You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.01 | সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১ মার্চ ১৯৭৪ এর মূল কপি - সংগ্রামের নোটবুক

1974.03.01 | সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১ মার্চ ১৯৭৪ এর মূল কপি

(উল্লেখযোগ্য সংবাদ টাইপ করে দেয়া হল)

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/01/1974.03.01-bichitra.pdf” title=”1974.03.01 bichitra”]

বিজয়ী বঙ্গবন্ধু
(প্রচ্ছদ কাহিনী)

উপমহাদেশের একটা পরিবর্তন যে আসন্ন তা বুঝা গিয়েছিল এ মাসের শুরুতেই। লাহোরে ইসলামী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা এবং পিন্ডির বহুমুখী কুটনৈতিক তৎপরতা সরাসরি এ ইঙ্গিতই দিচ্ছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন দুই আরব দেশ আল জিরিয়া – লিবিয়া সফর করলেন। শরণ সিং ঢাকা এলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল আবার গেলেন মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। ওদিকে পাকিস্তানেও ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বিভিন্ন আরব প্রতিনিধিদের আগমণ শুরু হয়।

হঠাৎ কুয়েতী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ সাবাহ আল জাবের এর নেতৃত্বে সাত সদস্যের এক প্রতিনিধি দল এলেন ঢাকায়। তখন থেকেই শুরু হলো আমাদের তথা সারা বিশ্বের মানুষের প্রতীক্ষা – কখন পাকিস্তান স্বীকৃতি দিচ্ছে বাংলাদেশকে। মানুষের বিশ্বাস আরো দৃঢতর হলো যখন দেখা গেল সাতজনের মধ্যে চারজন ফিরে গেলেন পাকিস্তানে। কুয়েতী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর সঙ্গীরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে রাজি করান বলে ধারণা করা যায়।

সে স্বীকৃতি যখন ঘোষণা করলেন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, তখন বাংলাদেশের বুকে নেমেছে সন্ধা। সূর্যের ম্লান আলোর রেশ তখনও রয়েছে। অদ্ভুত হৃদয়ানুভূতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন বিজয়ের আনন্দ অনুভব করল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা করলেনঃ এবার ইসলামী সম্মেলনে যেতে আর বাঁধা নেই। ২৩ শে ফেব্রুয়ারীর নতুন ভোরে প্রধানমন্ত্রী পাড়ি জমালেন লাহোরের উদ্দেশে। দ্রুত আবর্তিত নাটকের একটি দৃশ্য। প্রতি দৃশ্যেই বাংলাদেশের দৃপ্ত অবস্থান। শেষ পর্যন্ত নিজ অধিকারের স্বীকৃতি আদায়।

শুধু স্বীকৃতি আদায়েই সীমাবদ্ধ রইল না আমাদের দেশ। ৩৮ টি দেশের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী তার বক্তব্য রেখেছেন। সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মানবতার বাণী ধ্বনিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। সম্মেলন কক্ষে অভূতপূর্ব আনন্দ জোয়ারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ঢুকলেন। বেরিয়ে এলেন বিশ্বের সমস্ত মুসলিম দেশগুলোর প্রাণ স্পর্শ করে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন।

লাহোর বিমানবন্দরে যখন নামলেন, বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী পর পর ২৯ টি তোপ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো চারপাশ। বিজয়ী মুজিব প্রাণঢালা সম্বর্ধনা পেলেন পাকিস্তানের সরকার এবং জনগণের কাছে থেকে। অতীতের বহু দুঃখ বেদনার স্মৃতি সরে গিয়ে আগামী দিনের সহমর্মিতা এবং প্রীতির সম্পর্ক উন্মোচনের দিন শুরু হল। উপমহাদেশের দুটি ক্ষুদ্র দেশ পরস্পরের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধনকে দৃঢ করার কাজে এগিয়ে যাবে। অমীমাংসিত সমস্যাবলী সমাধানের পথে ছিল যে বাঁধা, তা আজ অপসৃত। লাহোর থেকে ফেরার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের মুজিব জানালেনঃ নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে উপমহাদেশে।

সাম্প্রতিককালের বিশ্ব রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য সব ঘটনাবলী দর মধ্যে বাংলাদেশ – পাকিস্তানের পারস্পরিক স্বীকৃতি অন্যতম একটি বিরাট ঘটনা। এ ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকে বিমূঢ় হয়ে পড়লেও আমরা তা হই নি। বাংলাদেশের মানুষ এটাই চেয়েছিল এবং তাই হয়েছে। স্মরণযোগ্য, গত সংখ্যায় বিচিত্রা লিখেছিলঃ পরিবর্তনশীল রাজনীতির আলোকে পাকিস্তান যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তবে তা এমন কিছু অস্বাভাবিক হবে না। বরং তা – ই স্বাভাবিক। কারণ উপমহাদেশের বুকে একটা অচল অনড় রাজনৈতিক অবস্থা চিরস্থায়ী হয়ে থাকতে পারে না। ইতিহাসের সচলতায় তাই আবার প্রমাণিত হল, পরিবর্তন শ্বাশত এবং অবশ্যম্ভাবী।

কিন্তু এর পেছনে নিশ্চয়ই অনেক কারণ কাজ করেছে – যার ফলে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত বাধ্য হল, তার এককালীন অংশকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে নিঃশর্ত স্বীকৃতি দিতে।

প্রথমেই ধরা যাক, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ তার মুক্তি সংগ্রামে বিজয় অর্জন করার পর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এবার মধ্যপ্রাচ্য ই উঠে এলো প্রধান ভূমিকায়ঃ বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক রচনায়। ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো তারা। বাংলাদেশ এদিকে আবার পাকিস্তানের স্বীকৃতি ছাড়া লাহোরে যেতে পারে না – ঘোষিত হল এই নীতি। এবার আরবদের চাপ পড়ল পাকিস্তানের ওপরঃ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও। অতীতকে ভুলে যাও, নতুন বন্ধুত্বের পথে যাত্রা শুরু হোক।

বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতির পেছনে হয়তো আরো অনেক নেপথ্য কুটনীতি সক্রিয় হয়ে থাকবে, যা দৃশ্যমান নয়৷ তবে তা নিয়ে আলোচনারও প্রয়োজন খুব একটা আছে – এমনও নয়। কুটনীতির পথ বড় বিচিত্র। বহু বিচিত্র পথ ধরেই এ কুটনীতি এগিয়ে চলে। ঢাকা – পিন্ডির মধ্যে যে নতুন সম্পর্কের দুয়ার খুললো তার মধ্যেও সে বৈচিত্রের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যাবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বোধহয় প্রধান নয়। প্রধান হল, উপমহাদেশের আন্তঃ রাষ্ট্রীয় সম্পর্কটা নতুন পথে মোড় নিতে চলেছে। গত ২৫ শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এক সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা এসে সাংবাদিকদের বলেছেনঃ পুরনো যে অতীত তাকে ভুলে নতুন ভাং বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান এগিয়ে যাবে, ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে – এটাই কাম্য।

বাংলাদেশ – পাকিস্তানের পারস্পরিক স্বীকৃতি অভিনন্দিত হয়েছে সারা বিশ্বে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কুট ওয়াল্ডডেইম, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী চি পেং ফেই, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার, ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সহ সবাই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

পাক রাজনীতিতেও ঘটেছে পরিবর্তন ঘটেছে। সামরিক একনায়কতন্ত্রের স্থানে এল সাংবিধানিক গনতন্ত্র। পাকিস্তানের সাথে ভারতের চুক্তি হল, সিমলায় সহযোগিতা মূলক মনোভাবের বিস্তৃতি ঘটল পাকিস্তানে। তারপর গত বছরের ২৯ আগস্ট সম্পাদিত হল দিল্লী চুক্তি। বাস্তব অবস্থার মূল্যায়নে ধীরে ধীরে পাকিস্তানও এল এগিয়ে। তার পরই আসে আলজিয়ার্সের জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের উপস্থিতির কথা। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ হল বাংলাদেশের কয়েকটি আরব দেশ বাংলাদেশকে জানালো স্বীকৃতি। এবার পাকিস্তান তাকালো আরবের দেশগুলোর পানে৷ তারপর তারও দৃষ্টি নিবদ্ধ হল বাংলাদেশের প্রতি।

হঠাৎ মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হল যুদ্ধের তান্ডব, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আরবদের প্রতি বাংলাদেশ জানাল তার দৃঢ সমর্থন। শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশ পাঠালো এক লক্ষ পাউন্ড চা, সামরিক সেচ্ছাসেবক, ডাক্তার ও নার্স। মধ্যপ্রাচ্যের নিপীড়িত দেশগুলো উপলব্ধি করলোঃ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তাদের বন্ধু। আরো কিছু স্বীকৃতি এলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে, জানিয়েছেেন স্বাগত। রাজধানী ঢাকার পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেনঃ চীনের স্বীকৃতিও আসন্ন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের সম্ভাবনাও এখন প্রশস্ত।

এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল বলেছেনঃ ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে হয়ত ঢাকাই পাবে প্রাধান্য। আর এ বৈঠক বসবে নিঁঃসন্দেহে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আগামী ৯ ই এপ্রিল অধিবেশনের পূর্বে। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদান প্রেসিডেন্ট সাদাতের ঢাকা সফর সবকিছুর পর এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঢাকার গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। বিশ্ব অঙ্গনে এখন রাজধানী ঢাকাও পালন করবে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কিন্তু সবকিছুর পরও ৭৪ এর ফেব্রুয়ারী বেঁচে থাকবে আমাদের স্মৃতিতে। দীর্ঘ একটি মাস। কত দ্রুত ঘটে গেল সময়ের বিবর্তন। আর সাথে সাথে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন৷ যার সাথে ছিল আমাদের বৈরিতা, তার সাথেই হল আমাদের আলিঙ্গন। লাহোর বিমানবন্দরে পাক নেতৃবৃন্দের আনন্দাশ্রু, শালিমার উদ্যানে নতুন মিত্রতার মিলনের অপূর্ব দৃশ্য – মুজিব ভুট্টোর উর্ধ্বে প্রসারিত দুটি বাহু – চারদিকে হর্ষধ্বনি সবই আমাদের স্মৃতিতে মিশে থাকবে বহুদিন। এক বিরাট উদারতা নিয়ে আমাদের পুরনো দিনের বেদনা এবং হিংসাকে দিয়েছি বিসর্জন। অনাগত দিনের বন্ধুত্ব ও মিত্রতার পথে যাত্রাকে জানাই আমরা স্বাগত। জানা ও, বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জনাব ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরে। কবে তিনি আসছেন তা অবশ্য জানা যায় নি।

অপেক্ষা করা যাক, উপমহাদেশের রাজনীতিতে আরো নতুন পরিবর্তনের জন্য। যে পরিবর্তন তিনটি দেশকে করবে আরো ঘনিষ্ঠতর। অবশ্য সবই নির্ভর করে রাজনীতির গতি প্রকৃতির উপর। কারণ রাজনীতির বিচিত্রিতা জন্যই তো লাহোরের মাটিতে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা, সামরিক ব্যান্ড বেজেছে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’

***

সংবাদ শিরোনাম

এ সপ্তাহের উল্লেখযোগ্য জাতীয় সংবাদ হলঃ পাকিস্তান কর্তৃক নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশের প্রতি শর্তহীন স্বীকৃতি ঘোষণা। ২২শে ফেব্রুয়ারী বিকেলে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এই স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন। পাকিস্তান হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী বিশ্বের ১১৫ তম দেশ।

ঢাকায় প্রায় ২২ ঘন্টা ব্যাপি একটানা কুটনৈতিক তৎপরতার ফলশ্রুতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি। লাহোরে আহুত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য সম্মেলনে যোগদানকারী ৭ টি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের এক প্রতিনিধি দল গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাতে লহোর থেকে ঢাকায় আসেন। কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব সাবেহ আল আহমেদ আল জাবেরের নেতৃত্বে আগত এই প্রতিনিধি দল ঢাকায় পৌছে এই রাতেই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে মিলিত হন। রাত বারোটা থেকে এই বৈঠক চলে রাত প্রায় সোয়া দুইটা পর্যন্ত। এর পর তারা ভোর সোয়া ৩ টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠক চলে ভোর প্রায় ৬ টা পর্যন্ত।

বৈঠক শেষ করে ভোর সাড়ে ছয় টায় প্রতিনিধি দলের ৪ জন সদস্য ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব সান আলতোহামী, সোমালিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী, সেনেগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংস্থার প্রতিনিধি লাহোরে রওনা হয়ে যান।

এরপর পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। জল্পনার অবসান ঘটে সন্ধা সোয়া ছ’টায়। এই সময় খবর পাওয়া যায়, পাকিস্তান বাংলাদেশকে শর্তহীন ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারীঃ সরকার নিম্নতম মানের পাটের বিধিবদ্ধ মূল্য মনপ্রতি ৬০ টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ১লা জুলাই থেকে তা কার্যকরী হবে।

১৯শে ফেব্রুয়ারীঃ ঢাকা পৌরসভাকে কর্পোরেশন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে মন্ত্রী সভার বৈঠকে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এ ব্যাপারে শীগগির একটি আইন পাস করা হবে।

২০শে ফেব্রুয়ারীঃ দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চ ডুবে ৮ জন যাত্রী মারা গেছে এবং ৭ জন মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছে।

২১শে ফেব্রুয়ারীঃ সারা দেশে শহীদ দিবস পালিত হয়৷

লাহোরে আহুত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য সম্মেলনে যোগদানকারী ৭ টি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের এক প্রতিনিধি দল লাহোর থেকে ঢাকায় আসেন। কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব সাবেহ আল আহমেদ আল জাবেরের নেতৃত্বে ঢাকায় পৌছে রাতেই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে মিলিত হন।

২২শে ফেব্রুয়ারীঃ পাকিস্তান বাংলাদেশকে শর্তহীন ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির পর পরই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দানের কথা ঘোষণা করেন।

ইরান এবং তুরস্কও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

২৩শে ফেব্রুয়ারীঃ লাহোরে আহুত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সকালে যাত্রা করেন। প্রতিনিধি দলের অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব ডঃ কামাল হোসেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ৷

পাটের নুন্যতম মূল্য ৬০ টাকা ধার্য করা হয়েছে – সাংবাদিক সম্মেলনে নতুন পাটনীতি ঘোষণা কালে পাট মন্ত্রী এই তথ্য পরিবেশন করেন।

২৪ শে ফেব্রুয়ারীঃ ডাক ধর্মঘট চলছে। আজ ১১ দিন। সরকারের দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে আড়াই লক্ষ টাকা।

***

দেশ দেশান্তর

পাকিস্তানের রাজনীতিঃ ঘাত প্রতিঘাত

‘৭১ এর ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানের রাজনীতিতেও দেখা দিয়েছে পরিবর্তন। দীর্ঘ ১৫ বছর যে দেশটি ছিল প্রেসিডেন্ট শাসিত, সে দেশেই পার্লামেন্টারী প্রথা চালু হয়েছে। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গনতন্ত্রের জাগরণও দেখা দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘৭১ এ ডিসেম্বরের শেষ দিকে সামরিক এক নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে ক্ষমতা হাতে নেন। তখন পাকিস্তানে ছিল চরম আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ক্রমে ক্রমে সেই বিশৃঙ্খল অবস্থাকে একটা শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করেন। নতুন শাসনতন্ত্র পেশ করেন গত বছরের ১৪ই আগস্ট। সেই শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৪ আগস্ট তিনি নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। আর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ‘৬৯ বছর বয়স্ক প্রবীণ রাজনীতিবিদ চৌধুরী ফজলে এলাহী।

পাকিস্তানের এই নতুন শাসনতন্ত্র সে দেশের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছে। নতুন শাসনতন্ত্রে ফেডারেল পার্লামেন্টারী পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচিত করার অধিকার দিয়েছে পাকিস্তানের জনগণকে। সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে৷ ভোটারের বয়সসীমা ১৮ বছর পর্যন্ত নামিয়ে আনা হয়েছে। দ্বি – কক্সবিশিষ্ট জাতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হল ন্যাশনাল এসেম্বলী। উচ্চকক্ষ – সিনেট। নিম্নকক্ষই হচ্ছে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নিম্নকক্ষে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট রয়েছে ২১০ টি। এর মধ্যে ১০ টি হচ্ছে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট। অবশ্য এই দশটি ছাড়াও মহিলারা অন্যান্য আসনের জন্য পুরুষদের সাথে ‘সমঅধিকার’ এর ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সিনেটের আসন সংখ্যা ৬৩ টি। প্রতি প্রদেশ থেকে সমান ভাবে ১৪ জন নির্বাচিত হবেন। বাকী সাতটি আসনের পাঁচটি হচ্ছে কেন্দ্র শাসিত উপজাতীয় অঞ্চল গুলোর জন্য নির্দিষ্ট। আর দুটি কেন্দ্রীয় রাজধানী থেকে প্রেসিডেন্টের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হবেন। পাকিস্তানকে বর্তমান প্রদেশ সংখ্যা ৪ টি – পান্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইসলাম। জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুই স্বীকৃত। অবশ্য অন্য ধর্মাবলম্বী এবং অন্যান্য ভাষার অধিকারও শাসনতন্ত্রে অনুমোদিত।

গত বেশ কিছুদিন ধরে পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে উত্তেজনা এবং বিক্ষোভের প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশই এই উত্তেজনার মূলকেন্দ্র। বেলুচিস্তান প্রদেশে আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল মন্ত্রীসভার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপকে কেন্দ্র করেই প্রথম জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের আগুন৷ ন্যাপ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুক্ত মন্ত্রীসভা তখন পদত্যাগ করলে গবর্নর গাউস বখস বেজেন্জোও পদত্যাগ করেন। পরে আকবর খান বুগতি গবর্নর হয়ে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করলেও শাসন তান্ত্রিক জটিলতা থেকেই যায়৷ বাইরের পত্র পত্রিকা, বেতার ইত্যাদি বলছে, বেলুচিস্তানে একটি জাতীয় সংগ্রাম চলছে। অবশ্য সঠিক খবর কি তা এখনো জানা যায় নি। ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খানও এখন কি করছেন তা জানা যাচ্ছে না। স্মরণযোগ্য, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য তিনি বহুবার ভুট্টোর প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন।

উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও যে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একটা বিক্ষোভ বিরাজমান তা সহজেই বুঝা যায়। আর পার্শ্ববর্তী দেশ আফগানিস্তান যেহেতু সীমান্তের পাখতুনদের কড়া সমর্থক, আন্দোলনও সে জন্য জোরদার। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রধান মওলানা মুফতি মাহমুদের কাছে এই সীমান্ত প্রদেশের একটি কেন্দ্রেই গত ‘৭০ এর নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন ভুট্টো। সীমান্তের অন্য এক বিশিষ্ট নেতা হচ্ছেন খান আবদুল কাইয়ুক খান। ইনি এখন ভুট্টো মন্ত্রীসভার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।

পান্জাব ও সিন্ধু প্রদেশই মোটামুটি পাকিস্তানের সমৃদ্ধতর অঞ্চল। এর মধ্যে আবার পান্জাবই সমৃদ্ধিতে অগ্রগতিতে সব প্রদেশকে ফেলে রেখেছে পেছনে। ভুট্টোর নিজ প্রদেশ হলো সিন্ধু।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে আজ ধর্মভিত্তিক দলগুলো একেবারে হতমান। পুরনো সেই মওদূদীর জমাতে ইসলামীরতার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে অনেক। মাওলানা মওদূদী দলের সভাপতিত্বে নেইঃ আছেন মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ। চৌধুরী রহমত এলাহী হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক। নীতিগত দ্বন্দ এবং কোন্দল আঘাত করেছে জামাতকে। বেলুচিস্তান, ধর্মের রাজনীতিগত ব্যবহার এবং বাংলাদেশেকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি, এসবই নীতিগত বিরোধের মূল বিষয়। নেজামে ইসলাম হয়ে পড়েছে আরো বহু ভাগে বিভক্ত। পিকিংপন্থী ন্যাপও দল হিসেবে তাদের শক্তি হারিয়ে শ্রীহীন। কাউন্সিল মুসলিম লীগের দওলতানা লন্ডনে পাক সরকারের দূত হিসেবে নিয়োজিত। এয়ার মার্শাল আসগর খান তার দল তাহরিকে ইশতেকলালকে ধীরে ধীরে শক্তিশালী করে তুলছেন। কিন্তু তবু সর্বদলীয় ভিত্তি তার দূর্বল। গত সিনেট নির্বাচনে ওয়ালী ন্যাপ যদিও অংশগ্রহণ করেন, তবু অন্য কোন দল ভুট্টোর পিপলস পার্টির কাছে দাড়াতেও পারেনি। আসলে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভুট্টোর দলই এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। মোটামুটি এর একটা সর্বজাতীয় ভিত্তি রয়েছে। প্রগতি মুখী সংস্কার মূলক কিছু কাজও করেছে ভুট্টো সরকার। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, ব্যাংক – বীমা – বড় শিল্পকারখানা জাতীয় করণ। কিন্তু তবু সংকটের চাপ দিন দিন বেড়ে চলেছে পাকিস্তানের জনগণের উপর৷ ভুট্টো সরকার এ সংকটের মোকাবিলা করেন কত স্বার্থকভাবে – সেটাই এখন দেখবার বিষয়। নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৯৭৫ এ। ততদিনে আবার কি ঘটবে, বলা মুশকিল।

তবে এখন যেভাবে চলছে তাতে দেখা যায়, ভুট্টোর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন। কাইয়ুম খানের মুসলিম তার সহযোগী। আর তার প্রদেশিক রাজধানীতেও ভুট্টোর দলের প্রাধান্য বর্তমান। প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানের এককালীন মুখ্য মন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন এখন পাক জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে আছেন। সিলেটের মাহমুদ আলীও এখন পাকিস্তানে। অধ্যাপক গোলাম আজম নাকি জেদ্দায় অবস্থানরত। মতান্তরে অবশ্য তিনিও আছেন পাকিস্তানে।

***

বৃটেনের নতুন নেতৃত্ব

নির্বাচনের দিন ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে বৃটেনে। ২৮ শে ফেব্রুয়ারী হতে যাওয়া এই নির্বাচনে কি হবে সেটাই জল্পনা কল্পনার বিষয়বস্তু। কে জিতবে – সেটাই এখন প্রধান আলোচ্য। পত্র পত্রিকাগুলো জনতম যাচাইয়ের রিপোর্ট পেশ করছে। নির্বাচনের পূর্বকালীন এবং বর্তমানের অবস্থার মূল্যায়ন প্রকাশিত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যগুলো তুলে ধরছে প্রচার মাধ্যমগুলো।

খনি শ্রমিকদের ধর্মঘটের মুখে গত ৮ ই ফেব্রুয়ারী নির্বাচন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী হীথ। বৃটেনের সমকালীন রাজনীতিতে এ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় হীথ এসেছেন জনগণের গণভোটের সামনে। রক্ষণশীল সরকারের কাছে এ নির্বাচন, নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখবার নির্বাচন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে ১৯৪৫ এবং ‘৭০ এর নির্বাচনের পর ‘৭৪ এর নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে মূলতঃ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে। ৪৫ এর নির্বাচনে চার্চিলের নির্বাচনী হাতিয়ার ছিল গেস্টাপো। নাজীবাদ আর গেস্টাপোর ভয় দেখিয়ে জনমনে শঙ্কার উদ্রেকই ছিল চার্চিলের উদ্দেশ্য। আশা ছিল তারঃ ভোট তার বাক্সে যাবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। শ্রমিক দল হলো বিজয়ী, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসলেন অ্যাটলি। ‘৭০ এর নির্বাচনে বেতন এবং দ্রব্যমূল্যকে কেন্দ্র করে উইলসন তার শাসন আমলের প্রথম পর্যায়েই এলেন নির্বাচন চান। উদ্দেশ্য ছিল নতুন করে জনমতের রায় নিয়ে গতিতে বসা কায়েমী হয়ে যায়। কিন্তু ঘটলো বিপরীত। মারাত্মক এক পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল শ্রমিক দলকে।

অর্থনৈতিক সংকটের সেই যে শুরু, তারপর তা আর কমলে না। বরং দিন দিন সে ভার বেড়েই চলল বৃটেনে। বিশেষত এবারের তেল সংকট যেন বৃটেনকে একেবারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। শিল্প সংকট, শ্রমিক দূর্যোগ এসব যেন হয়ে উঠলো বৃটেনের নিত্য দিনের সমস্যা। এই সময়েই উঠলো বেতন বাড়ানোর জন্য বৃটেনের খনি শ্রমিকদের দাবী৷ মুদ্রাস্ফীতির চাপে এমনিতেই হীথ দিশেহারা। নতুন এই বেতন বৃদ্ধির দাবী কেমন করে মানেন তিনি? সরকারের ঘোষিত যে নির্দিষ্ট বেতনের সিলিং তাকে ভাঙলেই তো দেখা দেবে ফ্যাসাদ। কিন্তু দরিদ্র খনি শ্রমিকরা তা মানবে কেন? বাজারে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, যে টাকা এখন তারা পাচ্ছে, তাতে চলছে না সংসার। অগত্যা তাই ধর্মঘটই হল সহায়। আর হীথ এলেন নির্বাচনের ময়দানে। বক্তব্য তারঃ বৃটেন বাসী, আমার আরদ্ধ কাজ আমি করতে পারছি না, এই উগ্র ধর্ম ঘটীদের জন্য। শ্রমিক দল ঐ উগ্রপন্থীদের উসকাচ্ছে। আমি তোমাদের সঠিক রায়টিই চাই।

রায় কার পক্ষে যাবে সেটাই তো হলো প্রধান সমস্যা। আর যেই আসুক জনমতে রায় নিয়ে, সমস্যা ও সংকটের চাপ যে তাদের স্বস্তিতে থাকতে দেবে – তার নিশ্চয়তা কোথায় আজ বৃটেনে?

তবু নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ যখন ঘোষিত হয়েছে, তখন কোন রাজনৈতিক দলই নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে পারে না৷ আর বৃটেনের রাজনীতিতে যেহেতু অতীত থেকে এখন পর্যন্ত সব সময়ই দেখা গেছে যে দুই রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই প্রধান, এবারও তার ব্যাতিক্রম হবার কথা নয়। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে, শ্রমিক দল ও রক্ষণশীল দল। অবশ্য উদারনৈতিক এবং কম্যুনিস্ট দলও রয়েছে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে৷ কালের বিবর্তনে আজ উদারনৈতিক দল হয়ে পড়েছে দূর্বল৷ তবে এখন এ দলও যেন ধীরে ধীরে বেশ শক্তি সঞ্চয় করছে।

এবারের নির্বাচনী ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, হীথ নির্বাচন ঘোষণা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার ফন্দি আঁটছে। কিন্তু তবু ৯ ই ফেব্রুয়ারী তাদের দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা করার প্রাককালে দলের চেয়ারম্যান ক্যালাহ্যন এ নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছেন।

শ্রমিক দলের পার্লামেন্টারী গ্রুপের নেতা প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী উইলসনও নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছেন এই বলে যে, টোরি দল অর্থাৎ রক্ষণশীলদের সৃষ্ট সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বৃটেনবাসী তাদের মতামত জানা্ার সুযোগ পেল। উইলসনের বিশ্বাস, বৃটেনবাসী এ সুযোগ যথাযথ ভাবে ব্যবহার করবে। তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন – আসুন আমরা একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার নির্বাচিত করি – যে সরকার হবে বৃটেনের সমস্ত জনগণের। তা আরাধ্য হলে আমরা আবার ঐক্যবদ্ধ ভাবে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হতে পারবো।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হীথও আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়েছেন। পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে তিনি উগ্রপন্থীদের দায়ী করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হীথ বলেছেনঃ শ্রমিক দলের নেতৃত্বও আজ উগ্রপন্থীদের হাতের মুঠোয়। ফলে গণতান্ত্রিক বৃটেনের রাজনৈতিক ভবিষ্যতই এখন অ – নিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ সময়ে চাই সবার সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনা৷ প্রধানমন্ত্রী হীথ তাই একটা কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়েছেনঃ ‘হু গভার্নস বৃটেন? ‘ ওদিকে উইলসনও তার জবাব দিয়েছেনঃ খনি শ্রমিকদের ধর্মঘটের জন্য টোরিরাই দায়ী। এটা সরকারী ব্যর্থতা। সরকার ইচ্ছে করলেই একটা আপোস সূত্র বের করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। উইলসনের মতে, খনি শ্রমিকদের ধর্মঘটের ভীতি দেখিয়ে হীথ চাইছেন, মানুষের দৃষ্টি থেকে জিনিসপত্রের চড়া দাম, মুদ্রাস্ফীতি এবং কমন মার্কেটের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে দূরে রাখতে। উইলসন অভিযোগ করেছেনঃ হীথ বৃটেনকে সমৃদ্ধির রাস্তা থেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছেন। কিন্তু হীথের শুধু ওই এক কথাঃ একটা নির্বাচিত সরকারের সামনে একটা ট্রেড ইউনিয়ন কিভাবে বাঁধা হয়ে দাড়ায়?সরকারকে সমর্থন দিয়ে দেশের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা কি তার দায়িত্ব নয়? হীথ বলেছেনঃ উগ্র ধর্মঘটীদের অসহযোগী মনোভাবকে প্রশমিত করে নির্বাচনটা অন্তত সুন্দরভাবে করতে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন উইলসনকে। কিন্তু সে সুযোগটাও দেন নি।

অভিযোগ – পাল্টা অভিযোগে বৃটেনের নির্বাচনী রাজনীতি বেশ জমে উঠেছে। অন্য দিকে রক্ষণশীল দের পক্ষ থেকে নির্বাচনে এবার অংশ নেননি ইনোক পাওয়েল৷ তার অভিযোগঃ নেতৃত্ব দূর্বল। অবশ্য শেষ মুহুর্তে উত্তর আয়ারল্যান্ডের কোন এক কেন্দ্র থেকে হয়ত তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েও ফেলতে পারেন। তার যে আসল কেন্দ্র, সেখানে টোরি দল মনোনয়ন দিয়েছে ডাঃ স্টোন নামে এক অখ্যাত ব্যক্তিকে। প্রধানমন্ত্রী হীথের সাথে নিউ সিডকাপ কেদ্রে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শ্রমিক দলের এক তরুণ আইনজীবী কলিন হারগোভ। বয়স তার মাত্র ২৮ বছর। অবশ্য তবু কৃমার হীথ যে জিতে যাবেন, তাতে সবাই নিঃসন্দেহ। এর অন্যতম কারণ নাকি মহিলাদের অকুণ্ঠ সমর্থন।

নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে উগ্রপন্থীদের কথা বেশী শোনা না গেলেও তাদের নেতা জেরেমী থর্ম ইতিমধ্যে বলেছেন, নির্বাচন চলাকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে তিনি দেশের বৃহত্তম দুই দলের মধ্যে একটা ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। অর্থাৎ দুই দলের নির্বাচনের ঘোষণাপত্র দেখেই বোঝা যায় যে, একের প্রতি অপরের দৃষ্টি এখন কতটা বিরূপ। টোরি দলের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের প্রথম কথাই হলঃ সুন্দর বৃটেনের জন্য দৃঢ ও কঠোর কাজ। শ্রমিক দল ক্ষমতায় গেলে অর্থনীতি ধ্বসে যাবে – এমন কথাও বলা হচ্ছে সেখানে৷ ধর্মঘটী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারীও বাদ পড়েনি সেখানে৷ শ্রমিক দল তাদের ঘোষণাপত্রে দ্রব্যমূল্যের বর্তমান অবস্থা, বেকারত্বের মত কমন মার্কেট ইস্যু, এসবকেই মুখ্য বক্তব্য হিসেবে রেখেছে৷ তাদের বক্তব্যঃ ক্ষমতায় গেলে আপোসে ধর্মঘটের মীমাংসা করা হবে। শ্রমিক দল অবশ্য অর্থনৈতিক কার্যকরণ গুলোই বেশী করে তুলে ধরেছে। কমন মার্কেট নিয়ে তাদের বক্তব্য হলোঃ কমন নীতির জন্য চড়া দামে খাদ্য কিনতে হচ্ছে। অথচ মার্কেট বহির্ভূত দেশ থেকে কিনলে অনেক কম দামে কেনা যেত। এমন অবস্থায় জনমত যে কোন দিকে ঝুঁকবে – বোঝা মুশকিল।

অবশ্য বৃটেনের বিভিন্ন পত্রিকার জনমত যাচাই রিপোর্ট বলছে, টোরি দলের প্রাধান্যই বেশি। এক ডেলি টেলিগ্রাফের যাচাই রিপোর্ট ছাড়া অন্য সব পত্রিকা ডেলি মিরর, অবজারভার ইত্যাদি রায় প্রাধান্য রক্ষণশীলদের। ডেলি মিরর প্রশ্ন করেছিলঃ এ ধরণের ধর্মঘট হলেই কি নির্বাচন দেয়া বাঞ্ছনীয়? প্রায় শতকরা ৪৭ ভাগ ভোটারের উত্তর – হ্যাঁ৷ বোঝা দুষ্কর নয়, এই হাঁ কিসের সূচক। কারণ শ্রমিক দল ছিল খনি শ্রমিকদের ধর্মঘটের পক্ষে। হীথের নির্বাচন ঘোষণারও বিরোধী ছিল তারা। তাদের বক্তব্য, আরো ১৮ মাস হীথ সরকার চালাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে নির্বাচনে এলেন কেন? শ্রমিক দলের বক্তব্যঃ এটা হীথের কুট কৌশল।

ডেলি এক্সপ্রেস যে জরিপ চালিয়েছে, তাতে দেখা যায়ঃ বৃটেনের ৩০ শতাংশ মানুষ চড়া দ্রব্যমূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতিকে দায়ী করেছে বর্তমান সংকটের জন্য। বাকী ২৭ শতাংশ মানুষ বলছে, খনি শ্রমিকদের বর্ধিত বেতন দাবী এবং ধর্মঘট, ২৬ শতাংশ দায়ী করছে, ধর্মঘটী উগ্রপন্থীদের চরম পন্থাকে, ১০ শতাংশ ভাবছে কমন মার্কেটই হচ্ছে সংকটের কারণ।

বোঝা যাচ্ছে না, ৭৪ এর বৃটেন নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কি হবে? তবে অবস্থা দেখে শুধু এটুকু বলা সম্ভব যে, বৃটেনের জনগণ নতুন কোন পরিবর্তনের ঝুঁকি হয় তো এখন নিতে চাইবেন না৷ আর সেক্ষেত্রে হয় তো রক্ষণশীলরাই থাকছে শাসন ক্ষমতায় অপরিবর্তিত।

***

পাকিস্তানের স্বীকৃতি
নতুন পথ খুলে যাবে কি?
– আহমদ আনিসুর রহমান

১৯৭৪ সনের ২২শে ফেব্রুয়ারীির সন্ধায় পাকিস্তানের স্বীকৃতি এলো বাংলাদেশের জন্য। প্রায় ১৪০ সদস্যের আন্তর্জাতিক সমাজের ১১৬ টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এসে গিয়েছিল পূর্বাহ্ণই৷ এক চীন ছাড়া বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে চীন ছাড়া অন্য কারো স্বীকৃতি দেবার বাকী নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৫ শে জানুয়ারী, ১৯৭২, যুক্তরাজ্য ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২, ফ্রান্স ১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ এবং ৪ এপ্রিল, ১৯৭২ এ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সবচাইতে আগে প্রয়োজন প্রতিবেশী দেশ গুলো থেকে, তারাও বহু পূর্বেই স্বীকৃতি দিয়েছে। (ভারত ৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ এবং বর্মা ১২ ই জানুয়ারী, ১৯৭২)

সীমান্তবর্তী দেশগুলোর স্বীকৃতি, গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলোর জন্যে সবচাইতে প্রধান এবং প্রাথমিক প্রয়োজন। কেননা, প্রতিষ্ঠা হবার সাথেই তার সেই গৃহযুদ্ধের তরল পরিস্থিতিতে যদি হুমকি আসার সম্ভাবনা থেকে থাকে, তাহলে তা আসবে এই সব সীমান্তবর্তী দেশ গুলো থেকেই।

সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র গুলোর সাথে সাথে বৃহৎ শক্তির স্বীকৃতি প্রয়োজন, কেননা আজকের এই শান্তির রাজনীতির পৃথিবীতে বৃহৎ শক্তিসমূহের সন্তোষই শুধু যে কোন ঘটনার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির একমাত্র উপায়।

বাংলাদেশ ইতিপূর্বেই দুটি পেয়ে গিয়েছিল। এমন কি পাকিস্তানের স্বীকৃতির প্রয়োজন থাকতে পারতো সেই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি – (তথা মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতি আসন পাবার স্বার্থের ক্ষেত্রে) – সেই ক্ষেত্রেও তো আর পাকিস্তানের স্বীকৃতির তেমন প্রয়োজন ছিল না৷ ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ সনে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র সমাজের তরফ থেকে বাংলাদেশকে গ্রহনের হস্ত প্রসারিত করে। ৮ ই জুলাই ইরাক এবং তার পর পরই দক্ষিণ ইয়েমেন স্বীকৃতি দিলে আরব বিশ্বেও আর স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয় নি। তবে পাকিস্তানের এই এতো দেরীতে আসা স্বীকৃতির সংবাদে বাংলাদেশে এতো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া কেন? স্বীকৃতির সংবাদের সাথে সাথে রাজধানী সহ সারা দেশেই শুধু নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালী বস্তিগুলোতে পর্যন্ত এক প্রশান্তি, তৃপ্তি এবং সন্তোষসহ আনন্দের উপলক্ষ এসে উপস্থিত হয়। হৈ চৈ, উল্লাসধ্বনি এবং উল্লাসজ্ঞাপক পটকার শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে ওঠে এবং শহরের শরীর জুড়ে মিছিল বেরুুতে শুরু করে। কেন এই ব্যাপক আনন্দ এবং তৃপ্তি। –

আপাতদৃষ্টিতে এতো বিলম্বে প্রায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়া পাকিস্তানের স্বীকৃতিতে বাঙালী জাতির এতো অস্বাভাবিক খুশী এবং উল্লাসে ফেটে পড়ার একটিই মাত্র প্রধান এবং বাস্তবিক কারণ জনমনে থাকতে পারে বলে মনে হয়। (উল্লাসরত এক জন পথচারীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, স্বীকৃতিতে খুশী কেননা এখন জিনিসপত্রের দাম কমবে)। তা হলো, এখন স্বীকৃতির ফলে পুনরায় পাকিস্তানের সাথে বানিজ্য শুরু হবে এবং সেক্ষেত্রে বর্তমানে ভারতীয় বানিজ্যের প্রায় একচেটিয়া বাজারে পরিণত হয়ে আগে বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসায়ের পরিবর্তে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজার সৃষ্টি হবে, পাক ভারত বানিজ্যিক প্রতিযোগিতায় মাঝখান দিয়ে লাভবান হবে বাঙালী ক্রেতা সাধারণ।

এমন চিন্তা করা অযৌক্তিক নয়৷ যে কোন দেশই অন্য একটি দেশের একচেটিয়া বাজারে পরিণত হলে বৈজ্ঞানিক স্বতঃসিদ্ধের মতই প্রায়, এ বিষয়টি সত্য যে ব্যবসায়ী রাষ্ট্রটির ব্যবসায়ীরা বাজার রাষ্ট্রটিকে যাচ্ছে তাই, স্বরাষ্ট্রে অচল যা, এই ধরণের নিকৃষ্ট পণ্য পাঠাবে এবং তারই জন্য স্বরাষ্ট্রে যে দামে বিক্রি হয়, তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি দাম আদায় করবে। বাজার রাষ্ট্রটির জনগণের নিকট অন্য কোন অল্টারনেটিভ না থাকায় তাদের ঐ পচা মালই ঐ চড়া দামে কিনতে বাধ্য হতে হয়। ফল হয় অগ্নিমূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতির পথ প্রশস্তকরণ। ফলশ্রুতি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড গুড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রটি ব্যবসায়ী রাষ্ট্রটির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। হতে পারে সে সেই রাষ্ট্রটির নীতিনির্ধারকেরা যতই এমনটি না ঘটাবার জন্য উদগ্রীব থাকুক না কেন। (লেনিনের সূত্র অনুযায়ী এই রকম পরিণতি অপরিহার্যতার বিষয়টি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। এই মর্মে রীতিমতো একটি লেনিনবাদী সূত্রও রয়েছে৷) কিন্তু স্বীকৃতির অর্থই যে পাকিস্তানের সাথে বানিজ্য সম্পর্কে অবশ্যম্ভাবী পুনর্স্থাপন, তার কোন অর্থ নেই৷ পাকিস্তানের সাথে অর্থ বানিজ্য করবার ইচ্ছে যদি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের থাকতো – তাহলে তা স্বীকৃতি ছাড়াও করা যেত – কেননা আন্তর্জাতিক আইনে বানিজ্যিক সম্পর্কের জন্য স্বীকৃতি কোন অপরিহার্য শর্ত নয়। স্বয়ং বাংলাদেশও মিশরের সাথে মিশরের স্বীকৃতির বহু পূর্বে থেকেই, নগণ্য পরিমাণে হলেও, বানিজ্যিক সম্পর্ক রেখে আসছিলম ঢাকায় মিসরীয় কনস্যুলেটও ছিল৷

তারপরও একাধিক রাষ্ট্রের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়াটাও একটি রাষ্ট্রের ‘এক চেটিয়া বাজার’ স্ট্যাটাস থেকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলক বাজারে’ উত্তীর্ণ হবার জন্য কোন অনস্বীকার্য নিশ্চিতিক নয়৷ জাপানের সাথে বাংলাদেশের বানিজ্যিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এবং জাপানী কোন পণ্য অন্য যে কোন দেশের তুলনায় গুণে মূল্যে শ্রেষ্ঠতর হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক যন্ত্রের নীতি সমূহের ফলে জাপান এখানকার বাজাারটিকে তার প্রতিপক্ষের সাথে খোলাখুলি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাচ্ছে না।

১৯৭২ সনের ১৯ শে মার্চে সম্পাদিত ভারত – বাংলাদেশ ‘ঢাকা চুক্তি ‘র ৫ম ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতের সাথে এমন কোন বানিজ্যেই লিপ্ত হবে না বা হতে পারবে না, যাতে অন্য পক্ষের বানিজ্য স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে।

যদি তাই হয়, তাহলে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এনে একচেটিয়া বাজারের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাজারে পরিণত করার চেষ্টা করা হবে এই চুক্তি কে লঙ্ঘন করার চেষ্টা।

বাঙালী অল্পে খুশী হয়, অল্পে অস্থির হয়। কিন্তু পৃথিবী বড় কঠিন জায়গা।

পাকিস্তানীয় স্বীকৃতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সর্বনাশ থেকে উদ্ধারের জন্য কোন চূড়ান্ত ব্যবস্থা নয়৷ বাংলাদেশকে এখনো অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে এবং অদক্ষ কুটনৈতিক যন্ত্র নিয়ে এ যে যে পরিমাণ কুটনৈতিক বিজয় ঘটাতে পেরেছে তারই মাধ্যমে তাকে অগ্রসর হয়ে দেখতে হবে কিভাবে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির সঠিকভাবে পথের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে৷

***

দৃষ্টি খুলে যায় এমন একটা কিছু লিখতে চাই
-বিচিত্রার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অন্নদাশংকর রায় – এর সাক্ষাৎকার

[রবীন্দ্রোত্তর যুগের বরেণ্য সাহিত্যিক, পথে প্রবাসে, সত্যাসত্য প্রভৃতির স্রষ্টা বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা অন্নদাশংকর কালজয়ী প্রতিভা অন্নদাশংকর রায় সম্প্রতি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে উপস্থিত হয়েছিলেন।

আমরা বিচিত্রার পক্ষ থেকে অন্নদাশংকর রায় এর সাক্ষাৎকার গ্রহন করার অনুমতি প্রার্থনা করি৷ তিনি এবং তার সহধর্মিণী লীলা রায় আমাদের অনুরোধ রক্ষা করতে সম্মত হন৷ গত ১৮ ই ফেব্রুয়ারী তারিখে স্থানীয় এক হোটেলে আমরা সাক্ষাৎকার গ্রহন করি। নীচে ওই সাক্ষাৎকারের বিবরণ ছাপা হলো]

তখন বেলা একটা বেজে গেছে৷ আমরা লিফটে চড়ে দু তলায় উঠে নির্দিষ্ট কক্ষটির দরজায় টোকা দিই। দু তিনবার টোকা দেবার পরও কেউ দরজা খুলে দেয় না৷ তখন আমরা নীচে গিয়ে খোঁজ নিই৷

রায় তখন লাঞ্চ সেরেছেন। লাঞ্চ শেষ করে আইসক্রিম আইসক্রিম খাচ্ছিলেন৷ আমাদেরকে তিনি উপরে, তার কামরার সামনে, অপেক্ষা করতে বলেন। আমরা তার কথা মত তার বন্ধ কামরার সম্মুখে অপেক্ষা করতে থাকি। মিনিট পনেরো পর রায় উপরে উঠে আসেন। রায় দরজা তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। আমাদের আহ্বান জানালে আমরাও তার কামরার ভিতর প্রবেশ করি।

অন্নদাশংকর রায় – এর পরনে হালকা নীল রংয়ের শার্ট এবং জেট ব্ল্যাক ট্রাউজার। ট্রাউজারের কাপড় পশমী।

লীলা রায়ের পরনে হালকা ইট রংয়ের শাড়ী এবং সাদা সিল্কের ব্লাউজ। মাথার বাদামী চুল পাতা কেটে আচড়ান।

পরিচয় বিনিময় করার সময় লীলা রায় আমাকে করজোড়ে নমস্কার জানান।

রায় পরিচয় বিনিময়ের পর জুতো খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। আমরা তার হাতে এক কপি চলতি সংখ্যা বিচিত্রা দিলে তিনি সেটির পাতা উল্টে দেখতে থাকেন।

কামরায় আমাদের অচেনা আরো দু ব্যাক্তি ছিলেন। তারা ওদের নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলেন। ক’মিনিট পর ওরা বিদায় নেত।

ইত্যবসরে আমি লীলা রায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকি৷ লীলা রায় জানতে চান ক’মাস আগে বিচিত্রার তরফ থেকে সমরেশ বসুর যে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, সেটা কে নিয়েছিলেন। আমি জানাই সাক্ষাৎকারটি আমি নিয়ে ছিলাম।

লীলা রায় বলেন, তোমার ওই লেখাটা আমি পড়িনি। তবে রায় পড়েছে। ও বলছিল, সমরেশ নাকি আমার নাম নিয়ে কিছু বলেছে।

বললাম, হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন, আপনার একটা প্রশ্ন ওকে নিজের রচনা সম্পর্কে দ্বিতীয় বার ভাবতে উৎসাহিত করেছে।

লীলা রায় বললেন, কি জানি। সমরেশ কেন ওকথা বলেছে। তবে, ও এক বার শান্তিনিকেতনে আমাদের সঙ্গে ছিল বটে। একদিন, তখন সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে, আমাদের বাড়ীর গেট ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে একজন – একটি যুবক ঢুকে পড়ল৷ আমার কাছে এসে বলল, আমার নাম সমরেশ বসু। আপনি আমাকে চেনেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি তোমাকে চিনি। তখন সমরেশ আমাদের সঙ্গে প্রায় মাসখানেক ছিল। পরে জানতে পারি, সমরেশই কথায় কথায় জানায়, কারা যেন তাকে মারবে বলে খুঁজে বেড়াচ্ছে – সে তাদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য শান্তিনিকেতনে পালিয়ে এসেছে।

বললাম, আপনি তো সমরেশ বসুর গল্প অনুবাদ করেছেন?

হ্যাঁ করেছি। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ায় গল্প গুলো ছাপা হয়েছে।

আপনি সমরেশ বসুর আর কোন গল্প বা উপন্যাস অনুবাদ করার কথা ভাবছেন?

হাঁ, ওর গঙ্গা উপন্যাসটা অনুবাদ করার ইচ্ছা আছে আমার। তবে, গঙ্গার ভাষা একটু অন্যরকম। অনুবাদে এই ভাষার স্বাদ বজায় রাখা ডিফিকাল্ট হবে।

– আপনি বাংলাদেশের কেনো লেখক – লেখিকার বই অনুবাদ করার কথা ভেবেছেন?

– আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনও তেমন কিছু পছন্দ করে উঠতে পারিনি। তবে, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক মাজহারুল ইসলাম সাহেব আমাকে এই বইয়ের কবিতাগুলো অনুবাদ করে দিতে বলেছেন। এই বইটি – আধুনিক কবিতা। এটি সম্পাদনা করেছেন – রফিকুল ইসলাম। এতে যেসব কবিতা আছে, আমি সেগুলো অনুবাদ করবো৷

এরপর আমি বিছানায় শায়িত অন্নদাশংকর রায়ের পাশে একটি চেয়ারে বসি।

জনাব রায়েের সমীপে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিলঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আপনি তো এই নিয়ে ঢাকায় দ্বিতীয় বার এলেন?

অন্নদাশংকর রায়ঃ হ্যাঁ। স্বাধীন হওয়ার পর এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। বছর চল্লিশেক আগে, ১৯৩৩ সালেও আমি একবার ঢাকায় এসেছিলাম, তেত্রিশের জুলাইয়ে এসেছিলাম আর ১৯৩৪ এর ফেব্রুয়ারিতে চলে গিয়েছিলাম।

বিচিত্রাঃ আপনি তো তখন হাকিম ছিলেন?

অ রাঃ সরকারী চাকরী করতাম

বিচিত্রাঃ আপনি কি এখন শান্তিনিকেতনে আছেন?

অ রাঃ না, আমি এখন কলকাতায় আছি। রিটায়ার লাইফ লিভ করছি। চাকরী থেকে রিটায়ার, লেখার কাজ থেকে রিটায়ার নয়৷

বিচিত্রাঃ আপনি কি এর আগে বিচিত্রা পত্রিকাটি দেখেছিলেন?

অ রাঃ আমি কলকাতায় গড়িয়াহাটার একটি স্টল থেকে মাঝে মধ্যে পত্রিকাটি কিনি।

বিচিত্রাঃ গতবার আপনি ঢাকায় ক’দিন ছিলেন?

অ রাঃ গতবার চার দিন ছিলাম। এবার ন’দিন থাকব।

বিচিত্রাঃ আপনি কি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছেন?

অ রাঃ আমরা আপনাদের গেস্ট – অতিথি। আপনারা যে যখন খেতে ডাকছেন – যাচ্ছি। সবাইয়ের সঙ্গে মেলামেশা করার অবকাশ কোথায়?

বিচিত্রাঃ আপনি তো মূলত সাহিত্যিক। এইসব আনুষ্ঠানিকতা আপনার কাছে মূলত বিরক্তিকর মনে হয় না?

অ রাঃ উপায় কি!

বিচিত্রাঃ আপনি তো এক সময় বাংলা ছাড়া আর একটি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন।

অ রাঃ ও হ্যাঁ, উড়িয়া ভাষায় কবিতা লিখতাম।

বিচিত্রাঃ ওই ভাষায় লেখা আপনার কোন বই আছে?

অ রাঃ সবুজ কবিতা নামে একটা এন্থোলজি বেরিয়েছিল। তাতে আমার কবিতা ছিল। ওই এ্যান্থোলজির সম্পাদক ছিলেন কালিন্দাচরণ পানিগ্রাহী – খুব গুণী লোক। একবার মন্ত্রী হয়েছিলেন।

বিচিত্রাঃ আপনার প্রথম বই তো পথে প্রবাসে। প্রমথ চৌধুরী যেটি পড়ে দারুণ প্রশংসা করেছিলেন।

অ রাঃ প্রথম প্রকাশিত বই পথে প্রবাসে। তবে, প্রথম লিখেছিলাম তারুণ্য।

বিচিত্রাঃ রত্না ও শ্রীমতী উপন্যাসের তৃতীয় খন্ড আপনি এত দেরী করে লিখলেন কেন?

অ রাঃ আমি ভেবেছিলাম আর লিখবো না। পনে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়।

বিচিত্রাঃ এই পরিবর্তনের কারণ?

অ রাঃ গল্পের ভেতর এমন অনেক জিনিস ছিল যা লিখলে অনেকে অসন্তুষ্ট হতো। শেষ পর্যন্ত কম্প্রোমাইজ করতে হলো।

বিচিত্রাঃ এই যে কম্প্রোমাইজ করলেন, এর জন্য আপনার মনে কোন খেদ নেই?

অ রাঃ কম্প্রোমাইজের জন্য কোন খেদ নেই। সাহিত্যে জীবনকে পুরোপুরি ইমিটেট করা যায় না। সম্ভব নয়।

বিচিত্রাঃ আপনি বলেছেন, বাংলাদেশে খবরের কাগজের ভাষা খুব জোরালো। এই কথাটির দ্বারা আপনি কি বোঝাতে চেয়েছেন?

অ রাঃ ওদের কাছে ভাষা তো একটা হাতিয়ার। তলোয়ার যেন। ওরা ভাষা দিয়ে আন্দোলনকে সফল করে তুলেছে – তুলছে। বাঙালী মিলিটারী আর কোথায়? রক্ষীবাহিনী আছে। কিন্তু রক্ষীবাহিনী মিলিটারী নয়। বাংলাদেশের বাঙালীদেরও হাতিয়ারও লেখনী। ওটা দিয়েই বাঙালী আন্দোলন করবে। আন্দোলনে সাফল্য অর্জন করবে। বাঙালীরা বড্ড ভাবুক হয়। বাঙালীরা যুদ্ধে যেতে চায়, তবে জওয়ান হয়ে নয়, অফিসার হয়ে। আমাদের ভারতেও বেঙ্গল রেজিমেন্ট নেই। রেজিমেন্ট হবে কোথা থেকে, আমি ভারতের কথা বলছি, দশটা বাঙালী একত্রিত হলে ন’টা দল করবে, আর একটা পাগল হয়ে যাবে – মোট কথা, বাঙালীদের মিলিটারী আউটলুক নেই। আমি অবশ্য বাংলাদেশের বাঙালীদের কথা বলছি না। আমি এখানে গেস্ট হিসেবে আছি, এখানকার ঘরোয়া ব্যাপারে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

বিচিত্রাঃ এখন আপনি কি লিখছেন?

অ রাঃ একটা বড় নভেল লেখার খুব ইচ্ছে আছে। সেটা টরে হবে। আপাতত হিন্দু সংস্কৃতির উপর লেকচার দেবার জন্য তৈরী হচ্ছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ওই বিষয়েও বক্তৃতা দেয়ার জন্য বলেছেন।

বিচিত্রাঃ হিন্দু সংস্কৃতি বলতে আপনার ধারণা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

অ রাঃ হিন্দু সংস্কৃতি বলতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃতি বোঝায়৷ এতে মারাঠা, তামিল, পান্জাবী সবই আছে। বাঙালী সংস্কৃতি মূলত হিন্দু সংস্কৃতি থেকে আলাদা৷ বাঙালী সংস্কৃতি হিন্দু মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতি। বাঙালী সংস্কৃতির ইনগ্রেডিয়েন্টস অনেকগুলো৷ মুসলমানরা এই উপমহাদেশে আসার আগেও এখানে একটা সংস্কৃতি ছিল৷ সেটার নাম আমি দিতে চাই সিন্ধু সংস্কৃতি। তারপর হলো হিন্দু মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতি। আমি এর নাম দিতে চাই ভারতীয় বা হিন্দুস্তানী সংস্কৃতি। এরপর ইউরোপীয়ানদের সংস্পর্শে আসার ফলে আর একটি সংস্কৃতির জন্ম হলো। এর নাম আমি দিতে চাই হিন্দু – মুসলিম – ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি। আমি বলব, বলতে চাই, এটা বিশুদ্ধ সংস্কৃতি নয়৷ আধুনিক হিন্দুস্তানী বা ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশেল আছে। ইউরোপকে ছাড়া আধুনিকতার কথা চিন্তাও করা যায় না৷ ওটা বাদ দিলে চলবে না।
বিচিত্রাঃ আচ্ছা রায় সাহেব, বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো বই লেখার কথা ভাবছেন? একদা জাপানকে নিয়ে যেমন লিখেছিলেন?

অ রাঃ জাপানের মতো বাংলাদেশের উপর বই লেখা সম্ভব নয়। জাপানে সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক তফাৎ আছে।

বিচিত্রা আপনি কি পশ্চিম বঙ্গের তরুণ লেখকদের লেখা পড়েন?

অ রাঃ পড়ি। তবে, সিসটেমেটিকলি নয়। যখন যার লেখা হাতের কাছে পাই তার লেখাই পড়ি।

বিচিত্রাঃ আপনি সুনীল, শক্তি, বরেণ, অতীন এদের লেখা পড়েছেন?

অ রাঃ পড়েছি। প্রায় প্রত্যেকের লেখাই। কিন্তু বললাম তো নিয়ম করে নয়। আর কি জানেন, সুনীল মাসে চারটি করে উপন্যাস লেখে – ইচ্ছে থাকলেও ওর লেখা – সব লেখা পড়ে ওঠা সম্ভব?

বিচিত্রাঃ সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?

অ রাঃ মোটামুটি পরিচয় ছিল – অন্তরঙ্গতা ছিল না। উনি নিভৃতি পছন্দ করতেন, আমিও নিভৃতি পছন্দ করতাম। আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রও আলাদা – লেখার মন মেজাজও এক নয়। হ্যাঁ, আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল, ভাল পরিচয় ছিল, ওর পান্ডিত্য সম্পর্কে আমি সচেতন। আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ছিল না।

বিচিত্রাঃ আপনি যুবক বয়সে এক ইউরোপিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি আপনার একতম সহধর্মিণী লীলা রায়। আমরা যতদূর জানি, তখনকার সমাজ এ ধরণের বিয়ে সমর্থন করত না, প্রশ্রয় দিত না। আপনাকে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় নি?

[আমার এই প্রশ্নটি শুনে জনাব অন্নদাশংকর রায় কেমন যেন উন্মনা হয়ে পড়লেন। ভাবলেন কি যেন কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে। তারপর বললেনঃ ]

অ রাঃ আপনি একটি ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করেছেন। আমি এ ব্যাপারে আর কিছু বলব না। আপনি আর জিজ্ঞেস করবেন না।

বিচিত্রাঃ আপনার লেখা গল্পগুলো পড়লে মনে হয় চরিত্রগুলো যেন অলৌকিক কিছুর সন্ধান করছে। পার্থিব দুনিয়ার চৌহদ্দির ভিতরে থেকেও তারা অপার্থিব একটা কিছুর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে মনে হয়? আপনি কি কনশাসলি এইসব গল্প লেখেন? লিখলেও, কেন লেখেন?

অ রাঃ কি জানেন, একভাবে বলতে গেলে আমি আমার গল্পগুলোতে একটা ইনার লাইফের কথাই বলতে চাই। গল্পে স্পিরিচুয়াল ভাবটা যেন থাকে, এটা আমি বিশেষভাবে, হ্যাঁ তা কনশাসলি তো বটেই, খেয়াল রাখি। দৃষ্টি খুলে যায় এমন একটা কিছু লিখতে চাই আমি।

বিচিত্রাঃ আপনি কি জন্মান্তরে বিশ্বাস করেন?

অ রাঃ আমি মানুষের আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাসী। আমি মনে করি, মানুষের মৃত্যু হলেই সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। ওই যে বলে, গরু ছিল, মানুষ হয়েছে। বা ভেড়া ছিল, ছাগল হয়েছে। ওসব বিশ্বাস করি না। তবে আমি বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পরেও জীবন রয়েছে৷

বিচিত্রাঃ উনিশ শ একাত্তর সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনি একটা ছড়া লিখেছিলেন? এই ছড়া লেখার আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার পরিচয় ছিল?

অ রাঃ প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। তবে ওর অবদান সম্পর্কে আমি জেনেছি। শেখ মুজিবর রহমান অত্যন্ত ভালো লোক। দয়ালু। হ্যাঁ এটাই ওর চরিত্রের মহৎ দিক। শুরুতে উনি দয়া দেখিয়েছেন, কারো প্রতি কঠোর আচরণ করেননি। এখন উনি শক্ত হচ্ছেন। বিপ্লব টিপ্লবের কথা ভুলে যাও। বিপ্লব আর আসছে না। দেশ গঠনের জন্য তৈরী হও।

বিচিত্রাঃ অনেক ধন্যবাদ। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যায় আপনি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ওই প্রবন্ধে আপনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হলে সহিংস বিপ্লব ঘটবে। ভারতে কি গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে?

অ রাঃ এ সম্পর্কে এখনই নির্দিষ্ট করে কিছু বলার সময় আসেনি।

বিচিত্রাঃ গণতন্ত্রের মাধ্যমে কি সমাজতন্ত্র অর্জন সম্ভব? আপনার মতামত?

অ রাঃ গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র সবই ধার করা বুলি। এসব বুলি দিয়ে কদ্দুর আর কি অর্জন করা যায় আমি তা নিশ্চয় করে বলতে পারছি না৷

বিচিত্রাঃ যুদ্ধোত্তর দেশে ভায়োলেন্সের প্রবণতা সম্পর্কে আপনার কি মতামত?

অ রাঃ এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, নতুন কোনো ব্যাপারও নয়। সবদেশেই একটা যুদ্ধের পর ভায়োলেন্স পারসিসট করে। ইটালিতে এটা ছিল, আমেরিকাতেও ছিল। যুদ্ধ একটা ভয়ংকর ব্যাপার। যুদ্ধ মানুষকে অমানুষ করে। আমি তাই কখনো যুদ্ধ সমর্থন করি না।

বিচিত্রাঃ মুক্তিযুদ্ধ আর যুদ্ধের মধ্যে আপনি কোন পার্থক্য খুঁজে পান?

অ রাঃ সব যুদ্ধই সমান ঘৃণ্য৷ আমি গান্ধীজীর নীতিতে বিশ্বাসী, আমি মনে করি, সব সমস্যার সমাধান অহিংসভাবেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বিচিত্রাঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

অ রাঃ বাংলাদেশের জনগণ শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, প্রতিবাদ জানিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ ভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। নিজের জীবন বাজী রেখেছেন। তার শুভবুদ্ধিতে কেউ কর্ণপাত করেনি। তাই যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হলো। এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না৷

সাক্ষাৎকার – শেখ আবদুর রহমান।

***

লেখালিখি

কবিতাশিবির, কতিপয় কবি ও একটি ম্যানফেস্টো

গত সপ্তাহে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের তত্ত্বাবধানে এবং কন্ঠস্বর গোষ্ঠীর উদ্যোগে টিএসসির সম্মুখে আইল্যান্ডে বাংলাদেশের তরুণ, তরুণতর এবং তরুণতম কবিদের কবিতাপাঠের আসর সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করেছিলাম। এবার জানাচ্ছি কবিতা শিবিরের পক্ষ থেকে আয়োজিত কবিতাপাঠের আসরের বিবরণ।

কবিতা শিবিরের পক্ষ থেকে কবিতা পাঠের যে আয়োজন করা হয়, সেটি কন্ঠস্বরের আয়োজন থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। এই আসরের যারা কবিতা পাঠ করেন তাদের প্রত্যেকেই একটি করে রক্তলাল গোলাপ দিয়ে সম্মানিত করা হয়।

সভাপতি এবং প্রধান অতিথির ভাষণও খুবই উপভোগ্য এবং মনোজ্ঞ হয়ে ছিল। আগে কবি এবং কবিতা সম্পর্কে বলে নিই। পরে ভাষণের বক্তব্যও আপনাদের জানাব।

কবিতা শিবির আয়োজিত কবিতা পাঠের আসরে প্রথম নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে শোনান সানাউল হক খান।

কবিদের নাম ধরে কবিতা পড়তে আহ্বান জানিয়েছিলেন হাবিবুল্লাহ সিরাজী ও শাহনূর খান। এক পর্যায়ে মুহম্মদ নুরুল হুদাকে কবিতা পড়তে আহ্বান জানান হয়। ঘোষক তার নামের মুহম্মদ বাদ দিয়ে নুরুল হুদা বলে ডাক দেন। কবি মাইকের সামনে দাড়িয়ে বলেন, নুরুল হুদার সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই বলে আমি মুহম্মদ নুরুল হুদা এখানে কবিতা আবৃত্তি করতে দাড়িয়েছি৷ কবিতা শিবিরের সঙ্গেও আমার কোন বিরোধ নেই। তার গোলাপের সঙ্গেও না।

মুহম্মদ নুরুল হুদা তার কবিতাটি পড়ার সময় সর্বক্ষণ নারী শ্রোতাদের দিকে চক্ষুস্বর আবদ্ধ রাখেন। তার মুখে স্বভাবসুলভ হাসিটিও সর্বক্ষণ লেপ্টে ছিল।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কবিতা পড়ার আগে বলেন, সানাউল হক খান ও শাহনুর খান আমার চেয়ে ভালো কবিতা লেখেন। ওদের মত তরুণ কবিদের সামনে নিজের কবিতা পড়তে সংকোচ বোধ করছি। অগ্রজ বণে এদের সামনে কবিতা পড়তে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আবিদ আজাদ কন্ঠস্বর গোষ্ঠী আয়োজিত কবিতা পাঠের আসরে নিজের রচিত কবিতা পড়েননি। সেদিন বোধহয় তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। কবিতা শিবির আয়োজিত কবিতা পাঠের আসরে তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং বলেন, যে কবি আমার চাকরি খেয়েছে, এ কবিতা তারই উদ্দেশ্যে।

জিনাত আরা রফিক নিজের কবিতা পড়ার আগে বলেন, বেশী ক্ষণ বিব্রত করতে চাই না। আমার কবিতাটি খুবই ছোট।

শিহাব সরকার বলেন, আমি খুব ছোট একটি কবিতা পড়ব। মাত্র চার লাইনের একটি কবিতা। কবিতার নাম সামান্য ক্ষতি।

যেসব কবি কবিতা পাঠ করেন, তাদের প্রত্যেককে কবিতা পাঠের পর হাততালি এবং বিবিধ মন্তব্য করে উৎসাহিত করা হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তার নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতা ও কবিদের একাংশ হাততালি দিয়ে তাকে সম্মানিত করেন।

এই আসরে পশ্চিম বাংলার দুই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও কবিতা পাঠ করার কথা ছিল। উপস্থিত অনেক শ্রোতা ও কবিরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুই কবিকে চোখের দেখা দেখা ও তাদের কবিতা শোনবার জন্য অধীরতা প্রকাশ করেন। ত্রিশংকুকেও অনেকে শক্তি এবং সুনীল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। ত্রিশংকু যখন জানান, শক্তি সুনীল চট্টগ্রাম গেছেন এবং আজ আর ছটার আগে ফিরছেন না, তখন অনেককে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়।

এই আসরে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি আল মাহমুদ। কবিকে কিছু বলতে অনুরোধ জানান হয় কবিতা শিবিরের পক্ষ থেকে। আল মাহমুদ এই আসরের আয়োজনকারীদের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন কবিদের কোনো উপদেশ দেয়া উচিৎ নয়। সে ধৃষ্টতা আমিও দেখাব না। তবে আমার একটা অনুরোধ আছে। সেটা আপনারা বিবেচনা করলে আনন্দিত হবো৷ আমি চাই আমাদের কবিতায় আমাদের দেশের মাটির গন্ধ লেগে থাক। কবিতা বাংলা হয়ে উঠুক। কবি আল মাহমুদ তার দুটো কবিতা আবৃত্তি করে শোনান অতঃপর।

আল মাহমুদের পর ভাষণ দেন সভাপতি আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তার ভাষণটি খুবই উপভোগ্য হয়েছিল। তিনি তার ভাষণ শুরু করেন এইভাবেঃ ‘আমি আবু হেনা মোস্তফা কামাল মফস্বলবাসী কবি৷ কবিদের মধ্যে অকবি, হংসমধ্যে বকো যথা…

কবি আরো বলেন, সাহিত্যের মাস্টারদের স্বভাব কবিতার দেহ ব্যবচ্ছেদ করা… কবিতার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা। কবি আল মাহমুদের প্রতি আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, কবিদের কেউ ডিকটেশন দিতে পারে না। যার যেভাবে খুশী কবিতা লিখতে পারেন। কবিরা কারও পরামর্শ বা উপদেশ – অনুরোধ রক্ষা করতে অপারগ।

কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার ভাষণের শেষে যে মন্তব্যটি করেন তা শ্রোতাদের অনেককেই আপ্লুত করে। তিনি বলেন, আজ যাদের সঙ্গে বসার সৌভাগ্য হয়েছে, দশ বছর পরও কি তাদের পেছনে বসতে পারব? সে সৌভাগ্য কি আমার হবে?

নীচে কবিতা শিবিরের ম্যানিফেস্টোটি মুদ্রিত হলঃ

কবিতা শিবিরের ম্যানিফেস্টো

আজ ১৯শে ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার, ১৯৭৪ সিকদার আমিনুল হক কবিতা শিবিরের পক্ষ থেকে এ ঘোষণাটি পাঠ করছি –

১। কবিতা শিবিরের কবিরা মনে করে, মানুষের পক্ষে হয়তো একটি গোলাপ তৈরী করা সম্ভব নয়। কিন্তু একটি কবিতাকে গোলাপের মত তৈরী করা আজও সম্ভব।

২। আমাদের কবিরা বিশ্বাস করে, কোন হঠকারী ব্যাক্তির পক্ষেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ডেকে আনা সম্ভব নয়, যতদিন না কবিরা বা শিল্পীরা তাকে স্বাগত জানাবেন। পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধই চাওয়া হয়েছিল। আমরা পৃথিবী থেকে এই ঘৃণ্য ব্যভিচারের অবসান চাই। এবং বিশ্বাস করি কবিতা বা যে কোন মহৎ শিল্পই যুদ্ধ বিরোধী।

৩। যারা আপোষ করে তারা কাপুরুষ। কাপুরুষেরা চিরকালই দূর্বল এবং ভীরু। ভীরুরা কোন দিনই সক্ষম কবিতার জন্ম দিতে পারে না। কেননা কবিতা সাহসী কর্ম। বহু শতাব্দীর মানুষের কাছে তাকে জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

৪। জননী ও মৃত্যুকে ভুলে থাকার জন্যই আমরা কবিতা লিখি।

৫। শুদ্ধ কবিতা হচ্ছে একটি গোলাপ। তাকে আমরা কোন দিনই দেখিনি। বাতাসেই তার চিহ্ন থাকে৷

৬। শিশু, ফুল কিংবা কবিতা এবং কখনো অন্তরঙ্গতার জন্য হয়তো বাড়িয়ে থাকে না। পৃথিবীর কদর্যতম শব্দটিও তাদের সামনে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করা যায়।

৭। কবিতা শিবিরের কবিরা বিশ্বাস করে যে কবিতা শিবির থেকে সব কবিরাই একদিন সেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নির্বাসিত হবেন। কিন্তু কবিতা শিবিরের প্রতি যে শেষ কবির অনুগত্য তখনো অটুট থাকবে, তিনিই আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম কবি।

কবিতা শিবিরের উদ্দোক্তা সিকদার আমিনুল হক। এ ব্যাপারে তাকে সর্বপ্রজত্নে সহযোগিতা করেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, জাহিদুল হক ও শাহনুর খান এবং হাবিবুল্লাহ সিরাজী ওরা চারজন।

সম্প্রতি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে কয়েকজন লেখক ঢাকায় এসেছিলেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে ত্রিশংকুর আলাপ পরিচয় ঘটে। এদের মধ্যে সুনীল, শক্তি, বরেণ ও অতীনের সঙ্গে তিনি কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলার সুযোগ পান। তারই প্রতিবেদনঃ

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রাসঙ্গিক এক প্রশ্নের উত্তরে বলেনঃ আমার প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ লেখা হয়েছে সাগরদার(সাগরময় ঘোষ) কল্যাণে। আমি আমেরিকা থেকে ফেরার পর সাগরদা একদিন ডেকে বললেন, এবারের পুজো সংখ্যা দেশ – এ তুমি উপন্যাস লিখছ। সাগরদা আমাদের কালের শেষ সম্পাদক৷ উনি যখন কারো কাছে লেখা চান তখন লেখক সম্পর্কে পরিপূর্ণ আস্থা রেখেই লেখা চান। আমি আগে উপন্যাস লিখিনি কখনো। আমেরিকা থেকে দুটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। দুটি চিঠিই দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সাগরদা উপন্যাস লিখতে বলার পর আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। এর আগে উপন্যাস লিখিনি তো। পুজো সংখ্যায় লেখা দেবার দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে, আমি ততই নার্ভাস হয়ে পড়তে থাকি। একে তাকে জিজ্ঞেস করি, উপন্যাসের পরিচ্ছেদ কিভাবে শুরু করতে হয়? কোথায় শেষ করতে হয়? হিসাবটা কি? তারপর একদিন লেখা শুরু করি অনেক ভেবেচিন্তে আত্মজীবনী ধরণের একটা কিছু লিখতে শুরু করি – ওই নিজের জীবনের উপর একটু কল্পনার রং চড়িয়ে দিলাম আর কি! বন্ধু বান্ধবদের জীবন, জীবন যাত্রা, ঝোঁক, তাদের মুখে শোনা গল্প এসবও আমার উপন্যাসে এসে গেছে। আমি রোজই কিছু কিছু লিখে দিয়ে আসতাম, যা লিখতাম তা আর পড়ে দেখতাম না। উপন্যাস লেখা শেষ হলো। তারপর শুরু হলো আমার দুশ্চিন্তা। পাঠক এ লেখা নেবে তো? যদি না নেয়। এমন চিন্তা বা দুশ্চিন্তায় অক্লান্ত হওয়ার কারণ ছিল। কি জানেন, আমাদের ওখানে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর যে লেখকের লেখা পাঠকরা নেয় না, সে লেখকের কপাল খারাপ বলতে হবে। তার লেখা অবধারিত ভাবেই পাঠক প্রত্যাখান করে নিয়েছেন বলে ধরে নিতে হবে।

– আপনি এক একটা উপন্যাসের জন্য কত করে নেন? পত্রিকায় প্রকাশিত রচনার কথা বলছি?

– এটা কোন পত্রিকার জন্য লিখছি তার উপর নির্ভর করে। তবে মিনিমাম এক হাজারের কম নয়।

– দেশ বিনোদন সংখ্যায় প্রকাশিত প্রকাশ্য দিবালোকে উপন্যাসের জন্য কত পেয়েছেন?

– আড়াই হাজার।

– চাকরী বাকরী করেন?

– আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরী করি। কলকাতার কড়চা আর চিঠিপত্রগুলো দেখার ভার আমার উপর।

– আপনার লেখার কোন নির্দিষ্ট সময় আছে?

– সারাদিনই লিখি। তবে সন্ধার পর কখনো লিখি না।

– তরুণ লেখকদের মধ্যে শুধু আপনারই গাড়ী আছে শুনতে পাই। এটা কি লেখার পয়সায় কিনেছেন নাকি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত?

– গাড়ী আমার রোজগার করা পয়সায় কেনা৷ পৈতৃক সূত্রে কেমন করে পাব? আমি যখন ছোটো, দশ এগারো বছর বয়স যখন আমার, তখন আমাদের দু বেলা খাবার জুটতো না। তার আবার গাড়ী!

আর এক আসরে গল্প করতে করতে সুনীল গাঙ্গুলী ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু ও শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ও তার স্ত্রী বিজয়া মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে মুখরোচক কয়েকটি ঘটনা শোনালেন। সুনীলের ভাষায়ঃ একদিন সমরেশ বসু, আমাকে এবং আরো কজন বন্ধুকে নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন। সেটাই আমাদের প্রথম যাওয়া – রাত তখন একটা হবে, দরজা খুলে দিলেন সমরেশ বাবুর স্ত্রী – সমরেশ বাবুর দুই বিয়ে, ওর আর এক স্ত্রী নৈহাটিতে থাকেন। মহিলা সমরেশ বাবুর প্রায় দ্বিগুণ হবেন, বেশ লম্বা চওড়া। তা দরজা খুলে দিয়েই উনি ধ – ড়াম করে সমরেশ বাবুকে এক ঘুষি মারলেন। ঠিক চোয়াল বরাবর। সমরেশ বাবু একেবারে পপাত – ধরনীতল। তার স্ত্রী তখনো ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছেন। সমরেশ বাবু তখন বলছেন, ওই রকম পড়ে থাকা অবস্থায়ই, এরা বন্ধু, এর নাম সুনীল। কিন্তু মহিলা অনড় অটল। আমার মনে হয় ওর রোজকার একটা কোটা আছে, মানে ওই মুষ্টাঘাতের আর কি, সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত উনি নিস্তার হন না। পরে অবশ্য সে রাতেই মহিলা আমাদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করেছিলেন। আমাদের এক বন্ধুর নাম শরৎ মুখোপাধ্যায়। শরৎ খুব ভুলোমনা। একদিন গভীর রাতে শরৎ আর এক বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে হাজির। কি ব্যাপার? না। শরৎ বলে, আমি আমার বাড়ীর রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। একবার শরৎ ওর প্রেমিকার নাম ভুলে গিয়েছিল। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হয়েছিল শরৎ বিয়ে করার পর। শরৎ এর খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু বেলাল – বেলাল চৌধুরী। বিয়ের কদিন পর বেলালকে নিয়ে শরৎ বেশ রাত করেই নিজের বাড়ীতে ফিরে যায়। সেদিন একটু পান টানও করে ফেলেছিল শরৎ। শরৎ এর বউ ওর ফিরতে রাত হচ্ছে দেখে মশারী টানিয়ে শুয়ে পড়েছিল। শরৎ ঘরে ঢুকে মশারী তুলে বেলালকে শুতে বলে। তখন শরৎ এর বউ বিজয়া মশারীর ভেতরে শুয়ে…. এমনই ভুলোমনা শরৎ। সুনীল গল্পগুলো বলার সময় তার মুখে হাল্কা হাসি লেগে ছিল। এসব গল্প সুনীল আসর মাত করবার জন্য বলেছিল কিনা কে জানে। যা গল্প বানাতে পারে এক একখান!

বরেণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং অতীন বন্দোপাধ্যায় ধীর স্থির প্রকৃতির মানুষ। দুজনই সল্পবাক। বরেণ কথায় কথায় বললেন, আমাদের আদিবাড়ী ঢাকা জেলার শ্রীনগর থানায়। ভেবেছিলাম, এসেছি যখন,একবার ঘুরে দেখে আসব। কিন্তু তা আর হলো কই?

বরেণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম সাড়া জাগানো গল্পটি তার জীবনের প্রথম গল্পও বটে। গল্পটির নাম বজরা। ১৯৫৮ সালে দেশ পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হয়। এই গল্পের প্রেণা সম্পর্কে প্রশ্ন রাখলে বরেণ বলেনঃ আমি একবার বাড়ী থেকে পালিয়ে সুন্দরবনের প্রান্তে গিয়ে থেকেছিলাম। ওখানকার একটা স্কুলে মাস্টারী করতাম। তখন এবং তার পরেও ওই এলাকার মানুষজনদের নিয়ে আমি গল্প লিখেছি। বজরা গল্পে সুন্দরবনের পটভূমি আছে। আমি কিন্তু শুধু পটভূমি নিয়েছি আমার লেখার মূল বিষয়বস্তু মানুষ, তাদের আচার আচরণ।

বললাম, আপনি ডালুমাসী বলে একটা গল্প লিখেছিলেন মনে আছে? নরনারী পত্রিকায়?

জানেন তো, বরেণ বললেন, অনুরোধে অনেক আজেবাজে লেখা লিখতে হয়। তা ছাড়া প্রয়োজনও লেখককে অনেক সময় তার নিজস্ব সত্ত্বা বিকিয়ে দিতে বাধ্য করে।

বরেণ গঙ্গোপাধ্যায় বর্তমানে গল্প বিচিত্রা নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছেন।

– আপনার পত্রিকা কেমন চলছে?

প্রশ্নের উত্তরে বরেণ বললেন, পাঠকদের তরফ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। বিজ্ঞাপনও পাওয়া গেছে মোটামুটি।

অতীন বন্দোপাধ্যায়ের একটি গল্পের নাম সমুদ্রে অগ্নিকান্ড। গল্পটি গল্প – বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে সমুদ্রের ভুতুড়ে জাহাজ এবং অগ্নিকান্ডের ঘটনার উল্লেখ আছে।

জানতে চাইলাম, গল্পটা তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লেখা কিনা?

অতীন বললেন, না, এমন ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখিনি। তবে, অমন ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন এমন লোকের সাথে কথা বলেছি।

– আপনি সমুদ্রে কত দিন ছিলেন?

– বাইশ মাস। পাঁচটা কন্টিনেন্টেই ঘুরেছি।

– আপনি চাকরী বাকরী করেন?

– কলেজ স্ট্রিটেই একটা বইয়ের দোকানে ঘন্টা তিনেকের জন্য বসি। ওদের অ্যাডভাইসর বলতে পারেন।

– লিখে আপনার মাসে কি রকম অর্থাগম হয়?

– বাজারে আমার বিশ – বাইশ টা উপন্যাস আছে। রয়ালিটির টাকা পাই৷ তাছাড়া আমার স্ত্রী ও চাকরী করেন।

– তাহলে আপনার আর্থিক অবস্থা ভালোই, কি বলেন?

– হ্যাঁ, মন্দ নয় অন্তত।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলার সুযোগ ঘটেনি আমার। তবে তার ব্যবহার আমাকে আপ্লুত করেছে।

শক্তি বলেন, আমি ভাই কবিতা লিখছি। ১৯৫৭/৫৮ থেকে। সনেট লিখেছি এক সময়। আজ কাল আর সনেট লিখি না।

বললাম, আপনার জীবনে প্রেম এসেছে?

– আরে বোকা, প্রেম ছাড়া কি কবিতা হয়? তবে, এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চেও না। প্রেম ভালোবাসা এসবের কোন ব্যাখ্যা হয় না।

বললাম, আপনি নাকি বলেছেন, এ কোন বকলমের দেশে এলাম রে বাবা!

– দূর! আসি অমন কথা বলিনি।

– সেদিন রাতে আপনি নাকি কার হাত কামড়ে দিয়েছিলেন?

– মাথা খারাপ! আমি হাত কামগাতে যাব কোন দুঃখে?

এই কথা বলে শক্তি বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে বললেন, দেখ! আমি এখন কেমন ল্যাজ নাড়াচ্ছি।

– ত্রিশংকু

***

ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন স্থান এবং তারিখ…

কথা চলছে, উপমহাদেশের তিন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা দিল্লীতে বসবেন এক বৈঠকে। ত্রি – পক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনের চুড়ান্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করাই তাদের লক্ষ্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের এই বৈঠক সম্ভবত আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে।

বাংলাদেশ পাকিস্তানের পারস্পরিক স্বীকৃতি দানের পর উপমহাদেশের পুরো পরিস্থিতিতে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। আলাপ আলোচনার পথ এখন উন্মুক্ত। যে সমস্যা গুলো সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছে আলোচনার মাধ্যমে, এখন তার সমাধান হতে পারে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠেঃ সমস্যার জটিলতা কোন জায়গায়? উত্তর হবেঃ বাংলাদেশ পাকিস্তানের মধ্যকার লেন দেন এবং স্বাভাবিক কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। অন্য দিকে ভারত পাকিস্তানের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছিল গত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে৷ ঐ দু দেশের মধ্যে একের সাথে অপরের যোগাযোগ এবং কুটনৈতিক সমর্পক হয়ে পড়েছিল বিচ্ছিন্ন। এগুলোই হচ্ছে উপমহাদেশের বিরাজমান সমস্যা। এ সবের সমাধান করতে গিয়েই বসতে হচ্ছে শীর্ষ সম্মেলনে। ।

শীর্ষ সম্মেলন কোথায় হবে কিংবা কোথায় হওয়া প্রয়োজন – এ আলোচনার আগে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচার সম্পর্কে কিছু কথা এসে পড়ে। কারণ, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি এবং গণচীনের স্বীকৃতি – দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঐ প্রশ্নের সাথে জড়িত। আমার এ প্রশ্নের সমাধান যদি এখনই আমরা পেয়ে যাই, তাহলে আর ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকের প্রয়োজনও বাংলাদেশের জন্য খুব একটা থাকে না। পাকিস্তানের সাথে যে সব সমস্যায় আমাদের দেশ জড়িত – তার সমাধানের জন্য দ্বি পাক্ষিক আলোচনাই হবে যথেষ্ট এবং বেশী ফলদায়ক।

দাউদকান্দি জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছেন, বাংলার মানুষ ক্ষমা করতে জানে। বঙ্গবন্ধুর এ কথা কে আমরা যদি সূচক হিসেবে ধরে নিই, তাহলে বলতে পারি, বৃহত্তর স্বার্থে আমরা ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে ছেড়ে দিতে পারি, অবশ্য দেশের ভেতর এবং বাইরের অনেকেই এটাকে বাংলাদেশের দূর্বলতা বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কুটনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন লাহোরের ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে। এবারও তিনি আর একটা দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে চলেছেন। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করা হলে সারা বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশ যে কি সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবে, তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী এ জন্যই সম্ভবত বলেছেনঃ তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমরা ক্ষমা চাও। বাংলার মানুষও তোমাদের ক্ষমা করবে।

প্রধান মন্ত্রীর এ বক্তব্য বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল গতির আলোকেই বিচার্য। জাতীয় স্বার্থ ও প্রয়োজনের দিক থেকে বিচার বিবেচনা করে দেখলেও দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের জন্য খুব একটা প্রয়োজনীয় নয়৷ আমাদের লক্ষ্যের প্রাধান্য এখন নির্দিষ্ট, উপমহাদেশের পরিস্থিতির সরলীকরণ এবং সমস্যার নিস্পত্তি। এ কাজকে দ্রুততর করার প্রয়োজনই এখন সর্বাধিক। পাকিস্তান যখন বাধ্য হয়েছে আসাদের স্বীকৃতি দিতে, তখন পুরনো সমস্যা মিটিয়ে নতুন বন্ধুত্বের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া বোধহয় খুব বেশি কষ্টকর নয়। আর এই পথ অনুসন্ধানের জন্যই ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন। গত বছরের আগস্টে সাক্ষরিত দিল্লী চুক্তির চুড়ান্ত বক্তব্যঃ উপমহাদেশের তিন দেশের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠান।

প্রথমতঃ ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা এখন বেশ সহজতর হয়ে পড়েছে৷ কারণ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আলোচনার এখন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর এখানে এটাও বলা প্রয়োজন পুরো পরিবেশ এবং পরিস্থিতি রয়েছে বাংলাদেশের অনুকূলেই। এই অনুকূল অবস্থান যদি কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ, তাহলে তার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি হয়ে উঠবে উন্নত৷ গত তিন বছরের জাতীয় অভিজ্ঞতাই তার প্রমাণ। তিন দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহ – অবস্থানের যৌক্তিক পরিণতির জন্য পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সুযোগ ঘটবে বাংলাদেশে আসার। এর ফলে পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদানের ক্ষেত্র হয়ে উঠবে প্রশস্ত।

দ্বিতীয়তঃ দিল্লী চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য বসছে ত্রি পক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন। আমাদের কাছে মনে হয়, এর ক্ষেত্র হতে পারে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা।

ইতিমধ্যে অবশ্য এক রকম কথা উঠেছে যে, এ সম্মেলন নাকি অনুষ্ঠিত হবে কায়রোতে।

স্থান এবং কাল নিয়ে দেশে দেশে রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান প্রশ্নে বিতর্ক বিরল দৃষ্টান্ত নয় একদমই অবশ্য। ভিয়েতনাম প্রশ্নে প্যারিসের যে বৈঠক – তার ইতিহাস এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য। সব কিছু স্মরণে রেখেই আমরা বলছিঃ ত্রি পক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকাতেই হোক। কারণ ঢাকাকে নিয়ে উদ্ভব ঘটেছিল সেই ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। তাই ঢাকার বুকেই ঘটুক আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি। উপমহাদেশের বুকে একটি গুণগত পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ। এই পরিবর্তনকে নিজের অনুকূলেই রাখতে হবে বাংলাদেশকে। আর তার জন্য প্রয়োজন, প্রতি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বলিষ্ঠ জাতীয় উদ্যোগ।

কায়রো আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু দেশ, মিসরের রাজধানী। সেখানে কোন বৈঠক বা শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলন হলে আমাদের পক্ষ থেকে কোন রকম বাঁধা বা প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কিন্তু পাক প্রধান মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশ সফরে। প্রধান মন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিশ্চয়ই কোন আপত্তি থাকতে পারে না ঢাকায় আসার ব্যাপারে। ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীরও তেমন আপত্তি থাকার কথা নয়। তাহলে আসলে বাঁধাটা কোথায় আর ঢাকাতে ত্রি পক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনে?

অবশ্য এ প্রশ্নে এখনো কোন নির্দিষ্ট ঘোষণা শোনা যায়নি। তাই আমাদের বক্তব্য স্বভাবতই থাকতে পারেঃ ত্রি পক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন ঢাকায় হোক৷ এতে বিশ্ব পরিসরে একটি নব্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে অনেক গুণ।

ইউনিকোডে টাইপ – Maruf Muktadir Khan