You dont have javascript enabled! Please enable it!

মরীচিকার পিছনে স্বরণ সিং

বিশ্ব সফরে বেরিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীস্বরণ সিং। বিদেশী রাষ্ট্রনায়কদের শুনালেন তিনি বাংলাদেশের কাহিনী। গত ২৫শে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে ইয়াহিয়ার তান্ডব। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের নিজস্ব দুতাবাস আছে পাকিস্তানে। তাদের মারফৎ অবশ্যই জেনেছে তারা পূর্ববাংলায় পাক-সৈন্যদের বীবৎস অত্যাচারের বিবরণ। তারপরও অবিদিত কোন কিছু যদি থেকে থাকে তবে ভারতে আছে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। তাদের ভীতিবিহ্বল চোখগুলাে ইয়াহিয়ার ঘাতকবুত্তির চাক্ষুষ উদাহরণ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনী। প্রধানমন্ত্রী নিজে লিখেছেন বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র। বহু টালবাহানার পর রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট করেছেন গােটা বিশ্বে সাহায্যের আবেদন। তাতেও টনক নড়ে নি বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের। এত প্রক্রিয়া যেখানে ব্যর্থ সেখানে স্বরণ সিং হবেন সার্থক—এই কল্পনা অবাস্তব। শ্রীজয়প্রকাশনারায়ণ ঘুরছেন বিশ্বময়। তার পিছনে নেই কোন সরকারি অনুমােদন। তবু বুকভরা আশা নিয়ে তিনি গিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। যেখানেই যাচ্ছেন সেখানে পাচ্ছেন লােকদেখান সহানুভূতি। কোন কোন রাষ্ট্রে এ সহানুভূতিটুকুও জোটে নি। সর্বত্র তিনি লক্ষ্য করেছেন আন্তরিকতার অভাব। এই পটভূমিকার উপর পদচারণা করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং।
বৃটেন স্থগিত রাখবে না পাকিস্তানে সাহায্য সরবরাহ। আমেরিকাও তার পদাঙ্ক অনুসরণকারী। সােভিয়েট রাশিয়া কার্যতঃ বাংলাদেশের ঘটনাবলীর নীরব দর্শক। সবার মুখে এক কথা—পূর্ব বাংলাকে ঠাণ্ডা করে এনেছেন ইয়াহিয়া খান। তাকে সাহায্য না দিলে চীনের হবে পােয়াবারাে। ইসলামাবাদকে কুক্ষিগত করবেন পিকিং। পাকিস্তানের ব্ল্যাক মেইলিং-এর কাছে বৃহৎ শক্তিগুলাের কী নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ। মানবতা এবং গণতন্ত্র, সব মিথ্যা। একমাত্র সত্য সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থ। এই যদি হয়ে থাকে বিশ্ব বিবেকের হাল তবে কেন মরীচিকার পিছনে ছুটছেন স্বরণ সিং? নিরাশ ফিরবেন তিনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবার খেলা দেখছে ভারত। এত দেখার পরেও যাদের চৈতন্যে দয়া হয় না তাদের ঘটে বুদ্ধি জোগাবে কে? নয়াদিল্লী স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকান। দেখবেন, পাক-ভারত শক্তিসাম্য বজায় রাখা পশ্চিমী গােষ্ঠীর চিরচরিত নীতি। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের আকুল ক্ৰন্দ্ৰনে এ নীতির ব্যতিক্রম ঘটবে না। ভাবতে অবাক লাগে, সােভিয়েট রাশিয়াও পরােক্ষ মদৎ দিচ্ছে অবাঞ্ছিত পশ্চিমী পাঁয়তারায়। এদিকে ইয়াহিয়া মারমুখী। তিনি ঝেটিয়ে বিদায় করছেন গণতন্ত্রী বাঙ্গালীকে। সৈন্যদের সঙ্গে লেলিয়ে দিয়েছেন মােল্লাতন্ত্রীদের। ঐশ্লামিক ধুয়াে তুলেছেন আরব দুনিয়ায়। এই রাষ্ট্রগুলাে জেগে জেগে ঝুমুচ্ছে। হত্যা, লুণ্ঠন এবং নারী ধর্ষণ ঐশ্লামিক রীতি সম্পন্ন কিনা—এই সহজ প্রশ্নটি জাগছে না তাদের মনে। পক্ষগতদুষ্ট বিষাক্ত পরিবেশে কোথায় নয়াদিল্লী পাবেন ন্যায়বিচার?
নিদারুণ ভুল করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। বাস্তব অবস্থার সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারেন নি তিনি। অক্ষম হয়েছেন মন্ত্রিসভায় অনুপ্রেরণা জোগাতে পর্বত প্রমাণ শরনার্থীর বােঝা চেপেছে ভারতের মাথায়। বিভিন্ন রাজ্যে তাদের স্থানান্তরের দাবী উঠেছে পূর্বাঞ্চল থেকে। অন্যান্য রাজ্য সরকার কত দূর এগিয়ে আসবেন তাও জানা যাচ্ছে না। মনের আনন্দে বাঙ্গালী খেদাচ্ছেন পাক সরকার। এখানে খিটিমিটি চলছে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে। অথচ শরণার্থী ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। এই শাসনের অবসান ঘটাবার কোন উদ্যোগে সক্রিয় মদৎ দেবে না বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে। এখন কি করবে ভারত? শ্রীমতী গান্ধী বলে দিয়েছেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি না হলে সক্রিয় ব্যবস্থা নেবেন নয়াদিল্লী। সম্ভাব্য ব্যবস্থার প্রকৃতি কি হবে? ভারত কি অস্ত্র হাতে নেবে? স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে অধিকতর সক্রিয় করে তুলবে? অবস্থা যা দাড়াচ্ছে তাতে এককভাবে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। অন্যের সাহায্যের আশা ছাড়ুন নয়াদিল্লী। ইয়াহিয়ার কৃতকর্মের বােঝা কারও উপর পড়েনি, পড়েছে ভারতেন উপর। কেনিয়ার নিজস্ব কালাে নাগরিকদের বৃটেনে প্রবেশাধিকার দিচ্ছেন না বৃটিশ সরকার। কোন প্রতিবাদ গ্রাহ্য করেন না তারা। ভারতে যখন আসে পাক বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ বিদেশী নাগরিক তখন এইসব বৃটিশ ধুরন্ধর সার্জেন দুনিয়ার শান্তির জিম্মাদার। তারিফ করেন নয়াদিল্লীর শহনশীলতার। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থৈর্য এবং মানবতার খাতিরে যখনই ভারত নেবে সক্রিয় পথ তখনই চারদিকে উঠবে সােরগােল। ইয়াহিয়ার দুঃখে চোখের জলে বুক ভাসবে অনেকের। এদের প্রতিক্রয়ায় বেশী গুরুত্ব দিলে ডুবতে হবে নয়াদিল্লীকে। অনাশ্যক সময় নষ্ট করেছেন কর্তৃপক্ষ। আর দেরী নয়। মনঃস্থির করে ফেলুন। অস্ত্রে শান দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বাহুতে শক্তি সঞ্চার করুন। ওরাই আনবেন পূর্ব বাংলার স্বাভাবিক অবস্থা। লাগব করবেন ভারতের বােঝ। স্বরণ সিং বিশ্ব পরিক্রমা করে ফিরে আসুন। এর জন্য আরও কিছু টাকার অপচয় ঘটুক। সব সহ্য করবেন জনসাধারণ। কিন্তু সহ্য করবেন না তাঁরা নয়াদিল্লীর সিদ্ধান্তহীনতা এবং কাল হরণে আদুরদর্শিতা। স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। তার পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় অংশীদার হবার দায়িত্ব সবার। অন্য কেউ এগিয়ে না এলে ভারতকে নিতে হবে সংগ্রামী ব্যবস্থা। কারণ এই ব্যবস্থার সঙ্গে শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন জড়িত। আর জড়িত এশিয়ার এই স্পর্শকাতর অঞ্চলের শান্তি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!