আতাউর রহমান খান
১৯০৫ সনের ৬ মার্চ আমার জন্ম। জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, আমার অতি আপনজন, স্নেহের তাজউদ্দীনকে স্মরণ করছি। তাজউদ্দীন মানুষ হিসেবে ছিল অনেক বেশি ধীরস্থির এবং স্বাধীনচেতা। সবার সাথে তার সম্পর্ক অত্যন্ত ভাল ছিল। শুধু ভালই না, সত্যিকার শ্রদ্ধার সম্পর্ক বলা যায়। তাজউদ্দীন মানুষকে অন্তরাত্মা দিয়ে ভালবাসত। ওর ধর্মই ছিল মানুষকে ভালবাসা। ওর বিশ্বাস ছিল, জনগণই হচ্ছে দেশের মালিক, এই জনগণকে যদি ভাল না বাসা যায় তাহলে দেশকে ভালবাসা যায় না—দেশকে ভালবাসার অর্থই জনগণকে ভালবাসা। কাজেই প্রত্যেকটি মানুষের সাথে তার সদ্ভাব ছিল।
১৯৭৩-৭৪-এর দিকে একবার এক বাড়িতে আমার দাওয়াত ছিল, তাজউদ্দীনও ছিল সেখানে। এক দুই কথা বলতে গিয়ে তাজউদ্দীন দুঃখ করে বলল, এই যে এত বড় একটা যুদ্ধ করলাম, নয়টা মাস এতগুলাে মানুষ কষ্ট করলাম, দেশকে স্বাধীন করার জন্য সত্যি বলতে গেলে একহাতেই সব কিছু করতে হল; কিন্তু মুজিব ভাই একদিনও একবার জিজ্ঞাসা করলেন না কীভাবে কী করলাম, কেমন করে করলাম! একটা মানুষের তাে কৌতূহল অন্তত হয় ? তার ভেতরে এই বিষয়ে আগ্রহ, কৌতূহল কিছুই ছিল না। অনেকটা আত্মগতভাবে আপনমনে কথাগুলাে বলে গেল তাজউদ্দীন। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “দুঃখ করে আর কী করবে!’ তাজউদ্দীন মনেপ্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। বাকশাল প্রসঙ্গে মুজিবকে বলেছিল, ‘জনগণ আমাদেরকে ভােট দিয়েছে। আমরা জনগণের ভােটেই দাঁড়িয়ে আছি।এটাই গণতন্ত্র । আর আপনি এই গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে চাইছেন বাকশাল করতে ? বাকশাল করার জন্য জনগণ আমাদেরকে ভােট দেয়নি। জনগণ ভােট দিয়েছিল সংবিধান তৈরি করার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। জনগণের ভােটেই গণতন্ত্র স্থাপিত হবে। আমরা চাই সেই গণতন্ত্র । একনায়কতন্ত্র চাই না।’ তাজউদ্দীন বলেছিল, আমরা ১০৬ জন সদস্য বাকশালের বিপক্ষে মতামত দেব। প্রয়ােজনে সংসদ থেকে বের হয়ে আসব। আমি বললাম, ‘পারবে না বের হয়ে যেতে। শেষ পর্যন্ত দেখবে যে তুমি ছাড়া আর কেউ বের হয়নি। তারপর যখন বাকশালের প্রস্তাব করা হল তখন কেউ বের হল না, তাজউদ্দীনও না। পরে তাজউদ্দীনকে বললাম, “মিয়া, তােমার তাে উচিত ছিল বের হয়ে আসা, তুমি বলেছিলে ১০৬ জন প্রতিবাদ করবে, প্রয়ােজনে বের হয়ে আসবে, কিন্তু কিছু করলে না কেন?’ উত্তরে তাজউদ্দীন বলে, ‘ভাইসাহেব, একটা গল্প বলি, শােনেন। আমাদের গ্রামে একজন মৌলভী সাহেব ছিলেন। খুব ভাল মওলানা । একদিন গ্রামে একজন ফকির এল। এই ফকির মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব বলতে আরম্ভ করলে অনেক মানুষ তার চারপাশে ভিড় করল নিজেদের ভাগ্যের কথা জানতে। কিন্তু একমাত্র মওলানা সাহেব ওই ফকিরের কাছে যান নাই দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মওলানা সাহেব, আপনি গেলেন না ? মওলানা বলেন, না ভাই, আমি যাবাে না। আমি বললাম, কেন যাবেন না ? মওলানা বলেন, জীবনে অনেক সময় আমি অনেক অন্যায় করেছি। এমনকি রাতের বেলায় চুরি-ছ্যাচড়ামিও কিছু করেছি। যেমন, মানুষের গাছের আম, বিশেষ করে কাঁচা-মিঠা আম না বলে চুরি করেছি। খেত থেকে মরিচ তুলে নিয়ে এসেছি। এই সমস্ত কাজ তাে করেছি, এখন যদি ওই ফকির সব বলে দেয় তাহলে তাে আমার আর চাকরি থাকবে না। কাজেই আমি ভয়ে ফকিরের কাছে যাই নাই।
এখানেই গল্পের ইতি টেনে তাজউদ্দীন বলল, ‘গল্পটা বললাম এই জন্য যে, বাকশালের বিপক্ষে যে ১০৬ জনের প্রতিবাদ করার কথা ছিল তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু দোষত্রুটি রেকর্ড করে রাখা হয়েছে। যদি ওরা আমার সাথে এসে বাকশালের বিরােধিতা করে কথা বলত তাহলে মুজিব ভাই প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই সেই তালিকা ধরে একটা বিচারের ব্যবস্থা করাতেন। এই ভয়েই কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। সবাই নিজের মধ্যেই পালিয়ে রইল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওরা কি করবে। জবাব হল, ভয় করি। আমাদের মাথার ওপর তলােয়ার ঝুলছে, বলা। যায় না কোন সময় মাথায় ফেলে দেয়, কাজেই নিশ্ৰুপ থাকা ভাল।’পরে আমি নিজে যখন বাকশালে যােগ দেই তার আগে তাজউদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি এ ব্যাপারে কী বল ? দেশে তাে রাজনীতির সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে | গেছে, রাজনীতি বলতে আর কিছু থাকবে না। ভাবছি এখন যদি বাকশালে যোেগদেই তাহলে আমি আউট অব পলিটিকস্ হয়ে যাই। আমার আর রাজনীতি বলতে কিছু থাকবে না। তাজউদ্দীন বলে, ‘আপনি যাবেন না। কেন যাবেন আপনি ? এখন পথ বন্ধ হল তাতে কী, ভয়ের তাে কোন কারণ নেই। নাই বা করলেন এমন রাজনীতি, আপনি যাবেন না।’ তাজউদ্দীনের নিষেধ সত্ত্বেও আমি বাকশালে যােগ দিলাম। পরে একদিন হাসতে হাসতে তাকে বললাম, তাজউদ্দিন, তুমিও তাে এখানেই আছ ?’ সে বলে, আমি দল করি। আমার এই দল ছেড়ে আমি যেতে পারি না, তাই আছি। কিন্তু আপনি গেলেন কেন ? আপনারা তাে অন্য দলের মানুষ, আমাদের দলের না।’
তাজউদ্দীন বলে, বাকশাল সামান্য কয়দিনের জন্য, এটা থাকবে। মুজিব ভাই বেঁকে চলছেন। রাশিয়া এবং বিভিন্ন লােকের বুদ্ধিতে বাকশালটা করানাে হয়েছে। কিন্তু এটা বেশি দিন থাকবে না। টিকবে না। দেখবেন ক’দিন পরেই। এইভাবে দেশ চললে দেখবেন সামনে কী হয় । আমরাও থাকব কিনা জানি না!’ আলাপকালে তাজউদ্দীন প্রায়ই দুঃখ করে বলত, “আমি যে রকম করতে চাই মুজিব ভাই সেভাবে কাজ করতে দেয় না। বাধা দেয়। তাজউদ্দীনের মনে অনেক দুঃখ ছিল। মনে আছে, ওআইসি সম্মেলনে লাহাের যাবার আগে শেখ মুজিবুর রহমান বলল, ‘ভারত হয়ে যাই, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে একটু দেখা করে তারপর যাব।’ তাজউদ্দীন বলে, “কেন, আপনি কেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে যাবেন ? আপনি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী, আপনি কেন কাউকে জিজ্ঞাসা করবেন ? আপনি কেন অন্যের কাছে মাথা নিচু করবেন?’ তখন মুজিবুর বলে, “ঠিক আছে, আমি সরাসরিই চলে যাব।’ তাজউদ্দীন বলে, ‘মুজিব ভাই, আপনি তাই করেন, এতে আপনার মানসম্মান থাকবে।’ অর্থাৎ সে যেটা মনে করত এতে ভাল হবে, বুঝত যে এই কাজে মঙ্গল আছে, তা সে সামনাসামনি বলে ফেলত। ভয় করত না। ভয় করার কথা চিন্তাও করত। তার মনে অত্যন্ত সাহস ছিল—সাংঘাতিক স্বাধীনচেতা মানুষ। কিন্তু বেচারা পেরে ওঠে নাই। সত্যের পথে তাকে কেউ সাহায্য করে নাই ।
মুজিবুরকে সবাই ভয় পেত, তাই ভয়ে কেউ তাজউদ্দীনকে সমর্থন করে নাই। করলে তাজউদ্দীনের অবস্থা অন্য রকম হত। তাজউদ্দীনের ওপর হস্তক্ষেপ করা, স্বৈরাচারী ভাব, এগুলাে তাজউদ্দীন মানত না বলেই শেষ পর্যন্ত তাকে সরিয়ে দিল। তাকে রাখলই না, বাদ দিয়ে দিল। মন্ত্রিসভা থেকে চলে আসার পর তাজউদ্দীন বলে, ‘ভালই হয়েছে, আমি রক্ষা পেয়েছি। মানুষটা আমাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে চায়। আমি মন্ত্রিসভায় থাকি বা না থাকি তাতে আর কিছু এসে যায় না। আমি তাজউদ্দীন, তাজউদ্দীন হয়েই বেঁচে থাকব, আমি মন্ত্রী হয়ে বাঁচতে চাই না।’ এই-ই ছিল তার স্বভাব। অন্তঃকরণটা খুব বড় ছিল। সাহসী আর স্বাধীন ছিল মন। মনে আছে, যখন সে আর মন্ত্রী নেই, একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বল তাে ঘটনাটা কী ? সে বলে, ‘আমার বিরুদ্ধে তাে অভিযােগ আছে। মুজিব ভাই চায় আমেরিকার সঙ্গে যােগাযােগ বেশি করতে। আর আমি চাই না।’ আমি তাজউদ্দীনকে বললাম, যাই বল না কেন, তুমি একটা কাজ ভুল করেছ। তুমি শুরুতেই বলে দিলে, আমেরিকার কোন সাহায্য আমরা নেব না। এটা ঠিক হয়নি।
তাজউদ্দীন বলে, “দেখেন, এই অগ্রিম বলে দেয়ায় ভাল হয়েছে। তা না হলে ওরা আমাদের উপর জাকিয়ে বসত। আমরা বিদেশী সাহায্য ততটাই নেব যতটা আমাদের প্রয়ােজন এবং সত্যিকার অর্থে যেটা আমরা কাজে লাগাতে পারব। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ প্রকল্পের ওপর যদি সাহায্য করে এবং শর্তহীন সাহায্য দেয় তবে আমরা সাহায্য নিতে রাজি আছি। এই হল আমার নীতি। দান, ঋণ এমনি এমনি ওদের ইচ্ছায় দেবে আর আমরা নেব, তা হবে না। আমাদের প্রয়ােজনে শর্তহীন সাহায্য নেব, এছাড়া সাহায্য নেব না। মুজিব ভাই বসে আছেন, আমেরিকা সাহায্য দেবে, তা দিয়ে আমরা দেশ উন্নত করব! কিন্তু তা কেন ? আমরা স্বনির্ভর হতে চাই। স্বনির্ভর হতে গেলে নিজেরা কষ্ট করে যে প্রকারেই হােক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে উন্নত করব, আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হব। সেই চেষ্টা না করেই কেন আমরা সাহায্য নেব!’ তাজউদ্দীন স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ ও সত্যিকার শুদ্ধ, সৎ সমাজের কথা চিন্তা করত। বলত, দেশ কোন কারণেই পরনির্ভরশীল হবে না। সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসসহ মৌলিক সব বিষয়েই স্বাধীন, স্বচ্ছ ও মুক্ত হবে সমাজ।
অনেকে মনে করত তাজউদ্দীনের বােধ হয় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যােগাযােগ আছে। কিন্তু এই কথাটি ঘোরতর মিথ্যা। আমার সাথে তার পরিচয় সে যখন স্কুলছাত্র সেই সময় থেকে। আসলে সে সবার সাথে মিশতে পারত। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় মওলানা ভাসানীর সাথে হাতির পিঠে চড়ে আমি কাপাসিয়াতে গিয়েছিলাম। হাতি যখন আমাদেরকে নিয়ে গজারির জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল তখন আমি ভাসানী সাহেবকে বলেছিলাম, ‘জঙ্গলের রাজা বাঘ আসতে পারে যে কোন সময়, কারণ আমরা ওদের রাজ্যেই ঢুকেছি।’ ভাসানী সাহেব বললেন, “চলেন দেখা যাক কী হয়। সেই নির্বাচনে তরুণ তাজউদ্দীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে বিজয়ী হয়। এক কথায় তাজউদ্দীনের মত রাজনীতিবিদ আমি আমার এই জীবনে দেখিনি। সত্যিকার অর্থে একজন রাজনীতিবিদ বলতে যা বােঝায় সে তাই ছিল। তাজউদ্দীন ছিল সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ।
মনে আছে ‘৭৫ সালের নভেম্বর মাসে আমি যখন তাকে শেষবারের মত দেখতে গেলাম, বুকফাটা কান্নায় মৃতদেহের দিকে তাকাতে পারিনি। সেই দৃশ্য দেখা আমার সহ্যক্ষমতার বাইরে ছিল। জেল হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। বিশ্বের কোথাও এমন ঘটনা ঘটেনি। শুনতে পাই, তাজউদ্দীনসহ চারজনকে হত্যা করার জন্য প্রেসিডেন্ট মােশতাকের নির্দেশে কয়েকটা সেপাই জেলখানায় গিয়েছিল।
(১৪.৮.১৯৯০)
আতাউর রহমান খান
রাজনীতিক।
তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী । ১৯৯১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র – তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা