কার কাছে নয়াদিল্লীর আবেদন?
ইসলামাবাদের কাছে কড়া নােট পাঠিয়েছেন নয়াদিল্লী। বিশ লক্ষাধিক শরণার্থী এসেছেন ভারতে। এখন তাদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। এইসব হতভাগ্য টিকতে পারেন নি নিজেদের ঘর-বাড়ীতে। পাক সৈন্যদের নিষ্ঠুরতা এবং গণহত্যার বিভীষিকা তাদের করেছে দেশছাড়া। মানবতার তাগিদে প্রতিবেশী ভারত দিয়েছে এদের আশ্রয়। কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে শরণার্থীদের ভরণ পােষণে। আইনের দিক থেকে এরা পাকিস্তানের নাগরিক। তাদের দায়িত্ব নিতে ইসলামাবাদ বাধ্য। নয়াদিল্লী বলছেন—পূর্ব বাংলায় এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে পাক সরকারকে যাতে শরণার্থীরা তাড়াতাড়ি নিজেদের পরিত্যক্ত বাড়ী-ঘরে ফিরে যেতে পারেন। আর তাদের দেখা শুনার জন্য যে দুভোর্গ ভুগতে হচ্ছে তার ক্ষতিপূরণ দাবীর অধিকার আছে ভারত সরকারের। এদিকে বাংলাদেশ বাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে আশাবাদী শ্রীমতী গান্ধী। নিঃসংশয় ভারতীয় সংসদ। নয়াদিল্লীর কথায় এবং ইসলামাবাদের কাছ প্রেরিত নােটের মধ্যে নেই সামঞ্জস্য।
লক্ষ লক্ষ নরনারীকে মেরে তাড়িয়েছেন ইয়াহিয়া খান। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ভারতের গণহত্যার অভিযােগ। শরণার্থীদের ফিরে যাবার পরিবেশ সৃষ্টির আবেদন জানানাে হয়েছে এই নরহন্তার কাছে। বাস্তব বুদ্ধির এমনতর অভাব নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আইনের এবং মানবীয় আচরণের প্রত্যাশা করা যেতে পারে একটি সভ্য সরকারের কাছে। নয়াদিল্লী ধার ধারেন না। যারা নিরস্ত্র লােকগুলাের উপর ঘাতক বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছেন এবং সুপরিকল্পিত উপায়ে পূর্ব বাংলা জনশূন্য করছেন তারা কি করে সভ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবেন? প্রায় দুমাসের হত্যাকান্ড দেখেও কি কেন্দ্রীয় সরকারের বুদ্ধির গােড়ায় জল ঢেকে নি? তারা কি মনে করেন, ভারতের আবেদনে জংলী সরকার রাতারাতি সভ্য সরকারে রূপান্তরিত হবেন? মুক্তিযােদ্ধাদের জয় সম্পর্কে নয়াদিল্লী যদি নিশ্চিত হয়ে যাবেন তবে বাংলা দেশের ভবিষ্যৎ অবশ্যই নির্ভর করবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উপর। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবেন একমাত্র তারাই। এ দায়িত্ব ইসলামাবাদের উপর ছেড়ে দিয়ে নয়াদিল্লী কি প্রকারান্তরে পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়ার শাসনই মেনে নিচ্ছেন না? এটা কি পরাজিতের মনেবৃত্তি নয়? এই পরাজয় কর্তৃপক্ষ যদি মেনেই নিয়ে থাকেন তবে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘পূর্ব বাংলা’ বলে আত্মপ্রবঞ্চনায় লাভ কি? ওটাকে পূর্ব পাকিস্তান বললেই তাে ল্যাঠা চুকে যায়।
ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবীর অধিকার মজুত রেখেছেন নয়াদিল্লী। এই ক্ষতিপূরণের পরিমাপ হতে পারে দুটি উপায় টাকার অঙ্কে কিম্বা নূতন করে সীমান্ত বিন্যাসে। সীমান্ত থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল বিস্তৃত এলাক থেকে এসেছেন শরণার্থীরপা। নগত টাকা না দিলে এবং এদের প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি না করলে তেরশ মাইল সীমান্তের ওপারে পঞ্চাশ মাইল বরাবর ভূমি দাবী করতে পারেন নয়াদীল্লী। এই বিস্তৃত এলাকায় চলবে শরণার্থীদের পুনর্বাসন। শূন্যে সৌধ নির্মাণ যদি সম্ভব হয় তবে এদের দেখাশােনা কে করবেন? পাক সরকার না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার না ভারত সরকার? গােটা কসরতটাই অবাস্তব এবং বিরক্তিকর।
নয়াদিল্লী ভালভাবেই জানেন, ভারতের কড়া নােট কিম্বা মৃদু নােটের কোন মূল্য নেই ইয়াহিয়ার কছে। বাংলাদেশে যে শান্তি আনবে তার আসল রূপ মহাশ্মশানের শান্তি। কবরখানায় মাথা গোঁজার জন্য ফিরে যাবেন না কোন শরণার্থী। তাদের তাড়াতেও পারবেন না কেন্দ্রীয় সরকার। ক্ষতিপূরণ কিম্বা শরণার্থী পূণর্বাসনের জমি আদায় করতে হলে প্রয়ােজন গায়ের জোর। আপােষে সব কিছু মেনে নেবেন ইয়াহিয়া খান এমন বাপের বেটা তিনি নন। তার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে হলে ঘাড় ধরে তা আদায় করতে হবে। নয়াদিল্লী কি বল প্রয়ােগে তৈরী? যদি তৈরীই থাকেন তবে বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে দোষ কি? মুক্তি যােদ্ধাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেই বা বাধা কোথায়? আর যদি না থাকেন তবে অবাস্তব নােট পাঠানাের কি দরকার? এতে কি কেন্দ্রীয় সরকারের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়বে? কর্তৃপক্ষের জানা উচিত, পত্রের সঙ্গে বারুদের গন্ধ না মেশালে ইসলামাবাদের টনক নড়বে না। যে নােটের পিছনে নেই বুলেটের গ্যারান্টি সেনােট অর্থহীন। ইয়াহিয়া যেদিন বুঝবেন ভারতের নােটের অমর্যাদার অর্থ— অস্ত্রে মােকাবিলা, সেদিনই তিনি দেবেন নয়াদিল্লী কথার যথাযােগ্য গুরুত্ব। ন্যায্য দাবী আদায়ের সময় আসবে তখনই, তার আগে নয়।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ মে ১৯৭১