You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাজেট বক্তৃতা
২৩ জুন ১৯৭৫

জনাব স্পীকার,
আমি জাতীয় সংসদের সামনে ১৯৭৫-৭৬ সালের বাজেট পেশ করিতেছি। ইহার সহিত আমি জাতীয় সংসদের অবগতি ও অনুমােদনের জন্য ১৯৭৪-৭৫ সালের সম্পূরক আর্থিক বিবৃতি বা সংশােধিত বাজেটও পেশ করিতেছি। বঙ্গবন্ধু বিঘােষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের শুভলগ্নে এই কর্তব্য পালন করিতে পারিয়া আমি অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরব অনুভব করিতেছি। আমি আশা করি যে, আগামী বৎসরের বাজেটে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হইবে।
২। বাজেট সম্পর্কে আলােচনার পূর্বে আমি জাতীয় অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিগত এক বৎসরে জাতি যে সকল জটিল অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছে এবং তাহা সমাধানার্থে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইয়াছে সেই সম্পর্কে সংসদকে সংক্ষেপে অবহিত করিতে চাই।
৩। চলতি বৎসর ছিল আমাদের জাতীয় জীবনের একটি কঠিন পরীক্ষার সময়। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য আমদানী পণ্যের উচ্চমূল্য এবং আমাদের কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানী বাণিজ্যের প্রতিকূল শর্ত ইত্যাদি কারণে গত অর্থ বৎসরের শেষদিকে, দেশ এক সংকটজনক বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। রপ্তানী বাণিজ্যের প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে, চলতি বৎসরের গােড়ার দিকে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে এবং অত্যাবশ্যক কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় পণ্যদ্রব্যের আমদানী অত্যন্ত সীমিত করিতে হয়। ফলে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৪। জাতীয় জীবনের এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে দেশ এক ধ্বংসাত্মক বন্যার কবলে পতিত হয়। এই বন্যায় দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জলমগ্ন হয়, তিন কোটি লােক প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ২.৯৭ কোটি মণ খাদ্যশস্য ও প্রায় ৩ লক্ষ বেল পাট বিনষ্ট হয়। এই বন্যার ফলে খাদ্যশস্যের ঘাটতি বৃদ্ধি পায় এবং দেশে। এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ছায়াপাত হয়। সরকার এই পরিস্থিতির মােকাবেলা করিবার। জন্য খয়রাতি নগদ অর্থ সাহায্য, গৃহনির্মাণ মঞ্জুরী ও অন্যান্য খাতে প্রায় ৬.৪৭ কোটি টাকা বিতরণ করেন। ইহা ছাড়াও বিপুল পরিমাণ খাদ্য ও বস্ত্র সামগ্রী। বিতরণ করা হয়। দুর্ভিক্ষের হাত হইতে দেশবাসীকে রক্ষা করিবার জন্য সরকার জরুরী ভিত্তিতে প্রতিটি ইউনিয়নে এক বা একাধিক লংগরখানা খুলিয়া মােট ৫,৮৬২টি লংগরখানার মাধ্যমে দৈনিক গড়ে প্রায় ৪৫ লক্ষ লােকের আহারের বন্দোবস্ত করেন। জনগণ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহও এই সময় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে সর্বতােভাবে সাড়া দেয়। সরকারের সর্বাত্মক তৎপরতা ও
পৃষ্ঠা: ২৪০

জনগণের সহায়তায় দেশ যদিও ব্যাপক দুর্ভিক্ষের হাত হইতে রক্ষা পায়, তবুও কয়েক সহস্র লােককে মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করা সম্ভব হয় নাই। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বন্ধু রাষ্ট্র, যাহারা এই দুর্দিনে আমাদের সাহায্যের জন্য আগাইয়া আসিয়াছিলেন, আমি সরকারের পক্ষ হইতে তাহাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বন্যার পানি নামিয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের দুর্দশা লাঘব করিবার জন্য জরুরী কৃষিভিত্তিক পরীক্ষামূলক সাহায্য প্রকল্পের অধীনে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সরকার ব্যাপক সাহায্য প্রদান করেন। ইহা ছাড়া “কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের অধীনে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর অধীনস্থ সাহায্যসহ ১১.২২ লক্ষ মণ গম বরাদ্দ করা হয়।
৫। দেশ যখন এইরূপ বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন তখন দেশের বৃহত্তম। ঘােড়াশাল সার কারখানায় এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে, যাহার ফলে ইহার উৎপাদন বিঘ্নিত হয় এবং সার বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়। ঘােড়াশাল সার কারখানার প্রয়ােজনীয় মেরামত ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হইয়াছে এবং উৎপাদন পুনরায় শুরু হইয়াছে।| ৬। বন্যার ভয়াবহতা ও তাহার ফলে কৃষিক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয় সেই সম্পর্কে আমি আগেই বলিয়াছি। এই ক্ষতি পূরণের জন্য সরকার বিভিন্ন জরুরী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ইহা অতীব আনন্দের বিষয় যে আমাদের এই কার্যক্রম কৃষক ভাইদের সহযােগিতা ও তৎপরতায় সাফল্য লাভ করে। এই সর্বাত্মক সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে দেশে যে মারাত্মক উৎপাদন ঘাটতির আশংকা করা গিয়াছিল তাহা এড়ানাে সম্ভব হয়। আমদানীর স্বল্পতাহেতু প্রয়ােজনীয় পরিমাণ কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা সম্ভব হয় নাই; তবুও খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন গত বৎসরের তুলনায় বিশেষ কম হইবে না।
৭। কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন চা, ইক্ষু, আলু, তামাক ও শাকসবৃজি ইত্যাদির উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই বৎসরে চায়ের উৎপাদন দাঁড়ায় ৭১০ লক্ষ পাউন্ডে, ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সালে এই উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৫৩২ লক্ষ পাউন্ড ও ৬০৭ লক্ষ পাউন্ড। ইক্ষুর উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিল যথাক্রমে ১৪.৩১ কোটি মণ ও ১৭.০১ কোটি মণ। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী এই বৎসর ইহার উৎপাদন প্রায় ১৭.৮২ কোটি মণ। ইহা হইতে প্রতীয়মান হয় যে সরকারের বিশেষ প্রচেষ্টা ও কৃষক সমাজের সহযােগিতার ফলে বিভিন্ন বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদন বিশেষ হ্রাস পায় নাই। এই জন্য জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া কৃষক সমাজকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
৮। খাদ্যশস্যের তুলনায় পাটে মুনাফা কমিয়া যাওয়াতে পাট উৎপাদন এই বৎসর অপেক্ষাকৃত হ্রাস পায়। গত বৎসর পাটের নিম্নতম মূল্য ৬০ টাকায় ধার্য করা হইয়াছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ইহার বাজার দর অনেক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কিছু সংখ্যক আড়তদার ও ফড়িয়া প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভােগী অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃষকের। নিকট হইতে নিম্নতম মূল্যে খরিদ করিয়া বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রয় করিয়া অধিক
পৃষ্ঠা: ২৪১

মুনাফা লাভ করে। ফলে কৃষক তাহার ন্যায্য পাওনা হইতে বঞ্চিত হয়। কৃষক যাহাতে বাজারে দাম পায়, সেইজন্য সরকার আগামী মৌসুমের জন্য পাটের কোন নিম্নতম মূল্য ধার্য করেন নাই। তাহা ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও সীমান্ত এলাকায় পাট ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিধার জন্য সরকার প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ক্রয়-কেন্দ্র খুলিয়াছেন। পাটের চোরাচালান রােধ করিবার জন্য সীমান্ত প্রহরাও জোরদার করা হইয়াছে।
৯। বিশ্ববাজারে মন্দাভাব ও কৃত্রিম আঁশের প্রতিযােগিতার ফলে পাট রপ্তানী এই বৎসর হ্রাস পায়। অভ্যন্তরীণ বাজারদর ও রপ্তানী মূল্যের বিশেষ পার্থক্যের। ফলে পাট শিল্প সংস্থা ও পাট সংস্থাসমূহ বিরাট লােকসানের সম্মুখীন হয় এবং এই ক্ষতিপূরণ মিটাইবার জন্য সরকারকে ভর্তুকি ও সহজ শর্তে মােটা অংকের ঋণ প্রদান করিতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, স্বাধীনতার পূর্বে পাট শিল্পকে বােনাস-ভাউচারের মাধ্যমে পরােক্ষভাবে এই ভর্তুকি প্রদান করা হইত।
১০। টাকার বৈদেশিক মান পুনঃনির্ধারণ, এই বৎসরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের প্রতিযােগিতা শক্তিবৃদ্ধি, পাট রপ্তানীর প্রসার, অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের যুক্তিসঙ্গত মূল্য নিশ্চিতকরণ ও টাকার বাস্তব মূল্য নির্ধারণকল্পে সরকার এই বৎসরের ১৭ই । মে টাকার বৈদেশিক মান পুনঃনির্ধারণ করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বৃটিশ পাউন্ডের মূল্য ১৮.৯৭ টাকার স্থলে ৩০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। আমার ঐকান্তিক বিশ্বাস যে, এই ব্যবস্থা রপ্তানী বাণিজ্যের প্রসার ও পাট চাষ ও পাট শিল্পের পুনর্বাসনের পথে একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ। টাকার এই নতুন বিনিময় হার হেতু পাট শিল্প উদ্ভূত এবং কাঁটা পাট ব্যবসাজনিত যে অতিরিক্ত আয় সঞ্জাত হইবে তাহার উপর যথাযথ কর আরােপ করা হইবে। এই আদায়কৃত অর্থকে পাট বিষয়ক ব্যাপারে নিয়ােজিত করিবার উদ্দেশ্যে“পাট তহবিল” নামক এক নূতন তহবিলের সৃষ্টি করা হইবে।
১১। মুদ্রার মান পুনঃনির্ধারণের ফলে বহিরাগত আয় বৃদ্ধি পাবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। ফলে অধিকতর কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য দ্রব্যের আমদানী স্বভাবতই বৃদ্ধি পাইবে। ইহা ছাড়াও সরকার এই বৎসর, কল-কারখানার পূর্ণ উৎপাদনক্ষমতা সদ্ব্যবহারের জন্য পূর্ণমাত্রায় কাঁচামাল, ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ইত্যাদি আমদানী করিবার জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করিতে পারিবেন বলিয়া আশা করা যাইতেছে। ফলশ্রুতি হিসাবে একদিকে যেমন আমাদের শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পাইবে অন্যদিকে তেমনি আমদানী-রপ্তানী শুল্ক, আবগারী শুল্ক প্রভৃতি খাতে রাজস্ব আয়ের পরিমাণও বাড়িয়া যাইবে এবং ঘাটতি অর্থসংস্থানের প্রয়ােজন হইবে না। প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বন্টন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এই মুদ্রামানের পুনঃনির্ধারণ, জনসাধারণের অত্যাবশ্যক ভােগ্যপণ্যের মূল্যের উপর বিশেষ কোন প্রভাব বিস্তার করিবে না।
পৃষ্ঠা: ২৪২

১২। আমি আগেই বলিয়াছি যে, এই বৎসর বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার জন্য প্রয়ােজনানুসারে শিল্পের কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী করা সম্ভব হয় নাই। ইহা সত্ত্বেও সুতা ও বস্ত্র, চিনি, নিউজপ্রিন্ট, সিমেন্ট প্রভৃতির উৎপাদন গত বৎসরের তুলনায় উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এই উৎপাদন মৌসুমের একটি উল্লেখযােগ্য সাফল্য। গত বৎসর লবণের মােট উৎপাদন ছিল ৪৫ লক্ষ মণ, এই বৎসর সেই স্থলে ইহার উৎপাদন দাঁড়ায় ২০৪ লক্ষ মণ। এই বৎসর, প্রথম নয় মাসে বস্ত্রশিল্প সংস্থার অধীনে ৬.৩৩ কোটি গজ কাপড় এবং ৭.৩৩ কোটি পাউণ্ড সুতা তৈয়ারী হয়, গত বৎসর একই সময়ে উপরিউক্ত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫.৫৯ কোটি গজ এবং ৭.১০ কোটি পাউন্ড; অর্থাৎ কাপড়ের উৎপাদন শতকরা ১৩ ভাগ ও সুতার উৎপাদন শতকরা ৩ ভাগ বৃদ্ধি পায়। গত বৎসর চিনি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪ লক্ষ মণ, এই বৎসর এই উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬.৫ লক্ষ মণে উন্নীত হয়; বৃদ্ধির হার শতকরা ১২ ভাগ। এই বৎসর প্রথম ৯ মাসে নিউজপ্রিন্ট ও যান্ত্রিক মুদ্রণ কাগজের (মেকানিক্যাল প্রিন্টিং পেপার) উৎপাদন ২৩,০৩৯ টন, গত বৎসর একই সময়ে ইহার উৎপাদন ছিল ১৯,১১০ টন; উৎপাদন বৃদ্ধির হার শতকরা ২০ ভাগ। ইহা ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক দ্রব্যের উৎপাদন উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়— যেমন মেশিন টুল, চট তৈয়ারীর তাঁত, ডিজেল ইঞ্জিন, সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, ফাইব্রিফেক্স সামগ্রী, সােডিয়াম সিলিকেট, টিউব লাইট, কাষ্ঠ আহরণ ইত্যাদি। সিমেন্ট এবং পেট্রোলজাত পদার্থ গত বৎসরের চাইতে প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি পায়। বাইসাইকেল ও ইলেকট্রিক কেবলস্ যথাক্রমে শতকরা ৪৬ ভাগ ও ২৬ ভাগ। বৃদ্ধি পায়। প্রয়ােজনীয় কাঁচামালের অভাবে ভােজ্যতৈল, ঔষধ-পত্র, সিগারেট, চামড়া, জুতা, বৈদ্যুতিক পাখা, কস্টিক সােডা ও স্টীল ইনগটস প্রভৃতি উৎপাদন সামগ্রিক হিসাবে হ্রাস পায়। পাট রপ্তানীর শ্লথগতির পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে ব্রডলুম বন্ধ করিলেও তুলনামূলকভাবে এই বৎসর পাট শিল্পের উৎপাদন বিশেষ হ্রাস পায় নাই। গত বৎসরের তুলনায় প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন হ্রাস পায় নাই।
১৩। এই অর্থ বৎসরের দ্বিতীয়ার্ধে শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ও বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের নবলব্ধ চেতনার ফলে, আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন ও উৎপাদন নৈপূণ্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। শ্রমিক ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যাহাদের সহযােগিতা ও সমবেত প্রচেষ্টার ফলে নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই বৎসর শিল্পোৎপাদনের আশংকাজনক ঘাটতি নিরােধ করা সম্ভব হইয়াছে, তাহারা প্রশংসার যােগ্য।
১৪। পুঁজি বিনিয়ােগে বেসরকারী উদ্যোক্তাদিগকে যথাযথ ভূমিকা পালনে। উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য এবং বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়ােগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে, সরকার চলতি অর্থ বৎসরের শুরুতে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়ােগের উধ্বসীমা ২৫ লক্ষ হইতে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করতে এবং বেসরকারী খাতেও বৈদেশিক
পৃষ্ঠা: ২৪৩

পুঁজি বিনিয়ােগের সুযােগ প্রদান করেন। নতুন নীতির অধীনে বেসরকারী খাতে, কয়েকটি নতুন শিল্প গড়িয়া তােলার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। আশা করা যাইতেছে যে, দেশের সংহতি ও শৃঙ্খলার উত্তরােত্তর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়ােগ আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌছাইবে। তাহা ছাড়া সরকারী নীতি অনুযায়ী ৭১৫টি পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই পর্যন্ত ১৩৩টি মালিকদের ফিরাইয়া দেওয়া হয়, ৮২টি ব্যক্তি মালিকানায় ও ৫১টি কর্মচারী সমবায়ের নিকট বিক্রয় করা হয় এবং ২১০টি বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে হস্তান্তর করা হয়।
১৫। আমি আগেই বলিয়াছি যে, ১৯৭৩-৭৪ সালের শেষদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতিতে সংকট দেখা দেয়। চলতি বৎসরের প্রথমার্ধে বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাভাব ও রপ্তানী বাণিজ্যের প্রতিকূল পরিস্থিতির দরুন এই সংকট আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে রপ্তানী আয় ছিল ২৭৬.৯১ কোটি টাকা। বর্তমান বৎসরে এই রপ্তানী আয়ের পরিমাণ ধরা হইয়াছিল ৩৪৮ কোটি টাকা। গত বৎসরের তুলনায় এই বৎসরের রপ্তানী আয় বৃদ্ধি পাইলেও প্রধানত পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানীর শ্লথগতির ফলে, এই বৎসরের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌছান সম্ভব হইবে না। কিন্তু আমাদের আমদানী চাহিদা বাড়িয়া গিয়াছে। বৈদেশিক সাহায্য ও প্রবাসী বাঙ্গালীদের উপার্জন স্কীমের অধীনে আমদানী আমাদের এই সংকটময় বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির মােকাবেলা করিতে সাহায্য করিয়াছে।
১৬। গত কয়েক বৎসরের মত এই বৎসরও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ঘাটতি, মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও বিতরণ ব্যবস্থায়। অনিয়ম। এই কারণগুলির সঙ্গে এই বৎসরে বন্যাজনিত খাদ্যাভাবও যুক্ত হইয়াছে। ইহা অবশ্য আশাপ্রদ যে এই বৎসরের দ্বিতীয়ার্ধে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার প্রথমার্ধের তুলনায় হ্রাস পায়। এই বৎসরে মুদ্রা সরবরাহ কিছুটা কমিয়াছে, জুন মাসের প্রথমদিকে ইহার পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে ৮০২.৭১ কোটি টাকায়। গত বৎসর জুন। মাসে ইহার পরিমাণ ছিল ৮১৬.৭৮ কোটি টাকা। আশা করা যায় যে, সরকার কর্তৃক সম্প্রতি গৃহীত কয়েকটি জোরালাে পদক্ষেপ যাহার মধ্যে ১০০ টাকার নােট বাতিল, বস্ত্র ও সুতার অবাধ বন্টন, নির্মাণ সামগ্রীর সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্য। স্থিতিকরণের প্রতি সরকারের সজাগ দৃষ্টি ও আগামী বৎসরে উৎপাদন মাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা, ইত্যাদি আগামী বৎসর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে রােধ করিতে সমর্থ হইবে।
১৭। মুদ্রাস্ফীতির চাপ প্রশমিত করা ও অর্থনীতিতে কালাে ও বাড়তি টাকার অশুভ প্রভাব দূর করিবার জন্য সরকার বিগত ৬ই এপ্রিল ১০০ টাকার নােট অচল বলিয়া ঘােষণা করেন। জনগণ তাঁহাদের সাময়িক অসুবিধা সত্ত্বেও, সরকারের এই প্রচেষ্টার সাফল্যের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সাড়া দিয়াছেন, তাহার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। জনগণের এই সহযােগিতার ফলে চোরাকারবারী ও কালােবাজারী বহু লােকের অসদুপায়ে অর্জিত টাকা আটকা পড়িয়াছে। সরকার অবগত আছেন যে,
পৃষ্ঠা: ২৪৪

এই টাকা বাতিল ঘােষণার ফলে কিছু কিছু সৎ ও নিরীহ জনসাধারণ অসুবিধার। সম্মুখীন হইয়াছেন। কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকারের এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। জনসাধারণের সুবিধার জন্য সরকার ৮০০ টাকা পর্যন্ত জমাদানকারীকে আংশিক নগদ ও অবশিষ্ট পাঁচ হইতে সাত বৎসর মেয়াদী শতকরা বার্ষিক ৮ ভাগ সুদসহ ঋণপত্রের মাধ্যমে পরিশােধ করিবার কার্যক্রম ঘােষণা করিয়াছেন। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই ঋণের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পূর্বেও পরিশােধ করিবার বিষয় পুনর্বিবেচনা করিতে পারেন। সরকারের এই সুচিন্তিত ব্যবস্থার ফলে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পাইয়াছে ও জিনিসপত্রের মূল্যের উপর ইহার কিছুটা শুভ প্রভাব পরিলক্ষিত হইতেছে।
১৮। সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া তােলার জন্য ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৯৭৩-৭৪ সাল পর্যন্ত কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উদার ঋণনীতি অনুসরণ করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন আশানুরূপ বৃদ্ধি পায় নাই। অপরপক্ষে দুর্ভাগ্যবশত কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ, মধ্যস্বত্বভােগী মজুতদার, কালােবাজারী এই সুযােগের অপব্যবহার করিয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঋণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও জোরদার করিয়াছেন। অবশ্য এই ঋণ-সংকোচ যাহাতে উৎপাদন ব্যাহত না করে তাহার প্রতি যথারীতি লক্ষ্য রাখা হইয়াছে।
১৯। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী জাতীয় জীবনের একটি অবিস্মরণীয়। দিন। এই দিনে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ৪র্থ সংশােধনীর মাধ্যমে জাতির রাষ্ট্রীয় জীবনে। এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এই পরিবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য সমাজের দুর্নীতি অপসারণ, ক্ষেতে-খামারে, কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় সংহতি দৃঢ়বদ্ধ করা এবং সেই জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধন। সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরের জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি ও সুশৃঙ্খল শােষণমুক্ত সমাজ গড়িয়া তুলিবার প্রয়াসেই এই সংবিধানের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছিল।
২০। কৃষক-শ্রমিকসহ সকল মেহনতী মানুষের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা আমাদের জাতীয় জীবনের আর একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। এই বৎসর ঐতিহাসিক ৭ই জুনে রাষ্ট্রপতি এই জাতীয় দলের গঠনতন্ত্র ঘােষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বানে দেশ গড়ার ডাকে, জাতীয় জীবনে যে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সাড়া পড়িয়াছে, তাহাতে আমি বিশ্বাস করি যে, জাতীয় জীবনে যে জড়তা, যে পঙ্কিলতা দেখা দিয়াছিল তাহা আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির চেতনাঘাতে অদূর ভবিষ্যতে দূরীভূত হইবে এবং জাতি এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসর হইতে সক্ষম হইবে, যেমন করিয়া। তাহারা স্বাধীনতার সংগ্রামে অগ্রসর হইয়াছিল।
পৃষ্ঠা: ২৪৫

২১। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রশাসনিক নৈপূণ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়ােজনমত পুনর্গঠনেও সরকার এ বছর বেশ কয়েকটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছেন। শাসন পদ্ধতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার জেলা প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস ও প্রশাসনের মৌল সংগঠনের পরিবর্তন করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হবে ও নতুন জেলাসমূহের প্রশাসনভার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রশাসনিক কাউন্সিলের উপর ন্যস্ত করা হইবে। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম অধিবেশনে এই নূতন প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিশদ রূপরেখা প্রদান করিয়াছেন।
২২। ১৯৭৫-৭৬ অর্থ বৎসরের বাজেট আলােচনা করিবার পূর্বে সংসদকে আমি ১৯৭৪-৭৫ সালের সংশােধিত বাজেট সম্পর্কে অবহিত করিতে চাই। ১৯৭৪-৭৫ সালের মূল রাজস্ব বাজেটে অভ্যন্তরীণ প্রাপ্তি ধরা হইয়াছিল ৫৫৯.৩৭ কোটি টাকা। অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪৭০.২৩ কোটি টাকা। ইহার ফলে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়াইয়াছিল ৮৯.১৪ কোটি টাকা। চলতি বৎসরের সংশােধিত রাজস্ব বাজেটে আয় ধরা হইয়াছে ৫৯৫.৫০ কোটি টাকা, ব্যয় ধরা হইয়াছে ৫৩১.১৩ কোটি টাকা, যাহার। ফলে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব বাজেটে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৬৪.৩৭ কোটি টাকা।
২৩। এইক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, সংশােধিত বাজেটে বিক্রয় কর, আয় কর, কর্পোরেশন কর, এবং স্ট্যাম্প, বন, রেজিস্ট্রিকরণ খাতে প্রাপ্তি উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান প্রধান কারণ হইতেছে খাদ্যে ভর্তুকি পাট শিল্প সংস্থা ও চা বাের্ডকে ভর্তুকি প্রদান বন্যাকবলিত এলাকায় খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ খাতে অধিকতর বরাদ্দ ও রেলওয়ের ব্যয় বৃদ্ধি।
২৪। ১৯৭৪-৭৫ সালের মূল বাজেটে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের বাহিরে বৈদেশিক ঋণ ও মঞ্জুরীসহ নীট প্রাপ্তি ছিল ৪৫৭.৯৭ কোটি টাকা। ইহার তুলনায় সংশােধিত বাজেটে এই নীট প্রাপ্তি দাঁড়াইয়াছে ৪৪২.০১ কোটি টাকা। নীট প্রাপ্তি হ্রাসের বিবিধ কারণের মধ্যে পাট বাণিজ্য সংস্থাসমূহ এবং পাট শিল্প সংস্থাকে মােটা অংকের ঋণদান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানে মূলধন বিনিয়ােগ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সংশােধিত বাজেটে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের উদ্বৃত্ত ৬৪.৩৭ কোটি টাকা এবং অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের বাহিরে নীট প্রাপ্তি ৪৪২.০১ কোটি টাকা মিলাইয়া, উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর খরচের জন্য মােট অংক দাঁড়ায় ৫০৬.৩৮ কোটি টাকা। মূল বাজেটে বার্ষিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর মােট বরাদ্দ ছিল ৫২৫ কোটি টাকা, সংশােধিত বাজেটেও মােট বরাদ্দের পরিমাণ একই। ৫০৬.৩৮ কোটি টাকার মােট অংকের তুলনায় উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রয়ােজনীয় ব্যয় ১৮.৬২ কোটি টাকা বেশি। এই ১৮.৬২ কোটি টাকা ১৯৭৪-৭৫ সালের সংশােধিত বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি। ঘাটতি অর্থ সংস্থান মারফত এই ব্যবধান পূরণ করা হইবে।
২৫। ১৯৭৪-৭৫ সালের সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমে কৃষি ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান খাতে মােট ৯২.৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। সমগ্র উন্নয়ন
পৃষ্ঠা: ২৪৬

বাজেটের ইহা ১৭.৬ ভাগ। বন্যা ও ঘােড়াশাল সার কারখানায় দুর্ঘটনার ফলে ঈপ্সিত পরিমাণ সার সংগ্রহ ও বিতরণ করা সম্ভব হয় নাই। সংশােধিত পর্যায়ে ৮৭ লক্ষ ৭৫ হাজার মণের স্থলে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বিতরণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭ লক্ষ ৭৮ হাজার মণ। সেচ কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় পাম্প ও নলকূপ খননের ক্ষেত্রে মার্চ মাস পর্যন্ত ৪০,০০০টি সেচ পাম্পের স্থলে ৩৪,৬৫৮টি, গভীর নলকূপ ২,৭০০টির স্থলে ১,৮২২টি ও অগভীর নলকূপ ২,০০০টির স্থলে ৩০০টি বসান হয়। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর অধীনে এই বৎসর ১০টি থানাসহ বর্তমানে দেশের ১৬২টি থানা এই কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে।
২৬। চলতি বৎসরে শিল্প খাতে মূল উন্নয়ন বাজেটে ৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছিল, সংশােধিত বাজেটে ইহার বরাদ্দের পরিমাণ ৬৫ কোটি টাকায় নামিয়া আসে। এই বৎসরে চট্টগ্রামের টি. এস. পি. কারখানা এবং যশােহরের রাজ টেক্সটাইল মিলের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হইয়াছে। সিলেট মন্ড কারখানা এবং সাভার ও গােয়ালন্দে দুইটি সূতী কলের নির্মাণ কাজ এই বৎসরে সম্পন্ন ও চালু হইবে। রাজশাহী, দিনাজপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও বরিশালে সূতী কলের নির্মাণ কাজের প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইয়াছে। বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্যান্য ৫টি দেশের আর্থিক সহায়তায় এদেশের বৃহত্তম কারখানা, আশুগঞ্জ সার ও রসায়ন কারখানার জমি উন্নয়নের কাজ দ্রুত অগ্রসর হইতেছে। বাংলাদেশ সার, রসায়ন ও ভেষজ শিল্প সংস্থা ও সুইজারল্যান্ডের সিবা গেইগীর সহযােগিতায় চট্টগ্রামে একটি কীটনাশক ঔষধ তৈয়ারীর কারখানা স্থাপনের কাজও চলিতেছে।
২৭। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই বৎসর উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধিত হইয়াছে। গত ১৮ই এপ্রিল আমাদের প্রতিবেশি ও বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সংগে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার পানি বন্টন সমস্যার সমাধানের সূচনা হয়। এই বৎসর সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমে বন্যানিয়ন্ত্রণ ও পানি উন্নয়ন খাতে মূল বাজেটে বরাদ্দকৃত ৮০ কোটি টাকার স্থলে ইহার পরিমাণ বাড়াইয়া ৮৬ কোটি টাকা করা হয়। এই বৎসরের সমগ্র উন্নয়ন কার্যক্রমের ইহা হইতেছে শতকরা ১৬.৩ ভাগ। এই বৎসরের কার্যক্রমের অধীনে গৃহীত প্রকল্পসমূহের মধ্যে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প– ১ম পর্যায়, গঙ্গা কপােতাক্ষ, ২য় পর্যায়, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প— পাবনা প্রকল্প, কুড়িগ্রাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, কর্ণফুলি সেচ প্রকল্প, নােয়াখালী জেলার সদর মহকুমায় বহুমুখী জল নিষ্কাশন প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এতদ্ব্যতীত চাঁদপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা শহরসহ মােট ২৩টি শহর রক্ষা প্রকল্পের জন্যও বর্তমান বৎসরে কার্যক্রম গ্রহণ করা হইয়াছে।“কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে কুড়িগ্রাম ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম পাড়ে ৫ মাইল এবং মহেশখালী দ্বীপে ৩ মাইল বন্যা নিরােধ বাঁধের কাজ সম্পন্ন হইয়াছে। ইহা ছাড়া বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে বর্তমান বৎসরে প্রায় ১০০ মাইল বাঁধ নির্মাণ এবং খাল খনন কার্য সম্পন্ন করা হইবে।
২৮। বিদ্যুৎ খাতে সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমের আকার অপরিবর্তিত রহিয়াছে। এই বৎসর ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা
পৃষ্ঠা: ২৪৭

মােট ৭২০ মেগাওয়াটে উন্নীত হইবে। ৪০ মেগাওয়াট ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হইয়াছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন ক্ষেত্রে বিদ্যমান মােট ৬৫৪ মাইল ১৩২ কে. ভি. সঞ্চালন লাইনের সংগে শীঘ্রই আরও ১৫০ মাইল সঞ্চালন লাইন যুক্ত হইতেছে। শীঘ্রই ১৪টি মহকুমা সদরকে গ্রীডের সংগে সংযুক্তকরণ এবং ৬০টি থানা সদরকে বিদ্যুতায়ন করার কাজ সম্পন্ন হইবে ।
২৯। বেতবুনিয়া ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন বাংলাদেশের যােগাযােগের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এই কেন্দ্র স্থাপনের ফলে উপগ্রহের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সহিত বাংলাদেশের যােগাযােগের সূচনা হয়। ইহা আমাদের আন্তর্জাতিক টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থায় বিশেষ অবদান রাখিবে। সংশােধিত উন্নয়ন কার্যক্রমে যােগাযােগ খাতের বরাদ্দ ১৭ কোটি টাকা হইতে বাড়াইয়া ১৮.৫৯ কোটি টাকা। করা হইয়াছে। বেতার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করিবার জন্য শীঘ্রই নয়ারহাটে একটি ১০০০ কিলােওয়াট শক্তিবিশিষ্ট মধ্যম তরঙ্গ উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার চালু করা হইবে। উচ্চমানের যান্ত্রিক সুবিধাদি সম্পন্ন রামপুরাস্থ টেলিভিশন ভবন নির্মাণ এই বৎসরে সমাপ্ত হইয়াছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্র উক্ত স্থানে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে। পরিবহন খাতে সংশােধিত বাজেটে বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা হইতে বৃদ্ধি করিয়া ৮১.২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এই ক্ষেত্রে ঢাকা-আরিচা। জনপথে মিরপুর, কালীগঙ্গা ও বংশী সেতু এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে তুরাগ ও বাইমাইল সেতুর নির্মাণ এই বৎসরের উল্লেখযােগ্য সাফল্য।
৩০। শিক্ষা খাতে এই বৎসরের সংশােধিত কার্যক্রমে ২৮.৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। কারিগরি ও প্রকৌশলী শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের অধিকতর গুরুত্ব প্রদান অব্যাহত থাকে। স্বাস্থ্য খাতে সংশােধিত উন্নয়ন বাজেটে ২১ কোটি টাকার স্থলে ২১.৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই বৎসর সমন্বিত স্বাস্থ্য প্রকল্পের অধীনে ৯০টি সমন্বিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন। হইয়াছে। খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের কাজে এই বৎসর উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ। করা হইয়াছে। তৈল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য ৬টি বিদেশী কোম্পানীর সংগে চুক্তি সম্পাদিত হইয়াছে। ইহা ছাড়া মুলাদি ও বেগমগঞ্জে অনুসন্ধানমূলক কূপ খননের কার্য বিভিন্ন পর্যায়ে রহিয়াছে।
জনাব স্পীকার,
৩১। আমি এখন ১৯৭৫-৭৬ সালের বাজেট আলােচনা করিতে চাই। ১৯৭৫-৭৬ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান করের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব প্রাপ্তির পরিমাণ ৭৫৫.৩৮ কোটি টাকা ও অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতে ব্যয়ের বরাদ্দ ৫৯৯.১৯ কোটি টাকা অনুমান করা হইয়াছে। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত থাকিবে ১৫৬.১৯ কোটি টাকা।
৩২। আগামী বৎসর রাজস্ব আয় খাতে কর বাবদ ধরা হইয়াছে ৫৮৪.৬২ কোটি টাকা, এই বৎসর সংশােধিত বাজেটে ইহার পরিমাণ ছিল ১৪২.২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ কর বাবদ আগামী বৎসর ১৪২.৪১ কোটি টাকা বেশি পাওয়া যাইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। সংশােধিত বাজেটের চাইতে আগামী বৎসরের
পৃষ্ঠা: ২৪৮

বাজেটে আমদানী ও রপ্তানী শুল্ক বাবদ ১০০ কোটি, আবগারী শুল্ক বাবদ ১১ কোটি, বিক্রয় কর বাবদ ৪৭ কোটি ও আয় কর, কর্পোরেশন কর ইত্যাদি বাবদ ২০ কোটি টাকা বেশি পাওয়া যাইবে বলিয়া অনুমান করা হইয়াছে। অন্যান্য কর খাতে অবশ্য আয় ৩৫.৫৯ কোটি টাকা কম পাওয়া যাইবে। আগামী বৎসর করবহির্ভুত রাজস্ব খাত হইতে পাওয়া যাইবে এই বৎসরের ১৫৩.২৯ কোটি টাকার স্থলে ১৭০.৭৬ কোটি টাকা।
৩৩। ১৯৭৫-৭৬ সালের অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব ব্যয় বর্তমান বৎসরের সংশােধিত বাজেটের চাইতে ৬৮.০৬ কোটি টাকা বেশি। এই বৃদ্ধির হেতুর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, রেলওয়ে, আইন-শৃঙ্খলা ও সুদ প্রদান খাতে অধিকতর বরাদ্দ উল্লেখযােগ্য। আগামী বৎসর অপ্রত্যাশিত খাতে ৩০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রাখা হইয়াছে।
৩৪। ১৯৭৫-৭৬ সালের রাজস্ব ব্যয় বরাদ্দের বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে, গণমুখী শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসারকল্পে সরকারের ঘােষিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকিবে। দেশে আইন শৃঙ্খলার উত্তরােত্তর উন্নতির প্রতিও বাজেটে দৃষ্টি দেওয়া হইয়াছে। আগামী বৎসরে আয়ের পরিমাণ ১৯৭৪-৭৫ সালের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ব্যয়ের পরিমাণ যথাসম্ভব সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হইয়াছে, যাহাতে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদের হার যথাসম্ভব বৃদ্ধি পায়।
৩৫। আগামী বৎসরের বাজেটে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব খাতের বাহিরে বৈদেশিক ঋণ ও মঞ্জুরীসহ নীট প্রাপ্তি ধরা হইয়াছে ৭৯৪.১০ কোটি টাকা। ইহার সহিত রাজস্ব খাতের উদ্বৃত্ত ১৫৬.১৯ কোটি টাকা মিলাইয়া উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর জন্য পাওয়া যায় ৯৫০.২৯ কোটি টাকা। আগামী বৎসরের উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৯৫০ কোটি টাকা। ৯৫০.২৯ কোটি টাকার মােট সম্পদের চাইতে উন্নয়ন কর্মসূচীর ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব ২৯ লক্ষ টাকা কম। এই ২৯ লক্ষ টাকা ১৯৭৫-৭৬ সালের বিদ্যমান কর ভিত্তিক সামগ্রিক বাজেটের সামান্য উদ্বৃত্ত মাত্র।
৩৬। আগামী বৎসরের উন্নয়ন বাজেটের বিভিন্ন খাতওয়ারী বন্টন বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে, এই বৎসরের তুলনায় ১৯৭৫-৭৬ সালে টাকার অংক। সর্বক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাইয়াছে। আগামী বৎসর কৃষি ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান, জনসংখ্যা পরিকল্পনা, শিল্প, বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ খাতে বরাদ্দ উল্লেখযােগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে।
৩৭। ১৯৭৫-৭৬ সালে কৃষি ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান এই দুই খাতে মােট ১৬৩ কোটি টাকা রাখা হইয়াছে। ১৯৭৪-৭৫ সালে এই দুই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৯২.৩৭ কোটি টাকা। আগামী বৎসর কৃষিক্ষেত্রে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কতিপয় বলিষ্ঠ কর্মসূচী নেওয়া হইয়াছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে চাউল ও গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হইতেছে ৩৪ কোটি ৭৪ লক্ষ মণ। আগামী মৌসুমে নিবিড় চাষ (ইনটেনসিভ কালটিভেশন) সহ ৪০ লক্ষ বেল পাট উৎপাদন করা হইবে
পৃষ্ঠা: ২৪৯

বলিয়া ধরা হইয়াছে। ইক্ষু উৎপাদনের লক্ষ্য হইতেছে ১৮ কোটি ২৫ লক্ষ মণ । সার বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা মােট ১ কোটি ৬২ লক্ষ মণ। সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আগামী বৎসরের লক্ষ্যমাত্রা হইতেছে ৪২,০০০ সেচ পাম্প, ৩,৭৫১টি গভীর নলকূপ ও ৪,৫০০টি অগভীর নলকূপ।
৩৮। গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান ও সমবায় ক্ষেত্রে স্পেশাল গ্রামীণ সমবায় প্রবর্তনের পরিকল্পনা ১৯৭৫-৭৬ সালের উন্নয়ন কার্যক্রমের এক উল্লেখযােগ্য সংযােজন। এই পরিকল্পনার অধীনে জাতীয় উৎপদন বৃদ্ধির জন্য বাংলার প্রতিটি গ্রামে বাধ্যতামূলক ভিত্তিতে এই সমবায় গঠন করা হইবে। জমির মালিক, কর্মক্ষম সকল ভূমিহীন কৃষক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট জনগণকে এই সমবায় গঠিত ও পরিচালিত হইবে। আধুনিক উপকরণ প্রয়ােগের মাধ্যমে সম্ভাব্য সর্বাধিক উৎপাদনই এই সমবায়ের লক্ষ্য। আগামী বৎসর ন্যূন পক্ষে ৬০ হইতে ১০০ গ্রামকে এই কর্মসূচীর অধীনে আনয়ন করা হইবে এবং পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের সকল গ্রাম এই স্পেশাল সমবায় কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হইবে। এই ক্ষেত্রে আমি সরকারের পক্ষ হইতে জনসাধারণকে স্পষ্ট করিয়া জানাইয়া দিতে চাই যে, এই ব্যবস্থায় জমির মালিকানা জমির মালিকেরই থাকিবে, উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছে। এইজন্য ১৯৭৫-৭৬ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রমে আলাদাভাবে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। এই স্পেশাল গ্রামীণ সমবায় কর্মসূচী সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সাধারণ কর্মসূচীর অতিরিক্ত। এই ব্যবস্থায় শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি পাইবে তাহাই নহে, বাংলার গ্রামে গ্রামে যে অসংখ্য ভূমিহীন কৃষক রহিয়াছে। তাহাদের কর্মসংস্থান হইবে এবং দেশের বেকার সমস্যার স্থায়ী ও ফলপ্রসূ সমাধান ঘটিবে। জাতীয় কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য, শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে যেমন উৎপাদনের আকার বাড়াইতে হইবে, অন্যদিকে তেমনি সকলের ন্যায্য চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া সুষম বন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। উৎপাদনের এই সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলাদি, মালিক, মজুর, সরকার ও সমবায়সহ সমবায়ের সহিত সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিদের মধ্যে, শুধু তাহাদের উৎপাদন ক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই নহে উপরন্তু তাহাদের চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া সমবেতভাবে সৃষ্ট এই সম্পদের বন্টন করিতে হইবে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পিত স্পেশাল গ্রামীণ সমবায় প্রতিষ্ঠা এই গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও পুনর্বিন্যাসের পথে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে এক বিরাট পদক্ষেপ। ইহা ছাড়া আগামী বৎসর সমন্বিত পল্লী কর্মসূচীর অধীনে আরও ৮৮টি থানা আনয়ন করিবার প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহাসহ এই কর্মসূচীর অধীনে মােট থানার সংখ্যা দাঁড়াইবে ২৫০টি। পল্লীপূর্ত কর্মসূচী খাতে এই বৎসরে ১৮ কোটি ৬২ লক্ষ টাকার স্থলে আগামী বৎসর ২১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে।
৩৯। ১৯৭৫-৭৬ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ খাতে ১৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে, বরাদ্দের পরিমাণ এই বৎসরের তুলনায় ৫০ কোটি টাকা
পৃষ্ঠা: ২৫০

বেশী । আশা করা যাইতেছে যে, আগামী বৎসর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ কার্যক্রমের অধীনে গৃহীত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নের পর দেশে প্রায় তিন লক্ষ একর জমিতে বন্যা নিরােধ এবং প্রায় দেড় লক্ষ একরে ও অধিক জমিতে সেচ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হইবে।
৪০। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করিবার জন্য বিভিন্ন মৌলিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য চলতি বৎসরে কতিপয় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সীমিত উৎপাদন ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধার উপর জনসংখ্যা বিস্ফোরণের প্রবল চাপ যথাযথ প্রশমিত করাই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর অন্যতম লক্ষ্য। জনসংখ্যা সম্পর্কিত নীতি প্রণয়নের জন্য সরকার উপরাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীমণ্ডলীসহ একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় জনসংখ্যা কাউন্সিল গঠন করিয়াছেন। জনসংখ্যা পরিকল্পনা খাতে সরকার আগামী বৎসরের বরাদ্দ, বর্তমান ৭.৭৪ কোটি টাকা হইতে বাড়াইয়া ২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করিয়াছেন।
৪১। শিল্পক্ষেত্রে ১৯৭৪-৭৫ সালে সংশােধিত বাজেটে বরাদ্দ করা হইয়াছে। ৬৫ কোটি টাকা। আগামী বৎসর এই খাতে বরাদ্দ বাড়াইয়া ১৩৬ কোটি টাকা করা হইয়াছে। বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইয়াছে ৭১ কোটি টাকা। আগামী বৎসরে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যমান ক্ষমতার সদ্ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি বি.এম.আর. (ব্যালেন্সিং, মডারনাইজেশন এণ্ড রিপ্লেসমেন্ট) প্রকল্প হাতে লওয়া হইবে। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কারখানা নির্মাণে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। তাহা ছাড়া বস্ত্র শিল্প সংস্থার অধীনে সূতীকল প্রকল্পসমূহের যথেষ্ট অগ্রগতি ও চট্টগ্রামে কীটনাশক ঔষধ তৈয়ারী কারখানার প্রথম পর্যায়ে শেষ হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। বেসরকারী বিনিয়ােগ ক্ষেত্রে এবং কুটিরশিল্প সংস্থার অধীনে আগামী বৎসর উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধিত হইবে বলিয়া আশা করা যায়।
৪২। বিদ্যুৎ খাতে আগামী বৎসর ১৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে। আগামী বৎসর ১০৬ মাইল প্রাথমিক সঞ্চালন লাইন ও ১৭০০ মাইল বিতরণ লাইন স্থাপন করিবার প্রস্তাব রহিয়াছে। তাহা ছাড়া ১০৯টি থানার বিদ্যুতায়ন ও ২,৬৪৬টি গভীর নলকূপ ও পাম্পে বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ করা হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে। পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকরণ যথাসম্ভব ত্বরান্বিত করিবার জন্য গ্রামাঞ্চলে শক্তিচালিত পাম্প, গভীর ও অগভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও পল্লী অঞ্চলে বৈদ্যুতিক আলাে প্রদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হইবে।
৪৩। স্বাস্থ্য খাতে এই বৎসরে সংশােধিত বাজেটে বরাদ্দ ২১.৭৬ কোটি টাকার স্থলে আগামী বৎসরে ৩৩ কোটি টাকা ধরা হইয়াছে। আগামী অর্থ বৎসরে ১৫৩টি সমন্বিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হইবে বলিয়া আশা করা যায়। ১৯৭৫-৭৬ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে মােট বরাদ্দ ধরা হইয়াছে ৪৫ কোটি টাকা। সংশােধিত বাজেট এই বরাদ্দের পরিমাণ ২৮.৭৮ কোটি টাকা। সর্বস্তরে শিক্ষার
পৃষ্ঠা: ২৫১

প্রসার ও কারিগরি ও প্রকৌশলী শিক্ষার উপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান অব্যাহত থাকিবে। অর্থনৈতিক উন্নতির প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে জাতির বিশেষ করিয়া তরুণ সমজের, দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের প্রতিও এই বাজেটে প্রয়ােজনীয় দৃষ্টি দেওয়া হইয়াছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে সরকার ক্রীড়া খাতে ৩০ লক্ষ টাকা বিশেষ। বরাদ্দসহ ৮০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন। ইহা ছাড়া লােক শিল্প ও চারুকলা উন্নয়নের জন্যও সরকার আগামী বৎসর বিশেষ বরাদ্দ করিয়াছেন। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কার্যে সরকারের বিশেষ বিবেচনা অব্যাহত থাকিবে।
৪৪। পরিবহণ ক্ষেত্রে আগামী বৎসরের প্রকল্পের মধ্যে কুর্মিটোলা আধুনিক বিমান বন্দর চালু করার প্রচেষ্টা, হার্ডিঞ্জ ব্রীজের মেরামত ও পুনঃনির্মাণ সম্পন্ন করা ও রেলওয়ে কর্তৃক ৫০টি যাত্রীবাহী গাড়ী ও ৫০০ মালবাহী গাড়ীর আমদানী উল্লেখযােগ্য। পরিবহণ ও যােগাযােগ খাতে ১৯৭৫-৭৬ সালের বরাদ্দ যথাক্রমে ১২৫ কোটি ও ৩৪.৫০ কোটি টাকা।
৪৫। শ্রমিকদের বর্ধিত সুযােগ-সুবিধা প্রদান করিবার জন্য সরকার এই খাতে আগামী বৎসরের বরাদ্দ শতকরা ১৩৪ ভাগ বৃদ্ধি করিয়াছেন। অনুরূপভাবে সমাজ কল্যাণ খাতেও বরাদ্দের হার শতকরা ১০০ ভাগ বাড়ান হইয়াছে। সাইক্লোন রিকস্ট্রাকশন খাতে বাড়ান হইয়াছে ১৩.৫০ কোটি টাকা। জনসাধারণের আবাসিক সমস্যা দূরীকরণার্থে সরকার গৃহনির্মাণ ও ভূমি উন্নয়ন খাতে বর্তমান বরাদ্দ হইতে আগামী বৎসরে ৩২ কোটি টাকা বাড়াইয়াছেন।

জনাব স্পীকার,
৪৬। সরকারের রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেট প্রকৃতপক্ষে সরকারের পূর্ণ কর্মসূচীর পরিচায়ক নহে, দেশে যে সকল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহ রহিয়াছে তাহাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মসূচীর একটি বৃহৎ অংশ প্রতিফলিত হয়। অতএব সামগ্রিক জাতীয় অর্থ ব্যবস্থায় এই সকল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের গুরুত্ব অপরিসীম। ইহাদের মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান উন্নয়নমূলক কাজ করিতেছে। অন্যান্য সংস্থা দেশের অধিকাংশ শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন ও অন্যান্য কৃত্যকাদি পরিচালনা করিয়া থাকেন। অতএব জাতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে পূর্ণতর ধারণা পাইতে হইলে এই সকল প্রতিষ্ঠানের আয়, ব্যয় ও অন্যান্য আর্থিক বিবরণী সম্পর্কে অবহিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এইজন্য ৬৪টি এই জাতীয় বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের একটি নিবদ্ধ সংসদের সম্মুখে পৃথকভাবে সরবরাহ করা হইল। আশা করি জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য জনসাধারণ ইহার মাধ্যমে এই সকল প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে অবগত হইতে পারিবেন। এই ব্যবস্থার ফলে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের আর্থিক নিয়মানুবর্তিতা ও অর্থ ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিবে। এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থিক বিবরণী হইতে দেখা যাইবে যে উপরিউক্ত ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের ১৯৭৫-৭৬ সালের মােট আয়ের পরিমাণ ১৭৭১.৭৫ কোটি টাকা এবং ব্যয়ের বরাদ্দ
পৃষ্ঠা: ২৫২

১৭০০.০২ কোটি টাকা। এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করিতে চাই যে, এই প্রথমবারের মত এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের বাজেট সংসদের সম্মুখে সামগ্রিকভাবে পেশ করা হইতেছে। সময়ের স্বল্পতাহেতু এই নিবন্ধে অপূর্ণতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকিতে পারে, কিন্তু প্রথম প্রয়াস হিসাবে ইহা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।

কর প্রস্তাবসমূহ জনাব

স্পীকার,
৪৭। একটু আগে আমি সার্বিক রাজস্ব আয়ের একটি চিত্র আপনার সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছি। কর রাজস্ব সম্পর্কে বলা প্রয়ােজন যে, ইতিমধ্যে রহিত আমদানী লাইসেন্স কর এবং বিনিময় মুদ্রা করের হিসাব বাদে বর্তমান আর্থিক বৎসরের সংশােধিত বাজেটের তুলনায় আগামী আর্থিক বৎসরে কর খাতে প্রায়। ১৭৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব পাওয়া যাইবে। এই অতিরিক্ত অর্থ প্রধানত তিনিটি কারণে আদায় হইবে বলিয়া আশা করা যায়। প্রথমত বর্তমান বৎসরের তুলনায় আগামী বৎসর শুল্ক ও কর আরােপনীয় আমদানী পণ্যের মােট পরিমাণ ন্যূনপক্ষে শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া ধরা হইয়াছে। এই পূর্বভাস তথ্য ও বস্তুভিত্তিক। দ্বিতীয়ত আমাদের টাকার বিনিময় হার পুনর্নির্ধারণের ফলে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের উপর আমদানী শুল্ক হ্রাস করা সত্ত্বেও, বাকী যে সমস্ত দ্রব্যের মূল্যভিত্তিক শুল্কহার আরােপিত রহিয়াছে, তাহা হইতে বােধগম্যভাবেই শুল্ক আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইবে। উপরােক্ত দুইটি কারণে আমাদের তিনটি প্রধান পরােক্ষ করের মধ্যে আমদানী শুল্ক ও বিক্রয় কর এই দুইটি খাতে রাজস্ব সরাসরিভাবেই উল্লেখযােগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাইবে। অপরটি অর্থাৎ আবগারী শুল্ক খাতেও অধিকতর কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানীর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কিছু রাজস্ব বৃদ্ধি আশা করা যায়। তৃতীয়ত আমি আনন্দের সহিত উল্লেখ করিতে পারি যে, নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজস্ব প্রশাসনে প্রভূত উন্নতি সাধিত হইয়াছে। ফলে, পূর্ববর্তী আর্থিক বৎসরের তুলনায় রাজস্ব আদায়ে বর্তমান বৎসরে প্রশাসনিক উৎকর্ষের মাধ্যমে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি অর্জিত হইয়াছে। আমরা আশা করি আগামী বৎসরেও ইহার গতিধারা অব্যাহত রাখিয়া অধিকতর রাজস্ব আদায় সম্ভব হইবে। বিভিন্ন খাতে বিগত বৎসরের তুলনায় বর্তমান বৎসরের সংশােধিত বাজেটে এবং আগামী বৎসরের বাজেটের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের অংকগুলি হইতে এই সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাইবে।
৪৮। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং জনসাধারণের অর্থনৈতিক কল্যাণের লক্ষ্য সম্মুখে রাখিয়া আমি আগামী অর্থ বৎসরের জন্য কোন উল্লেখযােগ্য নতুন কর প্রস্তাব সংসদের সম্মুখে পেশ করিব না। বরং আয় কর ও সম্পদ করের ক্ষেত্রে কিছু কিছু করভার লাঘব করার প্রস্তাব করিব। এতদ্ব্যতীত ইতিমধ্যেই আমদানী
পৃষ্ঠা: ২৫৩

লাইসেন্স কর, বৈদেশিক মুদ্রা কর এবং পাট কর রহিত করা হইয়াছে। বর্তমান অর্থ বিলে আরাে কয়েকটি কর, যথা ঃ বাড়ী ভাড়া কর, উৎকর্ষ কর, জলযানের উপর আরােপিত কর, মাল পরিবাহী মােটরযানের উপর আরােপিত কর এবং যাত্রী ও মালের ভাড়া উপর আরােপিত ‘টোল’ রহিত করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। তদুপরি ব্যক্তিগত কৃষি আয়কে করারােপ হইতে দুই বৎসরের জন্য মওকুফ করার যে সিদ্ধান্ত সরকার পূর্বে গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহার মেয়াদ আরও এক বৎসর। অর্থাৎ আগামী বৎসর পর্যন্ত বাড়াইয়া দেওয়ার প্রস্তাব করা হইতেছে। আবার কতকগুলাে ক্ষেত্রে বর্তমান কর হারের এবং করারােপ বিধানাবলীর যৌক্তিকীকরণ, বিভিন্ন অর্থনৈতিক বাস্তবতার এবং সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সংগতি বিধান এবং কর হারসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্দেশ্যে কিছু কিছু প্রস্তাব অর্থ বিলে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে। এইবার আমি অর্থ বিলের বিধানবলীতে অন্তর্ভুক্ত মুখ্য প্রস্তাবসমূহের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করিতেছি।

বহিঃশুল্ক
৪৯। বর্তমানে সিগারেট শিল্পে ব্যবহৃত বেশীর ভাগ কাগজের উপর শতকরা। ১০০ ভাগ হারে মূল্যভিত্তিক (Ad valorem) বহিঃশুল্ক আরােপিত আছে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে উক্ত কাগজের উপর আকার এবং প্রকার ভেদে শতকরা ৪০ এবং ৫৫ ভাগ হারে শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। একই জাতীয় কাগজের উপর শুল্ক হারের এই অসমতা উপরােক্ত হারদ্বয়ের অসদ্ব্যবহারের সুযােগ সৃষ্টি করে। সুতরাং উক্ত কাগজের উপরেও শতকরা ১০০ ভাগ হারে শুল্ক ধার্য করিয়া শুল্কহারগুলির মধ্যে। ভারসাম্য বিধান করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ ৫ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হইবে।
৫০। মৎস্যজীবী কর্তৃক আমদানীকৃত ৩ প্লাই নাইলন সূতার উপর শুল্কের হার মূল্যভিত্তিক শতকরা ৫০ ভাগ। ইহা ছাড়া অন্য সকল প্রকার কৃত্রিম আঁশের সূতার উপরে শুল্কের হার পরিমাণভিত্তিক (Specific)। অপর পক্ষে কার্পাস এবং পশমী সূতার উপর শুল্কের হার অন্যান্য সামগ্রীর মতই মূল্যভিত্তিক। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের উঠা-নামার সঙ্গে পরিমাণভিত্তিক এই শুল্কহার সব সময়ই পিছনে পড়িয়া থাকে। তাই পরিমাণভিত্তিক এই শুল্ক হারের অবসান করিয়া সকল প্রকার কৃত্রিম সূতার উপরে শতকরা ৫০ ভাগ হারে মূল্যভিত্তিক শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। একই কারণে জরী সূতার মূল্যের উপর শতকরা ৭৫ ভাগ হারে শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ ১ (এক) কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব। আদায় হইবে।
৫১। বর্তমানে আমদানীকৃত লুব্রিকেটিং তৈলের উপরে শুল্কহার দুই প্রকার, যথা অনধিক ১ গ্যালনের খুচরা প্যাকিং-এ প্রতি গ্যালন ৩.২৫ টাকা, বাল্ক। প্যাকিং-এ প্রতি গ্যালন ২.৫ টাকা। পরিমাণভিত্তিক এই শুল্কহার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলজাত দ্রব্যের মূল্যের উঠা-নামার সাথে তাল মিলাইতে অক্ষম। তাহা ছাড়া দেশে উৎপাদিত লুব্রিকেটিং তৈলের উপরে আবগারী শুল্কের হারও
পৃষ্ঠা: ২৫৪

মূল্যভিত্তিক। এই বিবেচনায় পরিমাণভিত্তিক এই আমদানী শুল্ক হারের অবসান করিয়া লুব্রিকেটিং তৈলের খুচরা এবং বাল্ক প্যাকিং-এর উপরে যথাক্রমে শতকরা ৩৫ এবং ৩০ ভাগ মূল্যভিত্তিক শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণে বিশেষ কোন তারতম্য হইবে না।
৫২। বর্তমানে আমদানীকৃত সিগারেটের উপর শতকরা ৩০০ ভাগ আমদানী শুল্ক ছাড়াও শতকরা ১০০ ভাগ রেগুলেটরী শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। আমদানীকৃত মার্বেল চিপসের উপরেও শতকরা ৭৫ ভাগ হারে কেবলমাত্র রেগুলেটরী শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। বর্তমান আর্থিক বৎসর শেষ হওয়ার সাথে সাথে এইসব রেগুলেটরী শুল্কের মেয়াদ শেষ হইয়া যাইবে। উল্লিখিত দ্রব্য সামগ্রীর উপর এই অতিরিক্ত শুল্ক বহাল রাখার উদ্দেশ্যে সিগারেট এবং মার্বেল চিপসের উপর ধার্য রেগুলেটরী শুল্ক সাধারণ শুল্কের সাথে একত্রীকরণের প্রস্তাব করা হইয়াছে।

আবগারী শুল্ক
৫৩। সুরাবিহীন পানীয় দ্রব্যের উপর বর্তমানে খুচরা মূল্যের শতকরা ৩০ ভাগ হারে আবগারী শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। এই পদ্ধতিতে শুল্কারােপের প্রধানতম শর্ত হইতেছে দ্রব্যটির উপর পরিষ্কার, সহজদৃষ্ট এবং অনপনীয়ভাবে খুচরা বিক্রয় মূল্য মুদ্রণ করা। কিন্তু বােতলের ক্রাউন কর্কের উপর মূল্য মুদ্রণের কোন যন্ত্র বর্তমানে বাংলাদেশে না থাকার দরুন উপরােক্ত আইনগত বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করা সম্ভব হইতেছে না। কাজেই এই পদ্ধতি পরিবর্তন করিয়া পরিমাণভিত্তিক হারে বিজ্ঞাপিত ধার্যকরণ পদ্ধতিতে শুল্কারােপের প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে আপাতত কোন অতিরিক্ত রাজস্ব আশা করা যায় না।
৫৪। প্রায় এক দশক পূর্বে কাচা তামাকের বাজার দর যখন বর্তমান মূল্যের তুলনায় অনেক কম ছিল তখন পরিমাণভিত্তিক হারে (প্রতি পাউণ্ড ৬০ পয়সা) শুল্ক ধার্য করা হয়। এই শুল্কহার তামাকের বর্তমান মূল্যের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে পরিণত হইয়াছে। তাই নিয়ত পরিবর্তনশীল মূল্যমানের সঙ্গে সংগতি বিধানের উদ্দেশ্যে বর্তমান পরিমাণভিত্তিক নির্দিষ্টাংক শুল্কহারের স্থলে বিজ্ঞাপিত ধার্যকরণ পদ্ধতি। প্রবর্তন করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহাতে শুল্ক ব্যবস্থায় প্রয়ােজনীয় নমনীয়তা নিশ্চিত হইবে।
৫৫। তামাকজাত দ্রব্যের উপর শুল্ক ব্যবস্থা ক্রমে ক্রমে জটিলতায় আচ্ছন্ন। হইয়া পড়িয়াছে। ইহাতে কিছু কিছু অসামঞ্জস্য এবং প্রয়ােজনীয় নমনীয়তার অভাবও পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং তামাকজাত দ্রব্যগুলির সংজ্ঞা ও শুল্ক হারের পুনর্বিন্যাস করিয়া দ্রব্যটিকে বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতির আওতায় আনয়ন করিবার প্রস্তাব করা হইয়াছে। এই বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণে আপাতত কোন তারতম্য হইবে না।
৫৬। কাগজ ও কাগজ বাের্ডের উপর বর্তমানে প্রতি হন্দরে যথাক্রমে ১৫.০০ টাকা এবং ১০.০০ টাকা হারে শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। এই পরিমাণভিত্তিক
পৃষ্ঠা: ২৫৫

নির্দিষ্টাংকের শুল্কহার প্রাক-স্বাধীনতাকালীন সময়ে ধার্য করা হইয়াছিল। ইতিমধ্যে কয়েকগুণ মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও রাজস্ব একই হারে স্থির রহিয়াছে। কাজেই এই শুল্কহারের যৌক্তিকীকরণ প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। তফসীলে বলবৎ নির্দিষ্টাংক শুল্কহারের পরিবর্তে বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতিতে শুল্ক হার প্রবর্তন করা হইলে পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে তাল রাখিয়া সময়ে সময়ে প্রয়ােজনানুসারে শুল্কহারের। পরিবর্তন সাধন সহজতর হইবে। শুল্ক পদ্ধতির এই যৌক্তিকীকরণের ফলে বর্তমানে কোন অতিরিক্ত রাজস্ব আশা করা যায় না।
৫৭। বৈদ্যুতিক বাল্বের বেলায় বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতি বলবৎ থাকার ফলে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে শুল্কহারের সঙ্গতি বিধান সহজতর হইয়াছে। অথচ বৈদ্যুতিক টিউবের ক্ষেত্রে তফসীলে নির্দিষ্ট হার ধার্য থাকার দরুন মূল্য পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে শুল্কহারের সঙ্গতি বিধান এবং যৌক্তিকীকরণ কঠিন হইয়া পড়ে। কাজেই বৈদ্যুতিক বাল্বের মত টিউবের ব্যাপারেও একই বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হইয়াছে। এর ফলে কোন অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা নাই।
৫৮। রেডিও সেটের উপর বর্তমানে প্রতি সেট ২৫.০০ টাকা অথবা মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগ—যাহা অধিকতর—হারে শুল্ক ধার্য রহিয়াছে। সেট সংযােজনের উদ্দেশ্যে আমদানীকৃত সম্পূর্ণ বিযুক্ত ক্ষুদ্রাংশের ১৫০% হারে আমদানী শুল্ক আরােপিত রহিয়াছে। কিন্তু সম্প্রতি সরকার এক ব্যাণ্ড রেডিও সেটকে সম্ভাব্য নিম্নতম মূল্যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় আনয়নের নীতি গ্রহণ করিয়াছে। এই নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আমদানী পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যাণ্ডের। রেডিওর বিযুক্ত ক্ষুদ্রাংশের শুল্ক হ্রাস করিয়া সংযােজনােত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যাণ্ডের উপর বিভিন্ন হারে শুল্কারােপ করা প্রয়ােজন। এই উদ্দেশ্যে আবগারী শুল্ক হারের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করিয়া বিজ্ঞাপিত নির্ধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে শুল্কহার ধার্যকরণের প্রস্তাব করা হইয়াছে।

আয়কর
৫৯। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করিয়া এবং স্বল্প আয়ের মানুষের করভার কিছু পরিমাণ লাঘব করিবার উদ্দেশ্যে কর আরােপনীয় আয়ের নিম্নসীমা ৬,০০০ টাকা হইতে বাড়াইয়া ৮,৪০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।।
৬০। একই উদ্দেশ্যে কর রেয়াতের জন্য ছেলেমেয়েদের শিক্ষা খরচের। পরিমাণ ৯০০ টাকা হইতে বাড়াইয়া ১,৫০০ টাকা ধার্য করিবার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব কমিবে।
৬১। কর রেয়াতের জন্য বর্তমানে ব্যক্তিগত এলাউন্সের ক্ষেত্রে বিবাহিত এবং অবিবাহিত করদাতার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। এই এলাউন্সের পরিমাণ বিবাহিত
পৃষ্ঠা: ২৫৬

করদাতার ক্ষেত্রে অবিবাহিতদের অপেক্ষা অতিরিক্ত ১,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ফলে ৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।
৬২। তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আপ্যায়ন ভাতা আয়করমুক্ত করার প্রস্তাব করা। হইয়াছে। ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব কমিবে।
৬৩। নতুন গৃহাদি নির্মাণে উৎসাহ প্রদানের জন্য ১৯৭৫ সনের ১লা জুলাই হইতে ১৯৮০ সনের ৩০শে জুন পর্যন্ত যেসব গৃহাদি নির্মিত হইবে, বাসস্থান হিসাবে সেইগুলি ব্যবহৃত হইলে তদ্দরুন ৮,৪০০ টাকা পর্যন্ত বাৎসরিক আয় করমুক্ত করার প্রস্তাব করা হইয়াছে।
৬৪। বাধ্যতামূলকভাবে কোম্পানীর মুনাফা বন্টনে যে আইন আছে তাহার প্রয়ােগ ৩ (তিন) বৎসরের জন্য স্থগিত আছে। এই বৎসর সেই সময়সীমা উত্তীর্ণ হইবে। দেশের অর্থনৈতিক ও সার্বিক কল্যাণ মানসে এবং শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করিবার উদ্দেশ্যে এই বিধানের প্রয়ােগ আরও ২ (দুই) বৎসরের জন্য স্থগিত রাখার প্রস্তাব করা হইয়াছে।
৬৫। বর্তমানে যদি কোন নিয়ােগকর্তা চাকুরীর শর্ত হিসাবে কোন কর্মচারীকে বাসস্থানের জন্য বিনা ভাড়ায় বাড়ী দেন তবে সেই কর্মচারীর বেতনের সঙ্গে বেতনের শতকরা ১০% ভাগ, এবং আসবাবসহ হইলে শতকরা ১৫% আয় হিসাবে ধরা হয়। এইভাবে নিরূপিত আয়ের সঙ্গে প্রকৃত ভাড়ার কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু যদি কোন কর্মচারী তাহার নিয়ােগকর্তার নিকট হইতে নগদ ভাড়া পান। তবে সম্পূর্ণ ভাড়াই তাহার আয়ের সঙ্গে যােগ হয়। এই বৈষম্য লাঘব করিবার জন্য নগদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা পর্যন্ত করারােপ হইতে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহার ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।
৬৬। পুঁজিসম্পদ (Capital asscts) বিক্রয়ের ব্যাপারে দেখা যায় যে মূলধন মুনার(Capital gains) উপর আরােপযােগ্য কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাজারদর হইতে অনেক ক্ষেত্রে কম মূল্য দলিলে লেখা হইয়া থাকে। প্রচলিত আইনানুযায়ী প্রকৃত মূল্যের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ ও আদায় করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। কারণ তাহা করিবার জন্য আয়কর অফিসারকে ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সম্পর্ক প্রমাণ করিতে হয়। ইহা সহজসাধ্য নয় হেতু বহুক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার ন্যায্য রাজস্ব হইতে বঞ্চিত হয়। তাই এই ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাকে রােধ করিবার জন্য দলিলে লেখা মূল্য অগ্রাহ্য করিয়া বাজার দরে সঠিক মূল্যায়নের প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা আয়কর বিভাগকে দিবার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহাতে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি পাইবে।
৬৭। এই সঙ্গে আরাে প্রস্তাব করা যাইতেছে যে যদি কোন ব্যক্তি বসতবাড়ী বিক্রয়লব্ধ অর্থে নতুন কোন বসতবাড়ী ক্রয় বা নির্মাণ করেন এবং বিনিয়ােজিত মূলধনের মুনাফা যদি শেষােক্ত বসতবাড়ীর ক্রয়মূল্য বা নির্মাণমূল্য অপেক্ষা কম হয় তবে এই মুনাফার উপর কোন আয়কর দিতে হইবে না। প্রচলিত আইনানুযায়ী সম্পত্তি ক্রয়ের ১ (এক) বৎসর পরে যদি তাহা হস্তান্তর করা হয় তবে মুনাফার
পৃষ্ঠা: ২৫৭

৫০% ভাগকে আয়কর হইতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যৌক্তিকতার দিক দিয়া, বিশেষ করিয়া মুদ্রাস্ফীতির কারণে এই ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রয়ােজনীয়তা রহিয়াছে। সেই হেতু এইরূপ মুনাফার অব্যাহতির হার নিম্নলিখিতভাবে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হইতেছে:
সময় – অব্যাহতির হার
(ক) যে সমস্ত সম্পত্তি এক বৎসরের মধ্যে হস্তান্তর করা হইবে -শূন্য (খ) যে সমস্ত সম্পত্তি এক বৎসরের পর কিন্তু তিন বৎসরের মধ্যে হস্তান্তর করা হইবে। -মুনাফার ৩০% ভাগ।
(গ) যে সমস্ত সম্পত্তি তিন বৎসরের পর কিন্তু পনের বৎসরের মধ্যে হস্তান্তর করা হইবে। -মুনাফার ৫০% ভাগ।
(ঘ) যে সমস্ত সম্পত্তি পনের বৎসরের পর হস্তান্তর করা হইবে- মুনাফার ৭০% ভাগ।
৬৮। সরকার কর্তৃক ঘােষিত “নতুন পুঁজি বিনিয়ােগ নীতির” ফলে নতুন শিল্প-কারখানার কর অবকাশের (Tax holiday) শর্তের ক্ষেত্রে কিছু সংশােধনী অপরিহার্য হইয়া পড়ায় প্রয়ােজনীয় সংশােধনী অর্থ বিলে সন্নিবেশিত হইয়াছে।
৬৯। বর্তমানে সকল আয়করদাতাকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা এবং কতকগুলি পেশার ক্ষেত্রে অধিক হারে প্রাক্তন প্রাদেশিক আইনের আওতায় ফাইন্যান্স ট্যাক্স দিতে হয়। স্বাধীনতা-উত্তর জাতীয় সরকারের কর প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উপরােক্ত কর রহিত করিয়া ইহার ৫০ টাকা আয়করের সঙ্গে একত্রীকরণের প্রস্তাব করা হইতেছে। এই উদ্দেশ্যে অর্থ বিলের আয়কর হার কাঠামাের পুনর্বিন্যাস সংযােজিত হইয়াছে। ইহার ফলে উক্ত কর খাতে হ্রাস-বৃদ্ধি হিসাব করিয়া নীট ১৫ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

সম্পদ কর
৭০। ১৯৭৩ সনের অর্থ আইনে করমুক্ত নীট সম্পদের নিম্নসীমা ২ (দুই) লক্ষ টাকাতে ধার্য করা হইয়াছিল। মুদ্রাস্ফীতির ফলে করমুক্ত নীট সম্পদের বর্তমান নিম্নসীমার যৌক্তিকীকরণের প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। সেই কারণে এই সীমা দুই লক্ষ টাকা হইতে চারি লক্ষ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হইতেছে। উপরন্তু এই করের বর্তমান সর্বোচ্চ হার (৬%) অত্যাধিক বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। কাজেই সর্বোচ্চ হার ৩% ধার্য করিয়া হার কাঠামােটিকে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহার ফলে ২ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

বিক্রয় কর
৭১। প্রচলিত আইনানুযায়ী লাইসেন্সধারী প্রস্তুতকারক বা উৎপাদনকারীকে আমদানীকৃত কাঁচামাল বা আংশিকভাবে উৎপাদিত মালের উপর আমদানী পর্যায়ে কোন বিক্রয় কর দিতে হয় না। স্থানীয় খরিদের ব্যাপারেও লাইসেন্সধারী উৎপাদনকারী ক্রয় পর্যায়ে অনুরূপ সুবিধা ভােগ করেন। বাস্তবক্ষেত্রে এই সুবিধার
পৃষ্ঠা: ২৫৮

অপপ্রয়ােগ হওয়ায় এখন হইতে প্রত্যেক লাইসেন্সধারী প্রস্তুতকারককেও কর শােধ করিয়া কাঁচামাল খরিদ ও ছাড় করাইতে হইবে বলিয়া প্রস্তাব করা হইতেছে। পরে। কর নির্ধারণী আদেশের পর আদায়কৃত করের জন্য ক্রেডিট দেওয়া হইবে। একই কারণে লাইসেন্সধারী পাইকারী বিক্রেতার ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা উঠাইয়া দেওয়া। হইতেছে। ইহার ফলে প্রায় দুই কোটি টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে।

বাড়ী ভাড়া কর
৭২। উন্নয়নের জন্য অর্থ সংস্থান মানসে গত বৎসরে অর্থ বিলে বাড়ী ভাড়ার উপর এই কর আরােপিত হয়। রাজস্ব আয়ের উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন অতি প্রয়ােজনীয় গৃহনির্মাণকে উৎসাহিত করিবার উদ্দেশ্যে এই কর উঠাইয়া দেওয়ার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহাতে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

উৎকর্ষ কর
৭৩। অনুরূপ কারণে ১৯৭৪ সালের অর্থ বিলে উৎকর্ষ কর(Betterment tax) আরােপের বিধান করা হয়। বিতরণমূলক ব্যবসার ক্ষেত্রে আরােপনীয় করসমূহের জটিলতা বৃদ্ধি এবং তাহার বােঝা ক্রেতাসাধারণের উপর চাপাইয়া দেওয়ার প্রবণতা রােধ করিবার উদ্দেশ্যে এই করটিও রহিত করিবার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহার ফলে প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।

বিবিধ কর
৭৪। জনসাধারণের করভার এবং হয়রানী লাঘব করিবার উদ্দেশ্যে এবং কর প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস ও উৎকর্ষ বিধানের স্বার্থে আরাে চারটি সামান্য রাজস্ববিশিষ্ট। কর যথা ঃ (১) জলযানের উপর আরােপিত কর, (২) মাল পরিবাহী মটরযানের উপর আরােপিত কর এবং (৩) যাত্রী ও মালের ভাড়ার উপর আরােপিত ‘টোল’ রহিত করিবার প্রস্তাব করা হইতেছে। ইহার ফলে মােট প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা রাজস্ব হ্রাস পাইবে।
৭৫। আমি এইমাত্র যে সকল প্রস্তাব আলােচনা করিলাম তাহা হইতে অতিরিক্ত নীট ১ কোটি ২২ লক্ষ টাকা পাওয়া যাইবে। ইহার সহিত পূর্বে উল্লখিত সামান্য উদ্বৃত্ত ২৯ লক্ষ টাকা যােগ করিলে মোেট আগামী বৎসরের বাজেটের সামগ্রিক উদ্বৃত্ত ১ কোটি ৫১ লক্ষ টাকায় দাঁড়াইবে।

জনাব স্পীকার
৭৬। চলতি বৎসরে যদিও আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা অর্জন করিতে পারি নাই তবুও আমাদের এই বৎসরের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব হইতেছে এই যে, আমরা উন্নয়ন কার্যক্রমের সাফল্যের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির পথ সুগম করিবার জন্য, প্রয়ােজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রশাসন
পৃষ্ঠা: ২৫৯

যন্ত্রকে কার্যকরী ও শক্তিশালী করিবার ক্ষেত্রে কতিপয় উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করিবার প্রচেষ্টা পাইয়াছি। আমরা মুদ্রানীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কতিপয় মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করিতে সক্ষম হইয়াছি। সর্বোপরি জাতীয় সার্বিক প্রবৃদ্ধির প্রয়াসে আমরা দল-মত-শ্রেণী নির্বিশেষে সকলকে একক দলের নেতৃত্বে সুসংবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছি। আমার বিশ্বাস, বর্তমান বৎসরে এই দৃঢ় পদক্ষেপসমূহ আমাদের জাতীয় উন্নতির পথ প্রশস্ত করিতে বিশেষ ফলপ্রসূ অবদান রাখিবে।
৭৭। পরিশেষে আমি বলিতে চাই যে, এই বাজেট সর্বপ্রকার জাতীয় সমস্যার সমাধান করিবে এই প্রতিশ্রুতি আমি দিতেছি না, তবে এই কথা আমি দৃঢ়প্রত্যয়ের সহিত বলিতে পারি যে, আমরা উন্নয়ন কার্যক্রমের সর্বাঙ্গীণ সফলতার জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট হইয়াছি তাহা জাতিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাইতে সাহায্য করিবে। ১৯৭৫-৭৬ সনের বাজেটের উদ্দেশ্য হইতেছে এমন একটি বাৎসরিক কর্মসূচী প্রণয়ন যাহা জনগণকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করিবে, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি রােধ করিবে, জাতীয় নীট সঞ্চয় বাড়াইবার জন্য প্রয়ােজনীয় কৃচ্ছু সাধনায় উৎসাহিত করিবে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে সম্পদের এইরূপ বন্টন নিশ্চিত করিবে যাহাতে সীমিত সম্পদের সর্বাধিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়।
৭৮। তবে এই সবই হইতেছে আমাদের যাত্রা শুরুর শুভ আয়ােজন মাত্র। বহু বাধা-বিপত্তির দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়া পৌছাইতে হইবে আমাদের সম্ভাব্য সমৃদ্ধির লক্ষ্যে। তাই আমাদের সকলকে সব রকম সংকীর্ণতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়া ত্যাগ ও সহনশীলতার মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাইতে আগাইয়া আসিতে হইবে দ্বিধাহীন চিত্তে। আমরা যদি এই প্রচেষ্টার উদ্‌যােজনে অসমর্থ হই তাহা হইলে আমাদের বহু আকাংখিত বহু রক্তের বিনিময়ে লব্ধ স্বাধীনতা নিরর্থক হইয়া যাইবে; আগামী দিনের সােনালী স্বপ্ন হইবে সুদূরপরাহত।
৭৯। অতএব আসুন আমরা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের নীতিকে অনুসরণ করিয়া অর্থনৈতিক মুক্তি ও শােষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়া বন্দিত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইবার ঐক্যবদ্ধ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করি।

খােদা হাফেজ। জয় বাংলা।
সংক্ষিপ্ত বাজেট বক্তৃতা
২৩, জুন ১৯৭৫

পৃষ্ঠা: ২৬০

Reference:
আমার জীবন কথা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম – এ. আর .মল্লিক পরিশিষ্ট

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!