পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা
শফিকুল হাসান
গত ১৯৭০ সালের বাইশে ফেব্রুয়ারি পল্টনের এক বিরাট জনসভায় কমরেড মাহাবুব-উল্লার নেতৃত্বে পূর্ব বাংলাকে একটি স্বাধীন ও জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘােষণা করা হয় এবং এই নতুন রাষ্ট্রের কাঠামাে এবং রূপরেখা সম্বন্ধে এগারাে দফা সম্বলিত একটি বাস্তব কর্মসূচি জনগণের নিকট তুলে ধরা হয়। এই কর্মসূচি বাস্তবে প্রয়ােগ বিধির প্রশ্নে এক্ষণে কমিউনিস্টদের মধ্যে মতবিরােধ দেখা দেয় এবং তারা কতগুলাে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
(এক) হক তােয়াহা গ্রুপ-পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) নাম দিয়ে এরা পাকিস্তানভিত্তিক কৃষি বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন। আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ পূর্ব বাংলায় কৃষি বিপ্লব অপরিহার্য, কিন্তু বর্তমানে পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি অত্যাচারী সেনাবাহিনীর (যাদের জনগণ বিদেশি অনুপ্রবেশকারী সেনাবাহিনী বলে মনে করেন) ঔপনিবেশিক চরিত্রের শােষণকে বজায় রেখে কৃষি বিপ্লব, বিশেষত পাকিস্তানভিত্তিক কৃষি বিপ্লব (সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে) সমাধা করা সম্ভব কি? পূর্ব বাংলার জনগণ যখন শােষণ, শাসন ও নিপীড়ন থেকে জাতীয় মুক্তির জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত তেমনি সময় ‘জনগণ ভুল করছে’ এই অমার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। পক্ষান্তরে তারা পূর্ব বাংলার জনগণ যে শােষণ পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে চায় এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করেছেন এবং পাকিস্তানের সংহতি কামনা করছেন। বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আধা সামন্তবাদী আধা ঔপনিবেশিক দেশ বিপ্লব-পূর্ব চীনের জনগণ ও বিপ্লবীরা সামন্তবাদ প্রধান দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও জাপানি সেনাদের (যারা অনুপ্রবেশকারী ছিল) প্রথমে বিতাড়িত করার উদ্দেশে এমনকি চিয়াং কাইশেকের সঙ্গেও ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র যুদ্ধই কোনাে দেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে সফল করতে পারে। মহান চীনের পথ আমাদের পথ— তাঁদের কার্যকলাপে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। কৃষি বিপ্লবের কথা বললেও বাস্তবে তারা তা করছেন না (যা করলে পূর্ব বাংলার সামন্তবাদী শোষণের অবসান হতাে) কেননা বিপ্লবের প্রথম ধাপ হিসেবে গ্রামে গ্রামে কৃষক বিশেষত ভূমিহীন গরিব কৃষকদের রাজনীতিগতভাবে সচেতন করে তােলা ও আলােচনার মাঝে তাদের সংগঠিত করা প্রয়ােজন, যা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে খুলনা ও যশােরের কিছু অংশে তারা কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও কোনাে লাল এলাকা বা ভিত্তি অঞ্চল গড়ে তুলতে সক্ষম হননি।
(দুই) সিরাজ শিকদার গ্রুপ। পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ নাম দিয়ে তাঁরা বলছেন, পূর্ব বাংলা হচ্ছে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং এ উপনিবেশকে মুক্ত করতে হবে। এ তত্ত্ব অনুযায়ী তারা সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন। তারা জনগণকে এড়িয়ে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন, ফলে জনগণের সঙ্গে তারা সম্পর্কিত নন। তাই গ্রাম বা শহরে তাদের কোনাে ভিত্তি এলাকা গড়ে ওঠেনি। কৃষক শ্রমিকদের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কহীন বেশ কিছু যুবক ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনাতে তাদের সঙ্গে পার্টিগতভাবে যুক্ত।
(তিন) জাফর-মেনন গ্রুপ। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণতন্ত্রের শ্রেণী সংগ্রামকে পৃথক পৃথকভাবে কার্যকরী করার পক্ষপাতী। এঁরা কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্কিত হবার চেষ্টা করেন এবং সিলেটে একটি ভিত্তি এলাকা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। টঙ্গি এলাকার শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত।
(চার) মতিন-আলাউদ্দিন-দেবেন বাসার গ্রুপ। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ নামে এরা পরিচিত। পূর্ব বাংলার জনগরে বেশির ভাগ কৃষক এবং তারা যেহেতু সামন্তবাদী শােষণে জর্জরিত সেহেতু পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে সামন্তবাদী শােষণের দ্বন্দ্বই প্রধান। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক চরিত্রের শশাষণ এমন উলঙ্গ রূপ নিয়েছে যে পূর্ব বাংলার জনগণ এখন পাকিস্তানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানি শােষকদের বিদেশি শক্তি বলে মনে করছে এবং তাদের শােষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তি কামনা করছে। ফলে পূর্ব বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা একই সঙ্গে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত বলে মনে করেন এবং এ দুই সংগ্রামকে সশস্ত্র গণযুদ্ধের রূপ দেবার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। কৃষক ফ্রন্টে মতিন-আলাউদ্দিন এবং শ্রমিক ফ্রন্টে দেবেন শিকদার ও বাসার রাজনীতি প্রচারের দায়িত্ব নেন। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খুব কম সময়ের মধ্যেই পাবনা, বগুড়া, যশাের, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল ও নােয়াখালীতে ভিত্তি অঞ্চল (লাল এলাকা) সমূহ গড়ে ওঠে। ঢাকার শ্যামপুর-নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ, পাবনার ঈশ্বরদী, পাকশি ও সৈয়দপুর, কুমিল্লার আখাউড়া, লাকসাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, নােয়াখালীর ফেনি ও চট্টগ্রামের বন্দর, রেল ও ডাক শ্রমিকরা এই পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত। খুলনা ছাড়া পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলাতে এই পার্টির রাজনৈতিক কার্যকলাপ জালের মতাে ছড়িয়ে আছে। এই পার্টি তাদের লাল এলাকাসমূহে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে ও দেশীয় শােষকদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালাবার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। তারা গেরিলা সেনা গড়ে তােলেন এবং সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা গড়ে তোেলার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণকে আহ্বান জানান। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়ােজন যে, পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকায় উপরােক্ত প্রতিটি পার্টিই গােপনে তাদের কার্যকলাপ চালাতে থাকে এবং প্রকাশ্যভাবে মওলানা ভাসানীর ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। এদের বাদ দিলে মওলানা ভাসানীর ন্যাপে আর যারা আছেন তারা হচ্ছে শ্রেণীগতভাবে পূর্ব বাংলার জাতীয় ধনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের প্রগতিশীল ভূমিকা অনস্বীকার্য।
নির্বাচনের দিন ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে ‘আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার নাম করে ইয়াহিয়া লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার নামে ‘কতগুলাে শৰ্তমূলক আইন জারি করে, যে শর্তগুলাে মেনে নিলে গণতন্ত্র বলতে অবিশষ্ট কিছুই থাকে না। শর্তগুলাের অন্যতম পাচটি হলাে (এক) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না দেয়া পর্যন্ত সামরিক শাসন চালু থাকবে এবং ইয়াহিয়ার হাতে সর্বময় রাষ্ট্রীয় ও নির্বাচনী ক্ষমতা থাকবে; (দুই) নির্বাচিত পরিষদ তিনি (ইয়াহিয়া) ইচ্ছা করলে যে কোনাে মুহূর্তে ভেঙে দেবার ক্ষমতা রাখেন এবং তার জন্য কোননা কৈফিয়ত দিতে তিনি বাধ্য নন; (তিন) নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সবাই একপক্ষে রায় দিলেও সেটা তার (ইয়াহিয়ার) মনমতাে না হলে তাতে তিনি স্বাক্ষর দেবেন না এবং তার স্বাক্ষর ব্যতীত কোনাে আইন শাসনতন্ত্রে গৃহীত হবে না; (চার) পাকিস্তানের সংহতির বিপক্ষে যে কোনাে প্রস্তাব আনা হলে পরিষদকে বাতিল করে দেয়া হবে; (পাচ) এই শাসনতন্ত্র একশাে কুড়ি দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে না পারলে নির্বাচিত পরিষদকে বাতিল ঘােষণা করা হবে। বামপন্থী কমিউনিস্ট দলগুলাে গণতন্ত্রের নামে এ প্রহসনকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান এবং ইয়াহিয়া সরকারকে সামরিক শাসন তুলে নেবার জন্য হুঁশিয়ার করে দেন। কিন্তু ডানপন্থী ক্ষমতালােভী তথাকথিত নেতৃবর্গ ক্ষমতা লাভের আশায় ইয়াহিয়ার লিগাল ফ্রেম অর্ডার এর গণতন্ত্রের পরিপন্থী শর্তসমূহ মেনে নেয়, ইয়াহিয়া সরকারকে শান্তিকামী ও গণতন্ত্রী বলে ভূয়সী প্রশংসা করে। তারা ইয়াহিয়া সরকারের সমালােচক বামপন্থী দলগুলােকে সমাজবিরােধী, গণদুশমন রূপে অভিহিত করে এবং নিজেদের গুণ্ডা বাহিনীকে তাদের উপর লেলিয়ে দেয়। কিন্তু পূর্ব বাংলার ইতিহাস নিজেই আজ প্রকাশ করছে কারা সত্যিকার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেন আর কারাই বা সত্যিকার গণদুশমন ছিল।
১৯৭০ সালের পাঁচই অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। হঠাৎ ইয়াহিয়া সে নির্বাচন সাতই ডিসেম্বরে পরিবর্তিত করে তার যথেচ্ছাচারিতার আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। গণমনে তীব্র বিক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও আপােসকামী ক্ষমতালােভী ডানপন্থী নেতারা জনগণের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে এবং ইয়াহিয়ার এ সিদ্ধান্তকেও আপােসের পথে মেনে নেয় এবং নির্বাচনী প্রচারকার্য চালাতে থাকে। পূর্ব বাংলার দুঃখময় রাত বারােই নভেম্বর প্রবল সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রায় তিরিশ লক্ষ লােক হতাহত ও সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ে। এমন দুঃসময়েও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা কেউ এই অসহায় নিরাশ্রয় জনগণকে সাহায্য করা দূরে থাক, একবার দেখবারও প্রয়ােজন বােধ করেন নি। মানবতার বিরােধী এই সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের ভেক ধ্বজাধারীদের মুখােশ খুলে পড়ে এবং বামপন্থী বিভিন্ন নেতা ও মাওলানা ভাসানী এদের তীব্র সমালােচনা করেন। এক কালের পাকিস্তান সংহতির অন্যতম অগ্রনায়ক ভাসানী চব্বিশে নভেম্বর পল্টন ময়দানে ঘােষণা করেন- “তােমাদের এই ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি সব বােগাস’। তিনি চৌঠা ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের অপর এক জনসভায় ঘােষণা করেন- ‘আজ থেকে পূর্ব বাংলা স্বাধীন, আমাদের এ দেশকে আমরাই সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে গড়বাে।’ তিনি তার দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকে দুস্থ মানবাত্মার সেবা করার নির্দেশ দেন।
এরই মধ্যে ক্ষমতালি পূর্ব বাংলার ডানপন্থী নেতারা শবদেহের উপর দাঁড়িয়ে মানবতাকে অস্বীকার করে ভােট ভিক্ষায় লিপ্ত হন। সাতই ডিসেম্বর এই তথাকথিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন, মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ও ন্যাপে অবস্থানরত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটি এবং আতাউর রহমানের জাতীয় প্রগতি লীগ অংশগ্রহণে বিরত থাকে। নির্বাচনে সকল দক্ষিণপন্থীরা, যথা আওয়ামী লীগ তিনটি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল (পি ডি পি), অন্যান্য স্বতন্ত্র দল ও দক্ষিণপন্থী পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মস্কো ন্যাপ অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তান নির্বাচনী কমিশনার পূর্ব বাংলার নিম্নরূপ নির্বাচনী রায় ঘােষণা করেন। আওয়ামী লীগ পেয়েছে মােট ভােটের শতকরা তেত্রিশ ভাগ; অন্যান্য দল সতেরাে ভাগ জাল ভােট ও বাতিল ভােট ছয় ভাগ মােট গৃহীত ভােট হলাে শতকরা ছাপান্ন ভাগ।
আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে মােট তিনশটি আসনের মধ্যে একশাে একষট্টিটি আসনে (অর্থাৎ পূর্ব বাংলার একশ তেষট্টিটি আসনের মধ্যে একশাে একষট্টিটি আসনে) জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদেও অনুরূপ বিজয় লাভে আওয়ামী লীগ সমর্থ হয়। নির্বাচনের এই ফল পাকিস্তানি শাসক ও শােষক গােষ্ঠীকে আতঙ্কিত করে তােলে। পশ্চিমা শােষক গােষ্ঠী ভেবেছিল আওয়ামী লীগ খুব বেশি হলে একশ কুড়িটি আসনে জয়ী হবে এবং বাকি ১৮০টি আসনের একটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের দ্বারা আওয়ামী লীগকে সংখ্যালঘু পার্টি হিসেবে দমিয়ে রেখে পূর্ব বাংলার ধনিক গােষ্ঠীসহ সকল জনগণকে চিরাচরিত প্রথায় শশাষণ করা যাবে। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনাকে পূর্ব বাংলার জনগণ কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি শােষক গােষ্ঠীর দুই প্রতিনিধি ইয়াহিয়া ও ভুট্টো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজতে থাকে।
এদিকে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ও পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতার দাবিতে প্রবল জনমত সৃষ্টি করে। কেননা নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ‘জয় বাংলা মানেই স্বাধীন বাংলা বলে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিল। বাস্তবে স্বাধীনতা আনয়নের প্রতিশ্রুতিই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সাফল্য ঘটিয়েছিল। এক্ষণে আওয়ামী লীগের ছাত্র প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ স্বাধীনতার দাবিতে এক উল্লেখযোেগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে এবং আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবর রহমানের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। অপরদিকে পূর্ব বাংলার সেনাবাহিনী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আধাসামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর সেনারাও (যারা এতদিন পাঞ্জাবি সেনা কর্তৃক পদে পদে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত এবং অপদস্থ হয়েছে। স্বাধীনতা ঘােষণার দাবিতে শেখ মুজিবকে চাপ দিতে থাকেন। এমনকি পূর্ব বাংলার সকল বাঙালি আমলা অফিসাররাও এই স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসেন। অন্যদিকে হক তােয়াহাদের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) ছাড়া অন্য সবকটি বামপন্থী দল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের ব্যাপক প্রচার ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন।
ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন সামরিক শাসকরা ঢাকা, ঈশ্বরদী, সান্তাহার, পাকশী, সিরাজগঞ্জ, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এক প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়, যা কমিউনিস্টরা কঠোর মনােভাব দ্বারা ব্যর্থ করে দেয়। উপায়ন্তর না পেয়ে ভুট্টোর পরামর্শ অনুযায়ী পয়লা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের টেকনাফ থেকে দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া সীমান্ত পর্যন্ত প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে যায়। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পিপাসু মারমুখি জনতার মিছিলে ছেয়ে যায় প্রতিটি শহর। শেখ মুজিবের নির্দেশে সমগ্র প্রদেশে প্রতিপালিত হয় হরতাল, বন্ধ হয়ে যায় অফিস-আদালত, যানবাহন, ব্যাঙ্ক-বীমা, স্কুল-কলেজ ও কল-কারখানাগুলাে। পশ্চিমা শশাষকগােষ্ঠী পুনরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা করে, কিন্তু সজাগ জনতা সে ষড়যন্ত্রকেও ব্যর্থ করে দেয়। সমগ্র পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য বিক্ষোভ মিছিল করে এগিয়ে যায় ধানমন্ডিতে অবস্থিত শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে। দোসরা মার্চ বর্বর সেনারা তেজগাঁও ও মালিবাগ এলাকায় গুলি করে নাগরিক হত্যা করা সত্ত্বেও তেসরা মার্চ শেখ মুজিব ‘অহিংস ও অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন হত্যাকাণ্ডের বিরােধিতা করে কালাে পতাকা উত্তোলন করার নির্দেশ দেন।
এদিকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে সামিল হয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে পাঞ্জাবি সেনাদের খতম অভিযান চালাতে নির্দেশ দেন। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একটি গেরিলা দল পাঁচই মার্চ রাত এগারটায় মহাখালী রেলগেটে পাঞ্জাবি সেনাদের একটি ঘাঁটি আক্রমণ করে একটি সশস্ত্র সেনাকে নিহত এবং অপর একজনকে আহত করে। ছয়ই মার্চ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও জনগণের গণতন্ত্র আদায় করার উদ্দেশে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রসমাজ ও দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিকদের সমন্বয়ে একটি ঐক্যফ্রন্টের আহ্বান জানান এবং পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফৌজ’ গঠনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন। তারা তাদের এই বক্তব্যের ব্যাপক প্রচার করেন এবং অন্যান্য বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করেন। বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্রলীগের নেতৃবর্গ ও কর্মীরা সশস্ত্র যুদ্ধের পথে স্বাধীনতা আদায়ের জন্য ঐক্য ফ্রন্টের প্রশ্নে একমত হন।
ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া সরকার এক আপােস আলােচনার জন্য শেখ মুজিব ও ভুট্টোকে এক গােলটেবিল বৈঠকে আহ্বান করেন। শেখ মুজিব সাতই মার্চ নিম্নোক্ত চারটি দাবি না মানা পর্যন্ত গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। দাবি চারটি হলাে- (এক) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নিতে হবে; (দুই) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; (তিন) অবিলম্বে গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্ত ন্তির করতে হবে এবং (চার) দোসরা মার্চ তেজগাঁয়ে হত্যাকারী সেনাকে তদন্ত করে বের করে উপযুক্ত শাস্তি বিধান ও নিহত ব্যক্তির পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।।
সেদিনই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী ছাত্রবৃন্দ রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং জনগণকেও স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেন। নয়ই মার্চ মাওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানের এক বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবের অহিংস নীতির তীব্র বিরােধিতা করেন এবং ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তুলে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য জাতিকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। তিনি স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার স্বীকৃতিও দাবি করেন। সেদিন রাতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অপর এক গেরিলা দল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত এক পাঞ্জাবি কর্নেলের বাড়ি আক্রমণ করেন এবং ঐ কর্নেলকে হত্যা করে তার স্টেনগান নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটি পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন এবং ভাসানী ন্যাপ যুক্তফ্রন্ট ও গণমুক্তি ফৌজের মাধ্যমে সশস্ত্র যুদ্ধের ব্যাপক প্রচারকাজ চালাতে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপােসকামী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ অহিংস ও অসহযােগ নীতির ভিত্তিতে সশস্ত্র যুদ্ধের তীব্র বিরােধিতা করতে থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগের ছাত্ৰপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগের মধ্যে মতবিরােধ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বাধীনতাকামী ছাত্রলীগের ‘রব গ্রুপ’ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের পথে দেশকে স্বাধীন ও জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করে একটি ভালাে প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেন।
সূত্র: দর্পণ
২১.০৫.১৯৭১