চোরের মায়ের বড় গলা
ইয়াহিয়া খাঁর জল্লাদ বাহিনী যখন ঢাকার ইংরেজী দৈনিক “পিপল” পত্রিকার অফিসে হামলা করে সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে ও সেখানকার ২০ জন সাংবাদিক ও প্রেস-কর্মচারীকে খুন করেছে, তারা যখন “ইত্তেফাক পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে, ঢাকা থেকে তারা যখন সমস্ত বিদেশী সাংবাদিককে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের যাবতীয় কাগজপত্র, ছবি প্রভৃতি সবকিছু যখন তারা কেড়ে নিয়েছে, কঠোর সেনসর আরােপ করে তারা যখন নিজেদের দেশের সংবাদপত্রের মুখে লাগাম পরিয়ে দিয়েছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুত্বের পদাশ্রিত যেসব সংবাদপত্রনায়ক সম্পূর্ণ নীরব হয়ে ছিলেন, এখন তারাই আবার মুখর হতে চাইছেন। মহান সাংবাদিকতা ব্রতের অপহারের যন্ত্রণায় গণতন্ত্রের হত্যাকারী সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে নয়। তাদের অভিযােগ, ভারতীয় সংবাদপত্র, সংবাদসংস্থা ও সংবাদ প্রচারের অন্যান্য মাধ্যমগুলি পূর্ববাংলা সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করছে এবং বি-বি-সি ও বৃটিশ সংবাদপত্রগুলি ভারতীয় সূত্রের উপর নির্ভর করেই মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। পাকিস্তানি সংবাদপত্রনায়করা কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়ন ও ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউটে এই অভিযােগ তুলবার জন্য কোমর বেঁধে লেগেছেন। যাদের নিজেদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবার কথা তারা যে এভাবে অনেক কাঠগড়ায় তােলার স্পর্ধা রাখতে পারে একথা বিশ্বাস করা কঠিন। সত্যি-মিথ্যা যাচাই করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা যদি বিশ্বের অভিজ্ঞ সাংবাদিক মহলের থাকে, এই পাকিস্তানি সংবাদপত্রনায়করা আসলে কাদের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি করছেন তা বুঝবার সামর্থ যদি তাদের থাকে তাহলে, কিছুমাত্র সন্দেহ নেই, এই হীন মিথ্যা অভিযােগ প্রত্যাখ্যাত হবে; উপবস্তু পশ্চিম পাকিস্তানের গােলাম সংবাদপত্রগুলিই স্বাধীনতা-হত্যাকারী শাসকদের সঙ্গে সহযােগিতার অভিযােগে অভিযুক্ত হবে।
করাচীর কাঁচের ঘরে বসে পাকিস্তানের সংবাদপত্র জগতের যেসব প্রভু এভাবে ঢিল ছুড়ছেন তাঁদের মুখের মত জবাব দিয়েছেন ঢাকার পিপল পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমান সাহেব। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের এই সংবাদপত্রগুলি প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক” বলে চালাবার চেষ্টা করেছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের পাঠকদের বােঝাবার চেষ্টা করেছে, গুন্ডা-বদমায়েসরা হাঙ্গামা করছে, তৃতীয় পর্যায়ে ভারতীয় “অনুপ্রবেশকারীদের” এবং শেষে দেশের বিচ্ছিন্নতাকামী শত্রুদের চক্রান্ত আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে। এসবই তারা করেছে ইসলামাবাদের শাসকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে এবং স্বাধীন সংবাদপত্রের সমস্ত মর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে। একটা কঠিন সময়ে জঙ্গী শাসকদের লৌহ যবনিকা ভেদ করে পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচারের আবরণ ছিন্ন করে সত্য সংবাদ প্রকাশ করার জন্য ভারতীয় সাংবাদিকরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। এই ধরনের পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সংবাদপত্রগুলির রিপাের্টার ও ফটোগ্রাফাররা যেভাবে চরম বিপদের ঝুকি নিয়েও কর্তব্যের আহ্বানে এগিয়ে এসেছেন সেজন্য ভারতের সংবাদপত্রগুলি সঙ্গতভাবেই গর্ববােধ করতে পারে। আর ঠিক একই কারণে পাকিস্তানের শাসকরা ভারতীয় সংবাদপত্রের উপর রুষ্ট হয়েছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলির মধ্য দিয়ে সেই রােষ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু ভারতবর্ষের সংবাদপত্রগুলির উপর গােসা করে লাভ কি? পাকিস্তানি পৃথিবীর অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকেই কি প্রকৃত সত্য গােপন করতে পেরেছে? লন্ডনের “ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাইমন ড্রিক লিখেছিলেন, “২৫ মার্চের রাত্রি থেকে তিনদিন ধরে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকায় সুপরিকল্পিতভাবে মানুষ খুন করেছে। শহরে প্রায় সাত হাজার মানুষ খুন হয়েছেন। তাকে এই কথা লেখার জন্য কি ভারতীয়রা শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন? কলম্বিয়া ব্রডকাষ্টিং সার্ভিসের রেডিওতে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রত্যাগত যে আমেরিকান ইঞ্জিনীয়ার জানিয়েছিলেন, একজন পাকিস্তানি মেজর বাঙ্গালী রক্ষিতা রাখবেন এবং তার অধীনস্ত প্রত্যেক সৈন্যকেও একজন করে রাখতে দেবেন বলে দম্ভ প্রকাশ করেছিলেন সেই আমেরিকান ইঞ্জিনীয়ার কি ভারতীয় সংবাদপত্র পড়ে একথা বলেছিলেন? সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, চেষ্টার বােলজ,। ব্রুস ডগলস-ম্যান, এমনকি উ থান্ট প্রভৃতির কথাগুলি কি ভারত থেকে ধার করা? শুধু মিলিটারি শাসকদের হুকুমনামা না ছেপে পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলি এইসব তৃতীয় দেশের পর্যবেক্ষকদের বিবরণ ও মন্ত ব্য তার পাঠকদের জানতে দেবে কিনা? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ভারতীয় সংবাদপত্রের আচরণ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তােলার অধিকার তাদের নেই?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৪ মে ১৯৭১