You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.26 | প্রধানমন্ত্রীর হুশিয়ারী | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

প্রধানমন্ত্রীর হুশিয়ারী

বৃহৎ শক্তিগুলােকে কড়া হুশিয়ারী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতে আগত শরণার্থীর সংখ্যা তিরিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজারে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশে এখনও চলছে ত্রাসের রাজত্ব। আরও হয়ত আসবেন। ইসলামাবাদের মতলব স্পষ্ট। গােটা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু পূর্ব বাংলাকে সংখ্যালঘু অঞ্চলে পরিণক করতে চান তারা। ওদের কৃতকর্মেরফ ল ভােগ করতে হচ্ছে ভারতকে। এতগুলাে শরণার্থী নিয়ে নয়াদিল্লী কি করবেন? কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে এদের ভরণপােষণে। অসহনীয় চাপ পড়ছে আর্থিক কাঠামাের উপর। বাইরের সাহায্য যা আসছে তা নগন্য। বৃহৎ শক্তিগুলাে যদি যথাসময়ে সচেতন হতেন তবে সমস্যার জটিলটা এত বাড়ত না। যতই দিন যাচ্ছে পাকিস্তান ততই বেপরােয় হয়ে উঠছে। হামেশাই চলছে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় হানাদারী। আকাশ সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে বারবার। এত শরণার্থীর সমাবেশে দানা বাঁধছে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা। পাকিস্তানের “আভ্যন্তরীণ সংকট” পরিণত হচ্ছে ভারতের নিজস্ব সংকটে। “দেখি কি হয়” নীতির পরিণাম নয় দিল্লী ধুকছেনন হাড়ে হাড়ে। পাকাপাকিভাবে শরণার্থীরা থাকতে পারেন না পরদেশে। তাদের ফিরতে হবে নিজেদের বাড়ীঘরে। এদের প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি করবেন কারা? শ্রীমতী গান্ধী বলছেন বৃহৎ শক্তিগুলাে। তারা দেবে ইয়াহিয়ার উপর চাপ। ইসলামাবাদ বুকে জড়িয়ে ধরবেন গৃহ-তাড়িত মানুষগুলােকে। মনে হয় শূন্যে সৌধ নির্মাণ করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। গত দুমাসে তিনি কি বুঝতে পারেন নি বৃহৎ শক্তিগুলাের ভূমিকা? ওরা ইয়াহিয়াকে জীইয়ে রাখবে। রাজনৈতিক স্বার্থের প্রয়ােজনে তারা পথে বসাবে না তাকে।
এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তবে ভারত তার নিজের পথ বেছে নেবে। এশিয়ার এই স্পর্শকাতর অঞ্চলে শান্তির জন্য তা নাকি দরকার। বৃহৎ শক্তিগুলাের উপর বেশী ভরসা করেছেন শ্রীমতী গান্ধী। অতীতে ভারতের আবেদনে তারা সারা দেয় নি। ভবিষ্যতেও দেবে কিনা সন্দেহ। ভারত কি করবে? নয়াদিল্লীর ধারণা, ছমাসের মধ্যে শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন স্বদেশে। তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে কে? বৃহৎ শক্তিগুলাে, না ইয়াহিয়া খান? যারা গত দু’মাসের মধ্যে বাংলাদেশের গণহত্যা এবং গণবিতাড়ন বন্ধ করতে পারল না তারা কি করে শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে? ইয়াহিয়া খান অনমনীয়। তিনি বলছেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যাদের লক্ষ্য তাদের হাতে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। যাদের উদ্দেশ্যে তিনি এধরনের বাক্যবাণ ছুড়ছেন তারা অবশ্যই আওয়ামী লীগ সমর্থক। এই দলই বাংলাদেশের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি। মুজিবর সম্পর্কে ইয়াহিয়ার মনােভাব আরও কঠোর। তিনি চান, মুক্তিযােদ্ধা এবং জাতীয়তাবাদী জননেতাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে পাক-ডিকটেটরের মর্জির উপর। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে এসেছেন তাও তিনি স্বীকার করতে চান না। এদের মধ্যে নাকি আছেন। সহায় সম্বলহীন ভারতীয়। তাঁদের তিনি কিছুতেই ফেরত নেবেন না। ইয়াহিয়ার ধমনীতে বইছে মিথ্যার দুষ্ট রক্ত। মনে আছে শয়তানি কূট পরিকল্পনা। শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই তিনি স্থায়ীভাবে রেখে দিতে চান ভারতে। ক্ষত সৃষ্টি করতে চান এদেশের সমাজ-জীবন। তাতে বাংলাদেশের জনসংখ্যাও কমবে এবং ভারতের সমস্যার জটিলতাও বাড়বে। চমৎকার কৌশল। গণহত্যা করলেন ইয়াহিয়া খান। পূর্ব বংলায় জনসংখ্যা কমিয়ে তার রাজনৈতিক ফসল তুলবেন ইসলামাবাদ। আর তাদের দুষ্কর্মের বােঝা বইবে ভারত। লােকসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সুর যত উচ্চগামীই হােক না কেন, বাস্তব অবস্থা এড়াতে পারবেন না তিনি। তার কথায় ভরসা পান নি বিরােধীদলগুলাে আশ্বস্ত হতে পারেন নি সাধারণ মানুষ এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কোন সম্ভাবনা দেখেন নি শরণার্থীরা। শেষ পর্যন্ত যদি একই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হয় ভারতকে বৃহৎ শক্তিগুলাে তখন কি তাকে পিছু টানবে না? যথা সময়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিলে যে সুযােগ পাওয়া যেত ছ’মাস পরে তা কি থাকবে? পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়ার শাসন পুণঃকায়েম হলে অনেক শরণার্থীই ফিরবেন না স্বদেশে। ইয়াহিয়াও স্বদেশে ফিরতে দেবেন না শরণার্থীদের এক বিরাট অংশকে। বাংলাদেশে চলবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ। দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ। ফিরে যানেওলাদের সংখ্যার চেয়ে আনেওলাদের সংখ্যা হবে বড়। শরণার্থীর সমস্যা এখন যেখানে আছে তখনও সেখানেই থাকবে। গজাবে হরেক রকমের সমস্যার শাখা-প্রশাখা। বৃহৎ শক্তিগুলাে মুখের দিকে চেয়ে বসে থেকে লাভ নেই। নয়াদিল্লীর হুমকির পিছনে নেই সঙ্কল্পের দৃঢ়তা। তাতে ভয় পান নি ইয়াহিয়া খান। ভয় পাবেন না বৃহৎ শক্তিগুলাে। যে সঙ্কটের সঙ্গে ভারত নিজে জড়িত তার সমাধানের উপায় কর্তৃপক্ষের অজানা। আর যাদের গায় লাগছে না একটি আঁচড় তারা করে দেবেন মুস্কিল আসান। প্রধানমন্ত্রী যদি এ আশা করে থাকেন তবে তার ভুল ভাঙ্গাতে বেশী সময় লাগবে না। তখন সমাধানের সুযােগ চলে যাবে। ভারতের আর্তনাদে কেউ কান দেবেন না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ মে ১৯৭১