ থাকাটাই ভাল। মুজিব ভাই যদি আমার প্রয়ােজন অনুভব করেন, যদি আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, তখন আমি আমার ধারণার কথা বলব। আমি যা বিশ্বাস করি তাই সবসময় বলি । চাটুকারিতা অথবা মিথ্যা আমি বলি না, এটা মুজিব ভাই নিজে খুব ভাল করে জানেন। এখন তাে সবকিছু একটা তুঙ্গে আছে। বাকশাল নিয়ে একটা হৈচৈ। তাই বাকশাল নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না। তবে বাকশাল করার জন্য যে অবস্থার দরকার সে অবস্থা এখন আমি সামনে দেখছি না। এবং এর ওপর অনশ্লট হয়ত কোন না কোন সময় আসতে পারে। কারণ বর্তমান অবস্থায় এই পদ্ধতিটা অনেকেই পছন্দ করবে না।’ আমার বন্ধু সাভারের আনােয়ার জং তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে ১৫ অগাস্টের পর জেলে এক রুমে ছিল। আনােয়ার জং আমাকে বলেছিল, তাজউদ্দীন সাহেব জেলখানায় দুঃখ করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে এইসব লােক হত্যা করল, কিন্তু তিনি কোনদিনই জানতে পারলেন না যে তাজউদ্দীন এর মধ্যে নেই। তাঁর প্ল্যাটফর্মের ওপরে দাঁড়িয়ে আমাকেও হয়ত একসময় জীবনটাও দিতে হবে। কিন্তু তিনি সেই জিনিসটা জেনে যেতে পারলেন না। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, বিশ্বাসঘাতকতা করল খন্দকার মােশতাক!’ জেল হত্যাকাণ্ডের পর আমি অনেককে বলেছি, এত ভাল কাজ করবার পর ফলাফল কেন এমন হয়, এত কষ্ট এত ত্যাগ স্বীকারের পর তাজউদ্দীন সাহেবের কেন এই পরিণতি? এই মানুষটিকে আমি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। তার মত সৎ, বিশ্বস্ত, উঁচুমনের মানুষ এই জগতে বিরল।

[৬.১০.১৯৯০]

 

আরহাম সিদ্দিকী – রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী

সূত্র – তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা