You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.10.22 | ‘রাষ্ট্রপ্রধানের পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ -দশজন আলেমের বিবৃতি - সংগ্রামের নোটবুক

‘রাষ্ট্রপ্রধানের পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ -দশজন আলেমের বিবৃতি
(বিশ্ববিখ্যাত ও দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরামের ফতোয়া)

• মরহুম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী
• মরহুম মাওলানা সৈয়দ সোলেমান নদভী
• মাওলানা মূফতী মোহাম্মদ শফী
• মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
• মাওলানা আতাহার আলী
• মাওলানা শামছুল হক (ফরিদপুরী)
• মাওলানা নুর মোহাম্মদ আযমী
• মাওলানা তাজুল ইসলাম
• শর্ষিনার পীর শাহ মাওলানা মোহাম্মদ ছিদ্দিক
• মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম

কে ছিলেন হজরত বিলকিস?
হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী(রাঃ) বলেনঃ

রাষ্ট্র ব্যাবস্থা তিন প্রকার,- রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সদস্যদের সমবায়ে গঠিত পরিষদই রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসনকর্তা। রাষ্ট্রপ্রধান এ পরিষদের একজন সদস্য মাত্র। তিনি জাতি কর্তৃক মনোনীত বা নির্বাচিত হলেও তার পূর্ণ কর্তৃত্ব এখানে নাই। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনিও পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের মত একজন পরামর্শদাতা মাত্র যদিও তার মত অন্যান্য একক সদস্যের মতের তুলনায় অগ্রাধিকার লাভ করে থাকে তথাপি এতে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। যদি তাই হতো তবে অন্যান্য সদস্যদের সমবেত মতের বিরুদ্ধে তার মতামতই প্রাধান্য লাভ করতো; কিন্তু বাস্তবে তা কখনও হয় না।
কোরান মজিদে হজরত বিলকিসের রাজত্ব কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে তার কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে…‘‘মা কুনতু কাতেয়াতান আমরান হাত্তা তাশহাদুন’’ অর্থাৎ বিলকিস তার সভাসদগণকে বলেন, “আপনাদের উপস্থিতি ব্যতীত আমি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না’’- এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি শাসনতন্ত্র অনুসারেই হোক বা বিলকিসের স্বাভাবিক অনুসৃত রীতি অনুসারেই হউক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুরূপই ছিল।
হজরত বিলকিসের মুসলমান হবার পর তার রাষ্ট্রাধিকার কেড়ে নেবার কোন প্রমাণ নেই বরং তার রাজ্য যে আগের মতই বহাল ছিল, ইতিহাসের তার যথেষ্ঠ প্রমাণ রয়েছে। বিলকিসের রাজত্বে ও রাজ্য শাসন পদ্ধতির প্রতি কোরানে কোনরূপ অবজ্ঞা ও অসমর্থন জ্ঞাপন করা হয়নি। উসুলে ফেকাহর সুবিধিত বিধান হচ্ছে, কোরান বা হাদিসে যদি অতীতের কোন ঘটনা বা ব্যবস্থাকে কোনরূপ অবজ্ঞা বা অসমর্থন প্রকাশ না করে বর্ণনা করা হয় তবে তা শরীয়তে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হতে পারে। সুতরাং বর্ণনা থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মহিলার নেতৃত্ব চলিতে পারে।
(ইমদাদুল ফাতাওয়া তাতিম্মায়ে ছানিয়া ১৬৯-৭০:৫৪ বৎসর পূর্বে প্রদত্ত)
(দৈনিক আজাদ, ২২শে অক্টোবর ১৯৬৪ ইং)

মাওলানা সৈয়দ সোলেমান নদভী ছাহেব বলেনঃ

রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলাম যেসব শর্তারোপ করেছে তা পালন করা কোন মহিলার পক্ষে দুঃসাধ্য। এ জন্যই নারী জাতিকে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু এই একমাত্র কারণে যদি কেহ মনে করেন যে কোন অবস্থায়ই মহিলা মুসলমানদের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারেন না, তবে তা ভুল হবে। কারণ যখন জাতি কোন ফেতনা-ফাসাদের সম্মুখীন হয় এবং সে ফেতনা থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কোন ব্যক্তিত্ব জনগণের দৃষ্টিতে কোন মহিলা ব্যতীত আর না থাকে, তবে উক্ত মহিলাকেই জাতির নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে।
(সীরাতে আয়েশা, ৩য় খ-১১৩ পৃঃ)

হজরত মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ শফী ছাহেব বলেনঃ

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ইসলামী শিক্ষা ও ঐতিহ্যের খেলাপ নহে।
(দৈনিক জঙ্গ, ৩রা নভেম্বর, ১৯৬৪ ইং)

হজরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ছাহেব বলেনঃ

এখন আমি এমন একটি বিষয়ে বলবো, যা খুব জোরে-শোরে তোলা হচ্ছে এবং কিছুসংখ্যক আলেম ও পীরদের দ্বারাও যা লোকসমক্ষে প্রচার করানো হচ্ছে- তা হলো রাষ্ট্রপ্রধান মহিলাকে নিযুক্ত করা। বলা হচ্ছে যে, ইসলামে কোন নারীকে মুসলমানদের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান বানানো যায় না। এই ব্যাপারে বিশেষ করে আমার লেখা বই থেকে নানা উদ্ধৃতি পেশ করা হচ্ছে। আর আমি সময় ও সুযোগ দেখে ইসলামের নীতি পরিবর্তন করে ফেলি বলে আমার নামে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এর জওয়াবে আমি অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে পারি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারীকে মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী এবং বিদেশে রাষ্ট্রদূত বানানো যায় কি? ছেলে ও মেয়েদের সহ-শিক্ষা ব্যবস্থা কি ইসলামসম্মত? পুরুষ ও মেয়েলোকের একত্রিত হয়ে একই অফিসে কাজ করা কি জায়েজ? স্টেজে নেমে মেয়েদের নাচ, গান করা কি ইসলাম সমর্থন করে? উড়োজাহাজে যুবতি মেয়েরা সেবিকা হয়ে পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে মদ পরিবেশন করে, তা কি জায়েজ… আর এসব যদি নাজায়েজ কাজই হবে, তাহলে আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ মেনে কাজ করা হয়নি কেন? এ সব ব্যাপারে ইসলামের কথা স্মরণ করা হয়নি কেন? আর আজ নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার প্রশ্নেই কেবল ইসলামের দোহাই দেয়া হয় কেন? এ হচ্ছে পাল্টা প্রশ্ন। এর পরে আমি আসল বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি আপনাদের সামনে পেশ করছি।
একথা সর্ববাদীসম্মত যে, ইসলামে রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ নীতিগতভাবে পুরুষদের কর্মক্ষেত্রের আওতার মধ্যে রাখা হয়েছে, এসবের দায়িত্ব পালনে মেয়েলোকদের শরীক করা হয়নি। মুসলমানদের আমীর বা নেতা হবার জন্যে যেসব শর্ত করা হয়েছে তার মধ্যে পুরুষ হওয়াটা একটা শর্ত, একথা অস্বীকার করা যায় না। আমি নিজেই এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ সহকারে বলিষ্ঠভাবে ইতিপূর্বে কয়েকবারই বলেছি, আর আজও আমি এই কথারই পুনর্ঘোষনা করছি।
কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে আমাদের সামনে বিষয়টি এ সাদাসিধেভাবে উপস্থিত হয়নি যে, নারী মুসলমানদের আমীর হতে পারে কিনা তা নিয়েই আমরা মাথা ঘামাতে বসবো। বরং আমরা বর্তমানে এক বিশেষ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আছি, তা হচ্ছে এইঃ
• দেশে এক জবরদস্তিমূলক অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে রয়েছে, তা আমাদের ধর্ম, চরিত্র, তাহজীব-তামাদ্দুন, অর্থনীতির পক্ষে অত্যন্ত মারাত্নক।
• এ ধরণের শাসন ব্যবস্থাকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় পরিবর্তন করার জন্য আগামী নির্বাচনে খোদার দেয়া এক মহা সুযোগ পাচ্ছি।
• দেশে মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহ ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তিত্ব এমন নেই যাকে কেন্দ্র করে দেশের বিরাটসংখ্যক লোক একত্রিত হতে পারে, অ্যার নির্বাচনে সফলতা লাভ করতে পারে ও এই উপায়ে বর্তমান স্বৈরতন্ত্রী জালেম শাসন ব্যবস্থাকে খতম করে দেয়ার কোন সম্ভাবনা হতে পারে।
• মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহর প্রার্থী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাধারণ জনতা তার সমর্থনে কোমর বেধে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
• তার পরিবর্তে অপর কোন ব্যক্তিকে দাড় করানো কিংবা এই নির্বাচনী সংগ্রামে নিরপেক্ষ থাকার মানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকেই সাহায্য করা।

এমতাবস্থায় আমাদের সামনে আসল প্রশ্ন হচ্ছে যে, একজন মেয়েলোকের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কি শরীয়তে এতই আপত্তিকর যে তাকে সমর্থন না করে তার বিপরীত বর্তমান জবরদস্তি আর অত্যাচার জুলুমের শাসনকে মেনে নিতে হবে? আমার মতে ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখে এমন কোন ব্যক্তিই বলতে পারে না যে, একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান করার পরিবর্তে এই স্বৈরাচারী ও জালেম শাসনকে কবুল করা উচিত। বরং আমি তো বলবো, একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানো যদি এক আনা দোষের কাজ হয় তা’হলে তার মুকাবিলায় বর্তমান অত্যাচারী ও জালেম শাসনকে বাঁচিয়ে রাখলে কমপক্ষে দশগুণ বেশী গুনাহ হবে। আর খোদার শরীয়ত তো অনেক বড়, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির একটি বালকও এক টাকা বাঁচানোর জন্য দশ টাকার ক্ষতি স্বীকার করাকে পছন্দ করতে পারে না।
এছাড়া, একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইসলামের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান পুরুষ হওয়া একটি শর্ত বটে, কিন্তু নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণ হারাম- এমন হারাম যে, অত্যন্ত ও সাংঘাতিক প্রয়োজন দেখা দিলেও তা জায়েজ হবে না, এমন কথা কেউই বলতে পারে না। কোরআন-হাদিস থেকে যদি কেউ তা প্রমাণ করতে পারেন তবে করুণ, আমরাও দেখবো। আসলে ইসলামের সাধারণ নিয়মের মধ্যে আমরা কোনই পরিবর্তন করছি না, না তার কোন সংশোধন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বর্তমানের এই বিশেষ ধরণের অবস্থার কতিপয় প্রয়োজন দেখা দেওয়ার কারণে একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা জায়েজ মনে করছি মাত্র। কেননা, এ কাজ যে চূড়ান্ত ও স্থায়ীভাবে হারাম- এ কথা প্রমাণ করার কোন দলিলই আমরা শরীয়তে পাইনি, এখন একজন নারীকে যদি আমরা মেনে না নেই, তা’হলে তার অপেক্ষা বহুগুণ বেশী বড় অন্যায়কে মেনে নিতে হয়, এবং তা এত বড় যে, শুধু নৈতিক দৃষ্টিতেই নয়, ইসলামের দৃষ্টিতেও তা অত্যন্ত বড় অন্যায় কাজ হয়ে পড়ে।
এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। তা হচ্ছে এই যে ইসলামে রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে কেবল পুরুষ হওয়াই কি একমাত্র শর্ত?… না সেই সঙ্গে আরো অনেক কয়টি শর্ত আছে? কোন এক বিশেষ সময়ে আমাদের সামনে যদি দুই ব্যক্তির মধ্যে একজনকে গ্রহণ করার প্রশ্ন দেখা দেয়, দুজনের একজনকে অনিবার্যভাবে কবুল করে নিতে হয়, আর তাদের একজনের মধ্যে কেবল নারী হওয়া ছাড়া অন্য কোন আপত্তিকর জিনিস না থাকে এবং অপর জনের মধ্যে কেবল পুরুষ হওয়া ছাড়া অন্য সব দিকই হয় মারাত্নকভাবে আপত্তিকর, তা’হলে ইসলামের জ্ঞানসম্পন্ন কোন ব্যক্তি কি আমাদিগকে নারীকে গ্রহণ না করে সেই পুরুষকেই গ্রহণ করার জন্যে বলতে পারে?
ভাইগণ, নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ের শরীয়তের দৃষ্টিতে এ-ই হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা। এই কারণেই আমরা আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমতাবস্থায় আমি দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন করতে চাই, আপনারা দেশের অধিবাসীরা- কেউই যেন এই নাজুক ও জটিল সংকটের সময় গাফিল হয়ে বসে না থাকেন- এই সুবর্ণ সুযোগকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে কাটিয়ে না দেন। খুব শান্তভাবে ঠান্ডা মনে চিন্তা করে ফয়সালা করুনঃ বিগত ছয় বছর ধরে দেশবাসী যে অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণের তলে নিষ্পেষিত হচ্ছে তাকেই কি স্থায়ী করে রাখতে চান?…. না, এ-কে পরিবর্তন করে এমন এক শাসন-ব্যবস্থা কায়েম করার ইচ্ছা রাখেন, যাতে দেশবাসী এক স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে জীবন যাপন করার সুযোগ পাবে ও নিজেদের যাবতীয় গুরুতর ব্যাপারে নিজেরাই ফয়সালা গ্রহণ করতে পারেন? প্রথম অবস্থা গ্রহণ করিতে যদি আপনারা রাজী না হন, বরং দ্বিতীয় অবস্থাকেই দেশে বহাল রাখতে চান, তাহলে খোদার ওয়াস্তে বলছি এই সুযোগকে কিছুতেই হারাবেন না। আপনার ভোট পূর্ণ দৃঢ়তার সঙ্গে কেবলমাত্র সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষে- মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহর নামে-ব্যবহার করুন। এই সুবর্ণ সুযোগ যদি আপনারা হেলায় হারিয়ে ফেলেন, তা’হলে আপনাকে এবং আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরদের এর কুফল দীর্ঘকাল পর্যন্ত ভোগ করতে হবে।
আমি খোদার নিকট দোয়া করছি, তিনি যেন আমাদের সকলকে সঠিক ও নির্ভূল পথ দেখান এবং ভুল পথে যাওয়া থেকে যেন তিনি আমাদিগকে রক্ষা করেন- আমীন।
(২৯শে নভেম্বর পল্টন ময়দানে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে)

মাওলানা আতাহার আলী সাহেব বলেনঃ

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহকে রাষ্ট্রপ্রধান পদে ভোট দেওয়া যাইতে পারে না বলিয়া একশ্রেণীর আলেম ও পীর নামধারী স্বার্থবাজ ব্যক্তি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের যে ধরনের বিকৃত উদ্ধৃতি ও অপব্যাখ্যা দান করিতেছেন তাহা আমি গভীর উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করিয়াছি। আরো পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার কুমতলবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ হইতে সেইসব বিকৃত উদ্ধৃতি ও অপব্যাখ্যামূলক তথ্যের ভিত্তিতে অসংখ্য পুস্তক-পুস্তিকা ঘরে ঘরে বিলিবন্টন করা হইতেছে।
এমতাবস্থায় খাঁটি সচেতন কোন আলেম ও পীরের পক্ষে কিছুতেই নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকা উচিত নহে। আমি দীর্ঘদিন যাবৎ রোগশয্যায় শায়িত থাকিয়াও এইরূপ পরিস্থিতিতে গভীর উৎকন্ঠা বোধ করিতেছি এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান পদে ভোট দেওয়া জায়েজ নহে বলিয়া যাহারা দাবী করিতেছেন, তাহাদিগকে উহা প্রমাণিত করার জন্য আমি চ্যালেঞ্জ প্রদান করিতেছি।
পক্ষান্তরে আমি ঘোষণা করতেছি যে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেব যিনি পবিত্র কোরানকে বিকৃত করিয়া বিভিন্ন ধরণের বিধান জারি করেঃ পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি চরম অবমাননা প্রদর্শন করিয়াছেন। “তাহাকে ভোট দেওয়া মুসলমানদের পক্ষে সম্পূর্ণ হারাম”।
এই ব্যাপারে কাহারও দ্বিমত থাকিলে তিনি ঢাকা ফরিদাবাদ এমদাদুল উলুম মাদ্রাসার ঠিকানায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ তর্কে প্রবৃত্ত হইতে পারেন।
স্বাঃ আতাহার আলী- ১০-১২-৬৪

মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী সাহেবদ্বয় বলেনঃ

যে ব্যক্তি আল্লাহর শাশ্বত চিরন্তন দ্বীনকে আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাইতেছেন, যিনি মুসলিম পারিবারিক আইনের নামে স্বরচিতআইনের দ্বারা আল্লাহ ও রসূলের পবিত্র শরীয়তকে বিকৃত করিয়াছেন এবং ইদ্দত, তালাক ও বিবাহ ইত্যাদি ব্যাপারে কোরানের সুস্পষ্ট আইনকে রহিত করিয়াছেন, তাহাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সমর্থন করা কোন মুসলমানের পক্ষে জায়েজ হইতে পারে না।
এইরূপ ব্যক্তির মোকাবেলায় এমন মহিলাকে প্রেসিডেন্ট করা কোনরূপেই অন্যায় হইবে না, যিনি এই শরীয়ত বিরোধী কাজ কখনও করেন নাই।
স্বাঃ নূর মোহাম্মদ আজমী
সেক্রেটারী, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল ওলামা, পূর্ব পাকিস্তান
স্বাঃ নাচিজ শামসুল হক (ফরিদপুরী)
প্রিন্সিপাল, জামেয়া কোরআনীয়া, লালবাগ, ঢাকা।
(১৯৬৪ সালের ৭ই ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে প্রকাশিত)

মাওলানা তাজুল সাহেব বলেনঃ

বর্তমানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনি প্রধান পুরুষ প্রার্থী-

১. তিনি জনসাধারণের ভোটাধিকার হরণ করিয়া পাকিস্তানের গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করিয়াছেন।
২. তিনি পাকিস্তানকে ইসলামী গণতান্ত্রিক পথ হইতে সরাইয়া একনায়কতন্ত্রের পথে লইয়া যাইতেছেন।
৩. তিনি মুসলিম পারিবারিক আইন জারি করিয়া শরীয়তকে বিকৃত করিয়াছেন এবং ইদ্দত, তালাক, ইসলামের আধুনিকীকরণের চেষ্টা ইত্যাদি ব্যাপারে পবিত্র কোরানের সুস্পষ্ট আইনকে রহিত করিয়াছেন, তাহাঁকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সমর্থন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে কিছুতেই জায়েজ হইতে পারে না, এতদসত্ত্বেও যাহারা তাহাঁকে সমর্থন করিবে, তাহারা ঐ ব্যক্তির যাবতীয় কৃতকর্মের গুণাহের সমঅংশী হইবে।

অপরপক্ষে যিনি মহিলা প্রার্থী-

১. তিনি পাকিস্তানের জন্মের পূর্বে ও পরে গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক।
২. তিনি জনগণের ভোটাধিকার ফিরাইয়া দিতে ওয়াদাবদ্ধ।
৩. তিনি একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটাইয়া পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করিতেছেন।
৪. তিনি কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক মুসলিম পারিবারিক আইনের অনৈসলামী ধারাসমূহ সংশোধন করার ওয়াদা করিতেছেন এবং পবিত্র শরীয়তকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করিতেছেন।
জাতির এই পূর্ণ সংকটময় মূহুর্তে কোরআন বিকৃতকারী ও গণতন্ত্র হত্যাকারীদের অপসারণ করা অপরিহার্য কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে।
এই কার্য সম্পাদন করিতে যদি কোন মহিলার আশ্রয় লওয়া হয়, তবে শরীয়তের দৃষ্টিতে তাহা নাজায়েজ হওয়ার কোনই কারণ নাই। বরং তাহাঁকে জয়যুক্ত করার সব প্রকার প্রচেষ্টা চালাইয়া যাওয়া অবশ্য কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে।
স্বাঃ তাজুল ইসলাম,৮-১২-৬৪
প্রিন্সিপাল, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া মাদ্রাসা।

শর্ষিনার পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ছিদ্দীক সাহেব বলেনঃ

একনায়কতন্ত্রমূলক সরকার কর্তৃক ইসলাম ও শরিয়তে ইসলামের খেলাফ কতকগুলি কাজ হওয়ায় দেশের জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া ওলামায়ে কেরাম ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতে বাধ্য হইতেছেন। কিন্তু এই সরকার সে সবের প্রতি কর্ণপাত না করায় দেশের জনসাধারণ ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন হককানী ওলামায়ে কেরামের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও অসন্তোষের ফলে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ইসলাম জনসাধারণের স্বার্থে এই সরকার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত শরীয়তের দাবীতে একান্তই সময়োপযোগী এবং শরীয়তসম্মত।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের চিন্তাশীল নেতৃবৃন্দ এবং ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্তকে আমি আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাইতেছি। এবং আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি আন্তরিকভাবে আবেদন জানাইতেছি যে, জনসাধারণ কর্তৃক অকুন্ঠভাবে সমর্থিত সম্মিলিত বিরোধী দলকে ইসলামের মহান স্বার্থে কামিয়াব করুন।
(দৈনিক আজাদ, ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৬৪ইং)

মাওলানা মোহাম্মদ আবদুর রহীম সাহেব বলেনঃ

নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া জায়েজ নাই বলিয়া শর্ষিনা হইতে সম্প্রতি যে ফতোয়া প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ মনগড়া কথায় পূর্ণ। তাহাতে যেসব দলিলের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার কোন একটি দ্বারাও একথা প্রমাণিত হয় না যে, নিতান্ত প্রয়োজনে ঠেকিয়াও কোন সময়েই নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান করা সম্ভব নহে।

সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র এর দ্বিতীয় খণ্ড এর ৪৬ অনুচ্ছেদ