পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা
শফিকুল হাসান
দেশের জনগণ যখন স্বদেশকে রাহুমুক্ত করার জন্য মরণপণ সংগ্রাম করে চলছেন ঠিক তেমনি সময় পাক সেনারা রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনের অস্ত্রাগার, ই পি আর সদর দপ্তর ও তার অস্ত্রাগার দখল করার এবং পুলিশ ও ই পি আরকে নিরস্ত্র করার এক প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। জয়দেবপুরে অবস্থিত পূর্ব বাংলার একমাত্র অস্ত্র কারখানাটি পাঞ্জাবি সেনারা দখল করতে গেলে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ ঘােষণা করে এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে সশস্ত্রভাবে বেরিয়ে এসে পাঞ্জাবি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং প্রচণ্ড গােলাগুলির পর পাঞ্জাবি সেনাদের হটিয়ে দিয়ে অস্ত্র কারখানাটি নিজেরা দখল করে নেয়।
এদিকে শেখ মুজিবের উল্লেখিত চার দফা দাবি নিয়ে আলাপ-আলােচনার জন্য দুরাত্মা জল্লাদ ইয়াহিয়া ভালাে মানুষের ছদ্মবেশে ঢাকা আগমন করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আপােসকামী ক্ষমতালিন্দু নেতারা এই নরপিশাচের সঙ্গে সাক্ষাত করে আপােস আলােচনায় লিপ্ত হন। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে জনগণ ও পূর্ব বাংলার ছাত্র সম্প্রদায় (এমনকি ছাত্রলীগের রব এপ যা ছাত্রদের মাঝে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল) এই আপােস আলােচনার তীব্র বিরােধিতা করেন এবং প্রতিবাদ সভা ও শােভাযাত্রায় এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের রক্ত স্বাধীনতার রক্ত’; রক্ত দিয়েছি আরাে দেবাে বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’, ‘খুনির সাথে আপােস আলােচনা চলবে না চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে এবং শেখ মুজিবের বাড়িতে নিজেদের আপােসহীন সংগ্রামী ভূমিকা নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। দুরাত্মা ইয়াহিয়া আলােচনার নামে সময় নিয়ে নরখাদক রক্তপিপাসু টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসক হিসেবে ও পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ষাট হাজার সেনাকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার উদ্দেশে ডেকে পাঠায়। এই সেনাবাহিনীর পূর্ব বাংলা অভিমুখে অগ্রসরের সংবাদ বিবিসি থেকে প্রচার করা হয়। নরপিশাচ ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীকে অবতরণের সময় ও সুযােগ দেবার উদ্দেশে আলােচনা দীর্ঘায়িত করতে থাকে এবং অবশেষে পশ্চিমা জল্লাদ ভুট্টোকে ডেকে পাঠায়। ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য গােলটেবিল বৈঠকে অবশেষে অঘােষিতভাবে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত জনগণ ইয়াহিয়া হুঁশিয়ার’ ভুট্টোর মুখে জুতা মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি স্লোগান সহকারে বিক্ষোভ শােভাযাত্রা চালাতে থাকেন। ইয়াহিয়া ও ভুট্টো আলােচনার নাম করে সময় নিতে থাকে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তাদের ধ্বংসলীলার পরিকল্পনার কথা জানতে দেয়নি। সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছলে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিকরা সেনাবাহিনীর অস্ত্ৰসমূহ জাহাজ থেকে নামাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। পশ্চিমা সেনারা শ্রমিকদের উপর গুলি চালিয়ে তাদের কাজে যােগ দেবার নির্দেশ দেয়, কিন্তু শ্রমিকরা সে নির্দেশ উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। | তেইশে মার্চ ঢাকায় সগ্রামী ছাত্ররা আওয়ামী লীগের অনুমােদন ছাড়াই পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ভস্মীভূত করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং জনগণকেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার আহ্বান জানান। সারা পূর্ব বাংলার জনগণ ঐদিন পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উড়িয়ে তাদের স্বাধীনতার আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় পঁচিশে মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্র পূর্ব বাংলার প্রতিটি জনপদকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা ও মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালিকে হত্যা করার এক নৃশংস ও পৈশাচিক নির্দেশ দিয়ে রাতের আঁধারে পূর্ববাংলা থেকে পালিয়ে যায়। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে দুঃস্বপ্নের মতাে নেমে আসে দুঃখময় রাত পঁচিশে মার্চ। পৃথিবীর ইতিহাসে হিটলার, মুসলিনীর ও ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতাকে স্নান করে দিয়ে টিক্কা খার সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলার শহর থেকে গ্রামগুলাে পর্যন্ত ধুলিস্যাৎ করে দিতে থাকে। পূর্ব বাংলার বুকে অনুপ্রবেশকারী পাঞ্জাবি সেনারা নিরস্ত্র জনগণের উপর অমানুষিক বর্বরতার সঙ্গে চালিয়ে যায় ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান, ব্রেনগান ও বােমা। এক অঘােষিত যুদ্ধের মাধ্যমে তারা নির্বিচারে গণহত্যা চালাতে থাকে এবং দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়ে তারা একটানা চল্লিশ ঘণ্টা সান্ধ্য আইন জারি করে এবং এ সময় শুধু ঢাকাতেই তারা কমপক্ষে চব্বিশ হাজার নিরস্ত্র নাগরিককে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। সঙ্গে সঙ্গে তারা চালায় লুটতরাজ, অগ্নিসংযোেগ এবং ধ্বংসলীলা ও নারী ধর্ষণের মতাে ঘৃণ্য পাশবিক কার্যসমূহ।
পূর্ব বাংলার এই নির্যাতিত মার খাওয়া জনগণ বিনা প্রতিবাদে এ মার খেতে রাজি হলাে না। গুলি খাওয়া বাঘের ন্যায় পূর্ব বাংলার বীর জনতা বিপ্লবী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে শশাষণ ও নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করে জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পূর্ব বাংলার প্রতিটি গ্রামে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা সশস্ত্র শত্রুকে সশস্ত্রভাবেই মােকাবেলা করার উদ্দেশে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমবেত হতে থাকেন। তারা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা পদ্ধতিতে সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে সশস্ত্রভাবেই আক্রমণ করেন এবং প্রতিক্রিয়াশীল পাক সেনাবাহিনীকে খতম করতে থাকেন। তারা বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে সক্ষম হন। চট্টগ্রামে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক ফ্রন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আবুল বাসারের নেতৃত্বে বর্তমানে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। পাবনাতে টিপু বিশ্বাসের পরিচালনায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড আবদুল মতিন ও কমরেড আলাউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গেরিলারা সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। টাঙ্গাইল, টঙ্গি ও ময়মনসিংহে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটি, ভাসানী ন্যাপ ও কৃষক সমিতি ঐক্যবদ্ধভাবে মােহনের গেরিলা নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বগুড়াতে তপনের নেতৃত্বে ও রংপুরে ছমির মণ্ডলের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধ করছেন। এই পার্টি সিলেট ও কুমিল্লায় সমন্বয় কমিটির সঙ্গে এবং বরিশাল ফরিদপুরে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে চলেছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন যথাক্রমে কাজী জাফর, মতিউর রহমান ও বাদশা। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে শ্রদ্ধেয় কমরেড দেবেন শিকদার (পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান) সম্প্রতি বেরিয়ে আসেন এবং আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আগরতলার যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এই বামপন্থী দলগুলাে ঐক্যবদ্ধভাবে এই যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধে পরিণত করার উদ্দেশে অন্যান্য স্থানেও ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন ও সংগঠিত হচ্ছেন। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, এই যুদ্ধরত বীর যােদ্ধাদের নাম ও কার্যাবলী কোনাে সংবাদপত্র বা সংবাদ প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করছেন না এবং এর পিছনে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকাই দায়ী।
আওয়ামী লীগ, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত মস্কোপন্থী ন্যাপ (সংশােধনবাদের জন্য যারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে) কোনাে দিনই পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতার প্রচেষ্টা চালায়নি এবং সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি সঠিক বলে স্বীকার করে নি। বন্দুকের নল থেকেই সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে’–এই মহান তত্ত্বকে তারা তাদের শ্রেণীগত চরিত্রের জন্যই গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে ওঠা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতারা নিজ দেশের রণক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধাদের অসংগঠিত অবস্থায় রেখেই প্রাণভয়ে ইন্দিরা সরকারের আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে স্বভাবতই মুক্তিযােদ্ধারা যােগাযােগ, খাদ্য সরবরাহ, সুসংগঠন, প্রয়ােজনীয় রসদ সরবরাহ ও সর্বোপরি নেতৃত্বের অভাব উপলব্ধি করেন ও তাদের মনােবল হারাতে থাকেন।
সূত্র: দর্পণ
২৮.০৫.১৯৭১