পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ ও সিংহল
সন্ধানী
পাকিস্তানে জঙ্গিশাহী কাগজে-কলমে মার্কিন মােড়লের দুটি জঙ্গি জোটে (সেন্টো ও সিয়াটো) দস্তখত করেছে আজ অনেকদিন হলাে। কিন্তু জঙ্গি জোটের সরকারি সদস্য থেকেও পাকিস্তান আজ পর্যন্ত ঘুমন্ত শরিক হয়ে আছে। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কঙ্গো, মধ্যএশিয়া বা সিংহলে, কোথাও সে ভারতের মতাে সাম্রাজ্যবাদীদের সাকরেদী করতে যায়নি, চীনা বিরােধী চক্রান্তেও নয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, পাকিস্তান ভারতের চেয়ে বেশি যুগােচিত প্রগতিশীল রাষ্ট্র। আসলে পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী নিজেদের রাষ্ট্রের ভৌগােলিক ও অন্যান্য অসুবিধা বিচার করে কোনাে জঙ্গিজোটে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি এবং ভারতের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক থাকার দরুন আত্মরক্ষার তাগিদে ও চীনে পণ্যের বাজার পাবার আশায় চীনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্তরে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ভারত, চীন এবং আমার দুজনেরই শত্রু; সুতরাং জ্যামিতির সূত্র অনুসারে (দুটি জিনিস, তৃতীয় জিনিসের সমান হলে, নিজেরাও সমান) আমরা বন্ধু ঠিক যেমন সুভাষচন্দ্রের ধারণা ছিল, ব্রিটিশ, ভারত ও জার্মানির শত্রু; সুতরাং জার্মানি ভারতের বন্ধু।
পূর্ববাংলার জনতা নয়া উপনেবিশবাদের এক আধা-উপনিবেশের উপনিবেশ স্বরূপ এবং পশ্চিমবঙ্গও তাই। তাই দেনাে’ রাজনৈতিক স্বাধীনতা জনতাকে শশাষণমুক্ত করা দূরে থাক, তাদের ঘাড়ে চাপিয়েছে শােষণের ডবল জোয়াল, স্বদেশী একচেটিয়া মুৎসুদ্দি পুঁজির সঙ্গে গেরাে-দেয়া বিদেশি নয়া-উপনিবেশবাদী মহাজনী পুঁজি এবং এই ব্যাপারের সঙ্গে আরাে যােগ করুন আধাসামন্ত-যুগােচিত ভূমি ব্যবস্থার জোয়াল। কাঁধ দুটো, জোয়াল তিনটে। এই তিন জোয়াল মেহনতি জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে নয়াদিল্লী পূর্ববাংলার স্বাধীকারের শােকে মায়াকান্না প্রচার করে যাচ্ছে বেতার ও একচেটিয়া কাগজ মারফত। মায়াকান্নায় অশ্রুপাত করছে দুনিয়ার যেখানে যত প্রতিবিপ্লবী ও নয়া-উপনিবেশবাদী আছে সবাই-কে কাকে টেক্কা দিতে পারে। কিন্তু পূর্ববাংলার জনগণের ন্যায্য স্বশাসনের দাবির হয়ে যে মুহূর্তে ঐ ‘অক্ষ’ বা ‘ত্রিকোণ’ এত ওকালতি করছে, সেই মুহূর্তে ঐ ত্রিমূর্তি প্রত্যক্ষ সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করেছে সিংহলীদের মুক্তির দাবি রক্তগঙ্গায় ডুবিয়ে দিতে এবং পশ্চিমবঙ্গে কার্যত জঙ্গি যথেচ্ছাচারের দ্বারা জনগণের বাচার দাবি পিষে মারতে। এর চেয়ে বেশি ভণ্ডামি আর কী হতে পারে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, পিঁপড়ের পাখা গজাচ্ছে। এপার ও ওপার বাংলার কোটি কোটি প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থে। কিন্তু নিউটনের সূত্র অনুসারে প্রত্যেকটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত ক্রিয়া আছে এটা নাভিশ্বাসের যুগে ভুলে গিয়েছেন তারা।
নয়াদিল্লী পূর্ব ভারতের সীমান্তে সান্ধ্য আইন ও দেশের নিরাপত্তার’ (কোন দেশ, কিসের দেশ, দেশ মানে মাটি না মানুষ?) খাতিরে নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স জারি করেছেন যার প্রয়ােগ শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত কোন দিক থেকে বাইরে থেকে না ভিতর থেকে। কাগজে বীরভূমে সামরিক ও সাজোয়া যানের বহর থেকে কি এই প্রশ্নের জবাব মেলে না, মেলে না রােজ সৈনিক ও পুলিশের গুলিতে ডজন ডজন যুবকের অকাল মৃত্যু থেকে? কিন্তু এটা তাে প্রমাণিত সত্য যে, শাসক শ্রেণী যখন সংসদীয় ধারার শাসনে গদি বাঁচাতে পারে না, তখনই তার গণতন্ত্রের পােশাক খুলে যায়, প্রচ্ছন্ন ফ্যাসিবাদী চেহারা আত্মপ্রকাশ করে এবং সে উৎকট জাত্যভিমান খুঁচিয়ে তুলে বাইরে থেকে দেশ বিপন্ন’ ধুয়া তুলে জঙ্গিশাসন লােকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এটা বলিষ্ঠতার লক্ষণ নয়, দুর্বলতার। তবে এভাবে বুর্জোয়া শ্রেণী যদি মেহনতি মানুষের বাঁচার লড়াইয়ের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে সেটা বামপন্থী আন্দোলনেরও দুর্বলতার পরিচায়ক। কারণ সেই আন্দোলনের নেতারা মেহনতি জনতাকে বােঝাতে পারেননি যে, প্রত্যেক জাতির মধ্যে দুটি জাতি থাকেধনিক-বণিক শশাষণকারীর জাত’ যারা অন্যটিকে জেঁকের মতাে শুষে, রক্ত কাড়ছে থালার ভাত’ (নজরুল)। স্বদেশী বুর্জোয়া নেতৃত্বে লব্ধ জাতীয় রাজনৈতিক স্বাধীনতা আজকের দিনে দেশে ঐ প্রথম জাতিটির হাতে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ ক্ষমতা হস্তান্তরিত করে কারণ আন্দোলনে মেহনতি জনতার পার্টির প্রাধান্য থাকে না। জাতীয়তার প্রগতিশীল ভূমিকা আজ আর নেই। বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী দেশের স্বশাসনের অধিকার বলতে বােঝায় শাসক শ্রেণীর অবাধ শােষণের ও মুনাফা কমাবার স্বাধীনতা। ঐ দ্বিতীয় জাতিটিই কিন্তু আসল দেশ যাদের প্রথম জাতিটি প্রতারণার দ্বারা যুদ্ধের খােরাক বানায় দেশের নামে যে দেশের নামে কুখ্যাত কাউটস্কি জার্মানির সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সমর্থন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আত্মপরিচয়ে লিখছেন, ‘দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা, সুফল্য, মলয়জশীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটাব ততােই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দান তাে উপাদান মাত্র, তা নিয়ে মানুষের সম্পদ কতােটা গড়ে তােলা হলাে। মানুষের হাতে দেশের জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারীবীজে শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি।
রবীন্দ্রনাথ ঐ দ্বিতীয় দেশটির কথা বলছেন যার নিরাপত্তার জন্য আবার বাষট্টি সালের মতাে অর্ডিনান্স জারি হয়েছে, বিনাবিচারে আটক আইন চালু হয়েছে, পূর্ব সীমান্তে সান্ধ্য আইন কায়েম করা হয়েছে। আমাদের ধারণা শরণার্থীদের ফেরত না দিলে ভারত যদি পূর্ববাংলায় পিটুনি জাতীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করে, তাহলে পাকিস্তান কাশ্মীরে বদলা নেয়ার চেষ্টা করবে এবং তারই জন্য আমেরিকা আট জাহাজ অস্ত্র তাকে পাঠাচ্ছে। আমেরিকা ও ক্রেমলিন বরের ঘরে মাসি, কনের ঘরে পিসি। সান্ধ্য-আইন ভারত-পাক সীমান্তের যে অংশে বলবৎ আপাতত দুই মাসের জন্য সেটা লক্ষণীয়। নয়াদিল্লী দুই বাংলার সীমান্তে গালামােহর করেছে কি ওপার বাংলা থেকে ইয়াহিয়াশাহী এপার বাংলা আক্রমণ করতে পারে, এই আশঙ্কায়? ইয়াহিয়া খ কি এততাই নির্বোধ যে, পূর্ববাংলার ভৌগােলিক অবস্থান অর্থাৎ সেটি যে ভারত পরিবেষ্টিত একটি পকেটস্বরূপ তা বােঝেন না? কিন্তু যে গেরিলারা লড়ছে ইয়াহিয়ার দস্যুদের বিরুদ্ধে তাদের প্রয়ােজনমতাে পিছু হঠার বা আশ্রয় নেবার পথ তাে বন্ধ হয়ে গেল। চট্টগ্রাম শ্রীহট্টে ও কুমিল্লা অঞ্চলে হালে যে চাষিরা গেরিলা যুদ্ধে নামছে তারা যাতে সংক্রমণাত্মক রাজনীতিসমেত প্রয়ােজন মতাে ভারতে কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করতে না পারে তার জন্যই এই সাবধানতা? এখানে উল্লেখযােগ্য যে সীমান্তের আলােচ্য অংশ একেবারে নাগাভূমি ও মণিপুরের (এই অঞ্চলের আদিবাসীরা নয়াদিল্লীর উপর প্রসন্ন নয়) লাগােয়া বলা যায় এবং তার পরই ব্রহ্মের কিছু মুক্ত এলাকা আছে। পূর্ববাংলার মুক্তি সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদবিরােধী গেরিলা জাতীয় ও দীর্ঘায়িত না হলে আসল বৈপ্লবিক জয়লাভ অসম্ভব অথচ আওয়ামী লীগের ছয়দফা প্রস্তাবে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে কোনাে উচ্চবাচ্য নেই, এমনকি শ্ৰেণী’ শব্দটি পর্যন্ত জনাব মুজিব কোথাও উচ্চারণ করেননি। সত্যিকার মুক্তিসংগ্রামে (আধ কোটি শরণার্থীর সেই সংগ্রামে গেরিলা যােদ্ধা হওয়া উচিত ছিল) পেশাদার সৈন্য কখনাে গেরিলা রাজনীতি সচেতন মুক্তিযােদ্ধা হতে পারে না।
মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ অর্থাৎ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বর্শাগ্র ধ্বংস হওয়ার ফলে সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদী নন্দনকাননে লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয় এবং প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় বললেই চলে। তাই সাম্রাজ্যবাদ (পুঁজিবাদের চরম পর্যায়) প্রত্যক্ষ থেকে পরােক্ষে চলে যায় (নয়া উপনিবেশবাদ) এবং তৃতীয় দুনিয়ার অধিকাংশ দেশের বুর্জোয়াসামন্ত গােষ্ঠীকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। এতে আপামর জনসাধারণের মুক্তিলাভ হয়নি। সেই মুক্তির একমাত্র পথ গৃহযুদ্ধ যার বর্শাগ্রের লক্ষ্য দুটি—বুর্জোয়াসামন্ত মুৎসুদ্দি গােষ্ঠী ও তাদের মুরুব্বী আগ্রাসী নয়া-উপনিবেশবাদ। এই বল্লম হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক গেরিলাবাহিনী। এদের যুদ্ধই জনযুদ্ধ এবং বর্তমানে আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া শ্রেণীর অস্ত্রবল অনেক বেশি বলে আচমকা আঘাত ও পশ্চাদপসরণের দ্বারা শত্রুক্ষয় ও নিজেদের শক্তি দীর্ঘকাল বৃদ্ধি করতে করতে শেষ পর্যায়ে নিজেরা যখন দলে ভারি হওয়া যাবে তখনই আসবে চরম মােকাবেলার জন্য পাল্টা আক্রমণের শুভ সুযােগ। শেষ পর্যন্ত শত্রুর অবস্থা ঘটবে চিয়াং কাইশেকের মতাে এবং জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে। বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রগতিশীল ভূমিকা আর অবশিষ্ট নেই বলেই আজ আর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রশ্ন ওঠে না। কমিনফর্মের মুখপত্রের নাম ছিল একজোড়া স্লোগান- ‘অটুট শান্তির জন্য, জনগণতন্ত্রের জন্য। প্রথমটি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল সরকারগুলাের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামের আহ্বান কারণ আগ্রাসী চরিত্র সাম্রাজ্যবাদের মজ্জাগত, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঐ যুদ্ধের চরম লক্ষ্য জনগণতন্ত্র এই থেকেই বােঝা যায় যে, আজ কোথাও কোনাে দেশে বুর্জোয়া শ্রেণী প্রকৃত মুক্তিসংগ্রামের বক্সা গ্রহণ করবে না, করতে পারে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের জন্য নয়াদিল্লীর এতাে ‘দরদের’ কারণ এই যে তাঁরা সবাই এক খোয়াড়েরই গরুর সামিল এবং রতনে রতন চেনেন।
পূর্ববাংলার পশ্চিমবাংলার ও সিংহলের ঘটনা একই সাম্রাজ্যবাদী সূত্রে গাঁথা ‘অক্ষ’, ‘ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ’ ইত্যাদি যা ইচ্ছা বলুন। এই তিনটি জায়গার মুক্তি সংগ্রামের গর্ভপাত করিয়ে তালেগােলে হরিবােলের অন্তরালে ভারত মহাসাগরে বিনা বাধায় সাম্রাজ্যবাদের সামরিক ঘাঁটি খাড়া করা এবং সেই ঘাঁটি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটি আসন্ন মুক্তি সংগ্রাম অঙ্কুরে বিনাশ করা, এটাই সাম্রাজ্যবাদ ও তার পােষা কুকুরদের (ত্রিমূর্তির) চরম লক্ষ্য। অমর ভিয়েতনামের দৃষ্টান্ত থেকে কোনাে শিক্ষাই তাদের হয়নি। তালে গােলে হরিবােলই শেষ পর্যন্ত সার হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আরাে আগে হতাে যদি এসব দেশের প্রগতিশীল পার্টিগুলাে মনে রাখতে যে বিনা ব্যতিক্রমে বিশ্বের সমস্ত দেশের বুর্জোয়া শ্রেণী বুর্জোয়া
গণতান্ত্রিক ধ্বজা ধূলায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ডলারের পায়ে স্বদেশের স্বাধীনতা নজরানা দিয়ে বসে আছে। ঐসব দেশের প্রগতিশীলরা যদি সত্যই দেশপ্রেমিক হতে চান, জনগণকে নেতৃত্বদানের উচ্চাশা রাখেন তাহলে ঐ ধ্বজা তাদেরই কাঁধে তুলে নিতে হবে কারণ তুলে নেবার আর কেউ নেই।
সূত্র: দর্পণ
১৬.০৭.১৯৭১