বৃটিশ রাষ্ট্রনায়কদের নতুন চাল
বাঙলাদেশের ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারির আলােচনা পাঠকবর্গের মধ্যে কৌতূহল উদ্রেক করবে। ইতিমধ্যে কোন কোন সংবাদপত্র আলােচনার ফলাফলকে আংশিক সাফল্য বলে বর্ণনা করেছে এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবকে বাঙলাদেশের সঙ্কট সমাধানের পক্ষে একটা প্রাথমিক পদক্ষেপও বলে মন্তব্য করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনায় বৃটেনের পররাষ্ট্রীয় নেতা বাঙলাদেশের সংকট সমাধান কল্পে উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের যাতে আলােচনার সূত্রপাত হতে পারে তার জন্য বৃটেনের রাষ্ট্রীয় নেতারা উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তারা চান ভারতও তাদের এই উদ্যোগকে সমর্থন করুক।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী নেতাদের মতলব খুবই পরিষ্কার। পাকিস্তানে বিগত নির্বাচনের রায় আগ্রহ করে, এমন কি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলােচনা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই পাক সামরিক শাসনের পূর্বপরিকল্পিত বর্বরােচিত আক্রমণ এবং গণহত্যার অভিযান সম্পর্কে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী নেতারা কোন প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন না। যারা গণতন্ত্রের বড়াই করে থাকেন এবং বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে থাকেন তাদের গণতন্ত্র যে নয়া ঔপনিবেশবাদের দ্বারা পরিচালিত এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। এই কারণেই বাঙলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়াকে মার্কিন সামরিক সাহায্যদান সম্পর্কে বৃটিশ সরকার নীরবে সম্মত জানিয়েছেন। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ধ্বংসই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাম্য। তারা চান মূলতঃ অখণ্ড পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের রূপ হচ্ছে বাঙলাদেশকে ছিটেফোটা অধিকার দিয়ে একটা কনফেডারেশনে আবদ্ধ করে রাখা। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র দপ্তরে সেক্রেটারি এ কথা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা চান পাকিস্তানের বৃহত্তম কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। তাদের সাথে ইয়াহিয়ার মতলবের কোন তফাৎ নেই। ইয়াহিয়া খানও ইতিমধ্যে ঘােষণা করেছেন যে তিনি বাঙলাদেশকে পররাষ্ট্র সম্পর্কীয় এবং ট্যাক্স বসাবার অধিকার ব্যতীত অন্যান্য অধিকার বাঙলাদেশের নির্বাচিত সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে রাজী আছেন। উভয় পক্ষের মতলবের মধ্যে অপূর্ব মিল আছে। এরা কেউ বাঙলাদেশের জনমত অনুসারে রাজনৈতিক সমাধান চান না।
বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য বৃটিশ ধুরন্ধরেরা এই কূটনৈতিক চাল চেলেছে। নিজেদের স্বার্থে একটা দেশকে দ্বি-খণ্ডিত করা এবং সেই একই স্বার্থে বাঙলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে দমন করে অখন্ডতার নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা উভয়ই টাকার এপিট আর ওপিট। উভয়ই নয়া-উপনিবেশবাদের কৌশল।
সামরিক জোটের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশের কৃত্রিম অখণ্ডতা সামরিক জোটের শক্তি, মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে হাতিয়ার এবং ভারতের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের হাতে অস্ত্র বটে। বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিনিময়ে পাকিস্তানের কৃত্রিম অখণ্ডতা বজায় রাখা হল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধূর্ত কৌশল।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বােধ হয় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সেই কূটনীতি ও তার পরিণাম বিস্মৃত হয়েছেন। শরণার্থী আগমনের কারণ যা শরণার্থী সৃষ্টির কারণও তাই উভয়েরই উদ্ভব সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের মধ্যে নিহত রয়েছে। অতএব প্রধানমন্ত্রী বৃটিশ ধুরন্ধরদের থেকে কী আশা করতে পারেন? যখন উচিত হচ্ছে বৃটিশ কমনওয়েলথ-এর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করা, ব্যবসাবাণিজ্যের পুরােনাে সম্পর্ককে আমূল পরিবতর্ন করে ভারতের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত্র ও ষড়যন্ত্রকে…
সাম্রাজ্যবাদীদের সমাধান পরিকল্পনা তাদের লক্ষ্য সিদ্ধির জন্য হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী এই সত্য বিস্মৃত হয়েছেন বলে বৃটেনে তাঁর সফরও ব্যর্থ হয়েছে। এই মােহ যতদিন থাকবে, ব্যর্থতাও বার বার ঘুরে আসবে।
সূত্র: কালান্তর, ৩.১১.১৯৭১