You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ ও সােভিয়েত ইউনিয়ন

দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্টদের প্রচার সত্ত্বেও ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছে যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানি সমরতান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলতে রাজি নয়।
সম্প্রতি ইন্দিরাজীর বহু বিঘােষিত সােভিয়েত সফরের প্রারম্ভে যে উত্তেজনা এবং আশা দেখা দিয়েছিল, ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতির ফলে তা এখন অনেকটা অবদমিত। নেপথ্যের সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে যে, ইন্দিরাজীকে এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের অনেক বেগ পেতে হয়েছিল সােভিয়েত কর্তৃপক্ষকে কিছুটা নরম করাতে।
প্রথমত, আমাদের ভারতীয় বৈদেশিক দপ্তরের ওয়াকিবহালতা এমনি সীমাবদ্ধ যে অনেকদিন লেগে গেছল বুঝতে যে, সােভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রে কোসিজিন বা পদগাের্নি থেকেও আসল শক্তিশালী নেতা সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বাধিনায়ক ব্রেজনেভ। ব্রেজনেভ মস্কোতে না এসে পৌছানাে পর্যন্ত কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়া তাে দূরের কথা, কোনাে আলােচনাই চলতে পারে না। মস্কোর রাষ্ট্রযন্ত্রের এসব নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে আমাদের বৈদেশিক দপ্তরের অজ্ঞতা হেতু, প্রথম দিন ইন্দিরাজীকে মস্কোতে প্রায় আলস্যেই সন্ধে কাটাতে হলাে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মচারীদের স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে।
তারপরের ঘটনাও প্রায় সমানই হতাশাব্যঞ্জক। সাংবাদিকরা যুক্ত বিবৃতির কথাগুলাে খুঁটিনাটি বিচার করে আশান্বিত হয়েছেন যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ববাংলার সমস্যার বিচারের ব্যাপারে ভারতবর্ষের অনেক কাছা কাছি সরে এসেছে (তার প্রমাণ দিতে গিয়ে তাঁরা বলেছেন- আবার আমাদের বৈদেশিক দপ্তরের কূটনীতিজ্ঞদের উপদেশানুসারে যে সােভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে পূর্ববাংলা’ বলতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তারা যখন কোসিজিনকে সরাসরি প্রশ্ন করেন সমস্যা সমাধানের উপায় কী হতে পারে, সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে তাঁদের ধমকে বলেন, এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাদেরও কিছু বলার নেই, ভারতবর্ষেরও কিছু করার নেই। ভারতীয় সাংবাদিকরা যখন পাকিস্তানের ভারত-বিরােধী যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলেন, তখন কোসিজিন তাদের এসব সন্দেহকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভারতবর্ষই শুধু বলছে পাকিস্তান যুদ্ধ চায়। কৈ? আমরা তাে তার কিছুমাত্র আভাস দেখতে পাচ্ছি না। কেন মিছেমিছি পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করবে?’
অবশেষে পর্বতের মুষিক প্রসবের মতাে এতাে উত্তেজনা ও আশা-ভরসার পর যা বের হলাে তা সেই পুরনাে রাজনৈতিক সমাধানের কথা এবং বাস্তুহারাদের আবার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত অবস্থা সৃষ্টির প্রয়ােজনীয়তার কথার পুনরাবৃত্তি।
সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং সােভিয়েত শিবিরান্তর্গত দেশগুলাের নেতাদের বক্তব্য অনুধাবন করলে, মস্কোয় ইন্দিরাজীর সফরের যে এই ফল হবে, তা আগে থেকেই বােঝা উচিত ছিল। বস্তুতপক্ষে সােভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ সংক্রান্ত মনােভাবের পরিচয় কিছুকাল পূর্বেই পাওয়া গিয়েছিল প্যারিসে আন্তপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে। | লােকসভার স্পিকার শ্রীধিলনের নেতৃত্বে উক্ত সম্মেলনে যে ভারতীয় প্রতিনিধ দল যায়, তারা যাবার পূর্বে এখানে বসে প্রথমে একটি প্রস্তাবের খসড়া করে, বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে। ঐ খসড়াটির ভাষা নাকি অত্যন্ত তীব্র ছিল; তাই প্রস্তাবটি পুনঃলিখিত হয়। অতঃপর একত্রিশে আগস্ট প্রতিনিধিদল প্যারিস রওনা হয়। | প্যারিসে গিয়ে প্রথমেই ভারতীয় প্রতিনিধিদল সােভিয়েত প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রস্তাবটি নিয়ে আলােচনা করেন। সােভিয়েত প্রতিনিধি বলেন যে, প্রস্তাবটি না উপস্থাপিত করাই ভালাে। ফলে ভারতীয়রা আবার বসে প্রস্তাবটিকে আরও নরম করেন।
সম্মেলনের অধিবেশন শুরু হলে ভারতীয় দলের বাংলাদেশের উপর এই প্রস্তাবটি সােশ্যাল ও ইকনমিক কমিটি নামে একটি কমিটিতে প্রেরিত হয় আলােচনার জন্য। এখানে উপস্থিত অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা মূল প্রস্তাবটিতে একটি সংশােধনী বাক্য জুড়ে দেন। তাতে বলা হয় যে, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানের জন্য চেষ্টা করছে। ভারতীয় প্রতিনিধিরা এর বিরুদ্ধে ভােট দেন।
সােভিয়েত ইউনিয়ন ও সােভিয়েত শিবির ভােটদানে বিরত থাকে। ফলে ভারতীয়রা পরাজিত এবং ঐ সংশােধিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
অতঃপর প্রস্তাবটি যায় সম্মেলনের মূল অধিবেশনে। সেখানে ফরাসি দেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিভুক্ত এক প্রতিনিধি লুই ওদ্যো— বার আর একটি সংশােধনী আনেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, উক্ত প্রস্তাবের শুরুতে নরম করতে করতেও যেটুকু পাকিস্তানের সমালােচনাব্যঞ্জক বাক্য আছে, সেটুকুও মুছে ফেলতে হবে। ভারতীয় প্রতিনিধিদের বিরােধিতা সত্ত্বেও, এই সংশােধনীটি গৃহীত হলাে। ফলে বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারিত হলাে না এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে।
লক্ষ করার বিষয় যে, এই সম্মেলনে প্রেরিত ভারতীয় প্রতিনিধিদলের মধ্যে দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট এমপি শ্রীইন্দ্রজিত গুপ্তেরও থাকার কথা ছিল। হয়তাে পার্টির সূত্রে তিনি জানতে পেরেছিলেন সােভিয়েত প্রতিনিধিদের কী ভূমিকা হবে। তাই বােধহয় শেষ মুহূর্তে শ্রীগুপ্ত তার যাত্রা বাতিল করেছিলেন, যাতে উক্ত সম্মেলনে সােভিয়েত নেতাদের বিরুদ্ধাচরণ তাকে না করতে হয়।
এ ছাড়াও রাজধানীতে বেশ কিছুদিন ধরেই সােভিয়েত বা অন্যান্য সােভিয়েত শিবিরান্তর্গত দেশগুলাের এমব্যাসির পার্টিতে প্রায়ই শােনা যাচ্ছিল এমন সব কথাবার্তা, যেমন, একটা রাজনৈতিক সেটেলমেন্ট হলেই সবদিক থেকে ভালাে হয়, বাঙালিরা আর কত কাল লড়াই করবে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাক সৈন্যদের সঙ্গে বা ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান দুই গরিব দেশ এভাবে কি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া উচিত?’ ইত্যাদি।
মােট কথা, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি এখনও পুরােপুরি সমর্থন করতে রাজি নয়। মস্কোর রাজনৈতিক তাত্ত্বিকেরা নাকি মনে করেন যে, বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তা আধা গৃহযুদ্ধ আধা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম। যতটা গৃহযুদ্ধ সেই অনুপাতে তারা পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি বজায় রাখার স্বপক্ষে আবার যতটা মুক্তি সংগ্রাম, সেই অনুপাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সীমাবদ্ধভাবে নৈতিক সমর্থন দিতে তারা রাজি।
এই জাতীয় গোঁজামিল তত্ত্ব কার্যত একেবারেই কোনাে ফল দেয় না।
আসলে সােভিয়েত ইউনিয়ন তার চিরাচরিত সুবিধাবাদী রাজনীতির ঐতিহ্য অনুসরণ করছে এবং যখন বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা তাদের নিজেদের শক্তি বলে দেশের কিছু অংশ মুক্ত করতে পারবে, তখনই সােভিয়েত ইউনিয়ন তাদের স্বীকৃতি দেবে প্রকাশ্যে। ঠিক এমনই ঘটেছিল চীনের ক্ষেত্রে। উনিশশ উনপঞ্চাশ সালের গােড়ায় চীনা কমিউনিস্ট বাহিনী যখন চীনের ব্যাপক অঞ্চলের অধিকর্তা, তখনও নানকিংএ সােভিয়েত কনসাল চিয়াং কাইশেকের প্রায় বিলীয়মান শাসনকেই চীনের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা বলে স্বীকার করেছিল। রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিচারের পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থে আঁতাত করার ও বন্ধু নির্বাচনের যে প্রবণতা সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংশােধনবাদের অতলে নিয়ে গেছে, সেই প্রবণতাই আজ তার বাংলাদেশ বিষয়ক কূটনীতিতে প্রতিফলিত। পশ্চিম পাকিস্তানকেও হাতে রাখা এবং ভারতবর্ষকেও খুশি রাখা- এই দ্বৈতনীতি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদও অনুসরণ করছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে এই উভয় মহাশক্তি কি ক্রমশই কাছাকাছি সরে আসছে?

সূত্র: দর্পণ
১৫.১০.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!