You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয়
শফিকুল হাসান

পূর্ববাংলা ও পাকিস্তানের ধনিক শ্রেণীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব আজ সমগ্র আপােসের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে পূর্ববাংলার বুকে এক সশস্ত্র সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছে। আর এই স্বার্থের দ্বন্দ্বে প্রাণবলি দিতে হচ্ছে পূর্ববাংলার লক্ষ লক্ষ নিরীহ মেহনতি জনগণকে। সৃষ্টির পর থেকেই আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক পাকিস্তানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় যে সকল দ্বন্দ্ব প্রাধান্য লাভ করে তাদের মধ্যে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব অন্যতম। এই দ্বন্দ্ব বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক চরিত্রের শােষণ এবং স্থানীয় সামন্তবাদী শােষণেরই ফলমাত্র।
উনিশশ সাতচল্লিশ সালে সাম্রাজ্যবাদী শােষকদের চক্রান্তে স্বাধীনতার নামে আপােসে পাক-ভারতের ধনিক ও সামন্ত শ্রেণীর নিকট পাক ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে সাম্রাজ্যবাদীদের শােষণ বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং তাদের এ নয়া ঔপনিবেশিক শােষণে উভয় দেশই অদ্যাবধি জর্জরিত। সাম্রাজ্যবাদীদের কবলে পড়ে পাকিস্তান উনিশশ সত্তর সালের জুলাই মাস পর্যন্ত মােট পঁয়তিরিশ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে প্রতিবছর এই পর্বত প্রমাণ ঋণ ও তার সুদ হিসাবে নয়া ঔপনিবেশিক কায়দায় মােট জাতীয় আয়ের শতকরা ২২.৫ ভাগ সাম্রাজ্যবাদীদের কুক্ষিগত হচ্ছে। উনিশশ সত্তর সালের জুলাই মাসে দেউলিয়া পাকিস্তান সরকার বিশ্ব ব্যাঙ্কের নিকট ঋণ দাবি করলে পাকিস্তানে ঘনীভূত আর্থিক সঙ্কট (saturated point of Economic debt servicing charge) অর্থাৎ যখন কোনাে দেশের জাতীয় আয়ের শতকরা পঁচিশ ভাগ ঋণ ও সুদ হিসাবে দেয়া হয় সৃষ্টির আশঙ্কায় বিশ্বব্যাঙ্ক তা প্রত্যাখ্যান করে। বাস্তবপক্ষে সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া ঔপনিবেশিক শশাষণে বহুপূর্ব থেকেই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্রভাবে দেখা দিয়েছিল এবং ক্রমশই তা তীব্রতর হচ্ছিল, উনিশশ সত্তর সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানকে ঋণদানে বিশ্বব্যাঙ্কের অসম্মতিই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ফলে পাকিস্তানি ধনিক শাসকগােষ্ঠী পূর্ববাংলার ধনিকশ্রেণীসহ সমগ্র পাকিস্তানের জনগণকে অস্বাভাবিক হারে শােষণ করতে থাকে। যার পরিণতি পাকিস্তানি শাসক ধনিক ও পূর্ববাংলার ধনিক শ্রেণীর দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তুলেছে এবং বর্তমানে তা সশস্ত্র রূপ লাভ করেছে পূর্ববাংলার ধনিকশ্রেণীর যা কখনােই কাম্য ছিল না।
পাকিস্তানের বৃহৎ ধনিক শ্রেণীর তেইশ পরিবার (যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি) পূর্ববাংলার উঠতি ধনিক শ্রেণীকে শােষণের ক্ষেত্রে অধিকার অর্থাৎ বাণিজ্যিক সুবিধাদি থেকেও বঞ্চিত করে পূর্ববাংলার কাঁচামাল ও বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পের বিকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। তারা। পূর্ববাংলার প্রায় সমগ্র শিল্পকে হয় নিজেরা একচেটিয়াভাবে দখল করেছে যেমন পাট, তুলা, চা ইত্যাদি শিল্পের সমগ্র কলকারখানা ও বাগানের মালিক হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজিপতিরা), নতুবা সঙ্কোচন নীতির মাধ্যমে তাদেরকে উচ্ছেদ করেছে (যেমন পূর্ববাংলার লুপ্তপ্রায় বিভিন্ন কুটিরশিল্প)। এমনকি পাকিস্তানের সমগ্র ব্যাঙ্ক ও বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকরাও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। বাস্তবপক্ষে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানি শােষক ও শাসকেরা একটি কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্র এবং নিজেদের উৎপন্ন শিল্পজাত দ্রবাদি বিক্রয়ের বাজার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী পাকিস্তানের শােষক ও শাসক গােষ্ঠীর পূর্ববাংলার জনগণের উপর এই ঔপনিবেশিক চরিত্রের শােষণ (অসামঞ্জস্যপর্ণ একচেটিয়া পুঁজির শােষণ, কুক্ষিগত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শােষণ, সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থার শােষণ অগণতান্ত্রিক দমনমূলক রাজনৈতিক শােষণ) পাকিস্তানের শাসক ধনিক শ্রেণী ও পূর্ববাংলার ধনিক শ্রেণীর মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। উনিশশ পঁয়ষট্টি সালে পূর্ববাংলার সামন্ত ও ধনিক শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ছয় দফার মাধ্যমে পূর্ববাংলার খানিকটা শশাষণের অধিকার লাভের উদ্দেশে পাকিস্তানের একচেটিয়া শাসক ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে ওঠে। উগ্রজাতীয়তাবাদের আড়ালে ছয় দফার ও আপােসের রাজনীতি পূর্ববাংলার শােষিত জনগণকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু উনিশশ একাত্তর সালে পূর্ববাংলার রাজনীতি সচেতন এই সংগ্রামী জনগণের চাপে পড়েই পূর্ববাংলার ধনিক শ্রেণীর নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেষ মুজিব সরাসরি আপােষের পথে অগ্রসর হতে গিয়ে ব্যর্থ হন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী তাদের শাসন ও শােষণ বজায় রাখার স্বার্থে উলঙ্গভাবে ধনিক শ্রেণীসহ পূর্ববাংলার জনগণের উপর চালিয়েছে পৈশাচিক আক্রমণ।
বর্তমান যুদ্ধ ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয় পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধ চলছে এবং চলবে। পূর্ববাংলার শােষিত নিপীড়িত জনগণের এই বিপ্লবী যুদ্ধের আঘাতে ভেঙে পড়ছে শােষক ও শাসক শ্রেণীর প্রতিটি শােষণের দেয়াল। শােষণ ও শাসন রক্ষাকল্পে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্টরা পূর্ববাংলার বুকে আজ যে সঙ্কট সৃষ্টি করেছে সে সঙ্কটের বেড়াজালে তারাও আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পূর্ববাংলায় ব্যাপক কৃষক ও শ্রমিক হত্যার ফলে পূর্ববাংলার কৃষিকর্ম হয়েছে ব্যাহত, কলকারখানা হয়েছে বন্ধ। রপ্তানিযােগ্য পণ্য পাট, তুলা, চা, চিনি, চামড়া, কাগজ, নিউজপ্রিন্ট, সার ও সিমেন্টের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবার ফলে শতকরা তিয়াত্তর ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারছে না। শুধু তাই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও শিল্পের সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে, কারণ সেখানকার কলকারখানার অধিকাংশ খুচরা অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, রপ্তানি বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি বন্ধ হওয়ার খুচরা অংশের অভাবে বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রির বিক্রয় কেন্দ্র ছিল পূর্ববাংলার বাজারসমূহ; বর্তমানে উক্ত বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত সামগ্রী অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। উৎপাদিত পণ্যের কাটতি না হওয়ায় ঐ স্থানের বস্ত্র শিল্প, রেয়ন শিল্প বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, মেশিন, টুলস, চীনামাটির তৈজসপত্র, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম ও খেলাধুলার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কলকারখানাগুলাে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হচ্ছে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই যা পশ্চিম পাকিস্তানের মেহনতি মানুষকে সংগ্রামী ও বিপ্লবমুখী করে তুলছে। বর্তমানে পূর্ববাংলা ও একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের এই তীব্র শিল্পসঙ্কট পাকিস্তানি শাসক ধনিক গােষ্ঠীকে ব্ৰিত ও দিশেহারা করে তুলছে।
এছাড়া পূর্ববাংলা থেকে রাজস্ব খাতে বছরে আদায়ীকৃত ষােল কোটি টাকা, সড়ক পরিবহন, রেল, নৌপরিবহন, ডাক ও তার, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সরকারি সংস্থাগুলাে থেকে আদায়ীকৃত বছরে প্রায় তিরিশ কোটি টাকা থেকে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী হচ্ছে বঞ্চিত। ইতিমধ্যেই পূর্ববাংলার বিভিন্ন ব্যক্তিসমূহ থেকে প্রায় ষাট কোটি টাকা হয়েছে অপহৃত। পূর্ববাংলার যুদ্ধ পরিচালনা করতে শাসকগােষ্ঠীর দৈনিক খরচ করতে হচ্ছে প্রায় এক কোটি টাকা। নরপিশাচ ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচার, নির্মম গণ অগ্নিসংযােগ, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের সংবাদ আজ বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জনগণের তীব্র ঘৃণা কুড়ােচ্ছে, তাই পাকিস্তানের শাসক ও শােষক ক্ষমতাসীনদের শত আবেদন সত্ত্বেও বৈদেশিক সাহায্য লাভে পাকিস্তান হয়েছে ব্যর্থ। মােটকথা উপরােক্ত কারণে পাকিস্তান আজ একটি সম্পূর্ণ দেউলিয়া স্থিতিহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমান আর্থিক সঙ্কট আজ পাকিস্তানের শাসক ও শােষক ধনিক শ্রেণীকেও গ্রাস করতে উদ্যত। এমনি দিশেহারা অবস্থায় তারা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিকট আর্থিক সাহায্যের জন্য ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছে। বৈদেশিক ঋণের দেয় সুদ পরিশােধে অক্ষমতা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের নিকট সময় চেয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, এমনকি সেনাবাহিনী ও সরকারি কর্মচারীদের নির্ধারিত পারিশ্রমিক প্রদান করতেও পাকিস্তান সরকার অক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। অবশেষে একশ টাকা ও পাঁচশ টাকার নােট বাতিল করে দিয়ে আর্থিক সঙ্কটে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাকিস্তানের শােষক শ্রেণী এটাই প্রমাণ করে চলেছে যে, বিশ্ব ইতিহাসের পরিচালক শক্তি জনগণের সামনে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলদের মতাে তারাও আজ এক কাগুজে বাঘ ছাড়া কিছুই নয়।

সূত্র: দর্পণ
১৩.০৮.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!