পূর্ব বাংলার সংগ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের ভূমিকা
শফিকুল হাসান
পাকিস্তানি শােষণ, শাসন, অত্যাচার ও উৎপীড়ন থেকে জাতীয় স্বাধীনতা ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার সংগ্রামী বীর জনতা বর্তমানে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত। অত্যাচারী অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার শােষিত লাঞ্ছিত জনগণ আজ হাতে তুলে নিয়েছে রাইফেল, চালিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পিতৃভূমিকে শশাষণ ও শাসন থেকে মুক্তির দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় ঐক্যবদ্ধ, অদম্য মনােবলে বলীয়ান। এতদসত্ত্বেও প্রাথমিক পর্যায়ের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের অসাফল্য ও বিপর্যয়ের মূলে সুনির্দিষ্ট কতগুলাে কারণ সম্পর্কে আলােচনা অবশ্যই প্রয়ােজন।
মুক্তিযােদ্ধাদের অধিকাংশই হলাে পূর্ব বাংলার যুব ছাত্র সম্প্রদায়। তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিদ্রোহী বাঙালি পুলিশ, মিলিটারি, ই পি আর এবং আনসার বাহিনী। রাজনৈতিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধারা প্রধানত দুটি শিবিরে বিভক্ত। রণনীতি ও রণকৌশলগতভাবেও এরা সম্পূর্ণ পৃথক ও পরস্পরবিরােধী মত পােষণ করে থাকে। এদের প্রথমটি হচ্ছে শেখ মুজিবের অনুগামী আওয়ামী লীগের সমর্থক- যারা নীতিগতভাবে শুধুমাত্র পাকিস্তানি শাসন থেকে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম করছে। এঁরা মুক্তি ফৌজ’ নামে প্রকাশ্য সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে এবং প্রকাশ্য সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এদের পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, যারা ইতিমধ্যেই স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা শ্রেণীগত চরিত্রের কারণেই অতি সতর্কতার সঙ্গে জনগণকে সশস্ত্র হতে না দিয়ে সর্বদা অহিংস ও অসহযােগের মাধ্যমে দাবি আদায়ের আপােসের রাজনীতি করে আসছে। সস্তা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে জনগণ থেকে তারা ভােট আদায় করেছে, কিন্তু জনগণকে রাজনীতিগতভাবে সচেতন বা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ ও সশস্ত্র করে তােলার কোনাে প্রচেষ্টা করেনি, বরং অহিংস নীতিতে সর্বদাই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরােধিতা করেছে। কারণ শ্রেণীগতভাবে আওয়ামী লীগ হচ্ছে পূর্ব বাংলার ধনিক ও সামন্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। শ্রেণীগত চরিত্রের জন্যই জনগণকে সশস্ত্র করতে তারা ভয় পেতাে এবং অহিংস আন্দোলন ও আপােস আলােচনার পথে দাবি আদায়কে কৌশলগতভাবে অবলম্বন করেছিল। পূর্ব বাংলার শতকরা পঁচাত্তর ভাগ কৃষক ও বারাে ভাগ শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে একাত্মতা বা তাদেরকে রাজনীতিগতভাবে সচেতন করে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা ইত্যাদি মূল কর্তব্যকে উপেক্ষা করে পূর্ব বাংলার ধনিক ও সামন্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয় ধনিক, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সমবেত করে, পাকিস্তানসহ বিশ্বের ধনিক শ্রেণীর স্বার্থকে বজায় রেখে আপােস আলােচনার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার ধনিক ও সামন্ত শ্রেণীর হাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তরের কর্মসূচিই ছিল আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতি।
তাদের এ আপােষের রাজনীতিকে ব্যর্থ করে দিয়ে নরপিশাচ ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী যখন পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র জনগণকে রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগান, কামান, ট্যাঙ্ক ও বােমা দ্বারা আক্রমণ করে গণহত্যা অভিযান চালালাে তখন দেখা গেল নেতৃত্ব দেবার মতাে একজন আওয়ামী লীগ নেতাও জনগণের পাশে নেই, কারণ অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ শ্রেণীগতভাবেই সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করতে অক্ষম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সশস্ত্র বাঙালি পুলিশ, মিলিটারি ও ই পি আর বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে গিয়ে সশস্ত্র প্রতিরােধের সম্মুখীন হলাে। বিদ্রোহী সশস্ত্র বাঙালি বাহিনী অহিংস নীতিকে পরিত্যাগ করে দেশপ্রেম ও আত্মরক্ষার তাগিদে সশস্ত্র শত্রুকে সশস্ত্রভাবে মােকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শ্রেণীগতভাবেই এরা সবাই ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক। সেই সঙ্গে যােগ দিল হাজার হাজার দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, বাঙালি আমলা, অফিসারসহ অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী। বুকে তাদের পিতৃভূমিকে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার অদম্য মনােবল, হাতে তাদের শত্রু নিধনের অস্ত্র।
কিন্তু তাদের পরিচালনা করার মতাে কোনাে নেতৃত্ব নেই, নেই কৃষক শ্রমিক জনগণের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক কোনাে সম্পর্ক। ফলে ব্যাপক কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনগণের আস্থা লাভে অসমর্থ মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করা কষ্টকর হয়ে পড়লাে। মরিয়া হয়ে এ মুক্তিযােদ্ধারা জনগণর উপর দৈহিক চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য হলাে। যেমন পাবনা জেলার নগরবাড়ী ঘাটে ট্রেঞ্চ কাটার জন্য স্থানীয় কৃষকরা একটি কোদাল দিয়েও সাহায্য করতে রাজি হয়নি, রাজি হয়নি ট্রেঞ্চ কাটতে বা পাকসেনাদের যােগাযােগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। অনেক স্থানে মুক্তি ফৌজকে জনগণ আশ্রয় দিতে সাহস করেনি, খাদ্য সরবরাহ করেনি, বা যানবাহন ব্যবহার করতে অনুমতি দেয়নি। মুক্তি ফৌজ ও ধৈর্যসহকারে এ পরিস্থিতির রাজনৈতিক মােকাবেলা না করে বল প্রয়ােগের চেষ্টা করেছে, যা তাদেরকে জনগণ থেকে আরাে বিচ্ছিন্ন করেছে।
জনগণের উপর আস্থা রাখা ও জনগণের উপর নির্ভরশীল হওয়া তাদের রাজনীতিগতভাবে সচেতন করে তােলা এবং তাদের সঙ্গে একাত্ম হবার পরিবর্তে উক্ত মুক্তি ফৌজ মুক্তিযুদ্ধকে স্বীয় গণ্ডিতে কুক্ষিগত করে এক আত্মঘাতী অহমিকায় মেতে উঠেছিল। এর মূলে ছিল মুক্তিফৌজের সেনাদের মাঝে সঠিক রাজনৈতিক আদর্শের অভাব, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপলব্ধির অভাব জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের অভাব এবং উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব, যার ফলে ওরা হয়ে উঠেছিল স্বেচ্ছাচারী উশৃঙ্খল এবং বিভ্রান্ত। তাছাড়া অস্ত্র পরিচালনায় অদক্ষতা, পরিকল্পনাহীনভাবে শত্রুসেনাকে সামনাসামনি মােকাবেলা করার মতাে ভ্রান্ত কৌশল, শত্রু সেনার শক্তিকে ক্ষুদ্র ভেবে কল্পনার আশ্রয় ও পরিচালকহীন অসংগঠিত অবস্থার ফলে সুসজ্জিত শত্রু সেনাদের বর্বর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। যােগাযােগের অভাব, ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের অভাব, প্রয়ােজনীয় রসদ ও খাদ্য সরবরাহের অভাব এবং সর্বোপরি নেতৃত্বের অভাবে তারা ক্রমে ক্রমে তাদের মনােবল হারাতে থাকে।
আওয়ামী লীগের বৃটেন, আমেরিকা ও ভারতের উপর নির্ভরশীলতার আশ্বাস প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তি ফৌজের মাঝে মােহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও বাস্তবের কষাঘাতে সে মােহ আজ আর নেই। একমাত্র ভারত সরকারই হাজার হাজার উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে, অনুমতি দিয়েছে নিজস্ব ভূমি মুক্তি ফৌজকে ব্যবহার করতে। কিন্তু আর কোনাে দেশ পূর্ব বাংলার জনগণের আর্তনাদে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেনি, বরং তাদের স্বার্থে এখনাে তারা পাকিস্তান সরকারকে নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে খুলে যাচ্ছে মুক্তিফৌজের দিব্যদৃষ্টি, কল্পনা থেকে কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি অর্জন করেছ তা জীবন ক্ষেত্রে তারা গ্রহণ করতে শুরু করছে।
আজ তারা বুঝতে শুরু করেছে, এ যুদ্ধ হচ্ছে শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে শােষক ও শােষিত শ্রেণীর এক আপােষহীন দ্বন্দ্ব, পরস্পর হিংসাত্মক রক্তপাত। এ যুদ্ধ হচ্ছে বিপ্লবী যুদ্ধ, যা দ্বারা পূর্ব বাংলার লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনগণকে উগ্র বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে অত্যাচারী শােষক শ্রেণীকে সমূলে উৎখাত করে জাতীয় স্বাধীনতা ও শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কয়েম করতে হবে। এটাই হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রাম আর বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের উচ্চতর রূপ। বাস্তব অভিজ্ঞতা আজ তাদের শিখিয়েছে পরনির্ভরশীল হয়ে, বিশেষ করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বা তাদের অনুচরদের উপর নির্ভর করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চালানাে সম্ভব নয়। নিজের জাতি ও দেশের জনগণের মুক্তির যুদ্ধে নিজ দেশের জনগণকেই ব্যাপক হারে সংগঠিত করে নিজস্ব গণবাহিনী গড়ে তুলে সশস্ত্র গেরিলা পদ্ধতিতেই এ দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব। ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগঠিত এবং সশস্ত্র করতে না পারলে, অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধে জনগণকে সমবেত করতে না পারলে পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।
তাই আজ তারা জনগণের সহায়তায় বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় গেরিলা পদ্ধতিতে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের উপর সাফল্যজনকভাবে আক্রমণ করে চলছে। জনগণের সঙ্গে একাত্মতা, কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবং রাজনীতিগতভাবে সচেতন হয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে আজ তারা নিঃসন্দেহ। আওয়ামী লীগ শত প্রচার চালিয়েও তাদের এ সঠিক উপলব্ধি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না এবং পারছে না। ফলে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন মুক্তিফৌজ ইউনিটগুলাের উপর কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, মতান্তর ঘটলেই তাকে পাকিস্তানি অনুচর’ হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশের নিকট সােপর্দ করা হচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্মরণ রাখা উচিত দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধাদের বাস্তব উপলব্ধিকে এভাবে দমিয়ে রাখা কোনাে ক্রমেই সম্ভব নয়, কারণ এটা হচ্ছে বাস্তব ইতিহাসের অমােঘ রায়।
পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের অপর দলটি হচ্ছে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অন্যান্য বামপন্থীদের সহযােগিতায় পরিচালিত ঐক্যবদ্ধ একটি বিপ্লবী ফ্রন্ট, যারা পাকিস্তানি শাসন ও শােষণ, সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, সামন্তবাদী শােষণ ও পুঁজিবাদী শােষণ থেকে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ও জনগণের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। গ্রামে গ্রামে ব্যাপক জনগণকে রাজনীতিগতভাবে সজাগ, ঐক্যবদ্ধ এবং সশস্ত্র করে সম্পূর্ণ গােপন গেরিলা পদ্ধতির মাধ্যমে বর্তমান যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধে পরিণত করে সমগ্র হানাদার সেনা ও তাদের তাঁবেদার শ্ৰেণীকে সমূলে খতম করাই হচ্ছে এদের রণকৌশল। পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রামে গ্রামে সাধারণ মেহনতি মানুষের মাঝে মিশে গিয়ে এরা গড়ে তুলেছে তাদের গণবাহিনী। সুযােগ মতাে যৌথভাবে তীব্র অথচ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে এরা হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের খতম করে চলছে, আবার পরক্ষণেই মিশে যাচ্ছে কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতার মাঝে।
এরা অন্যান্য নেতাদের মতাে জনগণকে বিপদে ফেলে রেখে নিজেদের বাঁচানাের উদ্দেশে পালিয়ে যায় নি, বরং পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণের পার্টি হিসেবে এরা পূর্ববাংলার লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনগণের সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, জনগণের অগ্রবাহিনী হিসেবে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের দুঃখকষ্টকে নিজের দুঃখকষ্ট হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং হানাদার শত্রুসেনাদের অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলার আহ্বান জানিয়েছে, উৎসাহ দিচ্ছে, প্রেরণা দিচ্ছে, উদ্দীপ্ত করে তুলছে এবং শক্তি সাহস যােগাচ্ছে। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারার বাস্তব প্রয়ােগে পূর্ব বাংলার বুকে এরা গড়ে তুলেছে পূর্ব বাংলার জনগণের নিজস্ব গণবাহিনী। চট্টগ্রাম, নােয়াখালি, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলে এ গণবাহিনী গড়ে তুলেছে মুক্ত এলাকা, গড়ে তুলেছে তাদের গােপন সামরিক ঘাঁটি। যেখান থেকে গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুসেনাদের উপর চালাচ্ছে প্রচণ্ড আক্রমণ, খতম করছে পূর্ব বাংলার জনগণের দুশমন পাকিস্তানি সেনা ও তাবেদার বাহিনীকে। এ সকল অঞ্চলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মুক্তিফৌজ ও অন্যান্য দলের কর্মীরাও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে দলে দলে শ্রমিক কৃষক শ্রেণীর সঠিক নেতৃত্বে সমবেত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে বহন করছে মুক্তিকামী যােদ্ধাদের সঠিক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ভবিষ্যত ইঙ্গিত। এ সকল এলাকার সমগ্র জনগণই আজ বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী যুদ্ধের সশস্ত্র যােদ্ধা। তারা দৃঢ় মনােবলে বলীয়ান এবং প্রচণ্ড শক্তিরূপে ঐক্যবদ্ধ। তাদের অসীম সাহস, দৃঢ় মনােবল এবং ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রমাণ করে চলেছে ‘জনগণকেবলমাত্র জনগণই হচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসের পরিচালক শক্তি। ব্যক্তি স্বার্থ দলীয় স্বার্থ এবং শ্রেণী স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে জাতীয় মুক্তির বৃহত্তর স্বার্থে আজ পূর্ব বাংলার প্রতিটি যুব সেনার অবশ্যই স্মরণ রাখা উচিত এ যুদ্ধ হচ্ছে বিপ্লবী গণযুদ্ধ, যা নিঃসন্দেহে দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। সুতরাং এ যুদ্ধে ব্যাপক কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণীর জনগণকে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে আত্মবলিদানে নির্ভয় হয়ে, সমগ্র বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করেই বিজয় অর্জন করতে হবে।’ পূর্ব বাংলার সশস্ত্র সংগ্রামী জনগণের জয় হবেই এ গণযুদ্ধের বিজয় সুনিশ্চিত।
সূত্র: দর্পণ
১১.০৬.১৯৭১