পূর্ব বঙ্গের লড়াই কেন সারা বাংলাদেশের লড়াই
বাংলাদেশের প্রতিরােধের প্রাচীরে মাথা কুটে মরছে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের দখলদার ফৌজ।
এই প্রতিরােধের রাজনৈতিক ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে এমন দুর্বার সক্রিয় রূপ কেমন করে ধারণ করল? এই প্রক্রিয়া বুঝতে হলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আধুনিক গণতন্ত্রের রূপ, বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতীয় সত্তার আত্মবিকাশের পথে সর্বাধুনিক বাধাগুলােকে বুঝতে হবে।
আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি জনগণের স্বাধীকার। এই স্বাধীকার সংজ্ঞা পেয়েছে প্রথমে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দের পিটিশন অব রাইটস এবং ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের বিল অব রাইটস- এই তিনটি সনদে।
আজ আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে সম্ভবত আমরা মনে করতে পারি না যে ঐ ইতিহাস বিখ্যাত গণতান্ত্রিক সনদগুলােতে শান্তির সময়ে স্থায়ী সেনাবাহিনী রাখা জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীকারের বিরােধী বলে ঘােষিত হয়েছিল। স্থায়ী সেনাবাহিনীকে জনগণের স্বাধীকার রক্ষার বিরােধী বলে ঘােষিত হয়েছিল কারণ গণতান্ত্রিক অধিকারের যােদ্ধারা অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে বেতনভুক্ত স্থায়ী সেনাবাহিনীকে জুলুমবাজ শাসকশ্রেণী জনগণের স্বাধীকার খর্ব করতে ব্যবহার করে।
পূর্ববঙ্গের শ্রদ্ধেয় নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একদা এই লেখককে বলেছিলেন যে, তিনি নিজেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার স্বপক্ষে উদ্যোগ নিয়ে যে কত বড় ভুল করেছিলেন তা আয়ুবশাহীর আমলে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলেন।
ইতিহাসের ধারায় পরমশ্রদ্ধেয় এই মানুষটিকে ইয়াহিয়া খানের দখলদার ফৌজের হাতে নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে বলে প্রকাশ।
বলা বাহুল্য যে, ইতিহাসের ছাত্রমাত্রেই জানেন যে, সামাজিক কর্তৃত্ব পুঁজিবাদী শ্রেণীর হাতে আসার প্রথম যুগে সামন্ততান্ত্রিক শাসনকে পর্যুদস্ত করার জন্যে ঐ শ্ৰেণী জনগণের স্বাধীকারের উপরিল্লিখিত সনদগুলােকে রাষ্ট্রীয় স্বাধীকারের মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিযােগিতামূলক পুঁজিবাদ যখন একচেটিয়া পুঁজিবাদে পরিণত হয়ে গােড়ার দিকের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলােকে বিলােপ করতে এগিয়ে এল, তখনই আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রের আসল ক্ষমতা স্থায়ী সেনাবাহিনী, পুলিশ, গােয়েন্দা দপ্তর, জেলখানা ও বিচার বিভাগের হাতে অর্পণ করা হলাে।
ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যিক পুঁজির স্বার্থেই যে অখণ্ড জাতীয়তাবােধ গড়ে উঠেছিল তাই শেষ পর্যন্ত বৃটিশ সাম্রাজ্য স্বার্থের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয় এবং পরিণামে বৃটেনকে এ দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ত্যাগ করতে হয়।
কিন্তু এই কর্তৃত্ব ত্যাগের প্রাক্কালে বৃটেন ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র স্থাপন করে যায়।
বলা বাহুল্য দুটি রাষ্ট্রেই উদীয়মান ধনিক শ্রেণী সাম্রাজ্য স্বার্থের পাহারাদার ও অর্থনৈতিক শােষণের অধিকারভােগী শ্রেণী হিসেবে রাষ্ট্র কর্তৃত্বের অংশীদার হয়।
এই দুটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীই কেন্দ্রিকতার ঝেকে আচ্ছন্ন, কারণ এরা নিজেদের দেশে একচেটিয়া পুঁজি মালিক ও সামন্ত শ্রেণীর যৌথ মালিকানায় রাষ্ট্র কর্তৃত্ব লাভ করেছে।
এ দেশের টাটা, বিড়লা, গােয়েংকাদের মতােই পাকিস্তানে ইস্পাহানী, দাউদ, ভালিকাদের রাজত্ব। এ দেশের রাজামহারাজা, জোতদার, জমিদারদের মতােই ও দেশে নবাব খাজা-মেহতররা একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে জোটবদ্ধ। সমস্যা, শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি, মােটামুটি একই ধরনের।
এ দেশে যেমন ‘হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে আঞ্চলিক ও ভাষা বিরােধের তীব্রতা দেখা যায়, পাকিস্তানেও বাঙালি, সিন্ধু, বেলুচ, পাখতুন, পাঞ্জাবি জাতিসমূহের স্বাধীকার বােধের তীব্রতা লক্ষণীয়।
পাকিস্তানে রাষ্ট্রের মালিক শ্রেণী প্রথমে ধর্মীয় উত্তেজনার আড়ালে থেকে, ভারত বিরােধী জেহাদের ধুয়া তুলে দেশের জনসাধারণকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক নিয়মেই জাতিসত্ত্বাগুলাে একচেটিয়া পুঁজি-মালিক ও নবাব-খাজা-মেহতরদের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ফলে অখণ্ড পাকিস্তানি জাতি সৃষ্টি করার নামে এরা সিন্ধু, বেলুচ, পাঞ্জাবি ও পাঠানদের একসঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান অঙ্গরাজ্যের গােড়াপত্তন করে। পূর্ববঙ্গের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান; ভৌগােলিক কারণে তাকে আলাদা থাকতে দিতেই হলাে।
পূর্ববঙ্গের সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে একচেটিয়া পুঁজিমালিক অথবা বড় ভূস্বামীদের স্থান নেই। কোনাে বাঙালি বৃহৎ শিল্পপতি গােষ্ঠীর অভ্যুদয় এখানে হয়নি এবং হিন্দু বড় বড় ভূস্বামী স্বার্থ অপসৃত হবার ফলে সামাজিক বিন্যাসে স্থানীয় বৃহৎ ভূস্বামী স্বার্থেরও প্রভাব নেই বললেও চলে। আয়ুব খাঁর আমলে বেসিক ডেমােক্রেসির আড়ালে গ্রামীণ এক জোতদার, ধনী কৃষক শ্রেণীর অভ্যুদয় ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় এদের স্থান খুবই নগণ্য।
অন্যদিকে, ছােট ছােট শিল্প বিকাশের সুযােগ একেবারে সীমিত। পূর্ববঙ্গের বিড়িশিল্পে নিয়ােজিত মূলধন ও শ্রমিকরা পাক-ভারত বাণিজ্য সংযােগ বিচ্ছিন্ন হবার ফলে অলস হয়ে পড়ে। পাকিস্তান শিল্প ও বণিক সমিতির পক্ষ থেকে ঊনসত্তর সালে বৃটিশ একচেটিয়া পুঁজির মালিক ইম্পিরিয়েল টোব্যাকো (পাকিস্তান) লিমিটেডের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখানাে হয় যে, ভারত থেকে টেন্ডু পাতা (বিড়ির পাতা) আমদানি নিষিদ্ধ করার আগে বছরে সাতশ কোটি সিগারেটের চাহিদা ছিল। টেন্ডু পাতা আমদানি নিষিদ্ধ হবার পর পূর্ববঙ্গে বছরে ষোলশ কোটি সিগারেটের চাহিদা হবে অনুমিত হয় এবং এই বর্ধিত চাহিদা মেটানাের জন্যে পনেরটি স্থানীয় ছােট ছােট সিগারেট প্রস্তুতকারীকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু বৃটিশ কোম্পানিটি তার উৎপাদন ক্ষমতা আগেকার ষাট শতাংশ থেকে আশি শতাংশ বাড়াবার অনুমতি পেয়ে যায় এবং ছােট ছােট সিগারেট প্রস্তুতকারীরা এর সঙ্গে অসমপ্রতিযােগিতায় পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
শুধু বৃটিশ নয়, মার্কিন পুঁজি মালিকরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গতিবান শিল্পপতিদের সহযােগিতায় মার্কিন কোম্পানিগুলােও পূর্ববঙ্গে শােষণ ও লুণ্ঠনের অগ্রগামী ভূমিকা গ্রহণ করে। মার্কিন বৃহত্তম কোম্পানি জেনারেল মােটরস (পাকিস্তান) লি: প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের পুত্র ক্যাপ্টেন গওহর আয়ুবের সঙ্গে ভাগাভাগি কারবারে লিপ্ত হয়। সরকারি বিদ্যুৎ ও জলসরবরাহ প্রকল্পগুলােতে (ওয়াপদা ও ওয়াপসা) মার্কিন কোম্পানিগুলাে নানাভাবে প্রচুর মুনাফা কামায়। ব্রহ্মপুত্র বাঁধ নির্মাণের কাজে (মােট খরচ একশ ছত্রিশ কোটি টাকা) পশ্চিম পাক শিল্পপতি ও মার্কিন কোম্পানিগুলাে একযােগে বখরার কাজ চালিয়ে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। | ভারি শিল্প যন্ত্রপাতি নির্মাণের জন্যে চীন ও সােভিয়েতের যৌথ সাহায্যে যে কারখানাটি স্থাপিত হয়, প্রথমে তা চট্টগ্রামে স্থাপন করার কথা থাকলেও তা পালটে পশ্চিম পাকিস্তানে কালাবাগের নবাবের এলাকায় স্থাপন করা হয়।
পাকিস্তান সরকার বিদেশি পুঁজির অবাধ অধিকার ঘােষণা করে পশ্চিম পাক শিল্পপতি এবং বিদেশি পুঁজির যৌথ শােষণের বুনিয়াদ রচনা করেন। একশ সাতটি পণ্যোৎপাদনকে ‘ক’ তালিকাভুক্ত করে বিদেশি লগ্নীর ওপর সমস্ত কড়াকড়ি তুলে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় পরিকল্পনা কালে পাকিস্তানে মােট শিল্প বিনিয়ােগের পরিমাণ পাচশ বারাে কোটি টাকার মধ্যে পূর্ববঙ্গের বরাদ্দ হয় একশ একচল্লিশ কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে প্রথম পরিকল্পনার অসমাপ্ত প্রকল্পগুলােকেও ধরা হয়। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে নিট শিল্প বিনিয়ােগের বরাদ্দ কার্যত একশ কোটি টাকারও কম হয়ে দাঁড়ায়।
একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পখাতে চারশ নব্বই কোটি ষাট লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়, কিন্তু প্রকৃত লগ্নী হয় পাঁচশ আশি কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি লগ্নী দেড়শ কোটি টাকা। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে পরিকল্পনার বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি লগ্নী করা হয়, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে এর পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়।
যদি আমরা মনে রাখি যে, পূর্ববঙ্গে যে সামান্য শিল্পলগ্নী ঘটেছে তার মালিকানা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি এবং বিদেশি পুঁজির কবলিত এবং যদি এ কথা লক্ষ করা যায় যে, ভারি শিল্পে (প্রধানত পশ্চিমপাক এলাকায়) লগ্নী বৃদ্ধির পরিমাণ শতকরা আঠারাে ভাগ, কিন্তু ক্ষুদ্র শিল্পে বৃদ্ধির পরিমাণ শতকরা আঠারাে ভাগ, কিন্তু ক্ষুদ্র শিল্পে বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ছয় শতাংশ, তাহলে আশ্চর্য হতে হয় যে পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করার ঝোক কী তীব্রই না ছিল। আরেকটি সংখ্যাতত্ত্ব এই নগ্ন শােষণকে উন্মুক্ত করে দেয়। দ্বিতীয় পরিকল্পনা কালে মােট শিল্পলগ্নীর পরিমাণ ছশ-চুয়াল্লিশ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র আঠারাে কোটি টাকা ক্ষুদ্র শিল্পের বরাদ্দ।
পূর্ববঙ্গের পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা, কফি, কাগজ, সার, কেমিক্যালস, সিগারেট প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে প্রধানত বিদেশি পুঁজি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের যৌথ মালিকানা, পূর্ববঙ্গের শিল্পবিকাশের প্রধান অন্তরায়। পাকিস্তানে বিদেশি পুঁজির সুযােগ-সুবিধা, ডিভিডেন্ট ও মূলধন দেশে পাঠাননার অবাধ সুযােগ ইত্যাদি পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর চরিত্র নগ্ন করে দেখিয়ে দিয়েছে যে, পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নয়ন এদের হাতে সম্পূর্ণ রুদ্ধ।
সরকারি ব্যয় বরাদ্দের এই পক্ষপাতমূলক ব্যবহার যে শুধু শিল্পায়ন ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য তা নয়। সরকারি চাকরি, সেনা বিভাগের স্থল, নৌ এবং বিমান বাহিনীতে নিয়ােগের বেলায়ও একই পক্ষপাতমূলক ব্যবহার করা হয়। সামরিক চাকরিতে বাঙালির সংখ্যা সাড়ে নয় শতাংশের কিছু বেশি, পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ নব্বই শতাংশেরও বেশি। একত্রিশ জন মেজর জেনারেলের মধ্যে একজন মাত্র বাঙালি (তিনি খাজা সাহাবুদ্দিনের পুত্র) বাকি সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি, প্রধানত পাঞ্জাবি। নিচের দিকে শতাংশ হিসেবে লে. কর্নেল ব্রিগেডিয়ার মেজর ও ক্যাপ্টেনদের সংখ্যা দুই থেকে তিন শতাংশ। সিভিল সার্ভিসেও বাঙালি অফিসারের সংখ্যা কম।
পূর্ববঙ্গে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ছ’হাজার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচ কোটি আশি লক্ষ মানুষের জন্য ছাব্বিশ হাজার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের মােট রপ্তানি পাঁচশ আশি কোটি টাকার মধ্যে চারশ তেইশ কোটি টাকার পণ্য সরবরাহ করে। এর মধ্যে চা পাট, বস্ত্র ও পেট্রোকেমিকেলস বাবদ রপ্তানি তিনশ কোটি টাকার কিছু কম।
পশ্চিম পাকিস্তানের গম, চাল, সােনা পূর্ববঙ্গে পাঠিয়ে যে দাম আদায় করা হয় তা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রচলিত দামের দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি। এটা অসম বাণিজ্য নীতির ঔপনিবেশিক কায়দা। শুধু এভাবেই নয়, পূর্ববঙ্গের জন্যে বরাদ্দ ছয় কোটি টাকা মূল্যের পাক-ইতালি সাহায্য চুক্তির মেশিনারি ও যন্ত্রাংশ, অবৈধভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে জাহাজ থেকে খালাস করার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দেয় যে, পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাক শাসকশ্রেণী কী নজরে দেখে।
স্বভাবতই এই একচেটিয়া পুঁজি বিদেশি পুঁজি সামন্ত শােষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিসত্তা বিদ্রোহ করেছে। আবালবৃদ্ধ বণিতা বাঙালি এই শােষণ অবসানের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমাদের দেশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও বিস্ময়ে এই অতুলনীয় সশস্ত্র প্রতিরােধের দিকে তাকিয়ে আছেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের এই প্রতিরােধ, কেন্দ্রীয় শাসনের নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ বলেই গণ্য হবে।
পূর্ববঙ্গের সমস্যা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলাের সমস্যা অনেকটা এক ধরনের। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অবিচার, বৈষম্য উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের প্রতি পক্ষপাতমূলক নজরের অভিযোেগ ইতিপূর্বে বহুবার উঠেছে।
গত দুই দশকের কেন্দ্রীয় আর্থিক নীতিগুলাে ও দপ্তরে দপ্তরে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বাঞ্চলে শিল্প প্রসারের উগ্র বিরােধী মনােভাবের বিচার করলে দেখা যায় যে, পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ঐ অঞ্চলের উন্নয়ন ও বিকাশের সমস্যার সামঞ্জস্য রয়েছে।
উভয় ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারমূলক উন্নয়ননীতি বিক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
উভয় ক্ষেত্রেই এই বিক্ষোভকে দমাবার জন্যে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল ও সাম্প্রদায়িক দলগুলােকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং উভয় ক্ষেত্রেই সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে বিক্ষোভকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে। অথচ গণতান্ত্রিক, উদার, ন্যায়নিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চললে, এই অকারণ রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি হতাে না।
কোনাে জাতিসত্তাকে পীড়ন করে, ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে তার আশা আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করে দিয়ে দেশের অখণ্ডতা, ভৌগােলিক ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। একমাত্র পূর্ণ স্বাধীকারের ভিত্তিতেই সুদৃঢ় ঐক্য স্থাপিত হতে পারে। সােভিয়েত রাষ্ট্র তার অঙ্গরাজ্যগুলােকে পররাষ্ট্র বিষয়েও স্বাধীনতা দিয়েছে, তাতে সােভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে যায়নি, আরাে শক্তিশালী হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদেরও পূর্ববঙ্গের এই বিদ্রোহকে যুক্তিসিদ্ধ বিশ্লেষণের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। কারণ সকল নিপীড়িত জাতিসত্তার সমস্যাই এক।
সূত্র: দর্পণ
০৯.০৪.১৯৭১