ফররুখ ভাই – কামরুল হাসান
আজ কবি ফররুখ আহমদ নাই। প্রায় সকলের চক্ষুর অন্তরালে থেকেই তিনি চির অমরত্বের লীলাভূমিতে চলে গেলেন, চলে গেলেন বিনা নোটিশেই। কবি ফররুখ আহমদ বাংলাদেশের সাহিত্যিক জগতে যেমন ছিলেন একক এবং তেমনি ছিলেন বিতর্কের উজানে শত পেশীবহুল বৈঠা নিয়ে যাওয়ার নাইয়া।
ফররুখ আহমদ এর সাহিত্য আলোচনা বা তার বিতর্কিত আদর্শ দর্শনের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা আমার উপপাদ্য নয়।
আমার লেখার বিষয় যে ব্যাপ্তিকে নিয়ে তিনি কবি ফররুখ আহমদ নয়। আমার ফররুখ ভাই। এখানে আমার বলার পিছনে কারণ আছে, কারণ ফররুখ আহমদ তার অনুজ সকলেরই ফররুখ ভাই ছিলেন কিন্তু তা সাহিত্যিক শিল্পী সমাজের মাঝের মানুষদের।
কিন্তু কবি ফররুখ আহমদ যখন থেকে আমার ফররুখ ভাই তখন তিনিও কবি খ্যাতি লাভ করেননি। কেবল খ্যাতি লাভ করাই নয় বরং তখন তার লেখায় মকস চলছে। এবং আমিও তখন শিল্পী খ্যাতি লাভ তো দূরের, ক্লাশে ড্রইং পরিক্ষায় সবচেয়ে বেশী নাম্বার পাওয়ার প্রতিযোগিতার মাঝেই আমার বিচরণ ক্ষেত্র। এমনি সময় এবং বয়সেই আমি পেয়েছিলাম ফররুখ ভাইকে। সে ১৯৩০ সালের কথা আমি তখন শিশু ক্লাসে ভর্তি হলাম যে স্কুলে সেটি সে সময়ের বাংলাদেশের অন্যতম এম-ই স্কুলের মধ্যে একটি। কলকাতার তালতলা এলাকার ইউরোপীয়ান এ্যাসাইলাম লেন এ এই স্কুল অবস্থিত ছিল, মডেল এম-ই স্কুল নামে এক ডাকে সকলেই জানতো, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মডেল স্কুল স্কীম এর সেটাই ছিল শেষ সরকারী স্কুল।
বিরাট এক পুরাতন জমীদার বাড়ি নিয়ে এই স্কুল। একই বাড়িতেই ছিলো নর্মাল ট্রেইনিং স্কুল। নর্মাল ট্রেনিং এ যারা আসতেন তারা তিন বছরের জন্য আসতেন এবং বোর্ডিং ও ছিল ঐ একই বাড়িতেই তাও হিন্দু এবং মুসলমান ছাত্রদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। তার মধ্যেই ফুটবল এবং বাস্কেট বল খেলায় মাঠ এবং তা পুরা সিমেন্ট এর।
নর্মাল ট্রেনিং এর শিক্ষার্থিরা যেহেতু স্কুল সংলগ্ন বডিং এ থাকতেন এবং যেহেতু তারা মাঝে মাঝে তাদের প্রেকটিস টিচিং এ আমাদেরকে পড়াতেন সেহেতু আমরা তাদেরকে বলতাম বোডিং স্যার। সোজা হিসাবে আর কি! যারা পড়াবেন তাদেরকে স্যার বলতে হবে। অতএব তারা বোডিং এ থেকে পড়াতে আসেন অতএব তারা হয়ে গেলেন বোডিং এর স্যার। কবি ফররুখ আহমদ এর ব্যক্তিগত সম্পর্কে যখন থেকে এসেছি তখনকার কথা বলতে গেলে এই মডেল এম ই স্কুলের কথা বলা আমার কেবল ইতিহাস রচনা বা কেবন স্মৃতিচারণই নয় বরং ফররুখ ভাই আমার সাথে দেখা হলেই মডেল স্কুলের গল্প করতেন এবং সে যে কি অভিব্যক্তি ও অনুভূতি এবং হৃদয়ের কি আবেগ নিয়ে বলতেন তা ভাষায় প্রকাশ করা আজ সম্ভব না। তবুও আমাকে লিখতে হচ্ছে এই জন্য যে, ফররুখ ভাই বারবার আমাকে বলতেন মডেল স্কুল নিয়ে লেখো। অমন স্কুল আর হয় না। তাই তার আদেশ পালন করছি।
রবীন্দ্রনাথ একটিই স্কুলে ছেলে বেলায় কয়েক দিনের জন্য গিয়েছিলেন এবং ঐ মডেল স্কুলেই এ কথা আমরা জানতে পারি। ঐ স্কুলের ছাত্র থাকতেই কারণ ঐ স্কুলে ক্লাসে কাঠের গ্যালারি ছিল। স্লোপিং গ্যালারী। একবার কথা উঠেছিল, সরকার ঐ গ্যালারী নিলাম করে দেবেন। তারপর প্রতিবাদ প্রচারে আমরা জানতে পারি এই গ্যালারিতেই বসে যেহেতু রবিন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় পা ঝুলিয়ে এবং দুলিয়ে বসে বসে পড়ে গেছেন। এবং ঐখানেই বসে বোধ হয় তার প্রথম কবিতা লেখা। এতা আমার অবশ্য তখন শিক্ষকদের কাছে শোনা সত্যাসত্য জানিনা। তবে রবীন্দ্রনাথ যে ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন এবং ঐ গ্যালারীতে বসে গিয়েছেন এই বিষয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ ছিল না। কারণ তখনকার মত সেই গ্যালারী নিলামে হয় নাই।
মরহুম এটি এম মস্তোফা, জনাব আবুল খয়ের, প্রাক্তন সচিব, বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প বিভাগের বর্তমান যুগ্ন সচিব জনাব নুরুজ্জামান, কবি হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের প্রত্নতাত্বিক বিভাগের ডাইরেক্টর ডঃ নাজিম উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কবির সাহেব, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার, খুলনা টিসার্স ট্রেনিং এর অধ্যক্ষ জনাব আবুল হাসেম প্রমুখ এরা সকলেই সেই মডেল এম ই স্কুলের ছাত্র। আমার বড় ভাই জনাব আবুল হাসনাত প্রথমেই ঐ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন প্রায় ৪ বছর পূর্বে। আমি ঢুকলাম ১৯৩১ সালে সে সময়ে কেজি ক্লাস বলে কিছুই ছিল না। তার জায়গায় বলা হতো ইনফ্যান্ট ক্লাস। সেই বাচ্চা বয়সেই সাথী হিসাবে পেলাম ফররুখ আহমদ ভাইয়ের ছোট ভাই মনীর আহমেদকে। সে আর একটি চরিত্র। শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রোনাথ চরিত্রের জীবন্ত সংস্করণ। ফররুখ ভাইয়ের মতই একরোখা, তবে লেখাপড়া কিছুই করেননি। ঐ মডেল স্কুল পর্যন্তই ইতি। কিন্তু কেন জানি না আমার সংগ সে ছাড়ে নি। কলকাতার আর্ট স্কুলেও আমার পিছু পিছু ১ বছর পরে ভর্তি হয়েছিলেন। মাত্র ১ বছরই ছিলেন।
পরবর্তিকালে ঢাকা কলা ভবনে মডেল হিসাবে বহুদিন লাইভ ক্লাসে সিটিং দিয়েছিল। মুনির আমার সহপাঠী এবং আমার বড় ভাই ফররুখ ভাইয়ের স্কুল সহপাঠি। অতএব খুব সোজা পথেই অগ্রজ ও অনুজের সম্পর্ক গরে উঠল। আমাদের স্কুলের বকুল তলায় আমি আর মুনির গুলি খেলছি। ফররুখ ভাই এসে বললেন, কিরে তুই নাকি হাসনাতের ভাই, মুখ তুলে বললাম হ্যা। সেই থেকে ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত তুই সম্বন্ধেই স্নেহের ডাক দিয়ে গেছেন। ফররুখ ভাইরা তিন ভাই ছিলেন, তার বড় ভাই সিদ্দিক আহমেদ। তিনি আজোও ফরিদপুরে বসবাস করছেন। সিদ্দিক ভাইয়ের ছেলে শহীদ সুফি। মনেম বিরোধী আন্দোলনে ১৯৬৭ সালে সে নিহত হয়। তার স্মৃতিস্তম্ভ আজ ফরিদপুর শহরে রয়েছে। ফররুখ ভাই ছিলেন ইসলাম এবং শরীয়তের গোরা অনুসারী এবং এতো গোড়া এবং অন্ধ যে তা আমৃত্যু তিনি তাকে যুক্তি তর্কের বাইরেই রেখে গেলেন। তিনি পাকিস্তানী আদর্শের একজন পর্বত কঠীন স্তম্ভ। কিন্তু তাও তার আপন দর্শনে রচিত পর্বত যে পর্বতের ধারে কাছে পাকিস্তানের কোন জাদরেল শাসকই ঘেষতে পারে নি।
আপন বিবেকের দিকে দৃষ্টি রেখে বলতেই হবে আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তান আমলের বহু কিছু আমরা মেনে নিয়ে ছিলাম, আমরা যারা ১৯৭১ সালের সংগ্রামে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলাম তাদের বহু সংখ্যক মহারথীই পশ্চিম পাকিস্তান বহুবার পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে ঘরে এসেছিলাম কিন্তু নীতির যুদ্ধে যে লোকটিকে আমরা চিরকাল শত্রু শিবিরের লোক বলেই চিহ্নিত করে এলাম সেই ফররুখ ভাইকে গত তেইশ বছরের পাকিস্তানে একটি দিনের জন্যও পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারেনি। এটা আপনাদের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তব ঘটন এবং পর্বত শিখরের মতই – এমনি নিজের একান্ত নিজের মতবাদে অটল ছিলেন ফররুখ ভাই। পরম বেদনা এবং অসহনীয় যন্ত্রণার ব্যাপারে এই বাঙ্গালাদেশের এতবড় একজন আদর্শের পর্বত বাংলার সাধারণ মানুষের চোখের আড়াল করে রেখেছিল ফররুখ ভাইয়ের ধর্ম এবং শরিয়ত। পাকা সেগুন কাঠকেও যেমন ভিতরে ভিতরে উইয়ে কেটে দেয় ফররুখ ভাইকেও তেমনি তাঁর ধর্মান্ধতার উই এ খেয়ে শেষ করে ফেলল। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। আকস্মাত ঘর ভেঙ্গে পড়লে দেখা যায় সকলের অলখ্যে ঘরের খুটিতে উই এর বাসা বেঁধেছিল, ফররুখ ভাই যেন ঠিক তেমনি ভাবেই আমাদের সামনে থেকেই ভেঙ্গে পরলেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র আধ ঘণ্টা আগে আমি তাঁর ফ্লাটের নীচের ফ্লাটে গায়ক আবদুল লতিফের বাসায় গিয়ে শুনলাম আজ চারদিন ফররুখ ভাই এর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। আমি প্রায় প্রতিদিনেরই লতিফ এর বাসার এক জন আড্ডাধারী মানুস, লতিফের স্ত্রী আমার মামাতো বোন সেই সুবাদেই ফররুখ ভাইয়েরও যে বোন এবং লতিফ আমারই মত আগ্রজ প্রতিম। লতিফ তখন শিল্পী গিয়েছিলো। আশ্চর্য আমি কাজের ব্যস্ততার জন্য গত এক সপ্তাহ লতিফের বাসায় যেতে পারিনি। লতিফের স্ত্রী আমাকে একবার অনুরোধ করলে ফররুখ ভাইকে দেখতে যাওয়ার জন্য। খুব চিন্তায় পড়লাম। আমি ফররুখ ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, তিনি আমাকে দেখতে পাবেন অথচ কথা বলতে পারবেন না এ যন্ত্রণা তাঁর এবং আমার দুজনেরই। বললাম, কাল সকালে অবস্থা বুঝে আসবো। বাড়ি ফিরে জামা – কাপড় ছেড়েছি মাত্র, লতিফের ছেলে এসে সংবাদ দিল। সেই সংবাদই রাত্রের বেতারে এবং টেলিভিশনে প্রচারিত হল, কবি ফররুখ আহমেদ ইন্দেকাল করেছেন। আমাদের তথাকথিত আদর্শের বিপরীতে তারের বিরাট বট গাছটা গোড়া উপড়ে পড়ে গেল। ফররুখ ভাই তাঁর আদর্শ না একগুয়োমি জানি না, যার জন্য মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মানুস হিসাবে সকলের ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই চলে গেলেন। অথচ ফররুখ ভাই ছিলেন সত্যিকারের নিপীড়িত আদম সন্তান্দেরই অতি আপনজন না হলে সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই একজন বৃটিশ সরকারের সনদ পাওয়া পুলিশ অফিসার এবং সৈয়দ পুত্র নিজের নামের আগে সৈয়দ লেখা ত্যাগ করেছিলেন। কারণ নির্দেশে নয়, কোন প্রভাবশালী নেতার ভয়েও নয়। হঠাত এক সময়ে আমরা দেখলাম ফররুখ ভাই আর সৈয়দ লেখেন না। প্রশ্ন করলাম একদিন। ফররুখ ভাই এর ভাষাতেই বলি, তিনি উত্তর দিলেন, অনেক ভেবে দেখলাম ও শালার সৈয়দের গুস্টির মধ্যে থাকলে সত্যিকারের মানুসের গুষ্ঠির বাইরেই থাকতে হবে আমাকে তোরা কি মনে করিস? ও শালার ফালতু ল্যাজটা কেটে বাদ দিয়ে দিলাম।
ফররুখ ভাই এর আব্বা ছিলেন পুলিশ অফসার এবং খান সাহেব বা খান বাহাদুর ঠিক আমার স্মরণে নেই, সনদ পেয়েছিলেন। তারা তখন থাকতেন পার্ক সার্কাসের ছয় নম্বর সার্কাস বাসাতে। এক দিন দেখা গেল ফররুখ ভাইয়ের আব্বার সনদ, যেটা ঘরের দেয়ালে অতি সমাদরের সাথে কাচের ফ্রেমে ঝুলছিলে। সেটা সার্কাস রোর কালো পীচ ঢালা রাস্তায় ছিটকে পড়ল, ফররুখ ভাইয়ের কীর্তি। এ নিয়ে বহু কাণ্ড নাকি হয়েছিল। ফররুখ ভাইরা ছেলেবেলাতেই মাকে হারিয়েছিলেন। তাদের বাড়িতে আর কোন দ্বিতীয় রমণীর অস্তিত্ব ছিলো না বলেই আমি জানি। এ নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে। ফররুখ ভাইয়ের ছোট ভাই মুনির, স্বাভাবিকভাবেই মাতৃস্নেহ বঞ্চিত কিশোর বালকের মতই থাকে। এক দিন আমাদের ক্লাস টিচার মুনিরের শার্টের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, কি ব্যাপার তোমার জামায় বোতাম নেই কেন, বাড়িতে কি কোন মেয়েছেলে নেই যিনি বোতামগুলো ঢেকে দেবেন। মুনিরের পত্রপাঠ উত্তর দান – না স্যার কেউ নেই, একটা বেড়াল আছে সেটাও আবার হুলো, এ রসিকতা নির্ঘাত ফররুখ ভাইয়ের অবদান। ফররুখ ভাই এবং মুনির দুজনেই অসম্ভব রকম বেড়াল প্রিয় ছিলেন।
নাসির আলীর কি কম? বিক এ রসিকতা ফররুখ ভাইয়ের কতদিন কত রকম ভাবে যে উপভোগ করেছি তাঁর লেখাজোখা নাই। ফররুখ ভাইয়ের কথা গুছিয়ে লেখা যায় না। আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন যে আমি চিত্ত এবং ব্যায়াম চর্চা এক সাথেই চালিয়েছি এককালে । সেটাও কিন্তু ফররুখ ভাইয়ের কাল। আপনারা আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, ফররুখ ভাই কেবল আমাকেই উৎসাহ দিতেন না। তিনি সত্যিই ছিলেন মাটির মানুষদের কাছালাছি। কলকাতার যারা পুরাতন বাসিন্দা তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন, লোয়ার সার্কুলার রোড এবং পার্ক স্ট্রীটের চৌমাথা থেকে একটু দক্ষিণ দিকে এগিয়েই ডান হাতের ফুটপাতের ওপর ঘাসের বেড়া এবং টিনের চালা দিয়ে গড়ে উঠেছিলো, কড়েয়া এ্যামাচার জিমনাস্টিক ক্লাব। জনাব আলী নামে একজন আধা বয়েসী লোকের পরিচালনায় এই ব্যায়ামশালা চলত। বস্তির একটা অন্ধকার ঘর থেকে বড় রাস্তার ওপর এই ক্লাবকে আনতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল এবং এর পিছনে সবটাই ছিলো ফররুখ ভাইয়ের দান। কড়েয়া এ্যামেচার জিমনাস্টিক ক্লাবের অধিকাংশ সদস্যই ছিলো গরীব মুসলমান। কেউ পার্ক শো হাইস সিনেমা হলের গেট কিপার, কেউ আজাদ অফিসের দারোয়ান। এরা অদম্য উৎসাহ নিয়ে ব্যায়াম করত। অথচ সেই অনুপাতে এদের খাবার জুটত না। দু’ ছটক দুধ বা ছোলা খাবারও পয়সা জুটত না। দিস্তা দিস্তা দাল পুরী আর চা। অপর দিকে কলকাতার অন্যান্য ব্যায়াম শালায় বিরলা পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিদিন এক মন করে দুধ সরবরাহ করা হত। অথচ ২৮/৩৯ সালে দেখা গেল এই কডেয়ার গরীব ছেলেরাই নিখিল ভারত প্রতিযোগীতায় বেশিরভাগ শীর্ষ স্থান গুলো দখল করে নিয়েছে। এফ আহমদ নাম দিয়ে ফররুখ ভাই – ই এদের ওপর সচিত্র প্রবন্ধ মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ছিলো জনতার ফররুখ ভাই।
ফররুখ ভাইরা কলকাতার শহরতলা যাদব পুরে বাড়ি করেছিলেন। ছয়াঢাকা, পাখীডাকা, প্রাণ জুড়ানো গরম তখন আজকের যাদবপুর। একতলা একটি ছবির মত বাড়ি। বাড়ির নাম আলোক পুরী, নামকরণ কার তা প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন। এ বাড়ির সামনের আম গাছের নীচে সেগুন কাঠের তৈরি পারুল্লালবার। মনির ব্যায়াম করবে। আমি গেলেও যেন অসুবিধা না হয়। এই ছিলেন সনেট লেখার ফররুখ আহমদ। আলোক পুরীর বাসিন্দাদের পোষাক তখন ছিলো শান্তীপুরি খ্যাত এওং ফিনফিনে পাঞ্জাবী কিংবা সিল্ক টাইলের ফুলহাতা শার্ট।
ফররুখ ভাইয়ের সেই তারুণ্যের জ্যোতি আজও আমার চোখে ভাসছে। যেন দাড়ি পাল্লায় ওজন করা সমস্ত শরীরটা। পৌরুষের জৌলুস শুধু চোখে মুখেই নয়, বুকের ছাতিতেই না, সারা অঙ্গ জুরে। ফররুখ ভাই তখন কবি হচ্ছেন, নানা জনের মুখে আমরা দুই কিশোর শুনি, আমি অর মুনির। কলেজে নাকি অধ্যাপক দের সাথে বাংলা সাহিত্য নিয়ে লড়াই চলছে। ১৯৩৫/৩৬ এর কথা। হাশেম ভাই, বরতমানে যিনি খুলনা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ্য, তিনি তখন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। অভিযান নাম দিয়ে একটি হাতে লেখা পত্রিকা তিনি বের করতেন প্রতি মাসে। মডেল স্কুলে দু জনবে সহ পাঠি ছিলেন। ফররুখ ভাই আর হাশম ভাই। কবি হাবীবর রহমানের সনেট লেখাও বোধ হয় ফররুখ ভাইয়েরই প্রভাব। ত্রিশ দশকের শেষের দিকে ভারতের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আরম্ভ। ফররুখ ভাই পালটে গেলেন। ভেতরকার সব। পায়জামা – পাঞ্জাবী, আর লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। কিন্তু ফররুখ ভাই ছিলেন মার্ক্স পন্থী। অনেকে বিশ্বাস করেন না। সে বোধ হয় ১৯৩৫ সালের কথা। তখনও স্বদেশী অন্দোলনের রেশ। আমরা কেবল এটা ওটা শুনি আর থ্রিল অনুভব করি। এমনি একদিন মুনির সন্ধ্যাবেলা আমাদের বেনে পুকুরের বাড়িতে এসে, যেন সাংঘাতিক একটা ঘটনা এমনি ভাব নিয়ে অতি গোপনে আমাকে ডেকে বললে, ‘জানিস, ফররুখ কম্যুনিস্ট হয়ে গেছে’। কোণ মতেই আমাদের উপলব্ধি করার বয়স সেটা নয়, তবে ব্যাপার বেশ ঘোরতর সেটা বুঝলাম। পুলিশের বাড়ির ছেলে বলেছে। নিশ্চয়ই কিছু শুনে বা কোন ঘটনা দেখে এসেই মুনির আমাকে বলেছিল। সেই ফররুখ ভাই অন্য মানুস হয়ে গেল।
পাকিস্তান হবে হবে পরিস্থিতি। কিশোর আন্দোলন হিসেবে মুকুল ফৌজ তখন মুসলমান সমাজের মূলে আসন গেড়ে বসেছে। পরিচালনা করি আমি, আজাদের মুকুলের মহফিলের সভ্য সভ্যাদের নিয়েই মুকুল ফৌজ। মহফিলের পরিচালক মোদাব্বের ভাই, বাগবান নামে চিঠি লেখেন এবং সাহিত্য বিভাগ দেখাশোনা করেন। কিন্তু ফৌজের সর্বাধিনায়ক আমি। নতুন গান চাই, একেকবারে নতুন। ফররুখ ভাই আমার ভরসা। সে আমলে দুটি গান সামনে চল সামনে চল এবং ওড়াও ওড়াও ওড়াও। সে সময় মুসলিম লীগের মত মুকুল ফৌজকে অনেকে পুরোপুরি ধর্মের খাচার মধ্যে পুরে ফেলতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তখনকার মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড আমাদের বীরুধে জঘন্য পার্ক সার্কাস ময়দানে মুকুল ফৌজের ওপর মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সদস্যরা হামলাও করে। ইসলামের ব্যবসায়ীরা অনেকেই তখন ফররুখ ভাই কে তাদের দলের মনে করে আমার বিরুদ্ধে দাড় করবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু তারা দ্বিতীয়বার আর ফররুখ ভাইয়ের কাছে আমার কথা বলার সাহস পান নি।
বহু বহু ঘটনা আজ এলোমেলোভাবে মনের জালে ধরা পড়ছে কিন্তু মনের এই অবস্থায় গুছিয়ে তোলা সম্ভব নয়। আমি, সরদার জয়েন উদ্দীন বন্ধুবর আবদুল গনি হাজারী, কবি হাবীবুর রহমান বলতে গেলে, এক পরিবারের ছিলাম। পাকিস্তান হয়ে গেছে, আমরা সব ঢাকায় হিজরত করেছি, থাকি ৩৬ নং র্যাংকিন স্ট্রিটের মরহুম আনোয়ার ভাই য়ের বাসার বাইরের মহলে, টিনের ঘরগুলোর মধ্যে দুটো ঘর নিয়ে। আমরা সকলেই তখন বেকার। তবে আজও অবাক লাগে, সেই চরম আর্থিক নিঃস্বস্তার সময়ে আমাদের মনের সমুদ্রে উচ্ছলতার জোয়ারের দোলায় সবকিছু কেমনভাবে ভুলে থাকতাম। ৩৬ নং এর একটি ঘরে হাজারী এবং আবুল হাসেম থাকতেন (বর্তমান লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর) অন্য ঘরে আমি সরদার জয়েন এবং কবি হাবীবুর রহমান। এটা ১৯৫০ এর গোড়ার দিকে। তখন মোটামুটি আমরা বেকারত্বের আইবুড়ো অবস্থা থেকে মুক্তি। হাবীবুর রহমান কাজ করতেম আজাদে। তাঁর ডিউটি রাতে, অতএব তিনি দিনে এসে যে চৌকিতে ঘুমোতেন, রাতে আমি আর জয়েন উদ্দীন সেই চৌকিতে ঘুমাতাম। একটি চৌকি, শোবার লোক তিন জন, ব্যবস্থা রাত এবং দিনের ভাগাভাগি। সরদার জয়েন উদ্দীনের একটি মিলিটারী কম্বল। ঘরের মাপ আট ফিট দশ ফিট। এমনি অবস্থায় একদিন প্রায় রাত এগারোটায় ফররুখ ভাই এসে উপস্থিত। আমি আর সরদার জয়েন উদ্দীন মুখে চাওয়া চাওয়ি করছি। অবস্থা বুঝে ফররুখ ভাই বললেন, তোদের চিন্তার কোন কারণ নেই। গল্প আর ঘরের মধ্যে পায়চারি করেই কাটিয়ে দেবো। বললাম, পায়চারিই যদি আপনাকে করতে হয় তাহলে আমরাও করব এবং সোজা রাস্তায় রাস্তায়। আমাদের এই প্রস্তাব যেন ফররুখ ভাইয়ের আসল মনের দরজায় কড়া নাড়া দিলেন। ‘অতি উত্তম প্রস্তাব দিয়েছিল রে’ বলেই সে কি আনন্দেচ্ছল হাসি। ‘তবে আরকি উর্দি পরে নাও রুটমার্চে বেরিয়ে পড়ি’। ফররুখ ভাইয়ের কম্যান্ডে। লুঙ্গী শার্ট আর চাদর গায়ে জড়িয়ে আমরাও প্রস্তুত। বের হয়ে পড়লাম, এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ চা পানের ইচ্ছা জাগলো ফররুখ ভাইয়ের। তখনকার দিনে রাত প্রায় একটার সময় চা পাওয়া যাবে কোথায়? শেষ অবধি সুরাহা হল, সেই আমলের ঢাকার পুরনো রেল ক্রসিং এর কথা কল্পনা করুন। সেই জায়গাতেই পয়েন্টস ম্যানদের চা খাবার একটা ব্যবসথা ছিল, বিশেষ কইরে নাইট ডিউটি যাদের তাদের জন্যই। কোন রকমে ঝুপড়ির মধ্যে এই ব্যবস্থা। তবে তাঁর মধ্যেই মার্বেল পাথরের টেবিল। সে সমইয়ে রেলওয়ের এই সব কর্মচারীরা প্রায়ই অবাঙ্গালী ছিল, বুঝতে অসুবিধা হল না, তাদের ঝুপড়িতে মার্বেল টপ এর টেবল কিভাবে আসতে পারে। যাই হোক, ফররুখ ভাই পরম তৃপ্তির সাথে আমাদের নিয়ে সেখানে বসে পড়েই চায়ের অর্ডার দিলেন। তিন কাপ মালাই চা নিয়ে এসো তো বাবা, মোরা মুসাফর মানুস বড় হালেকান হয়ে আছি। কলকেতিয়া মুসলমান দের কথ্য বাংলা এই ধরনের। ফররুখ ভাই আমাকে আর কলকাতার কোন মানুস পেলে প্রায় এই ভাষাতে কথা বলে হাসির প্রসবন বইয়ে দিতেন এবং ফররুখ ভাই মসজিদের দিকে পা বাড়ালেন। বললেন ঐখানে থেক্লেই রেডিওতে চলে যাবো। আমরা পা বাড়ালাম র্যাংকিন স্ট্রিটের দিকে। ফররুখ ভাই আর আমরা আদর্শ এবং নীতির নদীর দুই তীরের মানুস দুই দিকে চলে গেলাম সেই শিশিভেজা প্রভাব টুকুতেই মাত্র, কিন্তু ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দুই তীর থেকে মাঝ দরিয়ায় এসে সবার ঊর্ধ্বে যখনই মিলেছি তখনই ফররুখ ভাইকে দেখেছি শুধু বাংলারই নয়, পৃথিবীর অতির সাধারণ মানুশদেরই অতি আপন জন একজন ফররুখ ভাই। আজ আমার কলম আর চলতে চাইছে না। কারণ যতই হিসেব মেলাচ্ছি ততই দেখছি নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন সীমান্তের ওপারে পশ্চিম দিগন্তে আত্নার আত্নীয় হিসেবে তিনিই ছিলেন আমাদের হ্রদয়ের কেন্দ্র বিন্দুতে।
Reference:
সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১ নভেম্বর ১৯৭৪
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/01/forrukh-ahmod.pdf” title=”forrukh ahmod”]