You dont have javascript enabled! Please enable it!

আর কি করলে নয়াদিল্লী নড়ে বসবে?

মেঘালয় ও আসামের সীমান্ত এলাকার উদ্বেগজনক ঘটনাবলীর মধ্যে যেটা সবচেয়ে কেলেঙ্কারীর ব্যাপার তা হলাে, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে আমাদের তরফে তেমন কোনাে প্রতিরােধ ছিল না। সুতারকান্দিতে এলাকায় ঢুকে পড়ে সীমান্ত ঘাটিটা দখল করে নিয়েছিল। মেঘালয়ের দালু সেক্টারে তারা শুধু গােলার আঘাতে নজন সীমান্তরক্ষী সহ বাইশজন ভারতীয়কে হত্যাই করে নি, কিলাপাড়ায় আমাদের এলাকার মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে টহল দিয়েছিল। তারা এত গভীরে ঢুকে আসতে পেরেছিল যে, চারটি সীমান্ত গ্রামের মানুষ প্রাণভয়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। সন্ধ্যের পর আমরা পাকিস্তানিদের হটিয়ে দিতে পেরেছিলাম এটা কোনাে সান্তনাই নয়। কেননা পাকিস্তানিরা ভারতীয় এলাকা দখল করে সেখানে থাকবার জন্যে আসে নি। এসেছিল আমাদের নাক ঘষে দিয়ে নিজেদের গায়ের জোর ফলানাের জন্যে। সেই উদ্দেশ্যে তারা চমৎকারভাবেই সাধন করে ফিরে গেছে। ঘটনা এই যে, আমরা সীমান্তে যেখানে তাদের আটকানাে উচিত ছিল সেখানে তাদের বাধা দিতে পারি নি।
কিন্তু কেন? নয়াদিল্লীর হােমরা-চোমরারা যারা বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনাে সাহসের পরিচয় দেবার কথা চিন্তা করতেই লজ্জায় মরে যাচ্ছেন, তারা এই ব্যর্থতার কি যুক্তি দেখাবেন? সােমবার ও মঙ্গলবার আসাম আর মেঘালয় সীমান্তে যা ঘটেছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনাে সম্পর্ক নেই। সেটা একান্তভাবেই আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপার। এবং আমাদের সীমান্ত শত্রু সৈন্যের হাত থেকে রক্ষা করা হবে এটাই প্রত্যাশিত। তবু এক্ষেত্রেও এই নূন্যতম রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনেও আমরা সাহসের পরিচয় দিতে পারলাম না কেন? পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের এলাকার অনেক ভেতরে ঢুকে পড়ল তবু কেন আমরা তাদের বাধা দিতে পারলাম না? সুতারকান্দি কিংবা দালুর আক্রমণ হঠাৎ আসে নি। দু’মাস হয়ে গেল একদার পূর্ব পাকিস্তানে অস্থির অবস্থ চলছে। তার চেয়েও বড় কথা, এই দু’মাসে আমাদের সীমান্তে পাকিস্তানিদের আক্রমণের আরাে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। বনগা সেক্টরে ঠিক একইভাবে পাকিস্তানিরা বয়রা গ্রামে ঢুকে পড়ে অন্তত পাঁচজনকে হত্যা করেছিল। উত্তরাঞ্চলের ছিটমহল বাঁশপচাইয়ের ওপর আক্রমণও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তার পরেও কেন দালু আর সুতারকান্দি মতাে ঘটনা ঘটতে পারে? আমাদের সীমান্ত প্রস্তুতি কেন এখনাে এতটা দুর্বল। নাকি এই নগ্ন, নির্লজ্জ, উদ্বত আক্রমণের প্রতিও ভারত সরকার চোখ ফিরিয়ে থাকতে চান, পাছে পাকিস্তান চটে যায়, পাছে ব্যাপারটা ভারত-পাক ব্যাপারে দাঁড়িয়ে যায়? ওরা মেরে যায় মারুক; আহা-হা, তাই বলে কি আমরা মারতে পারি? লােকে কি বলবে? ওরাই বা কি ভাববে? আর মারার কথাও নয়। শত্রু সৈন্য আমাদের সীমান্তে আঘাত হানছে, আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়ছে। আমরা তাদের বাধা দেব, সেই জন্যে সীমান্তে আমাদের আয়ােজনকে প্রস্তুত রাখবাে। ব্যাপার শুধু এইটুকু। সেটটুকুও আমরা করতে রাজি নই, পাছে পাকিস্তান দুনিয়ার মােড়লদের কাছে বলার সুযােগ পায়—দ্যাখাে, ভারত আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্যে তৈরী হচ্ছে। নয়াদিল্লীর সতর্কতা সত্যিই ঐতিহাসিক, তাদের হিসাবের সত্যিই তুলনা নেই। আমাদের ঘরের পাশে যখন একটা ঐতিহাসিক ভাঙাগড়া চলছে, তার উত্তাপ, তার আগুন যখন আমাদেরও স্পর্শ করছে, তার পরিণতি যখন আমাদের ভাগ্যকে প্রভাবিত করতে পারে, তখনও আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি, পাছ ব্যাপারটা কোনভাবেই ভারত-পাক বিরােধ দাঁড়িয়ে যায়।
ঠিক কথা পাকিস্তান তার গৃহযুদ্ধকে ভারত-পাক ব্যাপারে দাঁড় করাতে চায়। এটাও ঠিক কথা যে, আমরা তা হতে দিতে চাই না। কিন্তু আমরা না চাইলেই কি পাকিস্তানকে ঠেকাতে পারছি? পাকিস্তান কি ইতিমধ্যেই ব্যাপারটাকে ভারত-পাক ব্যাপার করে তােলে নি? যে ৩৫ লক্ষ উদ্বাস্তু ইতিমধ্যেই এদেশে এসেছে এবং আগামী দিনগুলিতে আরাে যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু আসবে, তারা কি? বাংলাদেশ সরকার আজ পাকিস্তান। সরকারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার? আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই, তারা এমনি এমনিই চলে যাবে? নয়াদিল্লী কি তাই ভাবছেন? তাঁরা মনে রাখবেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা ইতিমধ্যেই উদ্বাস্তুদের ভারতীয় দুঃস্থ আর দুষ্কৃতকারী বলে গেয়ে রেখেছেন। তিনি বলেছেন, এদের কিছুতেই আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং আমরা জানতে চাই, পাকিস্তানকে বাধ্য না করলে এদের কিভাবে ফেরৎ পাঠাবেন? তার বক্তৃতার হুঙ্কারে?
পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং নির্ভয় না হলে যে উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে পারে না এটা বুঝতে কোনাে অসাধারণ জ্ঞানের দরকার হয় না এবং রাজনৈতিক পন্ডিত না হলেও এটাও সকলেই বুঝতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থা কখনােই স্বাভাবিক ও নির্ভয় হবে না। বুঝতে চাইছেন না শুধু ভারত সরকার। ইশ্বর আর ইয়াহিয়ার ওপর সর্বস্ব ছেড়ে দিয়ে তারা এখনাে ভাবছেন, সবকিছু হয়ে যাবে। নাকি তারা ভাবছেন বৃহৎ শক্তিগুলাে একদিন না একদিন পাকিস্তানকে বাধ্য করবে উদ্বাস্তুদের ফেরৎ নেবার জন্যে সেইসব বৃহৎ শক্তি যারা দশ লাখ মৃতের সামনে দাঁড়িয়েও অবিচলিত, যারা ৩৫ লাখ ভাগ্যহতের সমস্ত দায় ভারতের ওপর চাপিয়ে দিতেই ব্যস্ত? সেই জন্যেই কি দৈনিক পঞ্চাশ ষাট হাজার উদ্বাস্তু এলেও আমাদের কিছু করবার নেই? সেই জন্যেই কি পাকিস্তানিরা আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে গেলেও আমরা প্ররােচিত হতে প্রস্তুত নই?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!