You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.10 | শেখ মুজিবের সঙ্গে এক হয়ে সর্বাত্বক সংগ্রাম করবোঃ পল্টনে জনসভায় মওলানা ভাসানী | দৈনিক পাকিস্তান ১০মার্চ, ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

শেখ মুজিবের সঙ্গে এক হয়ে সর্বাত্বক সংগ্রাম করবোঃ

পল্টনে জনসভায় মওলানা ভাসানী

দৈনিক পাকিস্তান ১০মার্চ, ১৯৭১

মুজিবভাসানী এক হবে

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গতকাল মঙ্গলবার পল্টনের এক জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দ্বর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন যে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না । এবং এ ব্যাপারে কোন প্রকার আপোসও সম্ভব নয় । তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই দাবীর মর্যাদা রক্ষা করে অবিলম্বে ৭ কোটি বাঙ্গালীকে স্বাধীনতা দানের আহবান জানান। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষনা করেন, আগামী ২৫শে মার্চের মধ্যে এই দাবী মেনে না নিলে তিনি শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে এক হয়ে বাঙ্গালীর স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্নক সংগ্রাম শুরু করবেন ।

বর্তমান সংগ্রামের উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ কেউ বলেছে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলে শেখ মুজিবর রহমান তার সাথে আপোস করবে । তিনি বলেন, এই সন্দেহ অমূলক।শেখ মুজিবর বা মাওলানা ভাসানী বা যে কোন নেতা যদি এ ব্যাপারে আপোস করতে যায় জনতা তাকে আস্ত রাখেবে না। আপোসের সময় চলে গেছে এখন আপোসের আর কোন পথ খোলা নেই । মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আস্থা রাখার জন্য আহবান জানিয়ে বলেন, তাকে আপনার বিশ্বাস করবেন না ।

শেখ মুজিবর রহমানকে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার বীর হওয়ার আহবান জানান ।

তিনি বলেন, ১৩ বছর আগে কাগমারী সন্মেলনে আমি আসসালামু-আলাইকুম বলেছিলাম । মরহুম শহীদ সোহরওয়ার্দী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাক্তি হয়েও সেদিন আমার কথা অনুধাবন করতে পারেন নি ।কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, দুই অংশ যদি একত্রে থাকে তাহলে কালব্যাধি যক্ষার জীবাণু যেমন দেহের হৃৎপিন্ডের দু অংশকে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি পাকিস্তানের দু অংশই বিনষ্ট হবে । তাই বলেছিলাম যে, তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কর এবং আমার আমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়র করি। ‘লাকুম দীনুকুম ওলিয়াদীন’, শেখ মজিবর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে ।

তিনি বলেন, আমি ৭ কোটি বাঙালী আজ মোবারকবাদ জানাই এ জন্য, তারা এই বৃদ্ধের ১৩ বছর আগের কথা এতদিন পরে অনুধাবন করতে পেরেছে।

বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিঃসহায় মানষের ওপর বেপোরোয়া গুলীবর্ষণের নিন্দা করে তিনি ইয়াহিয়াকে ইতিহাস হতে শিক্ষা গ্রহনের পরামর্শ দেন । তিনি বলেন, অত্যাচারী শাসক ও জালিম কখনো ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না । তার পতন অনিবার্য । তিনি  বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ, মুসলিম লীগ সরকার ও আইয়ুব খানের পতনের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেন, এরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনছিল ।

তিনি বলেন, বৃটিশ জাতি বুদ্ধিমান ছিল। তাই তারা এদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বাংলার ৭ কোটি মানুষকেও তিনি অবিলম্বে স্বাধীনতা প্রদানের দাবী জানান ।

তিনি এ ব্যাপারে ইয়াহিয়াকে জনা্ব দেওলতানা, জনাব ভুট্টোকে ও জনাব খুরোসহ বিভিন্ন পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহনের পরামর্শ দেন ।

অহিংস আন্দোলন প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী বলেন, আমি কোনদিন অহিংসায় বিশ্বাস করি না । রাসুল (দঃ) অহিংসায় বিশ্বাস করতে বলেননি । জুলুমের প্রতিশোধ নিতে বলেছেন । জালিমের অত্যাচার যে সহ্য করে এবং যে অত্যাচার করে তারা উভয়ই মহাপাপী । তিনি বলেন, অহিংসা পন্থা অবাস্তব ।

দেশে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তিনি প্রেসিডেন্টকে দায়ী করেন । পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা সম্পর্কে প্রসিডেন্টের যুক্তি একজন নিরক্ষর নাগরিকের নিকটও গ্রহনযোগ্য নয় বলে তিনি অভিমত প্রকার করেন ।

দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে প্রেসিডেন্ট ভূমিকার নিন্দা করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ট দলের প্রতি কোন মার্যাদা না দিয়ে তার আইনগত কাঠামোর কথা জোর গলায় প্রচার করছেন। তিনি আইনগত কাঠামো আদেশেরবলে সবকিছু করবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন ।এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র ? গণতন্ত্রে এরূপ আদেশের কোন নজির কোন দেশে খুঁজে পাওয়া যায় না । তিনি এলএফ’র কঠোর নিন্দা করেন ।

তিনি বলেন ভুট্টোর পরিষদ বর্জনের হুমকি প্রসঙ্গে ন্যাপ প্রদান বলেন, এটাও নজিরবিহীন ঘটনা । আজাদীপূর্বকালে ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমানরা সংখ্যাগলিষ্ট হওয়া সত্বেও পার্লামেন্টে যোগ দেব না এরূপ কথা বলেনি । আইন পাসের ব্যাপার সংখ্যাগরিষ্ট দলেন সংখ্যাবলিষ্ট দল পরিষদে বাধা দার করেছে, যুক্তিতর্ক, ন্যায় বিচার ও ইনসাফের দোহাই দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ট দলকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত ওয়াকউট করেছে । ভুট্টোর উচিত ছিল সেই গণতন্ত্রসন্মত পথ অনুসরন করা । পশ্চিম পাকিস্তানী গরীব জনগণের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ট দল যদি কোন আইন পাস করত বা তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার চেষ্টা করত এবং একথা যদি ভুট্টোর দল প্রমাণ করতে পারত, তাহলে জনমত তার দলের পক্ষে যেত ।

তিনি ইন্দোনিশিয়ার মার্কিন ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে বলেন, সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে । কিন্তু এই হত্যার প্রতিশোধ ইন্দোনেশিয়ার জনণন নেবেই ।

নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে গুলি হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের মা-বোনদের আজ গুলি করে মারা হচ্ছে । গত পরশু আমি চলে গিয়েছিলাম। এক মহিলা কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর ছেলে রাজশাহীতে পড়ত, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে । সেই মহিলা চিৎকার করে কাঁদছে । বাংলা মা’র কোল এমনি করেই খালি করে বাংলাকে ক্রন্দসী বাংলা করছে ।

তিনি বলেন, সন্তানের জন্য মায়ের যে বেদনা তা ইয়াহিয়া বুঝবেন না । সন্তানহারা মায়ের অভিশাপ বিফলে যাবে না । বিভিন্ন দ্রবাদির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্য তিনি গ্রামে গ্রামে সর্বদীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহবান জানান । তিনি বলেন, সিমেন্টের দাম ইতিমধ্যেই প্রতি বস্তা এগার টাকা হতে পনের টাকাও ঢেউটিন প্রতি বার একাশি টাকা হতে দুশো ৪২ টাকা উঠেছে ।

তিনি বলেন পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবেই । এই স্বাধানীতা রক্ষার জন্য এখন হতে প্রস্তুতি নিতে হবে । এ ব্যাপারে বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে । চরিত্র গঠন করতে হবে । বাংলাদেশ হতে একটি কানাকড়িও যেন বাইরে পাচার না হয় তৎপ্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য আহবান জানান ।

মওলানা ভাসানী বাঙালী, অবাঙ্গালীম হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ইত্যাদি ভেদাভেদ ভুলে সকলকে মিলেমিশে থাকার আহবান জানান । তিনি বলেন, বিহারীদের আমি বড় বালবাসি । ওরা অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসেছে । ওরা পশ্চিম পাকিস্তানী নয়, হিন্দুস্তানের অধিবাসী ছিল । তাদের ওপর বহু নির্যাতন হয়েছে ।

তিনি বলেন, এদের সকলের সম্পতি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের । কারণ এগুলো আমাদের দেশের সম্পদ ।

সভার শুরুতেই গণআন্দোলনের যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের জন্য মওলানা ভাসানীর ইমামতীতে গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ।

আতাউর রহমান

পল্টন ময়দানের জনসভায় বক্তৃতাকালে জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বিলম্ব না করে বাংলায় জাতীয় সরকার ঘোষণা করার জন্যে আওয়ামী লীগ প্রদান শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আহবান জানান।

জনাব, আতাউর খান বলেন, আজ আর আমাদের মধ্যে কোন কোন্দাল নেই । বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে । বাঙালী জজ, সিএসপি ও সরকারী কর্মচারীরাও আজ জনগনের স্বার্থে এক্যবদ্ধ । তাঁরা রক্ত দিচ্ছেন এবং প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দিবেন । তাই এই মুহূর্তে শেখ মুজিব জাতীয় সরকার গঠন করলে সবাই তার হুকুম মেনে নেবে । আজকের এই মুহুর্তে আর বারবার ফিরে আসবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন ।

জাতীয় লীগ নেতার বলেন, বাংলার আজ মহা দুর্দিন । বাঙ্গালী জাতির আজ চরম পরীক্ষা। বাঙ্গালী এখন জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ভ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীনতার যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা পূরণ করা হয়নি ।

বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শোসকদের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, তাঁরা বাঙালীদের শাসন ক্ষমতায় অংশিদারিত্ব করতে চায় না । শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীকেও তারা বিশ্বাস করেনি । আজও সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে তাঁরা ক্ষমতা দিতে চাচ্ছে না । তাই একাবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে আবার তা বন্ধ করে দেয় এবং পরে আবার তারিখ ঘোষণা করে । শেখ মুজিবের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ভানুমতির খেলা শুরু হয়ে গেছে । চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল ফেলা হয়েছে । এই ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করতে হবে । কাজেই আপনি পরিষদের কথা ভুলে যান এবং জাতীয় সরকার ঘোষনা করুন ।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, বাঙালী জাতি আজ মৃত্যুকে উপেক্ষা করছে । বাংলাদেশের ৭ কোটি মুক্তি পাগল মানুষকে দাবিয়ে রাখা যাবে না ।

ইতিপূর্বে জনসভার প্রস্তাব পাঠকালে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় ন্যাপ সম্পাদক জনাব মশিউর রহমান বলেন, আজ রাজনৈতিক কোন্দালের দিন নয় । ন্যাপ কোন্দালে বিশ্বাস করে না । তাই আজ আমরা ঐক্যবন্ধ ।