You dont have javascript enabled! Please enable it!

এই কলকাতায়

সাত কোটি সন্তানেরে
হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছাে বাঁচিয়ে যত্নে
দালাল করনি!
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মুজিবর নিখোঁজ, এই সংবাদ সান্ধ্য দৈনিকের পাতায় ভর করে যখন গ্রিলের গরম চায়ের আসরে এসে উপস্থিত হলাে, সমগ্র গ্রিলটা তখন স্তব্ধ হয়ে গেছে। পশুর মতাে পশ্চিম পাক দস্যুরা ওপার বাংলা জ্বালাচ্ছে, পােড়াচ্ছে, ধ্বংস ও ধর্ষণ করছে। এপার বাংলার বুকের রক্ত অবরুদ্ধ স্রোতের মতাে চলকে উঠল। আমাদের হৃৎপিণ্ডে কামানের গর্জন। কিন্তু অসহায়। সীমান্তের এপারে বন্দি এবং ওপারের আত্মার দোসর আমরা অসহায় আক্রাশে মূক হয়ে গেছি। সুদীপ্তার চোখে জল। আমাদের চোখের ওপর উত্তপ্ত জলীয়বাষ্প।
‘টিক্কা খা নিহত!’ কাগজ থেকে এক নরপশুর ভাবলীলা সাঙ্গ হওয়ার কথা সােল্লাসে চিৎকার করে কে যেন জানাচ্ছে?
‘সামসুদ্দীনের গুলিতে জঙ্গি জল্লাদ টিক্কা নিহত? জয়, জয় বাংলা!’ বিমর্ষ চায়ের দোকানে বিজয়ােৎসবের জয়ধ্বনি বেজে উঠল আবার।
আর তখনই দেবনাথের মন্থর গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। স্বভাব কবি দেবনাথ তার পদ মিলিয়ে সুরের রেশ টেনে আবৃত্তি করছে : সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী! রেখেছে বাঁচিয়ে যত্নে দালাল করনি!
আমরা মুখ ফেরালাম দেবনাথের দিকে। সে আত্মস্থ। তখনও আবৃত্তি করছে। আবেগ যেন কণ্ঠগিরিগুহা থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসছে। বলছে :
ওপারে মুক্তির আলাে
মায়ের পা দুটি
হল লাল!
এপারে হত্যার লীলা
অসহায় কবন্ধ সকাল!
দু-একটি টেবিল থেকে অপরিচিত দু-একজন খদ্দেরও উঠে আসছেন আমাদের কেবিনে। ‘চমৎকার, আর কিছু শােনান!’
প্রশংসায় লজ্জা কিংবা অহংকার, দেবনাথের কোনােটাই নেই। অপরিচিত বলেও কেউ তার কাছে। সহজে এগােতে ইতস্তত করে না।
অনুরােধ করছে সুদীপ্তাও, রচনাই তােমার স্বভাব। এমন কত রচনা হারিয়ে যায়। তুমি বল, থামলে কেন দেবু, মুখে মুখে বীরেন টুকে নিক।’
আমি তৈরি হয়ে বললাম, ‘শুরু কর দেবনাথ। দেবনাথ শুরু করল :
যে ছেলে লড়তে জানে
সাচ্চা মরদ
স্বাধীন মনে ও প্রাণে,
সেই রেখেছে বন্দি মায়ের মান।
সেই খেয়েছে বাংলা দেশের ধান।
বুলবুলি যার ধান খেয়ে যায়
খাজনা দেওয়ার দুর্ভাবনা তার;
বাংলা দেশে জাগছে ছেলে
নাড়িয়ে দেবে দস্যু পদভার।
সময় হয়েছে, সময় এবার,
ঝাঁট দিয়ে দাও চক্রান্তের মল,
সুজলা সুফলা অঙ্গ শ্যামলা
স্নেহময়ী মার রুদ্ধ অশ্রুজল
রুধিরের রঙে রাঙা হয়ে আছে
কতদিন কতকাল!
খুলে দাও তরী,
হুঁসিয়ার,
ধর হাল!
দেবনাথের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল আর সর সর করে নােয়ানাে লােম যেন খাড়া হয়ে উঠছিল আমাদের শরীরে।
এই সময় কে যেন আর এক কোণ থেকে গেয়ে উঠেছে : ‘পদ্মার ঢেউ রে! আমার শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যায় যায় রে—’
কে যেন বলছে, সীমান্তের শেকল ভেঙে পড়ছে। এবার আমি ফিরে যাব আমাদের গ্রামে। ভিটে ছেড়ে মা বাবা কাকা খুড়িমা আসেননি। আমরা ভাই বােনেরা স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রী। আমাদেরই পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। মা দু’চোখ মুছতে মুছতে, আদর করতে করতে বলেছিলেন : “আমাগাে ভাবনা ভাবিস না রে মানিক। তগাে বাপ মায়ে ঠিকই থাকব। তুই মাইয়া দুডারে লয়্যা কইলকাতায় দিদিবাড়ি যা। ভগবান যদি দয়া করেন, মানিক রে, আবার ফিইরা আসিস বুড়ি মায়ের কোলে। তখন মা বুড়ি ছিলেন না, এখন হয়ত বুড়ি হয়ে গেছেন।’
একটি দীর্ঘশ্বাস মােচনের শব্দ। আবার স্বগতােক্তি, জানি না। ফিরে গিয়ে দেখতে পাব তাে মাকে? জানি না। চিনতে পারব তাে আমাদের গ্রাম? পশুর মতাে আক্রোশে ওরা সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ধ্বংস করছে। একাত্তরের ইতিহাসে নরভূক বর্বর হিটলার, ইয়াহিয়া-ভুট্টো। আশ্চর্য সমস্ত গণতান্ত্রিক দুনিয়া আজও চুপ করে এই মৃত্যুর লীলা, এই হত্যার হিংস্র উল্লাস দেখছে। আন্তর্জাতিক আইন! রােমানরা যেমন সিংহের খাচায় অসহায় মানুষ ছেড়ে লড়ায়ের মজা দেখতাে, এও সেই রকম। ওদের মধ্যে এখন কথা হচ্ছে, নিরস্ত্র মানুষ যদি সর্বাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত আইন লঙ্ঘনকারী নরপশুকে হারিয়ে জিততে পারে তখন বীর গণতন্ত্রীরা একটা ব্যবস্থা করবে। গণতন্ত্র তাে সিংহলেও, অথচ ওদের হাত ফ্যাসিস্ট হাতকেই মদদ দিচ্ছে!’
একটি হতাশ প্রশ্ন, ‘আচ্ছা। বাংলাদেশের জয় অনিবার্য তাে?’
উত্তরও করল একজন, ‘হারাবে কে? বর্ষা নামতে দাও, তারপর মার কাকে বলে দেখিয়ে দেবে বাংলাদেশ। অবশ্য তার আগেই হয়তাে ডালকুত্তার দল লেজ গুটিয়ে পালাবে।
আর একজন বললে, সাত কোটি সংঘবদ্ধ মানুষের কাছে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রও উত্তাল সমুদ্রের বুকে অহঙ্কারী রণপােতের মতাে নস্যাৎ হয়ে যাবে।’
সুদীপ্তা শুনছিল। বললে, ‘ভুট্টো-ইয়াহিয়াকে সময় দিয়েই প্রাণ দিতে হলাে অনেক বেশি বাঙালিকে। ভুট্টো-ইয়াহিয়ার এটা কাপুরুষের যুদ্ধ। সরল বাঙালিকে বাংলার মাটিতে ঠকিয়ে এইভাবেই ওরা পালিয়ে গিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে।
দেবনাথ মাথা নাড়ল, না। মুজিব তাে ঠকেননি। সময় দিয়ে, রিস্ক নিয়ে তিনি কূটনীতির যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। আজ সমস্ত বিশ্বের জনমত বাংলাদেশের পক্ষে। এটা কম বড় জয় নয়। প্রথম জয়, বিপুল গণতান্ত্রিক সমর্থন। দ্বিতীয় জয়, বৈঠকে বসে প্রমাণ করে দেওয়া যে, পাকিস্তানকে হেরে যাওয়া মুষ্টিমেয় দস্যুতেই টুকরাে করল। দেশদ্রোহী তারাই, বিচ্ছিন্নতাকামী তারাই। আবার পাকিস্তানিদের কূটনৈতিক হারও ঐতিহাসিক। আসল বাংলাকে যদি উপনিবেশ করে শশাষণই না করা যায়, তবে ওরা বাংলাকে বরং ধ্বংস করাই শ্রেয় মনে করে। এই বিচিত্র জাতীয়তা আর ঐক্যের দাবি তুলেই ওরা বলছে বাংলাদেশের লড়াইটা ওদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ধন্য আন্তর্জাতিক আইন, শােষণ করার, অত্যাচার করার, ধ্বংস করার পরওয়ানা! সেই পরওয়ানা মানুষ মানুষকে দিচ্ছে না, দিয়েছে মারণাস্ত্রকে। পাকিস্তানে ইয়াহিয়া কারও প্রতিনিধি নয়। ইয়াহিয়া চীন, রাশিয়া, আমেরিকার দেওয়া তার পূর্বসুরী আয়ুবের অস্ত্রে সজ্জিত একটা ধ্বংসের যমদূত। কিন্তু দুনিয়ার গণতান্ত্রিক শক্তি আজও যদি তাকে গণতন্ত্র হত্যায় বাধা না দেয়, তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্র আরও একবার বিপন্ন হবে। আর সেই আঘাত সেই বিস্ফোরণ ঘটবে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও। গণতন্ত্রের স্বার্থেই গণতন্ত্রী শক্তিকে সংহত হতে হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামের পাশে। নাহলে আবার হিটলার। আবার খুন, ধর্ষণ, অত্যাচার। পশুত্ব, মনুষ্যত্বের ওপর বালাৎকার।’
সমস্ত গ্রিলটা উত্তর্ণ হয়ে শুনছে। প্রত্যেকের মনেই এক প্রশ্ন, কয়েকটা নরখাদকের হাতে কয়েক কোটি অসহায় মানুষকে কাতারে কাতারে মরতে দেখেও যে দুনিয়া আইন দেখিয়ে চুপ করে বসে থাকে সে দুনিয়ার সেই আইন কোনাে নীতিশাস্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের গড়া সে আইনের হাতে মনুষ্যত্বই অসহায়।
সুদীপ্তা হঠাৎ জানতে চাইল, বীরেন, তুমি তাে এই বাংলার, না?’
মাথা দুলিয়ে বললাম, আমি বাঙালি। মনে মনে দুই বাংলাকে কোনােদিনই ভাগ করতে পারিনি। ভাগ হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। কয়েকজন কুচক্রী ভাগ করেছিল দেশটা। ইতিহাস তাদের কখনাে ক্ষমা করবে না। ভাগ হয়েছিল একটা ভৌগােলিক রাজনৈতিক ভূখণ্ড। কিন্তু ভাগ হয়নি আমার ভাষা সংস্কৃতি আত্মা।’
দেবনাথ তার তৎক্ষণাৎ রচিত কবিতা পকেট বুকে টুকে নিচ্ছিল। আমার কথায় মুখ তুলে তাকাল। বললে :
নকল দুর্গ মানচিত্রেই আছে
আমার দুর্গ আত্মা দিয়ে গড়া।
তুমি আছ, আছি আমি
তােমার আমার কাছে :
দুই বাংলায় জাগছে তারই সাড়া।

সূত্র: দর্পণ
০৯.০৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!