দু’শ কোটি টাকার সমাধান
রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে নয়াদিল্লী চেয়েছেন দশ কোটি টাকা। তাদের ধারণ—শরণার্থীর সংখ্যা তিরিশ লক্ষের উপরে উঠবে না। ছমাসের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বাংলাদেশে। তারপর সবাই চলে যাবেন নিজেদের বাড়ীঘরে। আগামী ছ’মাসের জন্য দু’শ কোটি টাকা পেলেই সমস্যার জটিলতা আর থাকবে না। কিসের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ এ অনুমান করলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি কোন মহল থেকে। গত ক’ সপ্তাহ ধরেই সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, শরণার্থীর সংখ্যা ষাট লক্ষের কোঠায় পৌছলেও অবাক হবার কিছু নেই। বাংলাদেশের স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হতে ছ’মাস লাগবে, না ছ’বছর লাগবে নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। যুদ্ধ যতদিন চলবে ততদিন। সেখানে সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে না। ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে হলে দরকার গায়ের জোর। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গায়ের জোর দেখাচ্ছেন গেরিলা তৎপরতায়। ওটা দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। ভারতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অবস্থান এত তাড়াতাড়ি শেষ হবার নয়। আর কেন্দ্রীয় সরকার যদি মনে করে থাকেন যে, অর্থনৈতিক চাপে পিষ্ট ইসলামাবাদ আগামী ক’মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাবেন তবে তা নিছক ইঙ্গিত চিন্তন। তার উপর ভিত্তি করে কোন চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ চলে না।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে বৃহৎ শক্তিগুলাে উপর নির্ভরশীল। ওরা যদি সক্রিয় হত তবে ইসলামাবাদের ভাগ্য বিপর্যয় অনেক আগেই দেখা দিত। সেখানেও চলছে স্বার্থের দাবা খেলা। বৃটেন এবং আমেরিকা কোনমতেই শক্তিহীন হতে দেবে না পাক শাসকগােষ্ঠীকে। তা দিলে শক্তিসাম্য নষ্ট হবে এশিয়ার এ অঞ্চলে। বেড়ে যাবে ভারতের সামরিক শক্তি। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমী সামরিক জোটে ধরবে ভাঙ্গন। এ অবস্থা তাদের কায়েমী স্বার্থের এবং সামরিক স্ট্র্যাটেজীর বিরােধী, সােভিয়েট নায়কদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও জটিল। পাক ডিকটেটরদের মন জয়ের জন্য তারা কিছুদিন আগেও পাল্লা দিয়েছেন চীন এবং আমেরিকর সঙ্গে। কিসের আশায় মস্কো নেতারা এখন ইসলামাবাদকে একেবারে পথে বসাবেন? বাংলাদেশে যারা লড়াই করছেন, তাদের নেতারা কমিউনিষ্ট নন, জাতীয়তাবাদী। পশ্চিম এশিয়ায় এই জাতীয়তাবাদীদের বহু ধাক্কা খেয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। তার পদক্ষেপ দ্বিধাগ্রস্ত। একমাত্র চীনের মতিগতিই পরিষ্কার। ভারত বিরােধিতা এবং নয়াদিল্লীকে বিব্রত রাখা মুখ্য উদ্দেশ্য। চীনের প্রধান হাতিয়ার পশ্চিম পাকিস্তান। তাকে আগ্রাসী রেখে সে পঙ্গু করতে চায় ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনা। জাতীয়তাবাদী স্বাধীন বাংলাদেশ তার পথের কাঁটা। এ কাটা যাতে শিকড় গাড়তে না পারে তার জন্য পিকিং নেতাদের তােড়জোরের অভাব নেই। ইয়াহিয়র হাতে তাই আসছে চীনের টাকা অবং অস্ত্র। সেগুলাে অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে গণহত্যায়। ঐশ্লামিক জোটের শরিক সৌদী আরব, ইরান এবং তুরষ্কের ধর্মভাই পাকিস্তান। তারা দিচ্ছে তাকে সামরিক এবং আর্থিক সাহায্য। আন্তর্জাতিক চাপে ইয়াহিয়া বাংলাদেশ ছাড়বেন—এটা কষ্টসাধ্য কল্পনা। যথেষ্ট পরিমাণে এ চাপ সৃষ্টি হবার পথে বাধা অনেক। একথা অবশ্যই হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন কেন্দ্রীয় সরকার।
পশ্চিমী শক্তিগুলাে হয়ত ভাবছেন একটি কনফেডারেশনের কথা। এই পশ্নেই ভেঙ্গে গেছে মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনা। এত রক্তপাত এবং তিক্ততার মধ্যে আবার কবর থেকে কনফেডারেশনের কঙ্কাল টেনে বার করা সহজসাধ্য নয়। ইয়াহিয়ার গদীচ্যুতি ঘটলেও তা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ। কারণ ইয়াহিয়া গেলে তার স্থান। নেবে আর এক ইয়াহিয়া। বাংলাদেশ যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানবেন না কোন গোঁজামিল। যিনি তা মানার পক্ষে ওকালতী করবেন তিনি নেতৃত্ব হারাবেন। সুতরাং ছ’মাসের মেয়াদী শরণার্থী ব্যবস্থা না কোন স্থায়ী সমাধান। নুইয়ে পড়বে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামাে। দেখা দেবে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা। ইসলামাবাদের বর্বরতা ধামা চাপা পড়বে। বিস্তৃত হবে ভারতীয় সঙ্কটের পরিধি। নৈরাশ্য দেখা দেবে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের মনে। মাসের পর মাস ভিক্ষার অন্ন খেয়ে শরণার্থীরা হারাবেন আত্মমর্যাদা। থাকবে না তাদের লড়াই এর চেতনা। সার্থক হবে ইয়াহিয়ার নারকীয় চাল। ছ’মাসে দু’শ কোটি টাকা মন্দের ভাল। নয়াদিল্লী সাময়িকভাবে হাঁফ ছাড়ার সুযােগ পাবেন। কিন্তু পর মুহূর্তেই দম বন্ধ হয়ে আসবে। শরণার্থীরা ফিরে যাবেন কোথায়? ইসলামাবাদের উপনিবেশে, না স্বাধীন বাংলাদেশে? এ প্রশ্নের সােজা উত্তর যতদিন না পাওয়া যাবে ততদিন শরণার্থীর সমস্যার সমাধান মরীচিকা হয়ে থাকবে। দু’শ কোটি টাকায় রাতারাতি মরুদ্যান গজাবে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ মে ১৯৭১