You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ৫ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা (এবং ইউনিকোড ভার্সন)

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

পৃষ্ঠা ১

ডিসেম্বরের আগেই ঢাকায় স্বাধীন বালার পতাকা উড়বে

বিমান আক্রমণ উপেক্ষাঃ সকল রণাঙ্গনে মুক্তি বাহিনীর অগ্রগতি

(জয়বাংলার রণাঙ্গন প্রতিনিধি)

সকল রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটি সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও অসংখ্য মৃতদেহ ফেলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দ্রুতবেগে পলায়ন করছে। দলে দলে রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করছে। যশোরে হানাদারদের তিনটি চৌকি এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে।  যশোর ক্যান্টনমেন্ট দ্রুত নাটোরে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মুক্তি বাহিনীর দূর্বার অগ্রগতি দৃষ্টে আশা পোষণ করা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বরের আগেই দখলীকৃত ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ব্যাপক সফর শেষে মুজিবনগরে পৌছো বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান কর্ণেল ওসমানীও এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন একই কথা।  তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে।

মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে কর্ণেল ওসমানী বলেন,  মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে উপায়হীন হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ সম্প্রসারিত করার ও ভারত আক্রমণের চেষ্টা করতে পারে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রণাঙ্গন ঘুরে তিনি দেখেছেন মুক্তিবাহিনীর হাতে খান সেনারা বিপুলহারে ঘায়েল হচ্ছে এবং তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে। 

মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে ৩০শে অক্টোবর পর্যন্ত চারদিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ৯৫ জন হানাদার সৈন্য নিহত এবং ২১ জন আহত হয়েছে। মুক্তি বাহিনীর ৪ জন বীর শহীদ হয়েছেন। 

হানাদার সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ হয় ঢাকা – কুমিল্লা – চট্টগ্রাম সেক্টরের মোগলহাট, গোসাইগন্জ হাট,পলাশবাড়ী, জয়পুরহাট ও অমরখানায়, রংপুর  – দিনাজপুর  – রাজশাহী সেক্টরের লালমনিরহাটের উত্তর পশ্চিমে এবং কুষ্টিয়া  – যশোর – খুলনা সেক্টরের মান্দ্রা ও বাকসায়। এক্ষণে সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তীব্র লড়াই চলছে। সিলেট জেলার রাধানগর, সারিঘাট, কানাইরঘাট ছাড়াও সালুটিগড় বিমান বন্দরের কাছে প্রচন্ড লড়াই হয়। রাধানগর ও সরাইঘাটির মধ্যে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার জন্য হানাদারদের বিমান আক্রমণ চালাতে হয়। কিন্তু বিমান আক্রমণ সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। 

***

বোমাঃ বোমাঃ বোমাঃ নির্বাচনী প্রহসন খতম

১লা নভেম্বর ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের অফিসে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা প্রচন্ড বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ।  ফলে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বোমা বিস্ফোরণের পর নির্বাচনী অফিসের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। 

***

ডান্ডাবাহিনী বনাম পিপলস্ গার্ড

পাকিস্তান পিপলস পার্টি ‘পিপলস গার্ড’ নাম দিয়ে নিজ দলের একটা সেচ্ছাসেবক দল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পিপলস গার্ডের প্রধান সংগঠক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আকবর খান বলেন, পিপলস পার্টিকে অন্যরা ‘ডান্ডা বাহিনীতে ‘ সংগঠিত করে অবিরাম সন্ত্রস্ত করছে এবং চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বলে পার্টির চেয়ারম্যান জেড, এ, ভূট্টো আমাদের নিজেদের বাহিনী গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘

***

ওড়িশার ঝড়ে প্রধান মন্ত্রীর তারবার্ত্তা

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত শনিবারের ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের উপকূলবর্তী অঞ্চলে জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করেছেন। ওড়িশার রাজ্যপাালের নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় তিনি বলেছেন, দূর্গতদের প্রতি আমার জনগণ ও সরকারের মনোভাব প্রকাশের ভাষা নেই। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের এই জাতীয় ঘটনায় আমাদের যে বর্ণনাতীত দূর্দশা ঘটেছে, ওড়িশার বিপর্যয় আমাদের সেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

***

সমাধান সম্ভব নয় 

– দিল্লী মিশন

দিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন যে, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিলে বাংলাদেশ সমস্যার এখনো শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। জনাব চৌধুরী বলেন,  ‘বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।  বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে শান্তি। ‘ দৃঢ়প্রত্যয়য়ের সঙ্গে জনাব চৌধুরী বলেন ‘পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সম্ভব নয়। ‘

ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতিসংঘের সেক্রেটারি উ থান্টকে পাক-ভারত সফরে আমন্ত্রণ প্রসঙ্গে জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন,  ইয়াহিয়া খান এখন শান্তির কথা বলছেন। তার কারণ ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার ‘পরিকল্পিত হঠকারিতা’ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, এখন তিনি বুঝতে পারছেন, এতে তার নিজের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। 

জনাব চৌধুরী দৃঢতার সঙ্গে বলেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ প্রতিজ্ঞ এবং ওয়াদাবদ্ধ। এরই জন্য আমরা লড়াই করছি এবং আমরা পাক বাহিনীকে লাথি মেরে বাংলাদেশ থেকে তাড়াবো!’

সম্প্রতি এক ইটালীয় টেলিভিশন সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেন। 

মুক্তিবাহিনীর সংগঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর মধ্য থেকে মুক্তি বাহিনীর লোক সংগৃহীত হয়। এখন পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর চরম আঘাত হানবার ক্ষমতা হয়েছে। ‘

জনাব চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলে মুক্তি বাহিনী কঠোর ট্রেনিং নিচ্ছে এবং মুক্তি বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। 

তিনি বলেন যে, প্রচুর সংখ্যক যুবক মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছে। 

শরনার্থীদের মধ্য থেকে মুক্তি বাহিনীর লোক সংগ্রহ করা হয় কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাঙ্গালী মাত্রই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে উদগ্রীব।  আমরা সবাই মুক্তিবাহিনীর সদস্য। 

***

উ থান্ট সাহেব নিজেও কি জাতিসংঘ সনদের মর্যাদা রক্ষা করছেন? 

গত কয়েক দিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার এবং জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট ভারত- পাকিস্তান উত্তেজনা হ্রাসের” জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। তার মধ্যে একটা খবর প্রচারিত হয়েছে জাতিসংঘ মহল থেকে।  তাতে বলা হয়েছে যে, সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নিরসনের জন্য নিজের মধ্যস্ততায় প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছেন।

জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল পদটি সামগ্রিক কাঠামোতেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং জাতিসংঘের কার্যক্রম ও জাতিসংঘ সনদ কার্যকরী করার ব্যাপারে তার বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। তিনি কোন ‘পাওয়ার ব্লক’ বা শক্তি বিশেষের ইঙ্গিতে পরিচালিত না হয়ে একমাত্র জাতিসংঘের সনদ, মূলনীতি ও আদর্শকেই বরণ করে নিতেন তা হলে হয়তো পরস্পরবিরোধী জাতীয় স্বার্থ ও বিবদমান শিবিরের শক্তি দ্বন্দের মধ্যেও জাতিসংঘ বহু অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে পারতো, নিজের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা আরো বেশি সপ্রমাণ করতে সমর্থ হতো।

কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট বাংলাদেশ সমস্যা সহ বিভিন্ন সমস্যার প্রশ্নে নিজের কার্যক্রম ও ভূমিকার দ্বারা এ কথাই প্রমাণ করেছেন যে, তিনি নিজের পদের মর্যাদা যথোপযুক্তভাবে রক্ষা করতে পারেন নি। এমনকি তাকে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দোস্ত অথবা বিশ্বের প্রতিক্রিয়াশীল শোষক গোষ্ঠীর সমর্থক হিসেবে অভিহিত করা হলেও অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না।  তিনি মাঝে মাঝে ভালো ভালো কথা বলে নিজের রসনা ও পরের কানকে তৃপ্ত করার প্রয়াস পান বটে, কিন্তু কার্য ক্ষেত্রে তিনি তার ধারে কাছেও থাকেন না। এর কারণ হয়তো বৃহৎ শক্তিবর্গের অঙ্গুলী হেলনেই তাকে চলতে হয় অথবা তিনি যা বলেন তা বাস্তবায়নের কোন রকম ইচ্ছে নিয়েই বলেন না বা তার মনোগত অভিপ্রায়ও তা নয়৷

বাংলাদেশে মানোবতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যার ব্যাপারে দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর তিনি ওটাকে ইতিহাসের দূরপণেয় কলঙ্ক বলে অভিহিত করলেও এ ব্যাপারে নিজের বা স্বস্তি পরিষদের মাধ্যমে কিছু করতে এগিয়ে আসেন নি।

পরে অবশ্য আকারে ইঙ্গিতে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের একটা কথা সজ্ঞানেই হোক আর অজ্ঞানেই হোক বলে ফেলেছিলেন।  কিন্তু ইয়াহিয়া খানরা যেই তার উপরে ঝাপিয়ে পড়লো অমনি উ থান্ট সাহেব একেবারে এবাউট – টার্ন করে নিজের বোল ও ভেলি পাল্টিয়ে ফেললেন। শুধু তাই নয়, ইয়াহিয়ার তালে তালে কন্ঠ মিলিয়ে তিনি আসল সমস্যার ধারে কাছে না গিয়ে সীমান্তের দু ধারে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল প্রেরণের প্রস্তাবে সায় দিয়ে ইয়াহিয়াদের খুশী করার প্রয়াস পেয়েছেন। অথচ বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধের ব্যাপারে তিনি কোন কর্মপন্থার প্রস্তাব করলেন না।

(চলবে)

***

শেষ কলাম

দিল্লীতে ইয়াহিয়ার চমুদের কান্ড

২রা নভেম্বর তারিখে নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী দূতাবাস থেকে ১১ জন বাঙালী কর্মচারী তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে দূতাবাস ছেড়ে আসার সময় তাদের বেদম মারধোর করা হয়।  বাঙালী কর্মচারীদের স্ত্রীরাও এই বর্বরতা থেকে রেহাই পান নি। দূতাবাসের অন্যতম বাঙালী কর্মচারী জনাব হুসেন আলী দূতাবাস থেকে বেরুতে পারেন নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে,  তাকে হত্যা করা হয়েছে। দিল্লীর বাংলাদেশ মিশন তাকে ছেড়ে দেবার জন্য ৪৮ ঘন্টার নোটিশ পাকিস্তানী হাই কমিশনকে দিয়েছে।

***

টোকিও ও বার্নের কুটনীতিকরাও যোগ দিলেন

জাপানে পাকিস্তানী দূতাবাসের জনাব এস, এম, মাসুদ ও মহম্মদ আবদুর রহিম এবং সুইজারল্যান্ডের বার্ণে নিযুক্ত পাকিস্তানী দূতাবাসের অস্থায়ী প্রধান জনাব ওয়ালিউর রহমানও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন।

***

কেনিয়া বাংলাদেশের পক্ষে 

২রা নভেম্বর তারিখে নয়াদিল্লী থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে কেনিয়ার হাই কমিশনার এস, কে, কিমালেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও শাসন তান্ত্রিক পদ্ধতি  অবিলম্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন।

পৃষ্ঠা ২

শয়তানের মুখে খোদার নাম

কথায় বলে ‘গুতোর নাম বাবাজি’। বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর হাতে চরম মার খেয়ে পিন্ডির বর্বর জঙ্গীচক্রের নেতা ইয়াহিয়া খানের গলা ক্রমেই খাটো হচ্ছে।  এজন্যই কথায় বলা হয়, মারের মত মহাষৌধ আর নেই। শেখ মুজিবকে যিনি ফাঁসি দেবেন, শেখ মুজিব যার চোখে একজন ‘ক্রিমিনাল ‘ এবং এই সেদিন যে ইয়াহিয়া গলাবাজি করে বলেছিল, ‘বিশ্ববাসীর জেনে রাখা দরকার আমি যুদ্ধ করবো’,  এখন তার গলা থেকেই শোনা যাচ্ছে,  ‘যুদ্ধ দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান হবে না’ এবং দেশের মানুষ চাইলে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হবে।’ ইয়াহিয়া সম্পর্কে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো বলেছেন আরো মজার কথা।  তিনি বলেছেন,  ‘পার্সিপোলিসে’ ইরানের রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেলে রাজা তাকে বলেছেন, ‘ইয়াহিয়ার মাথা গরম কমে গেছে! ‘ প্রেসিডেন্ট টিটো সৌজন্য বশতঃ বাকি কথাটুকু সম্ভবতঃ বলেন নি। এই কথা হল, ‘মাতলামির ঘোর কমলে তার মাথার চাঁদি আরো ঠান্ডা হবে। ‘

আর ঠান্ডা না হয়ে উপায় কি? ৭২ ঘন্টার মধ্যে বাঙালী দের ঠান্ডা করবেন ভেবে যিনি সারা বাংলায় রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, নারীর সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন, দর্প করে বলেছেন, ‘আমার সৈন্যরা ঢাকায় ফুটবল ম্যাচ খেলতে যায়নি, তারা হত্যা করতে গেছে।’ আজ মাতলামির ঘোর কেটে যেতেই ঠান্ডা মাথায় তিনি দেখছেন, ‘৭২ ঘন্টা তো দূরের কথা, সাতমাসেও বাঙালীরা ঠান্ডা হয় নি। বরং তাদের হাতে এখন অস্ত্র। গোটা বাংলাদেশে তার ‘পেশাদার’ সৈন্যরা বাঙ্গালী অপেশাদার গেরিলাদের হাতে কচুকাটা হচ্ছে।  ট্রেনিং শেষে বাঙালী মুক্তি যোদ্ধারা এখন ইয়াহিয়ার নরপশু হায়েনা সেনাদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত।

পরাজয় অত্যাসন্নরজেনে নির্লজ্জ নরপশু ইয়াহিয়া এখন নতুন সুরে কথা বলতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বিলাতের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে ইয়াহিয়া নামক এই বেহায়া খান বলেছে, ‘আমাদের চাইতে পাঁচ গুন বড় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা কিভাবে জয়লাভ করতে পারি?’ 

বেহায়া খান জানে, তার সৈন্যদের যুদ্ধ হবে এবং হচ্ছে বাঙালী মুক্তি ফৌজের সঙ্গে। এই মুক্তি বাহিনীর হাতেই তাদের পরাজয় অবধারিত। এই অনিবার্য পরাজয়ের লজ্জা এড়ানোর জন্য বেহায়া খান এখন যুদ্ধের দায়িত্ব ভারতের কাঁধে চাপাচ্ছে।  আগে তাদের মতলবও ছিল তাই। মুক্তি বাহিনী চূড়ান্ত পাল্টা আঘাত হানলেই তারা ভারত আক্রমণ করে বসবে। কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির মুখে বেহায়ার সেই স্বপ্নও ভেঙে গেছে।  ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘এবার যদি ভারত আক্রমণ করা হয়, তাহলে লাহোর ও শিয়ালকোট ভারত দখল করে নেবে। ‘ ফলে ‘ডেইলি মেলে’র প্রতিনিধির কাছে স্বনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট বেহায়া খান যানবলেছে, তা হচ্ছে পরাজয় – ভীত এক কাপুরুষের উক্তি।  সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর যে প্রাণপ্রিয় নেতাকে বেহায়া খান ক্রিমিনাল ও প্রেইটর আখ্যা দেয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল, এখন সেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার জন্য বেহায়া খাঁন এক কথায় রাজি আছে বলে ‘ডেইলি মেলে’র কাছে জানিয়েছে।  বেহায়া খাঁ বলেছে, ‘ভারত যদি বাংলাদেশে তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে বাধ্য হয়েই তাকে যুদ্ধে নামতে হবে, যদিও পরাজয় যে অনিবার্য,  তা তারা জানে। ‘ বেহায়া খাঁ’র বেহায়া নাম এখানেই সার্থক। কারণ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে যে স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার গঠন করেছে, বেহায়া খাঁ র চোখে তারা তাবেদার, আর বেহায়া খাঁ চোখের ডাক্তার, পতিতালয়ের দালাল, বীমা কোম্পানীর দালাল, মাইনকারচরের এক কানকাটা প্রাক্তন শিক্ষক প্রভৃতি কয়েকটি আস্তাকুড়ের জীব কুড়িয়ে এনে দখলীকৃত ঢাকায় যে তথাকথিত অসামরিক সরকার গঠন করেছেে, তারা হল বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার! এ কথা শুনে ঢাকার বেগম বাজারের নবাবী আমলের আস্তাবলের ঘোড়াগুলোও যে হাসছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। 

বেহায়া খাঁ র ভাড়ামীরও সত্যই কোন তুলনা নেই। বিলাতী পত্রিকাটিতে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে সে আরো বলেছে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের প্রতি এতকাল ন্যায়সঙ্গত আচরণ করেনি। এই বৈষম্যমূলক আচরনের অবসান ঘটানোর জন্যই নতুন শাসনতন্ত্র তৈরী করা হচ্ছে। ‘

শুনে হাসবো না কাঁদবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। বাঙালীদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার জন্য নির্বাচনী রায় বন্দুকের গুলিতে উড়িয়ে দিয়ে দশ লাখ বাঙালীকে হত্যা করে এখন বেহায়া খাঁ নিজে এটি শাসনতন্ত্র জারী করতে চায়। মনে হয়, বাংলাদেশ যেন বেহায়া খাঁ র মত এক সেপাইর বাচ্চার ভিটে বাড়ির প্রজা। প্রজাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার জন্য এখননসে ফরমান জারী করবে। বেহায়া খাঁ র জেনে রাখা উচিৎ, বাঙালীরা কারো কৃপার প্রার্থী নয়। তারা তাদের অধিকার এবার অস্ত্রের মুখে আদায় করে নেবে। বাঙালীরা বুঝেছে, মিঠে কথায় চিড়ে ভেজে না। আজ যে বেহায়া খাোর মুখে এত মিঠা মিঠা বাত, তাও রামগুঁতার ফল।

বেহায়া খাঁর মাতলামীর নেশা ছুটে গিয়ে এখন তার অবস্থা কি দাড়িয়েছে,  ‘ডেইলি মেলের’ প্রতিনিধির কাছে বলা একটি কথাতেই তা স্পট হয়ে গেছে।  বেহায়া খাঁ কাতর কন্ঠে বলছে, ‘আমি খোদার কাছে প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকেও এ  কথাটা বুঝতে দেন স্বাধীন বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তানকেই খন্ড খন্ড করবে না, ভারতের জন্যও তা হবে সর্বনাশের সূচনা ।  হায় বেহায়া খাঁ!

এতদিন খুঁটির জোরে ভেড়ার মত নেচে এখন মুখে খোদার নাম। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সর্বজবন্দীত নেত্রী।  তিনি গণতান্ত্রিক ভারতের নেতা। তিনি ভালোভাবেই জানেন, ভারতে গণতন্ত্রের বিপদ কখনোই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের কাছে থেকে কোনদিনই সূচনা হবে না। এই বিপদ সর্বক্ষণের হুমকির মত ঝুলে আছে পাকিস্তানের বর্বর ফ্যাসিবাদী মিলিটারি ডিক্টেটরশিপের কাছ থেকে। ঘরের পাশে নগ্ন ও বর্বর ফ্যাসিবাদ ভারতের গণতন্ত্রের জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি। পাকিস্তানে এই ফ্যাসিবাদের কবর রচনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ই এশিয়ায় গণতন্ত্র, শান্তি ও সমৃদ্ধির নবযুগ সৃষ্টি করবে। অন্ধকারের পেঁচা বেহায়া খাঁ এই আলোর উদার অভ্যুদয়ের সম্ভাবনাতেই আজ চেচামেচি শুরু করেছে। শয়তানের কাতর কন্ঠে আজ খোদার নাম।  আর শয়তানের মুখে কখন খোদার নাম শোনা যায়, তা আমাদের মত বিশ্বের সকল মানুষের জানা আছে – সে হল শয়তানের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পূর্বক্ষণ। 

***

যা দেখছি, যা ভাবছি

-আবদুল গাফফার চৌধুরী

প্যারিসে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লার মৃত্যু আকস্মিক।  যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে অপরিণত বয়সে এই মৃত্যু,  তাকে অনেকটা নির্বাসিত কিংবা দেশত্যাগী কোন রুশ সাহিত্যিকের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা চলে।

দেশত্যাগী বা নির্বাসিত কোন রুশ সাহিত্যিকের উদাহরণ টানলাম এই জন্য যে, প্রবাস জীবনে লেখা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর দুটি উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা ‘ ও কাঁদো নদী কাঁদো’ পাকিস্তানে আইয়ুব সরকার আমলের সরকার নিয়ন্ত্রিত  রাইটার্স গিল্ড এস্টাবলিশমেন্টের ছায়ায় পালিত বুদ্ধিজীবীরা খুব ভালো ভাবে গ্রহন করতে পারেন নাই। অবশ্য ঢাকার সাহিত্যিক মহলে অনেকেই খুশী হয়েছিলেন। এমন কি বই দুটি প্রকাশের পর কেউ কেউ তা খুশী মনে গ্রহনও করেছিলেন। কিন্তু যেই প্রকাশ পেল ফরাসী প্রতীকিবাদের আড়ালে ‘চাঁদের অমাবস্যা ‘য় আসলে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার হন্তাচরিত্র সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ করা হয়েছে, অমনি ঢাকার একটি আধা সরকারী পত্রিকা ঝটিতি বইটির প্রেসে দেয়া সমালোচনা প্রত্যাহার করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সরকারী চাকরী করতেন। এই সরকারী চাকরী উপলক্ষেই তার প্যারিস গমন, ফরাসী স্ত্রী গ্রহন এবং ফ্রান্সে দীর্ঘকাল অবস্থান।  ষাট দশকের মাঝামাঝি যখন তিনি ঢাকায় তার তার প্রকাশকের কাছে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ পান্ডুলিপি পাঠান, তখন এক কবি বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘ফ্রান্স আমার দ্বিতীয় স্বদেশ। বাংলাদেশ প্রথম। এই প্রথম স্বদেশে যখন সর্ব প্রকার নাগরিক অধিকার ও মনুষ্যত্ব বোধের ‘চাঁদে গ্রহন’ লাগার খবর পাচ্ছি,  তখন চাঁদে অমাবস্যাই আমার কাছে বোধগম্য সত্য।  ‘

তার উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ তে সাঁত্রের অস্তিত্ববাদের প্রভাব স্পষ্ট।  সম্ভবতঃ গত বছরের ঠিক এই সময়টাতেই প্যারিস থেকে সস্ত্রীক ঢাকায় এসেছিলেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। আইয়ুব সরকার তখন অপসারিত। তাই সরকারী সংস্থা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ভবনেই তাঁর সাদর সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলেন ঢাকার সাহিত্যিকরা। তখনও কেউ ভাবেনি, এই তাঁর শেষবারের মত স্বদেশ ফেরা। মৃত্যুকালে তার বয়স মাত্র পন্চাশ বছর হয়েছিল। কিছুদিন আগেও তিনি মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের এক সাহিত্যিকের কাছে চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ফ্রান্সে কিভাবে জনমত তৈরী হচ্ছে।  আরও একটি খবর দিয়েছিলেন তিনি সেই চিঠিতে, বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী রশীদ চৌধুরী ঢাকা থেকে পালিয়ে নিরাপদে প্যারিস পৌছেছেন।

ওয়ালিউল্লাহর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা বেশিরভাগ গল্প। তাতে গ্রামীণ চরিত্রের ভীড়। বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ তখনো গড়ে ওঠেনি, শহুরে জীবন তো নয়ই। ফলে সাহিত্যে তার প্রতিফলন কম। তিরিশ ও চল্লিশের দিকে কিছুটা বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্তের টাইপ চরিত্রের ছাঁচে মুসলমান মধ্যবিত্ত চরিত্র তৈরী এবং তাতে নাগরিকতার প্রলেপ দিতে চেয়েছিলেন আবুল ফজল ও আবু রুশ্দ। তারা খুব সফল হননি। তাদের এই আপাত ব্যর্থতা বাংলাদেশের কথাশিল্পেও কিছু কালের জন্য ভাঁটার টান সৃষ্টি করে।  এই ভাঁটার টান ফিরলো ‘যুদ্ধ ও মন্বন্তরের যুগে’।  ফেরালেন মূলত তিনজন কথাশিল্পী,  সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম ও শওকত ওসমান।

 শওকত ওসমানের জন্ম পশ্চিম বঙ্গে। তার প্রথম দিকের উপন্যাস ভীড় জমালো বাঙালী মুসলমান চাষী, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্ত।  ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তার লেখায় চরিত্র ও পরিবেশের বিস্তৃতি বাংলাদেশের সীমান্ত পেরুলো। শামসুদ্দিন আবুল কালাম প্রথম দিকে প্রভাবিত হলেন অচিন্তকুমার দ্বারা। অচিন্তকুমার দীর্ঘকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর ও মহকুমা শহরে জজিয়তি করেছেন। মামলা মোকদ্দমা উপলক্ষে বিভিন্ন বাঙালী মুসলমান চরিত্রের সংস্পর্শে এসেছেন।  এই পরিচয়েরই প্রথম ফসল ‘যতন বিবি’ গল্পগ্রন্থ। শামসুদ্দিন আবুল কালামের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘শাহেরবানু’তে এই ‘যতন বিবি’ র প্রভাব সুস্পষ্ট। 

সৈয়দ ওয়ালিউল্লার ‘নয়নচারা’ এদিক থেকে একটি উল্লেখ্য  ব্যতিক্রম।  গল্পের নাম নির্বাচনে তিনি ছিলেন তখনকার দিনে অতি আধুনিক, যেমন বক্র চাঁদের খন্ডতায়’।  কিন্তু চরিত্র সৃষ্টি ও গল্পের আখ্যান ভাগে তিনি ছিলেন বিষয়ানুগ ও চরিত্রের স্বধর্ম অনুসারী। কোন নির্দিষ্ট ভঙ্গি, স্টাইল বা চরিত্র-নির্মাণ-কৌশল দ্বারা তিনি প্রভাবিত হননি। বাঙলা গল্পের যুদ্ধকালীন পরিবর্তনশীল সাধারণ ফরম দ্বারা প্রথম দিকে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু সর্বত্র যথাযথ ভাবে তা মেনে চলেন নি।

সৈয়দ ওয়ালিউল্লার সবচাইতে জনপ্রিয় অথচ বিতর্কমূলক উপন্যাস ‘লালশালু’। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাতেও এই উপন্যাসটি অনুবাদ হয়েছে৷ বাঙালী মুসলিম নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে ধর্মের ভন্ডামি ও তার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োগের উপকথা এই লালশালু। দেশ ভাগের অব্যবহিত পরে পন্চাশের গোড়ায় – ঢাকায় গণসাহিত্যের নামে বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনশ্রেয়ী সাহিত্যের তখন প্রবল প্রতাপ৷ এই ‘গণ সাহিত্য পন্থী’ কয়েকটি পত্রিকায় রায় দেয়া হলে লালশালু প্রতিক্রিয়া পন্থী রচনা। কারণ, লালশালুতে যে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার কথা বলা হয়েছে,  বাংলাদেশের ‘জঙ্গী জনতা’  তাকে অতিক্রম করে এখন লড়াইয়ের মাঠে নেমেছে। এই উগ্র সমালোচনা অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। বাংলাদেশের পাঠক সাগ্রহে ‘লালশালু’কে গ্রহন করেছে, সমালোচনা – সাহিত্যে উপন্যাসটির বিশেষ স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে।  তবু ‘লালশালু’র বিপদ কাটেনি। ১৯৬১ সালে ‘লালশালু’ ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে স্পেশাল বেঙ্গলির পাঠ্যবই হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল৷ শিক্ষা কর্তৃপক্ষ অকস্মাৎ বইটির মনোনয়ন বাতিল করেন। অভিযোগ অশ্লীলতা।  সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তার একটি ছোট বই গল্পের বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘স্তন’. ঢাকার প্রকাশকের সকাতর অনুরোধে এই নামটিও তিনি বদলে দেন। শুধু গল্প উপন্যাস নয়, নাটক রচনাতেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার মন্চ – সফল বেশ কটি নাটক আছে৷ প্যারিসের শিল্পী মহলে তার আঁকা কটি ছবিও উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে।  লালশালু’র ইংরেজি সংস্করণের প্রচ্ছদ তার নিজের আঁকা৷

চল্লিশের গোড়ার দিকে যে তিনজন কথাশিল্পী কথা শিল্পে নবযুগের অগ্রপথিক হয়েছিলেন, তারা সকলেই আজ দখলীকৃত বাংলাদেশ ছেড়েছেন। শামসুদ্দিন আবুল কালাম বহু বছর আগে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে মনান্তর ও মতান্তরের জন্য দেশত্যাগী ও রোম প্রবাসী।  সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ চাকরি উপলক্ষ করে হলেও এতদিন ছিলেন প্যারিসে – সম্ভবতঃ সেচ্ছা নির্বাসনে। এই তিন বন্ধুর শেষ বন্ধু শওকত ওসমান গত পঁচিশে মার্চের পর ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাই এ কথা বলা কি আজ অতিশয়োক্তি যে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি বেগবান ধারাই আজ মুক্তিযুদ্ধে সামিল?

পৃষ্ঠা – ৩

শেরে বাংলার জন্মদিনে

(২৬শে অক্টোবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত)

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) শেরে বাংলার মৃত্যুর দু বছর আগে – তার জন্মদিনের একটি ইন্টারভিউর গল্প বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করবো। শেরে বাংলা তখন অসুস্থ।  শয্যাশায়ী।  তবু আমরা ক’ বন্ধু গিয়েছিলাম তার বাড়িতে তাকে দেখতে। এ কথা সে কথা, অনেক কথার পরে রাজনীতির কথা উঠলো। শেরে বাংলা হঠাৎ উত্তেজিত হযএ বলে উঠলেন, ‘আমাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বার বার বলা হয়েছে আমরা ভারতে দালাল। আমি বলে রাখছি, মুজিবকেও ওই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হবে। কারণ, সে বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য আমাদের চাইতেও আপোষহীন।  আমরা বুড়ো হয়েছি। তাই আপেষপন্থী। কিন্তু মুজিব তরুণ। তার রক্তে আগুন আছে। সে কিছুতেই পিন্ডির মুসলমান নামধারী শয়তানদের সাথে আপোষ করবে না। ফল কি হবে আমি জানি না। গায়েবের মালিক আল্লাহ জানেন। ‘  একটু থেমে বৃদ্ধ জননেতা বললেন, ‘পাকিস্তান ও মুসলমানের শত্রু ভারত নয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক বিবাদ থাকতে পারে, তা মিটে গেলে বন্ধুত্বও হবে। কিন্তু পাকিস্তান ও মুসলমানদের বড় শত্রু রয়েছে মুসলমানদের মধ্যে এবং পাকিস্তানেই।

আমরা বললাম, তারা কারা?

শেরে বাংলা বললেন, ইসলামের গোড়ার দিকে মহানবী এবং ইসলামকে ইহুদি ও খৃষ্টানদের কাছ থেকে বহু আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু ইহুদি কিংবা খৃষ্টানরা নবী বংশ ধ্বংস করেনি – খেলাফৎ বা ইসলামী গণতন্ত্র ধ্বংস করে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র স্থাপন করেনি। করেছে একজন মুসলমান, তার নাম এজিদ। কারবালায় মুসলমানদের রক্তে সে ফোরাত নদী লাল করে দিয়েছে। আমিও পাকিস্তানেও গণতন্ত্র ধ্বংস কারী এবং মুসলমান হত্যাকারী মুসলমান এজিদের আবির্ভাব আশঙ্কা করছি। বাঙালীরা চাইবে দেশে গণতন্ত্র থাকুক। সে চাইবে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং এজন্যে ইসলামের নাম নিয়ে সে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের গলা কাটবে – পাকিস্তান তার হাতেই ধ্বংস হবে। এজিদ নবী বংশ ধ্বংস করার পরেও  – খেলাফৎ বা গণতন্ত্র ধ্বংস করার পরও তার নামে মসজিদে খোৎবা পড়ার জন্য যেমন মোল্লার অভাব হয় নি, তেমনি পাকিস্তানের এজিদকেও সমর্থন করার জন্য আলেম নামধারী একদল মোল্লার অভাব হবে না।

ন’ দশ বছর আগে রুগ্ন, মৃত্যু পদযাত্রী শেরে বাংলার মুখে এই কথাগুলো শুনে মনে হয়েছিল, অসুস্থ মনের বিকার বা প্রলাপ। কিন্তু সেদিন বুঝিনি, কি ভয়ংকর সত্যের দিকে আমাদের চোখ ফেরাতে চাইছেন।

গত ২৫শে মার্চের পর ইয়াহিয়ার জল্লাদ সৈন্যদের ভয়ে যখন গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, চোখের উপর দেখছি নিষ্ঠুর, বর্বর হত্যাকাণ্ড,  দেখছি আজান রত মুয়াজ্জিনকে গুলি খেয়ে মরতে, দেখেছি মসজিদ পুড়ে যেতে – তখন শেরে বাংলার সেই ভবিষ্যদ্বানী আমার কানে যেন দৈববাণীর মত বেজে উঠেছে। তখন বুঝেছি, ইয়াহিয়া তো ইয়াহিয়া নয়, এ তো কারবালার সেই খুনী এজিদ। ইয়াহিয়ার অভিযানও খেলাফৎ বা গণতন্ত্র ধ্বংস করার।  তারও সমর্থক জুটেছে আরে খুনী মোল্লা মওদুদীর শয়তান চেলারা। ধর্মের নামে পবিত্র ইসলামের নাম ভাঙিয়ে এরা আজ দেশে স্বৈরতন্ত্র, খুনীর রাজত্ব কায়েমের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। কিন্তু খেলাফতের যে মর্যাদা – গণতন্ত্রের যে পতাকা উড্ডীন রাখার জন্য বারোশ বছর আগে মহানবীর নয়নমণি হযরত ইমাম হোসেন মুসলমান এজিদের ঘৃণ্য শয়তানীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র হয়েও রুখে দাড়াতে দ্বিধা করেননি, আজ বারোশ বছর পরেও সেই একই আদর্শের প্রেরণায় খুনী মুসলমান ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে – বিংশ শতাব্দীর ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হোসেনের পবিত্র আদর্শের অনুসারী বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রুখে দাড়িয়েছেন। কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতায় ইমাম হোসেন সেদিন যেমন টলেননি, তেমনি মালেক, সোলাইমান, ফরিদ আহমদ বা মাহমুদ আলীর মত কয়েকটি দ্বিপদ বিশিষ্ট উচ্ছিষ্ট ভোগী বাঙালীর বিশ্বাসঘাতকতায় শেখ মুজিব বা বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল নষ্ট হওয়ার কিছু নেই। শেরে বাংলা বাংলাদেশের মানুষের অধিকার অর্জনের জন্য যে সংগ্রামের সূচনা করে গেছেন, বঙ্গবন্ধু তাকেই পূর্ণ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাই আজ শেরে বাংলার জন্মদিনে তার পুতস্মৃতির প্রতি আমরা সংগ্রামী অভিনন্দন জানাই। শেরে বাংলার জয় হোক, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হোন – জয় বাংলা।

***

মুজাফর ন্যাপের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব

সম্প্রতি বাংলাদেশের কোন এক জায়গায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মুজাফর ন্যাপ) ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা সমাপ্ত হয়। সভায় কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। তন্মধ্যে এক প্রস্তাবে দলের পূর্ব ঘোষিত পুনরুক্তি করে স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন কিছুই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না।  প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়।

অপর এক প্রস্তাবে ভারত সোভিয়েট মৈত্রী চুক্তিকে অভিনন্দিত করে বলা হয় যে, এটা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে সহায়ক হয়েছে।

বর্ধিত সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবীতেও একটা প্রস্তাব গৃহীত হয়।  তাতে বলা হয় যে, শেখ মুজিবর রহমানের বিচারের কোন অধিকার ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার নেই। প্রস্তাবে তার মুক্তির ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। 

প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান ন্যাপের’ সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহমুদুল হক ওসমানীরও মুক্তি দাবী করা হয়। 

***

স্বাধীনতাই একমাত্র সমাধান

বাংলাদেশের আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে কেন্দ্র করে।  গত নির্বাচনে সমস্ত বাংলাদেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ করে যে, তারা স্বায়ত্তশাসন চায়। এই দাবীর ভিত্তিতেই তারা চায় পাকিস্তানের সংবিধান নতুন করে রচনা করতে। এর ভিত্তিতেই চলছিল আলোচনা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক চক্র চায় বাঙালীর এই দাবীকে রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে। ফলে আরম্ভ হয় আজকের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। বর্তমান যুদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার আর কোন সমাধান সম্ভব নয়।  যুদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, বাঙালীদের পক্ষে পাকিস্তানের সঙ্গে আর একরাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে বসবাস করা সম্ভব নয়। 

বাঙালী জাতির কাছে তাদের দাবীর ন্যায্যতা সম্পর্কে এখন আর কোন সংশয় নেই। বহু ঘোষিত রাষ্ট্র গঠনের নীতির ওপর ভিত্তি করেই তারা করে চলেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধ।  Ethnographic principle  – হল তাদের আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের যুক্তি। আর এ যুক্তি আজ থেকে অনেকদিন আগেই সমর্থন করেছেন ইউরোপের রাজনৈতিক দার্শনিকরা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। তাই বাঙালীদের দাবী বাইরের বিশ্বের পক্ষে বুঝতে পারা অনেক সহজ। বাইরের বিশ্বের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ভৌগোলিক অযৌক্তিকতারও বিরাট ভাবে প্রকট। তাই বিশ্বজনমত আজ স্বাধীন বাঙলা দেশের পক্ষে।  বাঙলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানাচছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সাধারণ মানুষ।

বাঙ্গালীরা আজ সামরিক দিক থেকে বহুগুণে শক্তিশালী। মুক্তি বাহিনীর অস্ত্রবল, জনবল ও সংগঠন আজ হয়ে উঠেছে বহুগুণ উন্নত। মুক্তি বাহিনীর শিক্ষা, অস্ত্রবল, জনশক্তি ও সংগঠন, সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে অন্য যে কোন দেশের অনুরূপ অবস্থায় গঠিত বাহিনীর চাইতে হীন নয়। এখন তারা সর্বাধুনিক অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে। বিদেশী সাংবাদিকরাও তাদের মনোবল ও রণকৌশলের প্রশংসা না করে পারছেন না। সারা বাংলাদেশ জুড়ে চলছে মুক্তি বাহিনীর অভিযান। বিদেশী পত্রিকার খবর অনুসারে  প্রায় ৬০ হাজার সুশিক্ষিত বাঙালী গেরিলা লড়াই করছে বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।  চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে কমপক্ষে সাতটি জাহাজ ডুবির কথা আজ বিদেশী পর্যবেক্ষক দ্বারাও সমর্থিত হয়েছে। এই জাহাজ ডুবীর ফলে বাংলাদেশের বন্দরে আসতে চাচ্ছে না বিদেশী বানিজ্য জাহাজ।  পাকিস্তানগামী জাহাজের এখন বিদেশী কোম্পানিতে ইনশিওর করতে লাগছে প্রায় দ্বিগুণ টাকা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লজিস্টিকের সমস্যা তাই আজ হয়ে উঠেছে আগের চাইতেও বেশী। সারা বিশ্ব আজ জেনে ফেলেছে,  বাঙলাদেশের কাদামাটিতে পাক ফৌজের সঙ্গীন অবস্থার কথা। 

বিশ্ব এখ জেনে গিয়েছে যে বাঙালী জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধের পশ্চাতে।  সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন সারা বাঙলাদেশের সর্বত্র উড়বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজয় পতাকা।

বিদেশী সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাঙলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধানকে স্বীকার করবেন না বলে ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গীচক্রকে জানিয়ে দিয়েছেন।  বঙ্গবন্ধু আজ শত্রুর কারাগারে।  কিন্তু তবু তিনি জানেন বাঙলাদেশ কি চায়। বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক তিনি। অটল প্রতিজ্ঞায় তিনি অবিচল। অবিচল সমগ্র বাঙালী জাতি। জয় বাংলা! 

***

নিক্সনের “দ্বিতীয় সর্বোত্তম সমাধান ” বনাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা

– মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) এমতবস্থায় মার্কিন সরকার কেন অনুরূপ উদ্যোগ কনেছেন তার কারণ অবশ্য আলোচ্য সংবাদটিতেই আছে। এ  প্রসঙ্গে জনৈক মার্কিন সরকারী কর্মকর্তা নাকি জানিয়েছেন যে নিক্সন সরকার দ্বিবিধ কারণে এই উদ্যোগ নিয়েছেন।

প্রথমতঃ মার্কিন সরকার স্পষ্ট ভাবেই বুঝতে পেরেছে যে, ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তা এড়াতে চান।

দ্বিতীয়তঃ মার্কিন সরকার চায় না এশিয়ায় এমন কিছু ঘটুক, যার ফলে নিক্সনের প্রস্তাবিত পিকিং সফর বাতিল হয়ে যেতে পারে। 

মার্কিন সরকারী কর্মকর্তা যে ভাবে ‘দ্বিতীয় সর্বোত্তম” মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহনের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তাতে মনে হয় বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের জন্য নয়, বরং অন্য উদ্দেশ্যেই নিক্সন সরকার উদ্যোগটা নিয়েছেন। তিনি বা তার সরকার ধরে নিয়েছেন যে ভারত পাকিস্তানের উত্তেজনা হ্রাস পেলেই তার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে।  বাংলাদেশ সমস্যার তার পরে কি হলো না হলো, তাতে তার কিম্বা তার সরকারের কিছু যায় আসে না। অন্য কথায় বলতে গেলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের দাবীটাই ভিন্নরূপে বাজারে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন।

বাংলাদেশ সমস্যা যে আসলে ভারত – পাকিস্তানের কোন সমস্যা নয়, এবং তা যে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকারই একটি সমস্যা, মনে হয় নিক্সন সাহেব তা আজও বুঝতে পারেন নি। অথবা পারলেও তা তিনি বুঝতে পারছেন না নিজেদের গরজে৷ কিন্তু তিনি বুঝুন আর না বুঝুন, বিশ্বের সমস্ত বিবেকবান মানুষই আজ বুঝতে পেরেছেন সমস্যাটা আসলে কি এবং কাদের মধ্যে।  সুতরাং ভারত – পাকিস্তানের উত্তেজনা হ্রাস পেলে বা এই দেশ দুইটির মধ্যে যুদ্ধ এড়ানো গেলেও যে বাংলাদেশে যুদ্ধ থামবে না, বরং তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে, নিক্সন সরকারের তা অবশ্যই আজ জানা ও বোঝা উচিৎ। কেননা বাংলাদেশ আজ যে যুদ্ধ করে চলেছে, তা কারো বিশ্ব স্ট্র্যাটেজির স্বার্থে শুরু হয় নি। বরং সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাঁচার তাদিদেই তা শুরু হয়েছে।  এবং ২৫শে মার্চের পর সেখানে যা ঘটে গেছে তার প্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একত্রে বসবাসের আর কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

কিন্তু নিক্সন সরকার কেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের রক্তলোলুপ জেনারেল গুলোকে তোয়াজ করে চলেছেন তা আমাদের কেন মার্কিন জনগণেরও বোধগম্য নয়। ইয়াহিয়া – চক্র কতৃক মার্কিন সরকারের সর্বোত্তম সমাধান (যদিও তা বাঙালীর কাছে গ্রহনযোগ্য নয়)প্রত্যাখাত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উচিৎ ছিল নরম হওয়ার বদলে তাদের প্রতি কঠোর হওয়া।  কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং তার “দ্বিতীয় সর্বোত্তম ” সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা কি ইয়াহিয়া চক্রকে তোয়াজ করা নয়? 

অথচ নিজেদের মান মর্যাদার প্রশ্ন ছাড়াও নিক্সন সরকারের অন্য কারণেও ইয়াহিয়া সরকারের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহন করতে বাধ্য।  এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব তো বটেই। কেননা, নিক্সন সাহেবদের দেয়া অস্ত্র দিয়েই ইয়াহিয়ারা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে।  অথচ ‘কম্যুনিস্ট হামলা প্রতিরোধ’ বা দেশে ‘কম্যুনিস্টদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ‘ দমনের জন্যই পাকিস্তানকে দেয়া হয়েছিল মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশে যা ঘটছে তার সাথে এর কোনটারই কোন সম্পর্ক নাই। সুতরাং নিক্সন সরকারের উচিৎ ছিল নরম না হয়ে বরংদ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথা গরম জেনারেল চক্রের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহন করা। তাহলে তারা বাধ্য হতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবী মেনে নিতে। সারা বিশ্ব যেমন জানে তেমনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন সাহেবও জানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সরবরাহকৃত অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে কঠোর মনোভাব গ্রহন করলে এবং আর্থিক সাহায্য না দিলে পশ্চিম পাকিস্তানের রক্তলোলুপ জেনারেল দের পক্ষে বাংলাদেশে একদিনও যুদ্ধ চালানো সম্ভব নয়। 

দ্বিতীয়তঃ মার্কিন সরকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা চান না যে এশিয়ায় এমন কিছু ঘটুক যার ফলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাবিত পিকিং সফর বানচাল হয়ে যেতে পারে।

প্রেসিডেন্ট নিক্সন আগামী মে মাসের দিকে পিকিং যাবেন। তার এই সফরের উদ্দেশ্যও হয়তো মহৎ। কিন্তু তিনি বা তার সরকার কি বলতে চান যে এশিয়ায় ইত্যবসরে তেমন কিছু ঘটেনি। ১০ লক্ষাধিক নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা,  প্রায় এক কোটি মানুষকে চৌদ্দ পুরুষের ঘর বাগী ত্যাগ করতে বাধ্য করে তাদের ভিটায় ঘুঘু চরানোর ব্যবস্থাটা কি তেমন কোন ব্যাপার নয়? বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে বাঙালী মুক্তি বাহিনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কি একাবারেই পরের বিশ্ব  স্ট্র্যাটেজির স্বার্থে চাপা দেবার কোন ব্যাপার? 

সুতরাং প্রেসিডেন্ট নিক্সন জেনে রাখতে পারেন যে কারো বিশ্ব স্ট্র্যাটেজির স্বার্থে মুক্তি পাগল বাঙালী তাদের জীবন মরণের প্রশ্নকে এক দিনের জন্যও হিমাগারে নিক্ষেপ করতে রাজী নয়৷ তারা ইয়াহিয়ার সেনা বাহিনীকে আরো ৭ মাস নির্বিচারে বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালাতে দিতে পারে না। যত রক্তেরই প্রয়োজন হোক না কেন তারা নিজেদের মুক্তি যুদ্ধকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। 

পৃষ্ঠা ৬

লাখো লাখো লোককে ভিন্ন দেশে তাড়িয়ে দেয়া সেদেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনেরই সামিল

গত ২৭ শে অক্টোবর ভারতের তরফ থেকে জাতিসংঘকে  জানানো হয় যে, পাকিস্তান সুপরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ চালাচ্ছে।

ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেন বিশ্ব নিরাপত্তা সম্পর্কে জাতিসংঘের প্রথম কমিটিতে বাংলাদেশে সংঘটিত লোমহর্ষক ঘটনাবলীর উল্লেখ করেন এবং বলেন একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (পাকিস্তানের) কার্যক্রমের ফলে ভারতের ঘাড়ে একটা দুর্বিষহ বোঝা চেপেছে। আবার সেই দেশটাই ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। 

শ্রী সমর সেন বলেন, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক কোন ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে ভারত – পাক উপমহাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে কিছুতেই উপেক্ষা করা যাবে না।

 বাংলাদেশে যা ঘটছে বা ঘটেছে তা সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার এবং তাতে নাক গলানোর কোন অবকাশ নাই বলে পাকিস্তানের প্রতিনিধি যে দাবী করেছেন, শ্রী সমর সেন তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন।  এ প্রসঙ্গে শ্রী সেন বলেন, কোন দেশের অভ্যন্তরের সংগঠিত ঘটনাবলী সে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিজস্ব ব্যাপার তাতে কোন দ্বি – মতের অবকাশ নেই, কিন্তু সে সব ঘটনাবলীতে যদি অন্য দেশ গুরুতর রকমে বা উল্লেখযোগ্য রকমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তা আর আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়ে থাকে না।

শ্রী সমর সেন বলেন, চরম পাশবিক শক্তি প্রয়োগে কোন রাষ্ট্র যদি সামরিক এবং মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করতে থাকে এবং গণহত্যা সংগঠন করতে থাকে, তাহলে ওটাকে আর কারো আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলা চলে না।

তিনি বলেন, সামরিক শক্তির ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানের সমর নায়করা ক্রমাগত ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে।  তাদের এসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভারতকে বাংলাদেশ সমস্যায় জড়ানো এবং সাধারণ মানুষের মনে ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করা।

শ্রী সেন জোরের সাথে বলেন, পাকিস্তানের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বিচার ও ব্যাপকভাবে গণহত্যার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে ভীতি  ছড়ানো যাতে তারা চিরকালের মত সেখানকার মানুষকে তাদের প্রতি  ‘জ্বী হুুজুর’ শ্রেণী পরিণত করতে পারে। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে খতম করেছে এবং লাখো লাখো লোককে খুন করেছে।

শ্রী সমর সেন বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে লাখো লাখো মানুষের সীমাহীন স্রোত বয়েই চলেছে। তার শিকার হয়েছে ভারত। এ দেশটা যদি ভারত না হয়ে অন্য কোন ক্ষুদ্র ও দূর্বল দেশ হত তা হলে তার অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় খন্ডত্ব এতোদিনে ধ্বংস হয়ে যেত৷ দুনিয়াতে এমন রাষ্ট্রের সংখ্যা অতি অল্প যারা নব্বই লক্ষাধিক শরনার্থীকে স্থান দিতে পারে। শুধু তাই নয়,  এখনো প্রতিদিন হাজারে হাজারে শরনার্থী ভারতে প্রবেশ করছে।

তিনি বলেন, পাশবিক শক্তি প্রয়োগে লাখ লাখ লোককে অন্য দেশে তাড়িয়ে দেয়া আঞ্চলিক অখণ্ডত্ব লঙ্ঘনেরই সামিল। সামরিক অভিযানের মাধ্যমে অন্য দেশের রাষ্ট্রীয় খন্ডত্ব লঙ্ঘনের সাথে এর কোন তফাত নেই, কেন না, উভয় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠে।

শ্রী সমর সেন বলেন, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ঘোষণায় অন্যের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং পরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার উপরে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

তিনি জিজ্ঞেস করেন, লাখো লাখো লোককে সীমান্তে অপর পারে ঠেলে দেওয়া কি পরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নয়?

পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপার তাদের দায়িত্ব কোন ভাবেইএড়াতে পারে না৷ লাখো লাখো মানুষের আগমনের ফলে ভারতের যে ক্ষতি হয়েছে তার দায়িত্ব পাকিস্তানকেই নিতে হবে। তবে পাকিস্তান যদি বলতে চায় যে, বাংলাদেশের ওপরে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নাই বা বাংলাদেশের উপরে তার কোন সার্বভৌমত্ব নাই সেক্ষেত্রে সে দায়িত্ব এড়াতে পারে।

শ্রী সমর সেন বলেন, বাংলাদেশে সামরিক কার্যক্রম শুরু করার পর থেকেই পাকিস্তান ভারতের আঞ্চলিক অখকন্ডত্বের বিরূদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিয়ে আসছে৷ অথচ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা  ঘোষণায় অনুরূপ কাজ বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ। 

শ্রী সমর সেন বলেন, পাকিস্তানের অনুরূপ কার্যকলাপের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে তাদের পরিচালিত দমনমূলক ব্যবস্থা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করতে চেষ্টা করা। এবং ভারতকে বাংলাদেশের ঘটনার সাথে যুক্ত করা।

***

বিশ্বজনমত

যে কোন মিমাংসা আওয়ামী লীগের সাথেই করতে হবে – ভারতের সাথে নয়

বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজ উইকে প্রকাশিত একটি মানচিত্রে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর অবস্থান  – সমূহ দেখানো হয়েছে।  বলা হয়েছে, পাক বাহিনী মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধাদের হাতে বিশেষভাবে নাজেহাল হচ্ছে।  সারা বাংলাদেশ জুড়ে প্রায় ৫০ হাজার গেরিলা যুদ্ধ করে চলেছে এবং বিশেষজ্ঞ দের মতে, রণক্ষেত্রে বাঙালী গেরিলা যোদ্ধাদের সাফল্য ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

পাক ভারতের যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে পত্রিকায় বলা হয়েছে,  যুদ্ধ বাঁধা অসম্ভব নয়। কারণ, পাক জঙ্গী রাজের মতিগতি সম্পর্কে কিছুই আগে থেকে বলা যায় না। পাক ভারত সীমান্তের সর্বত্রই সেনা সমাবেশ ঘটছে। পশ্চিমী বিশেষজ্ঞদের গোপন সূত্রে পাওয়া খবর থেকে জানা গেছে যে, কাশ্মীর অঞ্চলে পাকিস্তান প্রচুর পরিমাণ ছদ্মবেশী অনুপ্রবেশ কারী পাঠাচ্ছে।

ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক শক্তির তুলনামূলক হিসাব দিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তান তার বিমান বন্দরে জঙ্গী বিমানের দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের বিমান বন্দরে রয়েছে ৬০ টি আধুনিক ফরাসি মিরাজ বিমান। কিন্তু ভারতের বোমারু বিমানের সংখ্যা পাকিস্তানের দ্বিগুণ। ভারতের ট্যাংকের সংখ্যাও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি, ভারতের রয়েছে পাকিস্তানের চাইতে দ্বিগুণ সংখ্যক ট্যাংক।  এছাড়া ভারত সোভিয়েট রাশিয়ার কাছে থেকে প্রচুর পরিমাণ মারণাস্ত্র লাভ করেছে। ভারতের মোট সৈন্য হলো ১ লাখ। অন্য দিকে পাকিস্তানের মোট সৈন্য সংখ্যা ৪, ৫০, ০০০।  পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে, একজন মার্কিন কুটনীতিক বলেছেন, পাক – ভারত যুদ্ধ বাঁধলে পাকিস্তান সবকিছু হারাবে।

(নিউজ উইক, ১লা নভেম্বর)

মুক্তি ফৌজ দমনে পাক ফৌজ ব্যর্থ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা  ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর ২৮শে অক্টোবর সংখ্যায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, পাক বাহিনী মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা রোধে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকা ও ফরিদপুরের গ্রামে মুক্তি বাহিনী বিস্তীর্ণ এলাকা তাদের দখলে রেখেছে ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা চালু করেছে। ঐ পত্রিকার ঢাকাস্থ রিপোর্টার এই সংবাদ  সরবরাহ করেছেন।

তিনি জানিয়েছেন,  প্রত্যেকটি বড় শহরেই জঙ্গী শাহীর অত্যাচারে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ লোক ‘নিখোঁজ’।  পাক বাহিনী শহরগুলো নিয়ন্ত্রণ করলেও মুক্তি বাহিনীকে খতম করতে পারছে না। পাক বাহিনী গ্রামে গ্রামে অত্যাচার চালাচ্ছে।  একের পর এক গ্রাম পোড়াচ্ছে। কিন্তু তবু মুক্তি বাহিনীর সাথে এটে উঠতে পারছে না। বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে এখন মুক্তি বাহিনীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাথেই মীমাংসা করতে হবে, ভারতের সাথে নয়

বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্রিকা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এ বলা হয়েছে যে উ থান্ট যদি বাংলাদেশ সমস্যার মিমাংসা করতে চান, তাহলে ইয়াহিয়া ও আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারত – পাকিস্তান আলোচনা বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে,  পাক – ভারত যুদ্ধে সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ হস্তক্ষেপ ইসলামাবাদের পরামর্শ অনুযায়ী হতে পারে না।  এ বিষয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপকে যদি ফলপ্রসূ করতে হয়,  তবে সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে। উ থান্টের যে কোন মধ্যস্ততার লক্ষ্য হতে হবে আওয়ামী লীগ ও ইয়াহিয়ার মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা।  জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দের সাথে ইসলামাবাদকে কথা বলতে সম্মত করান। ইসলামাবাদ ও ভারতের মধ্যে কথা বলাবার ব্যবস্থা করে কোন লাভ হবে না।

পৃষ্ঠা – ৭

কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই শেখ মুজিবকে জেলে রাখাটা বরদাস্ত করতে পারে না

(সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ডঃ ব্রুনোর সুস্পষ্ট অভিমত) 

অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ডঃব্রুনো ক্রীস্কিবলেন, ইসলামাবাদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিলে বাংলাদেশ সমস্যার জটিলতা কমবে। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে জেলে রাখার কথা কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সহ্য করতে পারে না।

ডঃ ব্রুনো ক্রীস্কি সম্প্রতি ভিয়েনায় ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা কালে উপরোক্ত মন্তব্য করেন।  তিনি আরো বলেন, শেখ মুজিবর রহমান কে মুক্তি দিলে বাংলাদেশ সমস্যাকে কেন্দ্র করে যে উত্তপ্ত পরিমন্ডল সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রশমিত হবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিব আবার রাজনৈতিক জীবনে ফিরে এলে অবস্থা শান্তির দিকে মোড় নেবে। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান মন্ত্রী হওয়ার বদলে তার কারাবাস খুবই আশ্চর্যজনক।

ডাঃ ক্রীস্কি বলেন, তিনি শীঘ্রই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ ব্যাপারে তার মতামত জানিয়ে চিঠি দেবেন।

তার মতে, বাংলাদেশ সমস্যা জটিল হওয়ার ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত বাংলাদেশ শরনার্থীদের নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যাবার অধিকার স্বীকার করতেই হবে।

ইস্রাইলের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় না।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অস্ট্রিয়া সফরের পর অস্ট্রিয়ার প্রেস টেলিভিশনে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের প্রতি অস্ট্রিয়ার বিপুল সমর্থন ও সহানুভূতি ব্যক্ত হয়েছে।

***

পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধ করতে বদ্ধ পরিকর

(রাজনৈতিক ভাষ্যকার) 

পাকিস্তান বাংলাদেশে তাদের যুদ্ধের নিশ্চিত পরাজয়কে রোধ করবার জন্য পাক – ভারত যুদ্ধ বাধাবার ফিকির খুঁজছে। সীমান্ত অঞ্চলে করে চলেছে নানা প্রকার উস্কানিমূলক কর্ম। খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গত জুলাই মাস থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০ বার সীমা লঙ্ঘন করেছে। এই সময় তারা ভারতের আকাশের সীমাও লঙ্ঘন করেছে। এই সব কারণে যুদ্ধ বিরতি রেখার বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। 

রাষ্ট্রসংঘ পর্যবেক্ষকদের প্রদত্ত একটি নোটে পাকিস্তানের সীমানা লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কাশ্মীরে ভারত – পাকিস্তান সীমানা চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং ভারতীয় পিকেটে গুলির ওপর গুলি বর্ষণ করে প্ররোচনা সৃষ্টি করে চলেছে, রাষ্ট্র সংঘের সামরিক পর্যবেক্ষকরা তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ। পাক সৈন্যরা প্ররোচনা মূলক কাজ করছে বলে রাষ্ট্রসংঘ পর্যবেক্ষক দল হতাশা প্রকাশ করেছেন। নোটে বলা হয়, গত ১৪ই অক্টোবর থেকে একদল পাকিস্তানী সশস্ত্র সৈন্য উরি খন্ডে বিনা প্ররোচনায় গ্রেনেড ও মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায় ও গুলি বর্ষণ করে একটি ভারতীয় পিকেট দখলের জন্য চেষ্টা চালায়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী পাল্টা গুলি চালায়৷

পাকিস্তানের এই সব কার্যকলাপ থেকে এখন এই কথা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, পাকিস্তান যুদ্ধ চায়।

***

স্বীকৃতির প্রশ্নে ইন্দিরা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সম্প্রতি অস্ট্রিয়ায় এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে,  বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের সহায়ক হলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি ভেবে দেখবে ভারত।

তিনি এই প্রসঙ্গে এ অভিমত প্রকাশ করেন যে, পূর্ব বঙ্গের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা বর্তমানে আগের চাইতে অনেক কম। কারণ পূর্ব বঙ্গে নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি বৃন্দ ইয়াহিয়া খানের কারাগারে বন্দী। এখন যারা ইয়াহিয়া খানের দ্বারা নিযুক্ত হয়েছেন তারা জনপ্রতিনিধি নয়, গত সাধারণ নির্বাচনে তাদের কেউই কোন ভোট পান নি।

শ্রীমতী গান্ধী তীব্র ক্ষোভ ও ব্যাঙ্গের সুরে বলেন, ‘আমরা আজ যখন আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তৎপর হয়ে উঠেছি, তখনই দেখছি সব বন্ধুদের উদ্বেগের নাড়ী টন টন করে উঠছে। ‘

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তান যেভাবে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে  এবং ভারত থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক চাপ প্রবল হচ্ছে, তখন তাকে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।  পৃথিবীর কোন দেশকে এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। বস্ততঃ ভারতের এই আত্মসংযম মৌখিক প্রশংসা পেয়েছে মাত্র।

তিনি আরো বলেন,  পাকিস্তান যে অপরাধ করে চলেছে, তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সম্পর্কে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, কিনি বেঁচে আছেন কিনা আমরা জানি না। তিনি বেঁচে থাকলে এবং তার সঙ্গে আলোচনা হলে সমস্যা সমাধান হতে পারে।

পৃষ্ঠা – ৮

হানাদার ও রাজাকারদের দলে দলে আত্মসমর্পণঃ মুক্তি বাহিনীর সর্বত্র বিজয় – অভিযান

কুমিল্লা রণাঙ্গনের ফেণী ও বিলোনিয়ার মধ্যে অবস্থিত ফুলগাজী রেল সেতুটি মুক্তি বাহিনী গত সপ্তাহে ধ্বংস করে দিয়েছে। কুমিল্লা জেলার কসবার কাছে সম্প্রতি ৩ নং পান্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যদের বহনকারী একটি লঞ্চ মুক্তি যোদ্ধারা ডুবিয়ে দেন। এর ফলে বহু খান সেনা খতম এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস হয়ে যায়। 

বান্জারামপুরে আরো একটি লঞ্চ মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা ডুবিয়ে দেন। ফলে আরো বহু শত্রু সৈন্য খতম হয়।

একই অঞ্চলে গেরিলা যোদ্ধারা ব্যাপক অভিযান চালিয়ে গেরিলা যোদ্ধারা তিনটি স্পিড বোট ও দশটি দেশী নৌকা ডুবিয়ে দেন।

গত সপ্তাহে কুমিল্লা জেলার কসবার কাছে মুক্তি বাহিনী পাকিস্তানী সৈন্যবাহী একটি লঞ্চ হামলা চালিয়ে তৃতীয় পান্জাব রেজিমেন্টের দুই’শ সেনাকে খতম করেছেন। লঞ্চ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে পরে লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দেন। 

অমরাতোলিতে এক টহলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে অতর্কিত হামলা করে ৪ জন শত্রু সৈন্যকে খতম করেন। ৩ রা অক্টোবর নয়ানপুর রেল স্টেশনের কাছে ৩ জন হানাদার খতম করেন।

বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গত ২ রা অক্টোবর কুমিল্লা জেলার হোমরা থানার ১১ জন পাকিস্তানী পুলিশ ও ৫ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাছাড়া অস্ত্রশস্ত্র সহ ১৫ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।  ১লা অক্টোবর বল্লায় শত্রুবাহিনীর সমাবেশ ছাউনীতে আক্রমণ করে মুক্তি বাহিনী আশ্রমপুরা থেকে বল্লা পর্যন্ত যাতায়াতকারী সৈন্য দের মধ্যে ২৫ জনকে নিহত ও ৮ জনকে আহত করে।

হানাদার সৈন্য নিহত হলে তারা অবস্থা বেগতিক দেখে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে হানাদারদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষে ৪০ জন শত্রু সৈন্য প্রাণ হারায়৷

রংপুর

রংপুর সেক্টরে সম্প্রতি চিলাহাটির প্রায় ১৭ মাইল দক্ষিণ পশ্চীমে মুক্তি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের ফলে বহু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়।

গত ৪ঠা অক্টোবর মুক্তি বাহিনী বৈধামারীর কাছে মাইন বিস্ফোরণে শত্রু পক্ষের একটি জীপ ধ্বংস করে দিয়েছেন।

বিলম্বে প্রাপ্ত এক সংবাতে জানা যায়,  দিনাজপুর জেলা চিনিরবন্দরে দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড এক সংঘর্ষ হয়৷ এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধারা ৪ জন শত্রু সৈন্য হত্যা করেন এবং একটি রাইফেল দখল করেন।

৫ই অক্টোবর দিনাজপুর জেলার খানপুরে মুক্তি বাহিনী খান সেনাদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে লিপ্ত হন ও ৪ জন খান সেনাকে খতম করেন। এই সংঘর্ষে আরও ৯ জন শত্রু সেনা আহত হয়। রংপুর, সিলেট, চাটগাঁ, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও যশোর জেলায় মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের তৎপরতায় দখলদার সৈন্য ও রাজাকার খতম হয়েছে।

ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকায় ও সিলেটের রাধানগর এলাকায় প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়।  মুক্তি বাহিনীর মোকাবিলার জন্য খান সেনারা সিলেট শহরে সান্ধ্য আইন জারী করে ও নিষ্প্রদীপ মহড়া চলছে৷

চাঁটগা বন্দরে দখলীকৃত বাংলাদেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা করার মধ্যেই মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গত ১লা অক্টোবর এক ভয়াবহ আক্রমণে একটি তেলবাহী গ্রীক গাড়ি মারাত্মক ভাবে বিধ্বস্ত করেন।

কুষ্টিয়া – খুলনা – যশোরে ব্যাপক আক্রমণ

গত ৫ই অক্টোবর রেবিলবাড়ীর কাছে মুক্তি যোদ্ধারা একটি শত্রুঘাটির ওপর প্রচন্ড আক্রমণ চালান এবং ৩৫ জন খান সেনা খতম করেন। ৪ জন দস্যু সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত হয়।

একই দিনে মুক্তিবাহিনী একসাথে বাড়িয়াডাঙ্গার মধ্যে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং নবকাট্টিতে শত্রুপক্ষের একটি জিপ ধ্বংস করেন। গত ৩রা অক্টোবর বরিশাল জেলার বাবুগন্জের  কাছে দখলদার পাকিস্তানী সৈন্য ও কুখ্যাত রাজাকারদের ওপর গেরিলা যোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৪ জন হানাদার খতম করেন। 

***

ইউনিকোডে টাইপ – Maruf Muktadir Khan

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!