মার্কিন বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতা
(দর্পণের পর্যবেক্ষক)
মার্কিন সরকার অবশেষে জনসাধারণের দাবির প্রতি কিছুটা মাথানত করতে বাধ্য হলেন। এর প্রমাণ সম্প্রতি বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়া এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের খাত থেকে সামরিক বিষয় সংক্রান্ত সাহায্যকে বাদ দেয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে পৌছেছিল যে, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের সূচনা দেখা দেয় যার ফলে সরকারি নীতির প্রতি জনমত ক্রমশই বিরূপ হয়ে ওঠে।
সিনেটের নতুন নীতিটিকে যুগান্তকারী বলে অভিহিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়। ফুলব্রাইট, কেনেডি ইত্যাদি উদারপন্থী সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে সিনেটের প্রভাব পরবর্তী যুগে ক্রমশই বেড়ে চলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বৈদেশিক সাহায্য হচ্ছে মার্কিন সরকারের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র যার দ্বারা সে নিজ প্রভাব বজায় রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে, কমিউনিস্ট চিন্তাধারার প্রসার এবং বিভিন্ন দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম গড়ে ওঠার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখলাে যদি ধনতন্ত্রকে বৃহত্তর বিশ্বে জিইয়ে রাখতে হয় তাহলে একমাত্র উপায় অনুন্নত দেশগুলােতে পুতুল সরকার খাড়া করে প্রচুর অর্থব্যয়ে তাদের টিকিয়ে রাখা। এই নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুসরণ করেছে লাতিন আমেরিকায়, এশিয়ায় এবং ইউরােপের গ্রিস, স্পেন ইত্যাদি দেশগুলােতে।
এর ফলে মার্কিন অর্থনীতিতে ভাঙন ধরেছে। দেশে বেকার সমস্যা আজ চূড়ান্ত, জিনিসপত্রের দাম ক্রমশই বাড়ছে। অপরদিকে যে দেশগুলােতে কমিউনিজম রােধ করতে মার্কিন সরকার এত অর্থ ব্যয় করে চলেছে, ইতিহাসের অমােঘ নিয়মে সেইসব দেশে আজ মুক্তি সংগ্রামীদের জয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। অপরদিকে জাপানের মতাে দেশ যা নাকি পুরােপুরি মার্কিন সাহায্যে নিজের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি গড়ে তুলেছে সে আজ ওই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এসব কারণে মার্কিন জনসাধারণ ক্রমশই সরকারের বৈদেশিক নীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিল যার চরম প্রকাশ ঘটল সিনেটের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে।
ভবিষ্যতে মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য কীভাবে দেয়া হবে সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের মতে সরাসরি কোনাে অনুন্নত দেশকে সাহায্য না দিয়ে এই টাকা দেয়া উচিত বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যান্য সংস্থাগুলাের মাধ্যমে। অবশ্য এই বক্তব্যের রাজনৈতিক কারণ সুস্পষ্ট। এর প্রবক্তরা মনে করেন যে, এর ফলে বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বদনাম যেমন কাটবে (বদনাম হচ্ছে যে মার্কিন সরকারের এই সাহায্য হচ্ছে একমাত্র নিজ স্বার্থ কায়েম করার প্রচেষ্টা) তেমনি বিশ্ব সাহায্যকারী সংস্থাগুলােকে ক্রমাগত টাকা জুগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেগুলাের উপর নিজ প্রভাব আরও বেশি জোরদার করতে পারবে এবং এর ফলে এই সংস্থাগুলােকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের নীতি অনুসরণ করিয়ে নিয়েও অনেকাংশে দায়মুক্ত থাকতে পারবে এবং বর্তমান অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্যের পরিমাণ শুধু কমাবে তাই নয় তা দেয়ার ব্যাপারে ঠিক উপরিল্লিখিত হলেও ওই ধরনের কোনাে কায়দার পথ বেছে নেবে তাতে কোনাে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ : একটি রিপাের্ট
ঢাকা থেকে সদ্য প্রত্যাগত জনৈক মার্কিনী সাংবাদিক জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের পঁচিশ শতাংশ থানা এলাকা আজ মুক্তি বাহিনীর দখলে। বহু জায়গায় জেলা শাসকরা গােপনে মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করছেন। খােদ ঢাকা শহর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই গেরিলাদের হাতে চলে যায়।
সাংবাদিকটি আরও জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে বর্তমান সংগ্রামের আসল সত্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ কর্তৃপক্ষের অন্যদের কাছ থেকে গােপন করে যাচ্ছে। অবশ্য এর একটা কারণ হচ্ছে সেনাবাহিনীর কমান্ডাররাও সাধারণ মানুষের মনােভাব সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এদের অবস্থা অনেকটা দক্ষিণ ভিয়েতনামে অবস্থিত আমেরিকান সৈন্যদের মতাে। তিনি লিখেছেন যে, সর্বত্র পূর্ববাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর প্রশ্নে তিনি একটি উত্তরই পেয়েছেন। সেটি হলাে স্বাধীন বাংলাদেশ।
পাক সেনাবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ক্রমাগত বিপর্যস্ত হয়ে জনসাধারণের উপর তাদের অত্যাচারের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই রিপাের্টেই বলা হয়েছে যে, সম্প্রতি সৈন্যরা একটি গ্রাম ঘিরে এ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের সমস্ত মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং কিশাের, যুবক মাত্র গুলি করে মারে। অবশ্য যত এই ধরনের অত্যাচার হচ্ছে তত মুক্তি বাহিনীর দলও ভারি হচ্ছে। সাংবাদিকটির মতে যে, রাজাকারদের পাকিস্তানি সৈন্যদল বাড়তে সাহায্য করেছে তারাই আজ নিজেদের ক্রমাগত কুকর্মের ফলে ইয়াহিয়া সরকারের সব থেকে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র: দর্পণ
১৯.১১.১৯৭১