সমস্যার স্থায়ী সমাধানের হদিশ নেই
শরণার্থীদের অন্যান্য রাজ্যে পাঠান হবে। ভবিষ্যতে এদের দেখাশুনার ভার নেবেন কেন্দ্রীয় সরকার। আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় দু’মাস পরে একটা বাস্তব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নয়াদিল্লী। বাংলাদেশের ইয়াহিয়ার তান্ডবের সূত্রপাত গত পঁচিশ মার্চ। পাইকারীহারে শরণার্থীদের ভারতে আগমনের সম্ভাবনা ছাব্বিশে মার্চ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। দু’সপ্তাহের মধ্যেই সীমান্ত রাজ্যগুলােতে দেখা দেয় শরণার্থীর স্রোত। প্রতিদিন বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। বারবার সতর্ক করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারকে। পশ্চিম বাংলা সরকার ধর্ণা দিয়েছিলেন দিল্লীর দরজায়। কোন কথা শােনেননি কেন্দ্রীয় সরকার। তাদের জীদ, শরণার্থীরা থাকবেন সীমান্তের কাছাকাছি। সুযােগ মত চলে যাবেন স্বদেশে। এত সরল করে সমস্যাটা দেখেছিলেন নয়াদিল্লীর কর্তাব্যক্তিরা। শরণার্থীদের সংখ্যা যখন চল্লিশ লক্ষের কোঠায় পৌছল তখন তাদের টনক নড়ল। মুখে বললেন শরণার্থী সমস্যা জাতীয় সমস্যা। কিন্তু এই জাতীয় সমস্যার বােঝা ভাগাভাগি করে নিতে রাজী করাতে পারলেন না অন্যান্য রাজ্য সরকারকে। কেন্দ্র এখন। নিজের মাথায় নিচ্ছেন সব ভার। এদিকে শরণার্থী শিবিরগুলাের অবস্থা শােচনীয়। মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে কলেরা। তৈরী হচ্ছে রাজনৈতিক জটিলতা। স্থানীয় অসন্তোষ ঢুকছে তাদের মধ্যে। ভেঙ্গে পড়ছে। প্রশাসন ব্যবস্থা। কলকাতায় এসে যে সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই নয়াদিল্লীতে বসে তা করা যেত। সময় হারিয়ে কীর্তনের দরকার পড়ত না।
কিছুদিন আগে শিবিরগুলােতে ঘুরে শরণার্থীদের অবস্থা নিজে দেখেছেন শ্রীমতী গান্ধী। অবশ্যই বুঝেছেন, অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হবে না শরণার্থী অপসারণে একদিন বিলম্বের অর্থ কলেরা কিম্বা অন্যান্য সংক্রমক রােগে বহুলােকের প্রাণহানি। সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক জটিলতার ব্যাপকতা বৃদ্ধি। দু’দিন আগে সহজে যা হতে পারত আজ তার জন্য অনেক কাঠখড় পােড়াতে হবে। আরও দেরী হলে শুধু কাঠখড় পােড়ালেই চলবে না, হয়ত অবাঞ্ছিত ধকল সামলানাের দরকার পড়বে। আইন ও শৃঙ্খলার প্রশ্ন বড় হওয়া যাচ্ছে না। কারণ দীর্ঘসূত্রতা এবং সুদৃঢ় সঙ্কল্পের অভাব কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাভাবিক অঙ্গ। বিশেষ করে, সিদ্ধান্ত পাল্টাতেও তাদের সময় লাগে না। এবার আর সুযােগ নেই। পশ্চিম বাংলা সরকার মরিয়া। শরণার্থী অপসারণে বিকল্প হলে কেন্দ্র-রাজ্যের মন কষাকষি দানা বাধতে বাধ্য। আগেভাগে তৈরী থাকলে সমস্যার জটিলতা অবশ্যই কমত। জনগণের সামনে কেন্দ্রের অদূরদর্শিতা এমনিভাবে ধরা পড়ত না। একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, শরণার্থী সমস্যা নিয়ে নয়াদিল্লী লেজে-গােবরে একাকার হয়েছেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, জাতীয় সঙ্কটে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার অক্ষম। আর গরিমসির সময় নেই। শরণার্থী অপসারণের সক্রিয় আয়ােজন অবিলম্বে চালু হওয়া আবশ্যক। তা না হলে আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে গােটা পরিস্থিতি।
ভিন্ন রাজ্যে শরণার্থী প্রেরণ সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র। আইনের চোখে আগন্তুকরা বিদেশী। মানবতার দাবী ছাড়া অন্য কোন দাবীর অধিকারী নন তাঁরা। কিভাবে এবং কবে শরণার্থীরা ফিরবেন নিজেদের বাড়ীঘরে তার উপায় বালাতে হবে ভারতকে। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে যদি এ কাজে সাহায্যের হাত বাড়ায় ভাল কথা। না বাড়ালে নয়াদিল্লীকে খুঁজতে হবে বাস্তব পথ। এই পথটি যে কি তা নিজেই জানেন না প্রধানমন্ত্রী। তার কথাগুলাে অস্পষ্ট এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ সঞ্চায়ী। সারা বিশ্বে দূত পাঠিয়ে অনুকূল অথবা সৃষ্টি করতে পারবে না নয়াদিল্লী। আন্তর্জাতিক রাজনীতি কায়েমী স্বার্থের বেড়াজালে বাঁধা। ইসলামাবাদের প্রতি বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের গােপন দরদ স্পষ্ট। ওরা কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না পাক-ভারত শক্তিসাম্য। বাংলাদেশ জাহান্নামে গেলেও নয়। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের যদি মানবতাবোেধ এবং গণতন্ত্রের উপর আন্তরিক আস্থা থাকত তবে তাদের একটি হুমকীতে সাত হাত মাটির নীচে সেঁধিয়ে যেতেন ইয়াহিয়া খান। এখনও তিনি শিরদাঁড় সােজা করে টিকে আছেন। মনের আনন্দে বাঙ্গালী তাড়াচ্ছেন। পরে হয়ত একটা পুতুল সরকার খাড়া করে ইয়াহিয়া বলবেন—“সব ঠিক হ্যায়’। বৃহৎ শক্তিগুলােও কোরাস গাইবে—সব ঠিক। বাংলাদেশ ঠাণ্ডা। শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরী। তাতে হতভাগ্য মানুষগুলাের আস্থা ফিরবে না। পাকিস্ত েিনর সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে নাকে খত দিয়ে মুষ্টিমেয় শরণার্থী হয়ত আবার ওপারে পাড়ি জমাবেন। অধিকাংশই থেকে যাবেন ভারতে। এই সম্ভাব্য অবস্থা অসহনীয়। সখাত সলিলে নিমজ্জমান মানুষগুলাে আরও কঠিনভাবে জড়িয়ে ধরবেন ভারতের কোমর। তাদের নিয়ে ডুববেন নয়াদিল্লী। কেন্দ্রীয় সরকারের ভুলের মাশুল দেবেন এদেশের জনসাধারণ। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং তাদের সাময়িক সাহায্যের সক্রিয় প্রতিশ্রুতি ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। ইয়াহিয়া বােঝেন অস্ত্রের ভাষা। এই ভাষাতেই দিতে হবে তাকে উপযুক্ত উত্তর। বাংলাদেশে তার শাসনের অবসানের মধ্যেই নিহিত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের উপায় এবং ভারতের মুক্তির সন্ধান।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ জুন ১৯৭১