You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়া-ইন্দিরা ও বাংলাদেশ
প্রবীর বসু

বাংলাদেশের পূর্ব দিগন্তে ঝড় উঠেছে। এই ঝড়কে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজনৈতিক দল একদিকে যেমন ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর বর্বরতাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছে অপরদিকে মুক্তিফৌজ নামধারী বাঙালি সেনাবাহিনীর বীরত্বকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
এই নিন্দা ও অভিনন্দন এত বিচিত্র জায়গা থেকে এসেছে যে, সাধারণ রাজনৈতিক মানুষের কাছেও তা খানিকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে বাধ্য, যেমন বিভ্রান্তি হয় যখন কোনাে চোর প্রতিবন্ধী চোরের বিরুদ্ধে। চৌর্যবৃত্তির অভিযোেগ আনে।
ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে যে ভারতীয় দলগুলাে আজ সবচেয়ে বেশি রণহুঙ্কার দিচ্ছে, সেই স্বতন্ত্র, জনসংঘ থেকে কংগ্রেসের আদি ও নব দুই সংস্করণই ইয়াহিয়াকে গণতন্ত্রের শত্রু বলে অভিহিত করছে। ভাবখানা এমন যেন স্বতন্ত্র, জনসংঘ বা কংগ্রেস হলাে গণতন্ত্রের মূর্তপ্রতীক। একটা যুক্তি অবশ্য ঐ ভারতীয় দলগুলাে হাজির করবে যে, ইয়াহিয়া গণতন্ত্রের শত্রু হতাে না যদি না পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব কোনাে সাম্যবাদী দলের হাতে থাকতাে, কারণ সাম্যবাদীরা তাে কংগ্রেস মার্কা অর্থাৎ বুর্জোয়ামার্কা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। সুতরাং তাদের নিধনে কোনাে পাপ নেই। যদি পূর্ববঙ্গের আন্দোলনের নেতৃত্ব সাম্যবাদ বিরােধী মুজিবের বা কিছু প্রাক্তন বাঙালি সেনার হাতে না থাকতাে, থাকতাে শুধুই কমিউনিস্ট তােহা বা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে, তাহলে হয়তাে ইন্দিরাকে মদদ দিতে হতাে ইয়াহিয়াকে, স্বতন্ত্র জনসংঘ আদি নব কংগ্রেস সকলেই তখন বাংলাদেশের মুক্তিফৌজকে ‘সন্ত্রাসীবাদী ফৌজ’ নামে আখ্যা দিতাে এবং পশ্চিমবঙ্গকে সাম্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষার অজুহাতে রাতের অন্ধকারে দুই বাংলার সীমানা দিয়ে ইন্দিরার মর্টার আর এ্যান্টি এয়ার ক্রাফট ইয়াহিয়ার ‘ল এন্ড অর্ডার বাহিনীর হাতে পৌছে যেত।
এ কি কষ্ট কল্পনা? না, আমাদের সামনেই দৃষ্টান্ত। তাকিয়ে দেখুন সিংহলের দিকে। ঐখানে প্রধানমন্ত্রী মিসেস বন্দরনায়ক ক্ষমতাসীন এবং ‘গণতন্ত্রের মিত্র’। কেন? যেহেতু ঐ দেশে সাম্যবাদীদের বড়াে একটা অংশ সাম্রাজ্যবাদী দালাল সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ নিয়েছে, সেখানে সরকারি মুখপত্রও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ করতে গিয়ে বন্দরনায়েকের সেনাবাহিনী যখন ভারত ও ইংরেজ সরকারের সদ্য দেওয়া হেলিকপ্টার থেকে নিচে বােমাবর্ষণ করছে, তখন সাধারণ নিরপরাধ মানুষও মারা যাচ্ছে। সিংহলের চারপাশের জলপথে ভারতীয় নৌবাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাতে কোনাে বহিঃশত্রু সিংহলী বিপ্লবীদের সাহায্যে না ঢুকতে পারে।
পূর্ববঙ্গ ও সিংহল দু’জায়গায়ই নিরস্ত্র জনসাধারণ মারা যাচ্ছে সরকারি ল এন্ড অর্ডারের বােমা, কামান ও মেশিনগানে কিন্তু এক্ষেত্রে ভারত সরকার মানবতার ধুয়া তুলছে গণতন্ত্রের নামে, অন্যক্ষেত্রে মানুষ নিধনযজ্ঞে সহায়তা করছে গণতন্ত্রের নামে। একজায়গায় পাকসরকার তার বর্বরতাকে ঢাকছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাজনিত তথাকথিত ‘ল এন্ড অর্ডারের ধুয়া তুলে অন্য জায়গায় বন্দরনায়েক সরকার ল এন্ড অর্ডারের। ধুয়া তুলে সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু তফাত আছে? নেই, এক বিন্দুও নেই, বিশেষ করে শােষকশ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে। ইন্দিরা সরকারও ‘ল এন্ড অর্ডার-এর মিলিটারি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রকে রক্ষা করছে, কোলকাতায় ও গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলের অনুগামী বিশেষ করে নকশালদের হত্যা করছে শত শত, অজস্র গ্রেপ্তার করছে বিনাবিচারে আটকে রাখার গণতন্ত্র প্রয়ােগ করে, পুলিশকে প্রােমােশনের ঘুষ দিয়ে লেলিয়ে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বিপ্লবী জনসাধারণকে চোরাগােপ্তা খুন করবার জন্য।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ‘ল এন্ড অর্ডারের নাম করে মিলিটারি পুলিশ দিয়ে বিক্ষুব্ধ বা বিপ্লবী জনসাধারণকে হত্যায় ইন্দিরা ও ইয়াহিয়ায় তফাত রয়েছে। তফাত যেটুকু রয়েছে সেটা হলাে মাত্রার ও ব্যাপকতার। আবার ইন্দিরা ও সিরিমােভা বন্দরনায়কের মধ্যে তফাত তাে নেইই, বরং সক্রিয় বর্বর সহযােগিতা রয়েছে।

দুই
প্রশ্ন জাগে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়াকে দমন করতে ইন্দিরা ও ইয়াহিয়ার যদি কোনাে অমিল না থাকে, তবে কেন পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক সহিংস আন্দোলনকে ইন্দিরা তথা ভারতীয় সামন্ত ও পুঁজিপতি শ্ৰেণী সমর্থন করছে? কোনাে স্বার্থের প্ররােচনার না স্রেফ মানবতার দিক থেকে?
এ প্রশ্নের জবাবের আগে পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রকৃতি বােঝা দরকার।
১৯৪৭ সালের দাঙ্গা ও বাংলা বিভাগের পর পূর্ববঙ্গে অর্থনৈতিক শ্রেণীগত কোনাে পরিবর্তন হয়নি, শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক রদবদল হয়েছে মাত্র। ১৯৪৭ সালের আগে অর্থাৎ অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশে যে একচেটিয়া পুঁজিবাদ অ্যাংলাে মার্কিন পরাক্রম পুঁজিবাদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল, তাতে হিন্দু মালিকানার পরিমাণ ও পরাক্রম মুসলিম মালিকানার তুলনায় অনেক অধিক ছিল, ফলে একচেটিয়া পুঁজিবাদের হিন্দু মালিকদের নিকট প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুসলমান মালিকগণ অনেকটা দুর্বল ছিলেন। একই ইঙ্গমার্কিন প্রভুর ঘরে মুসলিম পুঁজিবাদী দুর্বলতা মুসলিম মধ্যবিত্ত নেতাদের পাকিস্তান দাবির দিকে নিয়ে যায় উপমহাদেশের বাজারে একাধিপত্যের নির্দিষ্ট অংশ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হলে মুসলিম একচেটিয়া পুঁজিবাদের নিজস্ব বাজার হবে, নিজস্ব শােষণক্ষেত্র হবে যেখানে বিড়লা টাটা ডালমিয়া সাহুজৈন প্রমুখ হিন্দু পুঁজিবাদের প্রভুত্ব বা অর্থনৈতিক পরাক্রম থাকবে না। ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়া এদিক থেকে হিন্দু একচেটিয়া পুঁজিবাদের শােষণক্ষেত্রে সীমিত হওয়ার সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, হিন্দু একচেটিয়া পুঁজি যে কারণে তার শ্রেণীস্বার্থে ভারতবিভক্তি পছন্দ করেনি। কিন্তু ইংরেজ একচেটিয়া পুঁজির লক্ষ্যই ছিল হিন্দু একচেটিয়া ও মুসলিম একচেটিয়ার মধ্যে ঝগড়া জিইয়ে রাখা এবং সে লক্ষ্যে মুসলিম একচেটিয়া বরাবর ইঙ্গমার্কিন একচেটিয়াকে প্রলুব্ধ করেছে। পাকিস্তান জন্ম নিয়েছে ইংরেজ একচেটিয়া ও দুর্বল মুসলিম একচেটিয়ার যৌথ ষড়যন্ত্রে এবং ভারতীয় সামন্ত শ্রেণীর সক্রিয় সহযােগিতায়; ভারতীয় হিন্দু একচেটিয়া ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারেনি শােষণব্যবস্থার ক্ষমতা হস্তান্তরের তাৎক্ষণিকতার এবং হিন্দু সামন্ত প্রভুদের চাপে।
যে সকল ঐতিহাসিক কারণে অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শােষণের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা ভারতীয় একচেটিয়ার অভ্যন্তরে মুসলিম একচেটিয়া হিন্দুদের তুলনায় দুর্বল ছিল, অনুরূপ ঐতিহাসিক কারণে অবিভক্ত ভারতে বাঙালি একচেটিয়ার উপস্থিতি ও পরাক্রম নগণ্য। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যদিওবা কেউ কেউ এগিয়ে ছিল, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তাও ছিল না।
আবার ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশে হিন্দুদের অর্থনৈতিক অবস্থান মুসলমানদের তুলনায় ভালাে। পূর্ববঙ্গে সামন্তশ্রেণীতে হিন্দু একাধিপত্যের খবর আমরা অনেকেই জানি, গরিব চাষি হিসেবেই বাঙালি মুসলমানরা পরিগণিত হতেন। এমনকি অবিভক্ত বাংলার উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীতে মুসলিমদের প্রায় অনুপস্থিতি বিশেষ লক্ষণীয়, নিম্ন মধ্যবিত্তদের মধ্যে মুসলিম উপস্থিতিও মাত্র গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে অনুপস্থিতির অন্যতম সাক্ষ্য হলাে বাংলা উপন্যাসের বাঙালির চরিত্র। চয়ণে মুসলমান নায়ক বােধ হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অবিভক্ত বাংলার কোনাে প্রথিতযশা হিন্দুসাহিত্যিক ও শিল্পী নিয়ে আসতে পারেননি, একে হিন্দু মধ্যবিত্তের চাপা মুসলিম-অবজ্ঞা বলেও অনেকে ব্যাখ্যা করতে পারেন, তবে আমাদের মনে হয় এর মূল কারণ মুসলিমদের অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাস। হিন্দু গরিব চাষি নিয়েই বা উপন্যাস বা ছােটগল্প তেমন কোথায়?
বাংলাদেশকে কেটে দু’ভাগ করায় হিন্দু একচেটিয়াবাদের যে ক্ষতিটুকু হয়েছে, তা ভারত বিভাগের ক্ষতির সমতুল্য, রাজনৈতিক লাভ হয়েছে অনেকটা, কারণ অবিভক্ত বাংলার শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের জঙ্গি চরিত্র বরাবরই সাম্রাজ্যবাদী ও তার তাবেদার শােষকশ্রেণীর দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানাে উক্ত শ্রমিক কৃষক আন্দোলনকে ছুরিকাঘাতের সামিল।
অপর পক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গােলাম জিন্নাসাহেব যে ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করে গেছে, তাতে মুসলিম একচেটিয়াবাদ ও মুসলিম সামন্তশাহীর যৌথ শােষণের ক্ষেত্র নিষ্কণ্টক করা হয়েছে। অবিভক্ত ভারতের মুসলমান একচেটিয়াবাদের বােম্বাই তৈরি হয়েছে করাচি ও অধুনা ইসলামাবাদে। আর ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল উক্ত পশ্চিম পাকিস্তানি একচেটিয়াবাদ পূর্ববঙ্গকে একটি উর্বর শােষণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযােগ পেয়েছে।
অবাধ শােষণের এই সুযােগে সমৃদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রকে পূর্ববঙ্গের নবগঠিত মুসলিম সামন্ত শাহী ও নপুংসক জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী অভিনন্দন জানিয়েছিল। এ কথা শেখ মুজিবর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নিজস্ব জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন ছাত্রজীবন থেকেই মুসলিম লীগের পতাকাতলে তিনি জিন্নাসাহেবের পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম করে এসেছেন। যে বাঙালি মুসলিম ধনী কৃষক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন হঠাৎ কেঁপে ওঠা ব্যবসায়ী, কনট্রাক্টর, কালােবাজারি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং সরকারি উচ্চ কর্মচারীরা সেদিন পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য জিন্না সাহেবের নেতৃত্বে উঠেপড়ে লেগেছিলেন, তাঁদের আশু লক্ষ্য ছিল তিনটি (ক) হিন্দু জোতদারদের বিতাড়িত করে সেখানে ধর্মের জিগীরে নিজেদের সামন্ততান্ত্রিক শােষণকে কায়েম করা, (খ) সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নতুন তৈরি হওয়া মুসলিম মধ্যবিত্তদের স্থাপিত করা, (গ) পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়াবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক শােষণে অংশীদার হওয়া। সুরাবর্দী (সােহরাওয়ার্দি) ও মুজিবর সাহেবের পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এই।
কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় লক্ষ্যেই বিবাদ বেঁধে গেল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের সঙ্গে উঠতি বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। চাকরি-বাকরি, অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা অর্থাৎ বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থায় গরিব মুসলিম কৃষক ও শ্রমিককে শােষণ করার অধিকার বাঙালি মধ্যবিত্ত কতটা পাবে আর অবাঙালি মধ্যবিত্ত কতটা পাবে- এই নিয়েই লেগে গেল ঝগড়া। এ ঝগড়ার প্রথম বিস্ফোরণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে-ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান ছয় বছরের মধ্যেই ভাষার ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। মনে রাখা দরকার ভাষা আন্দোলন মূলত পেটিবুর্জোয়া আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষকের শ্রেণী সংগ্রামের আন্দোলন নয়। ভাষা আন্দোলনের পর পরই ধর্মের জিগীর ভােলা পার্টি মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গ থেকে মুছে গেল।
বিক্ষুব্ধ বাঙালি মধ্যবিত্ত পেটিবুর্জোয়া তখন থেকেই পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক স্বাধীকারের দাবিতে সােচ্চার হতে আরম্ভ করলাে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার স্থান নিল নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বাঙালি প্রাদেশিকতাকে কেন্দ্র করে। সুরাবাদী (সােহরাওয়ার্দি) সাহেবের সঙ্গে লেগে গেল পশ্চিম পাকিস্তানি ধনকুবেরদের। পশ্চিম পাকিস্তানি ধনকুবেরা তখন মিলিটারি শক্তি প্রয়ােগ করে আয়ুব খাঁকে দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তদের শায়েস্তা করতে চাইলেন।
এই পটভূমিকায় বিক্ষুব্ধ বাঙালি মধ্যবিত্তদের নেতা মুজিবর ও সুরাবর্দী (সােহরাওয়ার্দি) সৃষ্ট আওয়ামী লীগ জন্ম নিল। পরবর্তী ইতিহাস আমাদের জানা আয়ুবের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের কৃষকগণ হিংসাত্মক আন্দোলনে নামলেন ভাসানীর নেতৃত্বে। মুজিবর তখন উচ্চকণ্ঠে ভাসানীকে ‘দেশদ্রোহী’ ‘পাকিস্তানের শত্রু বলে আখ্যা দিয়ে হিংসাত্মক আন্দোলনকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করতে আরম্ভ করলেন, অপরদিকে প্রেসিডেন্ট আয়ুবের নিকট ‘গণতান্ত্রিক অধিকার পাবার জন্য কাকুতি মিনতি চিৎকার চেঁচামেচি আরম্ভ করলেন। নাটকীয়ভাবে আয়ুবের পদচ্যুতি ঘটিয়ে ইয়াহিয়া খাঁ গণতান্ত্রিকতার অবাধ নির্বাচনের লম্বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে কৃষক বিদ্রোহ দমনার্থে পাক ফৌজ পাঠালেন। ইয়াহিয়া খাঁকে তখন পূর্ববঙ্গ থেকে প্রথম অভিনন্দন জানালেন বঙ্গবন্ধু মুজিবর’। ভাসানীও ভয় পেয়ে আন্দোলন থামিয়ে দিলেন। তার পার্টির সম্পাদক তােহার সঙ্গে ভাসানীর রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটল।

তিন
এর পরের দৃশ্য খুবই সাম্প্রতিক। মুজিবরের আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গের উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুখপাত্র হিসেবে শ্রমিক কৃষক শশাষণ ব্যবস্থায় অবাঙালির সঙ্গে বাঙালিকে এক পংক্তিতে বসাতে চাইল। ছয় দফা দাবি তার সাক্ষ্য। প্রাদেশিক স্বাতন্ত্রের দাবি তােলা হলাে ঐ যুক্তিতে, যে যুক্তিতে এককালে মুসলিম একচেটিয়াবাদ হিন্দু একচেটিয়াবাদের প্রতিযােগিতা থেকে রক্ষা করার জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি করতে চাইল ধর্মের ভিত্তিতে। মুসলিম একচেটিয়াবাদের তখনকার লক্ষ্য ছিল নিজের জন্য একটা সংরক্ষিত বাজার’ (প্রােটেকটেড মার্কেট) সৃষ্টি করা, ধর্মভেদকে তখন ব্যবহার করতে হয়েছিল ইংরেজি সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছানুযায়ী। তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল টাটা-বিড়লা প্রমুখ একচেটিয়াবাদ, কারণ তাদের শােষণের ক্ষেত্র ভাগ হয়ে কমে গেল। আজ সেই হিন্দু একচেটিয়াবাদ মুজিবরের বন্ধু জেগছে, কারণ এখানে তাদের স্বার্থ অভিন্ন। মুজিবর এখন ভাষার দোহাই দিয়ে, বাঙালিয়ানার দোহাই দিয়ে সােনার বাংলা ভালােবাসি’ গেয়ে যা আসলে চাইছেন সেটা হলাে, পূর্ববঙ্গের শ্রমিক কৃষক শশাষণ ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বি পশ্চিম পাকিস্তানি শােষকদের অবলুপ্তি এবং নিজের শ্রেণীস্বার্থকে কায়েম করে উক্ত শােষণ ব্যবস্থার মােলআনা ফল ভােগ। যে মুসলিম একচেটিয়াবাদ (যা আসলে পশ্চিম পাকিস্তানেরই জিনিস) এককালে টাটা-বিড়লাকে টেক্কা মেরে পাকিস্তান সৃষ্টি করিয়ে প্রতিযােগীহীন শােষণের ব্যবস্থা করেছিল, আজ সেটা বুমেরাং হয়ে ভাষাভিত্তিক প্রাদেশিকতাবাদের মধ্য দিয়ে মুজিবর বা বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী কর্তৃক তার ওপর আঘাত হয়ে ফিরে এসেছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি মুসলিম মারা যাবার ঘটনা যতই বিষাদপূর্ণ হােক, আজ মনে মনে হাসছে ভারতীয় হিন্দু একচেটিয়াবাদ, ভাবখানা এই কেমন পাকিস্তান করেছিলি?’ মুজিবরও ভেবেছিলেন বিনা রক্তপাতেই পশ্চিম পাকিস্তান শশাষকরা শশাষকের আসন বাঙালি শােষকদের ছেড়ে দেবে, তাই শেষ মুহূর্ত অবধি অহিংসার বাণী ছেড়েছিলেন, কিন্তু যে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছেন, সেখান থেকে ফিরে গেলে তাকে নেতৃত্ব হারাতে হয়। শুধু তাই নয়, তিরিশে মার্চ স্টেটম্যানে প্রকাশিত ব্রিয়ান মে নামে ইংরেজ সাংবাদিকের কাছে মুজিবর মন খুলেছিলেন ঠিকই- “আমি পূর্ববঙ্গকে কমিউনিজমের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এঁরা (ইয়াহিয়া খা ও পাক সামরিক চক্র) তা বুঝতে পারছে না।’
মুজিবর চেয়েছিলেন বাংলা বাংলা’, করে যদি বাংলাদেশেরই অভ্যন্তরীণ শ্রেণী সংগ্রামকে চাপা দেয়া যায়, যেমন জিন্না ইসলাম ইসলাম করে পাক শাসকগােষ্ঠীর শ্ৰেণী মতলবকে মুসলিম চাষি মজুরের দৃষ্টি থেকে সরিয়ে রেখে শ্রেণী শােষণের ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু মুজিবরকে ইন্দিরা বা ভারতীয় শশাষকগােষ্ঠী আখেরে লাভের কথা বিচেনা করে যতই মদদ দিক না কেন, পূর্ববঙ্গের বর্তমান রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রেণী সংগ্রামের দামামা বাজবে, মুজিবর-ইন্দিরা এবং বিচিত্র বাঙালি প্রেমের নির্লজ্জ ভণ্ডামির উপরে ঐটাই আশার কথা- পূর্ববঙ্গের পথ ভিয়েতনামের পথে যাবেই, কারণ এই সেদিন অবধি পাক-সরকারের ভাড়া করা গুণ্ডা আনসার, ইস্ট পাক রাইফেলস আর বাঙালি রেজিমেন্ট দিয়ে আর যাই হােক, মুক্তিযুদ্ধ হতে পারে না, নতুন মুক্তিফৌজ লাল পতাকা নিয়ে আসছে।

সূত্র: দর্পণ
৩০.০৫.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!