You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.07 | বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কীভাবে সফল হতে পারে | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কীভাবে সফল হতে পারে

বাংলাদেশের অমর জনগণ ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে সগ্রাম আরম্ভ করেছেন, তার প্রকৃতি জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম বস্তুত বিদেশি ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিসত্তার প্রতিরােধ সংগ্রাম।
এই সংগ্রাম শ্রেণী তাৎপর্যবিহীন হতে পারে না, কারণ শ্রেণী বিভক্ত সমাজে যা কিছু ঘটে তার পেছনে শ্ৰেণী মনােভাব থাকতে বাধ্য। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামও শ্ৰেণীনিরপেক্ষ হতে পারে না। জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণী নিজ নিজ চূড়ান্ত লক্ষ্য অনুসারে পরিচালিত হয়, কিন্তু সাময়িকভাবে সাধারণ লক্ষ্য সাধনের জন্যে এই শ্রেণী সংঘর্ষ অস্থায়ী ধরনের ঐক্যেরও সৃষ্টি করতে পারে এবং করেও। বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনার ঐক্য ও সংগ্রামের চলমান ধারাই সমাজ ব্যবস্থাকে উন্নত অবস্থায় নিয়ে যায়।
কিন্তু শ্ৰেণী মনােভাব থেকে উদ্ভুত ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণকালে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন প্রত্যেকটি মানুষকেই এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, শ্রেণী সংগ্রামে ঐক্যের উপাদান নিতান্তই স্বল্পস্থায়ী, বিরােধের উপাদানই মুখ্য ও প্রধান। সাময়িক রণকৌশলগত ঐক্যকে মৌলিক রণনীতিগত বিরােধীয় উপাদানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভুল ব্যাখ্যা দেখা দেয়। আবার, কোনাে বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে সামাজিক শক্তির বিন্যাসে সাধারণ লক্ষের ঐক্যকে ছােট করে দেখা মতান্ধ মূঢ়তারই পরিচায়ক।
১৯২২ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নতুন অবস্থা ব্যাখ্যা করে। দেখিয়েছিলেন যে, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ যখন বর্তমান যুগে প্রতিযােগিতামূলক বিকাশের ধারা পরিহার করে একচেটিয়া পুঁজিবাদী রূপ গ্রহণ করেছে তখন কোনাে দেশেই আর জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অর্থাৎ ঔপনেবিশক শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বুর্জোয়া শ্রেণীর কার্যকরী নেতৃত্ব থাকলে তা সফল হতে পারে না। আপােসমুখিনতা, সুবিধাবাদী আঁতাত ইত্যাদি ঝোকের দরুন মূল লক্ষ্য অর্থাৎ ঔপনেবিশক শােষণের বিরুদ্ধে জাতিসত্তার মুক্তি সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের সঙ্গে সুবিধাবাদী আপােসে পরিণত হয়।
ভারত-পাক উপমহাদেশের দুটি দেশেই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব ও দায়িত্ব প্রধানত সামন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে ন্যস্ত থাকার দরুনই স্বাধীনতার পরবর্তীকালে জনগণের অসীম দুঃখ ও ক্লেশ আর্থ-সামাজিক অবস্থা দেখা দিয়েছে।
সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ, পরিষ্কার ধারণা নিয়েই তাতে স্বাগত সমর্থন জানাতে হবে।
এ কথা ঠিক নয় যেহেতু বর্তমান স্তরে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম উদীয়মান মধ্য শ্রেণীগুলাে ও নবীন বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে অতএব প্রগতিশীল শক্তিগুলােকে ঐ সংগ্রাম থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে হবে। তাহলে কম্বােডিয়ার রাজা সিহানুক অথবা লাওসের রাজভ্রাতার নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকেও সমর্থন করা যায় না। দুঃখের বিষয় কিছু কিছু তথাকথিত প্রগতিবাদী শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে এবং প্রধানত বাঙালি সিভিলিয়ান ও পুলিশের সহায়তায় আরব্ধ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে নেহাত ইয়াহিয়ামুজিব লড়াই বলে দেখাতে চাইছেন। অর্থাৎ এঁরা আরব্ধ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বকে বড় করে দেখছেন এবং শ্রেণীসংগ্রামের উপাদানকে ছােট করে দেখাচ্ছেন। এরা গরম গরম বুলি ঝেড়ে বিপ্লবীদের প্রকৃত দায়িত্ব-জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে শ্রমিক শ্রেণীর ও গ্রামীণ সর্বহারা, গরিব কৃষক শ্রেণীর নেতৃত্ব নিয়ে আসার বিপ্লবী দায়িত্ব এড়াবার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
অন্যদিকে আরাে একদল প্রগতির ধ্বজাবাহী ‘শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা’, বলে উচ্চ নিনাদ করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে জনগণের ভূমিকাকে ছােট করে দেখাবার হীন প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন। এঁরাও একই পথের পথিক। শেখ মুজিবের ব্যক্তিসত্তাকে সংগ্রামের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে এভাবেও বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে শ্রেণীনিরপেক্ষতার ভান দেখিয়ে বিপথে, পরাজয়ের মুখে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চালানাে হচ্ছে। এ কাজ বুর্জোয়া শ্রেণীর পদলেহীদেরই কাজ।
সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বাংলাদেশের সমস্ত শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলে বুঝে নেয়া যায়। অবিভক্ত ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী মুক্তি সংগ্রাম প্রধানত বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বের আওতায় রাখা সম্ভব হয়েছিল এবং সংগ্রাম পরিচালনার গতিপথে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণীর ভূমিকাকে ছােট করে রেখে, বুর্জোয়া আপােস প্রবণতার খাতে সংগ্রামকে পরিচালিত করা হয়েছিল। তারই ফলশ্রুতি পাক-ভারত উভয় দেশেই সামন্ত একচেটিয়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে এবং তার পেছনে বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সমর্থন রয়েছে। সুতরাং মুখে সমাজতন্ত্রী ধাঁচ থেকে ‘গরিবী হঠাও-এর সমাজতন্ত্র বা গরিব হঠাও’ মার্কা উদ্ধত পুঁজিবাদের ক্লেশকর পর্যায়ে এসে আমরা উপস্থিত হয়েছি।
বাংলাদেশের মানুষকে পাক-ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে গণঅভূত্থান শুরু হয়েছে তার রণনীতি ও রণকৌশলের গতিশীল প্রয়ােগের উপরেই ভবিষ্যত ফলাফল নির্ধারিত হবে।
প্রত্যেকটি সংগ্রামই বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রূপ নেয়। প্রত্যেক সংগ্রামের পেছনে থাকে রাজনীতি। রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনের জন্য কখনও শান্তি কখনও সশস্ত্র সংগ্রাম, কখনও শান্তি আলােচনা কখনও দৃঢ়তার সঙ্গে অস্ত্রবলে সমস্যার সমাধান—এই উভয়বিধ কৌশলই নমনীয়ভাবে অলম্বন করার ক্ষমতা যে কোনাে নেতৃত্বের জন্য অত্যাবশ্যক এবং অপরিহার্য গুণ। মূল লক্ষ্য অর্থাৎ রণনীতি স্থির রেখে স্থানীয় অবস্থাকে দ্রুত অদল-বদল করে মূল লক্ষের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে পারাটাই সাফল্যজনক রণকৌশলের পরিচয়।
সুতরাং রণনীতিকে রাজনীতির লক্ষের সঙ্গে সুসামঞ্জস্য করে তােলাটা প্রাথমিক দায়িত্ব। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এই দুর্বল দিকের জন্যেই ইয়াহিয়া খানের সামরিক শক্তি প্রথম পর্যায়ে জাতীয় মুক্তি বাহিনীকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলতে পেরেছে। বাংলাদেশের নেতৃত্ব অচিরেই এই দুর্বল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন, এ ভরসা না পাবার কারণ নেই।
এই দুর্বল দিক পরিহার করতে গেলে প্রথমেই বাংলাদেশের অস্থায়ী জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট সরকারের গণভিত্তি সবল করে তুলতে হবে। অর্থাৎ যারা যারা আজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা পদ্ধতিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার পন্থায় বিশ্বাসী তাদের সবাইকেই জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের সরকারে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে।
এই গণভিত্তিকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করাতে হলে অবিলম্বে ছাত্রদের এগারাে দফা দাবিগুলাের ভিত্তিতে (শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী, পি ডি পি প্রভৃতি সমস্ত দলনেতাই একে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং এই এগারাে দফা দাবি মূলত মুজিব ও ভাসানীর ছয়দফা ও চৌদ্দদফার সুসামঞ্জস্য সাধারণীকরণ মাত্র) প্রয়ােজনীয় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারগুলাে ঘােষণা করতে হবে।
এগুলাে করতে হলে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের মধ্যে ভূমি বন্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রথমেই দরকার। তা হলেই বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে কৃষক সাধারণ বিপুল উৎসাহে ঘােষিত অধিকার রক্ষা করবার জন্যে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসবেন।
সঙ্গে সঙ্গে শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের ন্যূনতম দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে সনদ জারি করতে হবে। শ্রমিকদের এই ঘােষিত অধিকারগুলাে রক্ষা করার জন্যে তাদের মধ্যে গেরিলাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। ছাত্র ও যুবকেরা কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে গুপ্ত গেরিলা সংগঠন গড়ে তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করবেন।
যদি এই কাজগুলাে অবিলম্বে করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে বিপুল উৎসাহ, আবেগের সৃষ্টি হবে, তারা যত স্বচ্ছভাবে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত যােগসূত্র লক্ষ করতে পারবেন, ততটা দৃঢ়ভাবেই তারা এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসবেন।
অর্থাৎ রাজনীতিকে দৃঢ়ভাবে রণনীতির সমর্থনে এগিয়ে নেবার গণভিত্তি রচিত হবে। তখনই প্রকৃত জনযুদ্ধের পর্যায় শুরু হবে।
তখন রসদ অথবা সমবােপকরণ পাবার জন্যে কোনাে বন্ধু দেশের খোঁজে বেরুতে হবে না। পেলে ভালাে, না পেলেও সগ্রামের উপকরণ পাকসেনাদলের কাছ থেকেই আহরণ করা সম্ভব হবে। জনগণ জনযুদ্ধ শুরু করলে সারা দেশের ভূ-প্রকৃতি গেরিলা সেনাদলের সমর্থনে সক্রিয় হবে। অজস্র খাল, বি নদী-নালা, মেঠো পথ, জঙ্গলের আড়ালে তাদের আঘাত ও আত্মরক্ষার দৃঢ় ব্যুহ রচিত হবে।
মনে রাখা ভালাে যে, বিশ বছর ধরে যুদ্ধ চালাবার পর ইন্দোচীনে নতুন করে পঁয়তাল্লিশ সালে ফরাসি আক্রমণ শুরু হয়েছিল। চুয়ান্ন সালের জেনেভা চুক্তির মাত্র একবছর পর পঞ্চান্ন সাল থেকে নাে দিয়েম চক্রের পেছনে দাঁড়িয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জেনেভা চুক্তিকে কার্যত বাতিল করে দেয়। তারপর দিয়েমের ফ্যাসিস্ট চক্র গ্রামে গ্রামে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ধরে, মাইন বসিয়ে, পেট চিরে নাড়িভুড়ি বের করে নানা বীভৎস অত্যাচার করেও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে দমন করতে পারেনি। ১৯৬৫ সাল থেকে ছয় লক্ষ সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত মার্কিন সেনা ও কুড়ি লক্ষ সুসজ্জিত দক্ষিণ ভিয়েতনামী তাবেদার সেনা দল আক্রমণ চালিয়ে গেরিলাদের আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষার অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।

সূত্র: দর্পণ
০৭.০৫.১৯৭১