সামরিক শাসন বনাম বাংলাদেশের গণ-প্রতিরােধ
পূর্ববঙ্গের বীর জনগণের ওপর সামরিক ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খানের আঘাত নেমে এসেছে। সেই আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগঠন বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সামরিক আক্রমণের মােকাবিলা করতে দৃঢ়সংকল্পে দণ্ডায়মান।
আফ্রিকার নাইজেরিয়া বিয়াফ্রা সংঘর্ষের পর এটা আফ্রোএশীয় রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে বৃহত্তম রাজনৈতিক ঘটনা। নাইজেরিয়ার জেনারেল গাবােনের সেনাবাহিনীর আক্রমণে বিয়াফ্রার বেসামরিক জনগণ যে অপূর্ব প্রতিরােধ সংগঠিত করেছিল, অভূতপূর্ব দুঃখবরণ ও ত্যাগ স্বীকারের রক্ত ঝরা কাহিনী রচনা করেছিল, তা সারা বিশ্বের জনসাধারণকে চমৎকৃত করেছে।
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিয়াফ্রা নয়। আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বিয়াফ্রা পরাজিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে প্রতিহত করে বাংলাদেশ বিজয়ী হবে।
পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশ বাঙালি। পাকিস্তানের আর্থিক সংগতির মূল উৎস বাংলাদেশে। তবু পাকিস্তানের দরিদ্রতম জাতি বাঙালি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্য বাংলাদেশের ওপর বিতৃষ্ণায় বিমুখ।
পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান বলে বাংলাদেশ পরিচিত হলাে। বাংলা ভাষার স্থান দখল করল উর্দু ভাষা। সেদিনও বাঙালি পশ্চিমের এই ফতােয়া মেনে নেয়নি। কায়দে আজম মহম্মদ আলি জিন্নাহকেও সেদিন ঢাকা ছাত্রসভায় অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। সে ১৯৫২ সালের কথা।
ঢাকা শহরে কার্ফ। একশ চুয়াল্লিশ ধারা চুরমার করে ছাত্রসমাজ বেরিয়ে এল। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের রক্তে ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রামের রাজপথ লাল করে দিল। তবু তারা মাথা নােয়ায় নি।
বাংলা ভাষা কাফেরের ভাষা বাংলাসাহিত্য ভারতীয় আদর্শ প্রচার করে, এই ফতােয়া দিয়ে মুসলিম লীগ সরকার উর্দু ভাষার প্রসারের ব্যর্থ চেষ্টা করল। বাংলাদেশের মানুষ বলল, যে অমৃতময় ভাষায় প্রথম মা বলে ডেকেছি, যে ভাষা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষা, তা আমার জাতীয় ভাষা। তার বদলে উর্দু নয়, অন্য কিছু নয়।
সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলিম লীগ সরকারের লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, কারফু সব অগ্রাহ্য করে ঢাকা মহাকরণের সামনে মাথা তুলল শহীদ মিনার। শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করল বারােটি ছাত্রের পবিত্র রক্তধারা।
সেদিনও অনেকের মােহ ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ন্যায় বিচার করবে। সে মােহ কাটতে দেরি হয় নি।
১৯৫৪ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ জবাব দিল। তিনশাে নয়টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেল সাতটি। যুক্তফ্রন্ট অধিকার করল তিনশাে দুইটি আসন।
যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান এনে দিল, যে মুসলিম লীগ কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহের দুর্ধর্ষ নেতৃত্বে প্রাকবিভাগ ভারত উপমহাদেশের অঙ্গচ্ছেদ করে মুসলিম জাতিগুলাের স্বাধীন আবাসভূমি রচনা করল, সেই মুসলিম লীগ বাংলাদেশের জনগণের হাতে ধরাশায়ী।
স্বভাবতই পাকিস্তানের দ্রুত বর্ধমান একচেটিয়া পুঁজিপতি গােষ্ঠী, ইস্পাহানী দাউদের দল শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার মারফত বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করল। জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা (ইনি মীরজাফরের নবম পুরুষের বংশধর!) এলেন পূর্ববঙ্গের গভর্নর হয়ে। ভেঙে দিলেন যুক্তফ্রন্ট সরকার।
তারপর কিছুদিন দলবদলের পালা, উত্থান পতনের টালমাটাল। আবু হােসেন সরকার, আতাউর রহমান, বাংলাদেশে; বগুড়ার মহম্মদ আলী শহীদ সুরাবর্দী (সােহরাওয়ার্দি) চুন্দ্রিগড়, ডা. খান সাহেব, ফিরােজ খান নুন, কেন্দ্রে দ্রুতবেগে ক্ষমতা করায়ত্ত করলেন, আর ক্ষমতাচ্যুত হলেন।
কিন্তু যে দেশে পুঁজিবাদী বিকাশের ধারা এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ধারা ওতপ্রােত মিশে শাসকশ্রেণীকে নিরন্তর ক্ষয়মুখি করে চলেছে, সে দেশে একচেটিয়া পুঁজিপতিগােষ্ঠীর নেতৃত্বে পরিচালিত বুর্জোয়া খাজা নবাবদের শাসকশ্রেণী ক্রমশ অধিকমাত্রায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে চায়। সব দেশেই এরকম ঘটে থাকে। কারণ জনগণের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত না করে, একচেটিয়া পুঁজির শােষণ চালানাে যায় না।
তাই জিগির উঠল পাকিস্তানের সংহতির, কেন্দ্রের জন্যে আরাে বেশি ক্ষমতা। সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচ ও পাঠান জাতিগুলােকে উঠিয়ে দেয়া হলাে, মিলিয়ে দেয়া হলাে একমাত্র অঙ্গরাজ্যে; পশ্চিম পাকিস্তান হলাে তার নাম। সিন্ধু বলে কেউ থাকল না, পাঞ্জাবি, বেলুচ, পাঠান রইল না। সবাই হলাে পশ্চিম পাকিস্তানি।
পূর্ব পাকিস্তান অনেক দূরে তাই সম্ভবত বাঙালি জাতিসত্তাকে ভৌগােলিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা গেল না। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বাঙালি জাতিকে দাস জাতিতে পরিণত করার সবরকম চেষ্টা শুরু হলাে।
প্রথমেই বাঙালিদের সংখ্যাধিক্য হরণ করা হলাে। উভয় পাকিস্তানের মধ্যে সমতার ভিত্তি অনুসারে আসনবন্টন করে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে চিরতরে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হলাে।
তারপর শুরু হলাে অবাধ শােষণ। একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের অধিকাংশই উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের লােক। এর আগে তারা ছিল ভারতের জাঁদরেল আঁদরেল ব্যবসায়ী গােষ্ঠী। বাংলাদেশের মানুষ দুর্ভিক্ষ মৃত্যুর কারবারী ইস্পাহানী, হাসেমকাসেম দাদা, আদমজী হাজী দাউদ এদের চিনতাে। এসব মৃত্যু ব্যবসায়ী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃপক্ষের আসল মালিক। বাংলাদেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে এরা দিন দিন রক্তস্ফীত হয়ে উঠতে লাগল।
এই শােষণকে অব্যাহত রাখার জন্যেই চিরকাল বর্ধিষ্ণু পুঁজিপতি শ্ৰেণী জাতিসত্তা ধ্বংস করে কেন্দ্রীয় শাসন প্রবর্তনের উগ্র সমর্থক হয়ে ওঠে। সবদেশে সবকালে ভৌগােলিক সীমার মধ্যে দুর্বল জাতিগুলােকে শ্বাসরুদ্ধ করে অখণ্ড জাতীয়তার নামে এই প্রথাটি পুঁজিবাদী শােষকরা চালিয়ে থাকে।
পূর্ববঙ্গে যে সামাজিক পরিবর্তন দেখা দিল, তার পেছনে ছিল হিন্দু সামন্ত জমিদার শ্রেণীর দেশত্যাগ এবং পাকিস্তানি একজাতীয়তার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানি একচেটিয়া পুঁজি মালিক শ্রেণীর পূর্ব পাকিস্তানের অর্থে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উগ্র অনুপ্রবেশ।
বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের শতকরা নব্বই জন সাধারণ কৃষক। ক্ষুদ্র শিল্প বা হস্তশিল্প সম্পর্কে অভিজ্ঞতা প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং কলকারখানা সংগঠন করে যে ধনিক শ্রেণীর গােড়াপত্তন হয়, তা সেখানে অনুপস্থিত। সঞ্চিত মূলধনের স্বল্পপরিমাণ হেতু পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিদের পুঁজি এবং বিদেশি পুঁজির ওপরেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ নির্ভরশীল। অর্থাৎ বাংলাদেশে পুঁজি সঞ্চয়ের হার এতাে কম যে বাঙালি পুঁজিপতি শ্রেণী সরকারি পুঁজি ছাড়া বর্ধিষ্ণু হতে অক্ষম।
অন্যদিকে মধ্যশ্রেণীগুলাের মধ্যে ছােট ছােট উৎপাদক ব্যবসায়ী ও বৃত্তিজীবী শ্রেণী যথা শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সৈনিক, নাবিক এরা প্রধানত কৃষকের ঘরের সন্তান। এখনাে কৃষক শ্রেণীর সঙ্গে এদের সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। এখনাে কৃষকের সঙ্গে মধ্যশ্রেণীগুলাের সম্পর্কে নিবিড়।
শিক্ষা প্রসার ও দ্রুত সামাজিক বিকাশের মুখে এই নবােথিত মধ্যশ্রেণীগুলাে দেখেছে তাদের বিকাশ লাভের প্রধান অন্তরায় পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজি।
অন্যদিতে দ্রুত মূলধন গঠনের জন্যে তাদের একমাত্র সাহায্য দিতে পারে প্রসারিত সরকারি বিনিয়ােগ ক্ষেত্র।
ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পুনরুত্থানের প্রধান বাধা রূপে দেখা দিল পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং ততদিনে এই কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক শাসনের রূপ গ্রহণ করেছে। এই সামরিক ডিক্টেটরি শাসন জনসাধারণের সঙ্গে মৃদুতম সম্পর্কও রাখে না বা রাখতে পারে না। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনহীন অনুভূতি শাসক ও শাসিতের খােলাখুলি সম্পর্ক রেখা চাবুকের নির্মম আঘাতে এঁকে দিয়ে এই সামরিক শাসকরা দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থানে উপনীত হয়েছে। বাইরেকার অস্ত্রসজ্জা, দাম্ভিক উগ্র জনবিরােধিতা সত্ত্বেও এরা দুর্বল, কারণ জনগণ এদের বিপক্ষে।
শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার এই নব উদীয়মান মধ্যশ্রেণীগুলাের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি তাই বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক মেহনতি সকল শ্ৰেণী তার পশ্চাতে দণ্ডায়মান।
শেখ সাহেব সংবিধান পরিষদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারেন নি। কারণ পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী আগে থেকেই সংবিধানে তাদের শােষণের অধিকারকে কায়েম করার নিশ্চিত গ্যারান্টি চাইছিল। সামরিক ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খান কৌশলে, আপােষ আলােচনার মারফতে তার লক্ষ্য সিদ্ধ না হলে যে বলপ্রয়ােগে পশ্চাদপদ হবেন না, এ কথা বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের নেতা শেখ মুজিবুর বুঝতে পারেন নি এমন নয়।
আজ পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ নিজের অবস্থান রক্ষা করা সম্ভব নয় হৃদয়ঙ্গম করে স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে রাষ্ট্র বলে ঘােষণা করেছেন।
শেখ মুজিবুর উদীয়মান, মধ্যশ্রেণীগুলাের নেতা হিসেবে বাংলাদেশের জাতিসত্তার পূর্ণ সমর্থন লাভ করেছেন। কিন্তু তার নেতৃত্বের সীমারেখাও আছে। দখলদার পশ্চিম পকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে আজ তার মূল্যায়ন যুক্তিযুক্তও নয়, সম্ভবও নয়।
ইতিমধ্যেই সংগঠিত কৃষক সমিতির অশীতিপর নেতা মৌলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার ঘােষণাকে সমর্থন করে পঞ্চাশ হাজার সংগঠিত কৃষক ভলান্টিয়ারদের শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামে যােগ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। এ হলাে প্রতিরােধকে সামগ্রিক জনযুদ্ধে পরিণত করার প্রথম পদক্ষেপ।
অন্যদিকে বালুচ, সিন্ধী ও পাখতুন জাতিসত্তাগুলাে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকারের সমর্থনে এগিয়ে আসবেই। তার লক্ষণও পরিস্ফুট।
সামরিক কর্তৃপক্ষ যতই বলুন না কেন, তাদের পক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম অধিকারের জন্য বাঙালি জাতির এই দৃঢ় প্রতিরােধকে দমন করতে পারা সম্ভব নয়। কারণ যে কোনাে ঐক্যবদ্ধ জাতি যখন স্বাধিকারের জন্যে প্রাণপণ সংগ্রাম করে, তখন শক্তি সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। তখন যন্ত্রের সঙ্গে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মানুষের সংগ্রাম চলে। অর্থাৎ এই পরিবর্তিত সম্পর্ক বিরােধকে জনযুদ্ধের উন্নত স্তরে উপনীত করে।
জনযুদ্ধের বিজয় সম্পর্কে কোনাে সন্দেহ নেই। তবু এ কথা আমরা জানি পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পথ সহজ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অনেক প্রাণ, অঢেল রক্ত দানের বিনিময়েই দীর্ঘকালস্থায়ী জনযুদ্ধে জনগণের চূড়ান্ত বিজয় লাভ সম্ভব হবে।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনকে যে জনযুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে তার শিক্ষা এই যে জনগণই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের অধিকারী, অস্ত্র নয়।
চূড়ান্ত বিজয়ের উপর আস্থা রেখেই বাংলাদেশের অগণিত সাধারণ মানুষ সংগ্রাম চালাচ্ছেন। তাঁদের সাফল্য সহজ নয়। কিন্তু সুনিশ্চিত।
সূত্র: দর্পণ
০২.০৪.১৯৭১